পুনম,পর্বঃ২৫
আয়েশা_সিদ্দিকা
রুমা গালে হাত দিয়ে বসে আছে।রুমার চোখের দৃষ্টি ক্ষিপ্ত! মাথার চুল এলোমেলো। রুমার এখনো বিশ্বাস হচ্ছে না হারুন তাকে থাপ্পড় মেরেছে।একটা নয় দুটো নয়, চার চারটা থাপ্পড়! হারুনের সাথে এত বছরের সংসারে কখনো গায়ে হাত তোলেনি।আর সে কিনা আজ তুচ্ছ এক কারণে ওকে থাপ্পড় দিলো। হ্যা অনেক সময় কটু কথা বলেছে হারুন ।রুমার পরিবার নিয়েও নাক ছিঁটকে কথা বলেছে।রুমা সেগুলো গায়ে মাখতো না। এত বড়লোকের ছেলেকে যে ও বিয়ে করতে পেরেছে এই নিয়ে ও নিজেই অহম করতো।রুমা বাবার বাড়ি এতটা বিলাসিতা পায়নি….বিলাসিতা বলছি কেন? যেখানে মাসের শেষে শুধু ভাত কি দিয়ে খাবে এ নিয়েই হিমসিম খেতে হতো সেখানে বিলাসিতার প্রশ্নই আসে না।তখন বাবার একার রোজগারে সবার চলতে হতো…এখন তো তবু পুনমের জন্য ও বাড়ির মানুষ ভালোই আছে। মাথায় এসব অহেতুক কথা এসে ভীর করছে যেখানে ওকে মারা হলো কেন এখন সেটা জানাই মুখ্য।
কাল রাতের বেলা অনেক বার কল আসছিল হারুনের মোবাইলে।এরকম আগেও হয়েছে।হারুন ব্যবসার কল বলে এড়িয়ে যেতো।কিন্তু গতকাল জামিলা নামক একটা শব্দ রুমার কানে গেছে।সকালে কে ফোন করেছিল জানতে চাইলে হারুন এমন ভাবে তাকালো যেন অনেক অন্যায় কথা বলে ফেলেছে রুমা।রুমার সন্দেহ হলো…জামিলা কে জানতে চাইলে রেগে উঠলো হারুন। যেই না কথার তোড় দিয়ে চেপে ধরলো তখনই হারুন ওকে কতগুলো থাপ্পড় দিয়ে বললো,ছোটলোক ছোটলোকের মত থাকবি….এত জোড় আমার সাথে দেখাবি না! বেশি বাড়াবাড়ি করবি তাহলে আমার ঘরের দরজা তোর জন্য চিরতরে বন্ধ হবে! বলে হনহনিয়ে চলে গেলো হারুন।
রুমার এখন কি করা উচিত? রুমা নিজেই বুঝতে পারছে না।বাবার বাড়ি চলে গেলে যে কতটা শান্তি পাবে তা রুমার জানা।বিয়ের পর থেকে তাদের সাথে ওর সম্পর্কটা হয়ে গেছে সৌজন্যতার।তার কারণও অবশ্য রুমা।নিজেকে টাকা পয়সার অহংকারে এতটা মুড়িয়ে রেখেছিল যে তাদের সাথে মায়ার সুতোটা কেঁটে গেছে। তাছাড়া ও নিজেই বা সেখানে কি করে থাকবে?এত আরাম আয়েশ, টাকা পয়সা কি তাদের আছে?
রুমার চিন্তায় মাথার রগ ধপধপ করছে। স্বার্থে অন্ধ হওয়া রুমা নিজেই বুঝতে পারছেনা তার সংসার নামক সুতোটাও যে কেটে যাচ্ছে!
************************
নিয়াজ উদ্দিন বাজার করছেন।কাল পাবনী বললো চাল শেষের দিকে।তাই চালের বস্তা কিনতে এসেছেন।খাদ্য দ্রব্যের এত দাম!গলা কাটা মূল্য!
পাঞ্জাবিটা পিঠের কাছ থেকে ভিজে গেছে।বয়স হয়েছে এত ঝক্কি এখন শরীরে সয় না।তাছাড়া ইদানিং তিনি নিজে বাজারও করেননা। পুনম যতই টিউশনি, কোচিং নিয়ে ব্যস্ত থাকুক আগে নিজে বাজার করে রাখে…বাবাকে আসতে দেয় না।বাবাটা যে বুড়ো হয়েছে এ খেয়াল তার পুনমের আছে!পকেট থেকে নোটবুকটা বাহির করে টাকার হিসেব করে নিয়াজ উদ্দিন…. সালেহার ডায়েবিটিসের ঔষধ নেয়া লাগবে….যা টাকা আছে তাতে হবে তো?
অল্প কিছু ঔষধ কিনে চালের বস্তা নিয়ে রিকশায় উঠে নিয়াজ উদ্দিন।রিকশা কিছুটা সামনে আগালেই দেখতে পান এক বৃদ্ধলোক সাজিতে ছবেদা নিয়ে বসেছে।তিনি রিকশা থামিয়ে দু হালি ছবেদা কিনেন।পকেটে যা টাকা আছে তা দিয়ে এখনের রিকশা ভাড়া হবে….আর চারদিন পর বেতন পাবেন একয়টা দিন নাহয় হেঁটেই যাবেন অফিসে।পুনমের মা খুব ছবেদা পছন্দ করে!সারাদিন বোকা বলে যাকে বকেন তার জন্য দুহালি ছবেদা কিনে মুখে হাসির রেখা ফুটে ওঠে!
বাসার গেটের কাছে এসে নিজ কাঁধেই তুলে নেন চালের বস্তা। রিকশাওয়ালাকে বললে বাড়তি টাকা চাইবে যা তার কাছে এখন নেই।এত ভারি চালের বস্তা কাঁধে তুলতে গিয়ে কোমড় নুয়ে আসে,বুক ফুঁড়ে অজান্তেই দীর্ঘশ্বাস বেড় হয়!
সালেহার মত এখন তার মনেও প্রশ্ন জাগে, ছেলেটা বেঁচে থাকলে কি বাবার কাঁধের বোঝাটা নিজ কাঁধে তুলে নিতো? সালেহার কাছে কি একবার জিজ্ঞেস করবে? তোমার ছেলে থাকলে কি এই বাবার কষ্ট বুঝতো? নাকি শুধু তার বোকা মাকেই ভালোবাসতো?
******************
আর দুমাস পড় এইচএসসি পরিক্ষা। তারুণ মনোযোগ সহকারে পড়ছে….মাথা দুলিয়ে দুলিয়ে পড়ছে।কোঁকড়া চুল গুলো কপালে ছড়িয়ে আছে।চোখের চশমাটা নাকের ডগায় বারবার নেমে যাচ্ছে মাথা দুলানোর জন্য।শায়লার এক মুহুর্তের জন্য মনে হলো,সেই ছোট্ট তারুণ বুঝি!
তার তারুণ এত সুন্দর যে সে মা হয়েও তার বলতে মনে চায়, এত সুন্দর কেন হলি বাবু?এত সুন্দর ছেলেদের হতে নেই!সুন্দর ছেলেরা পেত্নীর মত বউ পায় জানিস?তুই যদি হিন্দুধর্মের হতি তবে সাক্ষাৎ মেয়েরা তোকে দেবদূত মনে করে পূজো করতো!পূজোর ফুলে তোর চরণ নিমজ্জিত থাকতো!
গুটি গুটি পায়ে হেঁটে শায়লা তারুণের কাছে এসে দাঁড়ায়। হায়দার বাসায় নেই…সে থাকলে তারুণের রুমে শায়লাকে আসতে দেখলে রাগ হত।এছাড়াও আর একটা কারণে শায়লা তারুণের সামনে আসে না।তারুণের মুখ দেখলে আর একটা মুখ চোখের সামনে ভেসে ওঠে যে…..
তারুণ কিছুটা অবাক হলো। মাকে ওর পাশে দাঁড়ানো দেখে।সচারাচর মা রুম থেকে বের হয় না।আর নিজেও কোন এক বিচিত্র কারণে ও মাকে এড়িয়ে চলে।এই যে এখন মা ওর চুলে হাত বুলিয়ে যে দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সেই দৃষ্টি কেন যেন তারুণ সহ্য করতে পারে না।
—তুমি এখন কেমন আছো মা?
—ভালো আছি….তুই কেমন আছিসরে বাবু?মাকে তো ভুলেই গেছিস…
—-তুমিও তো ভুলে গেছো মা।
—ভুলিনিতো….তোদের কথা মনে আছে দেখেই তো বেঁচে আছি।
তারুণের চিৎকার করে বলতে মনে চায়,তুমি সবসময় এরকম কেন থাকো না মা?আমি তোমায় বড্ড মিস করি!
কিন্তু তারুণ বলে না।সবকথা কেন যেন তারুণ বলতে পারেনা।
—-কি পড়ছিলি বাবু?
—-পদার্থবিজ্ঞান!
—খুব কঠিন নাকি?
—-সবাই বলে কঠিন কিন্তু আমার কাছে মনে হয় না।
কঠিন জিনিস সহজ করে নিতে পারি আমি!
শায়লা মমতা ভরা চোখে তাকিয়ে থাকে।ছেলেটা কবে বড় হবে?এখনো কথা বলে আদুরে স্বরে।মুখের আদোলও এতটা আদুরে! শায়লার ইচ্ছে হয় ছেলের সারা মুখে অজস্র চুমু দিয়ে আদর করে দিতে!যেমনটা ছোটবেলায় দিতো।কিন্তু আদর দেয়া হয় না, মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়।তারুণকে পড়তে বলে চলে যাওয়া নিলে, তারুণ সেই ছোটবেলার মত পিছন থেকে আঁচল টেনে ধরে…..
শায়লার চোখে পানি চলে আসে।ফিরে তাকায় ছেলের মুখপানে।জিজ্ঞাসা দৃষ্টিতে তাকালে তারুণ মাকে টেনে বিছানায় বসিয়ে দেয়।কোলে মাথা রেখে শুয়ে পড়ে চুপটি করে।শায়লার বুক ফেটে কান্না আসে।
—একটু গায়ে হাত বুলিয়ে দাও মা!
তারুণ জানে না তার মা কতক্ষণ স্বাভাবিক থাকবে? দেখা গেলো একমাসেও মা রুম থেকে বের হবে না।তখন বাসার সবার মুখে আবার শুনতে হবে,পাগলামি শুরু করছে। যা শুনতে তারুণের মোটেই ভালো লাগে না। তাই যতক্ষণ ভালো আছে ততটা সময় না হয় একটু আদর নেয়া যাক।
শায়লা ছেলের মাথায়, হাতে, পিঠে হাত বুলিয়ে দেন।তারুণ চোখ বুজে শুয়ে থাকে….শায়লা চুলে আঙুল চালাতে গুনগুন করে গেয়ে ওঠেন,
খোকা ঘুমালো পাড়া জুরালো
বর্গি এলো দেশে….
বুলবুলিতে ধান খেয়েছে খাজনা দিবো কিসে?
তারুণের চোখে হুট করে ঘুম নেমে আসে…..পদার্থবিজ্ঞানের বইটা টেবিলেই পড়ে থাকে……
******************
দীর্ঘ বারোঘন্টা জার্নির ফলে পুনমের মাথা ব্যথায় ধপধপ করছে।রাস্তায় জ্যাম থাকার ফলে এতটা লেট হলো।হোটেল চেকিং করে ওরা রুমে প্রবেশ করে।ছেলেদের জন্য একটা রুম আর মেয়েদের জন্য একটা রুম নিয়েছে ওরা।আর তানভীর রুম শেয়ার করবে না বিধায় সে আগেই তার জন্য আর একটা রুম বুকিং করে রেখেছিলো। হ্যা তানভীরও এসেছে এই সফরে।আর এটাই পুনমের সবচেয়ে বড় মাথা ব্যথার কারণ।যার কোন খবর না পেয়ে এতটা অস্থির ছিল তাকে কাছে পেয়ে পুনমের আরো অস্বস্তি হয়েছে।
মি.তানভীরকে দেখলে মনে হয় আলাভোলা কিন্ত আসলে শয়তানের নানা!কতবড় বদমাশ পুরো রাস্তা এমন ভান করেছে যেন ওকে চিনেই না।পুনম নামের কাউকে যেন সে এই প্রথম দেখেছে।
আর সবথেকে বড় পল্টিবাজ তো ওর বন্ধু বল্টু।কতবড় পল্টিবাজ হলে ওকে একবারও বললো না,যে তানভীর ওদের সাথে যাচ্ছে। জানলে কখনো পুনম আসতো না এই ফালতু ট্রিপে। আর বাহিরের মানুষ কেন থাকবে এই গ্রুপে?অসহ্য!
সব মেয়েরা যে যার মত রিলাক্স করছে।শশী ওয়াশরুমে। পুনম চোখ বন্ধ করে। ভেসে ওঠে কালকে রাতের দৃশ্যপট…..
বাস থামার পর ভিজা শরীরে বাসে ওঠে তানভীর। পুনম এতটাই চমকে গিয়েছিল….যে মস্তিষ্ক ফাঁকা হয়েগেছিল একবারে।তানভীরের পিছন পিছন আসে রাজু।তানভীর তার পাশের সিটে আর রাজু সাকিবের পাশের সিটে বসে পড়ে।পুনম চোখগরম করে তাকায় বল্টুর দিকে কিন্তু বল্টু এমন ভান করে যেন সে কিছুই জানে না।বাসের লাইট নিভিয়ে দেয়া হয়….যে যার মত চুপচাপ।
শুধু পুনমের নিশ্বাস ভারী হয়ে আসে।এতটা কাছে তানভীর বসে আছে যে পুরুষালী স্মেল পাওয়া যাচ্ছে। পুনমের মনে প্রশ্নের ভীর!এতদিন কোথায় ছিল?আমাদের সাথে যাচ্ছেই বা কেন?কিন্তু কোন প্রশ্নই করা হয় না।বাহিরে মৃদু আলোতে তানভীরের গম্ভীর মুখটা দেখে পুনম আরো চমকে যায়।বাসে উঠেছে বিশমিনিট হলো এখনো ওর সাথে কোন কথাই বললো না।কেন?
তানভীরের এত নির্লিপ্ত ভাব কেন যেন পুনম মানতেই পারছেনা।পুনম কাঠ হয়ে বসে আছে।শরীর জমে যাচ্ছে। একবার কথা বলতে চেয়েও পুনম বলেনি।কেন বলবে? এই ছেলের আলগা ভাব নিয়ে থাকুক।
সবাইকে কিছুটা ব্রেক দেওয়ার জন্য বাস কুমিল্লার একটা রেস্টুরেন্টে কাছে থামে।যে যার মত ঘুরছে….কেউ কফি খাচ্ছে কেউ ফ্রেস হচ্ছে কেউবা হাঁটছে…..
পুনম বসে আছে,টেবিলের উপর গরম কফির কাপ রাখা।কিন্তু সেদিকে পুনমের নজর নেই সে তাকিয়ে আছে সামনের টেবিলে। সেখানে শশী তানভীর বর্ষা শিমুল সাকিব বসে আছে।শশীর ফেস দেখেই বোঝা যাচ্ছে সে এতক্ষণে তানভীরের উপর ক্রাশ খেয়েছে….উফফ!এই মেয়ে চোখের পলকও ততটা ফেলেনা যতটা ছেলেদের উপর ক্রাশ খায়…
আর তানভীর ও সুন্দর হেসে হেসে কথা বলছে…
একবারো পুনমের দিকে তাকাচ্ছে না। আশ্চর্য এরকম বিহেভিয়ারের মানে কি?নবাবপুত্র কি ভেবেছে সে আমাকে ইগনোর করলেই আমি তার পিছু পিছু ঘুরবো?কখনো না! এসব সস্তা সিনেমা পুনমের সাথে চলবে না।
পুনম চোখ ঘুরিয়ে ডানপাশে তাকায়, সেখানে বল্টু আর রিমি বসে চা আর পরোটা খাচ্ছে। পুনমের কেন জানি সব রাগ গিয়ে বল্টুর উপর পড়ে….পুনম উঠে গিয়ে বল্টুর গালে ঠাস করে চড় মেরে দেয়…বল্টু অসহায় চোখে তাকায়!পুনম সামনে দাঁড়ানোর জন্য এই থাপ্পড়টা আশে পাশের কেউ দেখতে পেলনা কিন্তু গার্লফ্রেন্ডের সামনে থাপ্পড় দেয়ায় বল্টুর পেস্টিজে আঘাত লাগলো।বল্টু গালে হাত দিয়ে চেচিয়ে উঠলো,—আন্ধার রাইত মারলি কেন আমায়?
পুনম ঝুকে বল্টুর কলার খামচে ধরে বলে,
—তা মি.তানভীর তোকে কি খাইয়াছে? যে তোর বন্ধুর থেকে সে বড় হয়ে গেলো?
—-আমি কিচ্ছু জানি না বিশ্বাস কর।আর কথায় কথায় এরকম গায়ে হাত দিবি না।
—-একশোবার দিবো বল্টুর বাচ্চা!কতবড় সাহস আবার মিথ্যে বলে।তোর গার্লফ্রেন্ড ছুঁয়ে বল,যে তুই দুধে ধোয়া তুলসীপাতা! কি বল বল…
বল্টু কাচুমাচু করে তাকিয়ে আছে….কি বলবে? রিমিকে ছুঁয়ে মিথ্যা সে বলতে পারবেনা।এই তানভীর আর পুনমের কোন্দলে তার রিমি না হাতছাড়া হয়ে যায়।
রিমি এতক্ষণে বলে,
—-পুনম আপুই,তুমি ওকে মারলে কেন?
পুনম খেপা বাঘিনীর মত বলে,
—-সেটা তোমার বাবুকে জিজ্ঞেস করো?তোমার তুলতুলে বাবু ভালো জানে।
যত্তসব আদিখ্যেতা! বলে পুনম যেয়ে নিজের জায়গায় বসে।নিজের ঠান্ডা কফিতে ঠোঁট ছোঁয়ায়। সামনে তাকিয়ে দেখে, শশী কথা বলতে বলতে তানভীরের গায়ে ঢলে পড়বে এমন অবস্থা! আর কচ্ছপটাও কি সুন্দর দাঁত কেলাচ্ছ!
পুনম নিজেও বুঝতে পারছেনা,ওর এতো শরীর জ্বলে যাচ্ছে কেন?যা খুশি করুক সবাই,তাতে ওর কি? ও নিজের মত ঘুরবে ফিরবে জাস্ট! আর সব গোল্লায় যাক! হুহ!
—-আপুই তোমায় মারলো কেন?
—ওরে না জানিয়ে একটা কাজ করছি তাই মারছে….ভেবো না! তুমি তো জানো পুনম কেমন?রাগ করো না আবার ওর উপর!
রিমি কপাল কুঁচকে তাকিয়ে থাকে…বল্টু চুপিসারে নিশ্বাস ফেলে….এই মাইয়া জাতটাই ভেজাল্যা!
শিমুল এসে পুনমের পাশের চেয়ারে বসে।পুনম চুপচাপ বসে আছে,শিমুল বলে,
—–দেখ শশীর অবস্থা! আবার একটা ক্রাশ খাইছে।শালার সারাদুনিয়ার ছেলেদের উপর ক্রাশ খাইলো শুধুমাত্র আমিই বাদ রইলাম!
—-দেখ, তোরে মনে হয় ও ছেলের মধ্যেই ধরেনা।
—কি কি সব আবোল তাবোল বলছিস….
—তাহলে তোর উপর ওর চোখ গেলো না কেন?ডাল মে নিঃসন্দেহে কুচ কালা হে….
—-চুপ পুনম!একদম চুপ!ওই সব শশী মশীর ক্রাশের আশায় এই শিমুল বসে নেই….
—-তাহলে তুই বললি কে?
—-আমার ভুল হয়েছে মা।মাফ কর….
পুনম হেসে দেয় এবার। শিমুল পুনমের সাথে কথা বললেও ওর চোখ শশীর দিকে।সারাদিন দুটোতে ঝগড়া করবে কিন্তু একজন আর একজনের থেকে নজর সরলেই সমস্যা।
বাস ছেড়ে দিবে। যে যার মত বাসে উঠতে শুরু করে। পুনমের পাশ দিয়ে তানভীর চলে যায়। কি শান্ত এটিটিউড….শশী পুনমের কানের কাছে ফিসফিস করে বলে,…এই পুনু দেখেছিস,কি ছেলে মাইরি!একদম ঝাকাস!ব্লু শার্ট কালো জিন্সে তো একদম বোম্বাই মরিচ লাগছে….
পুনম ঝাড়ি মারে,—ভাতের সাথে ডলে খা তবে….দিনদিন আরো অসভ্য হচ্ছিস! লজ্জা শরম গুলে খেয়েছে….
—ওরে পুনম আমি এর জন্য অসভ্য হতেও রাজি….
পুনম হতাশ হয়ে বাসে উঠে পড়ে….আর কি বলবে?
বাস চলতে শুরু করেছে…তানভীর চোখবুঁজে সিটে বসে আছে।কোন এক অজানা কারণে সে পুনমের উপর রেগে আছে।এত এত রাগ তার ভান্ডারে জমা হয়েছে।হয়তো পুনম অবাক হচ্ছে তার সাথে কথা না বলায়। হোক….কথা বলবে না ও এই নিষ্ঠুর মেয়েটির সাথে!দয়া মায়াহীন মেয়ে!
বাসের সকল যাত্রী ঘুমে বিভোর। পুনমের ঘুম আসছেনা।মি.তানভীরের কি হয়েছে?এই প্রশ্নটাই মাথায় ঘুরছে।এতটা কাছাকাছি থেকেও এত সুক্ষ্ম ভাবে ওকে ইগনোর কি করে করছে?
হটাৎ করেই পুনমের কাঁধে তানভীরের মাথা এসে পড়ে….পুনম ভারী নিশ্বাসের শব্দে বুঝতে পারে মি.তানভীর ঘুমিয়ে পড়েছে।তানভীরের ঘুমন্ত নিশ্বাসে পুনমের গলার কাছটা উত্তপ্ত লাগছে! কি অসহ্য অনুভূতি!
পুনম ঠেলে সরিয়ে দিতে চেষ্টা করে কিন্তু সফল হয় না….বরং তানভীরের এক হাতে আরো আষ্ঠেপৃষ্ঠে জরিয়ে ধরে পুনমের কোমরের কাছটা।পুনম বিড়বিড় করে বলে, হে আল্লাহ সহায় হও!
তানভীর ঘোড়া বেঁচে ঘুমাচ্ছে…. পুনম নড়তেও পারছেনা এত ভারি!বাসে সবাই ঘুমিয়ে তাই পুনম আস্তে আস্তে ডাকে,…..
–মি.তানভীর! শুনছেন…একটু সরুন….আমার কষ্ট হচ্ছে!
—হুম বলে একটু নড়েচড়ে আবার ঘুমিয়ে পড়ে।
পুনম আর ডাকে না।সেও চুপচাপ জানালা গলে বাহিরে তাকায়! এত আধার!
পুনম বিড়বিড় করে বলে,… মি.তানভীর আপনি কি আমার ক্ষনিকের মায়া? নাকি আধার কাটিয়ে ওঠার কোন আলোছায়া?
রাজু বাসে চড়তে পারেনা।তার বাসে চড়লেই মাথা ঘুড়ায়…বমি বমি আসে….আজ তানভীর স্যারের জন্য কত কি করা লাগছে….
কোথায় যেন শুনেছিল বাম হাত শুঁকলে বমি কমে।রাজু এখন তাই ট্রাই করছে….কি এক বিশ্রী অবস্থা…. বাসের সবাই ঘুমে আর ও বা হাত শুঁকতাছে…যে হাত দিয়ে ঐ কাজ করে সেই হাত নাকের কাছে নিয়ে শুঁকতে হচ্ছে বলে ওর কান্না পাচ্ছে….. আর তার স্যার কি সুন্দর পুনমের কাঁধে মাথা দিয়ে ঘুমাচ্ছে….. সব স্বার্থপর!
হটাৎ করেই মোবাইলে মেসেজ টোনের আওয়াজ আসে।
ওপেন করে দেখে রাজু…তানভীর স্যারের বাবা!
লিখেছে,রাজু তানভীর কি করছে?
রাজু নাকমুখ কুঁচকে লিখে,
—-ঘুমাচ্ছে!
—হুট করেই কেন যাচ্ছে জানো?
—-ছোট ভাই ব্রাদাররা রিকোয়েস্ট করছে তাই….
—-ভালো। খেয়াল রেখো। আর আমাকে আপডেট জানাবে।
—জ্বি স্যার।
—-ঐ মেয়েটাও যাচ্ছে? পুনম নামের?
—-না স্যার!
—তুমি শিওর?
—একদম!
—রাজু মিথ্যে বললে তোমার খবর আছে…
—স্যার রাজু কখনো মিথ্যে বলেনা।স্যার আপনার কসম করে বলছি….ঐ মেয়েটা যাচ্ছে না!
হায়দার হোসেন সন্তুষ্ট হয়ে যায়…..
রাজু বিড়বিড় বলে, আল্লাহ আমায় মাফ করো….আমি মিথ্যা বলতে চাইনি….কিন্তু স্যারের কষ্টও আমি আর দেখতে চাইনা।মানুষটা এখন কি সুন্দর ঘুমাচ্ছে অথচ এতদিন প্রত্যেকটা রাত সে ছটফট করেছে….এই মানুষটা শুধু পুনম নামের মেয়েটির কাছে আসলে শান্ত হয়ে যায়! তাকে এতটা অশান্ত রাজু আর দেখতে চায় না!
রাজু হুট করেই অনুধাবন করে তার আর বমি আসছেনা! কি আশ্চর্য!
চলবে,