পুনম,পর্বঃ১২,১৩
আয়েশা_সিদ্দিকা
পর্বঃ১২
— ভাই,ক্যান আই স্লিপ উইথ ইউ?
তানভীর খুবই স্নেহ নিয়ে তাকায় তার আদরের ছোট ভাইয়ের দিকে।যে এই মুহুর্তে স্লিপিং স্যুট পড়ে হাতে বালিশ নিয়ে দরজার কাছে দাঁড়িয়ে তার কাছে অনুমতি চাইছে। হালকা অ্যাশ রঙের স্লিপিং স্যুট, কোকড়ানো চুলগুলো যা কপালে এলোমেলো ভাবে ছড়িয়ে আছে,নাকের ডগায় সবসময়ের মত চশমা যা ফর্সা গোলাকৃতি চেহারায় আদুরে ভাব ফুটিয়ে তুলেছে।অসম্ভব মেধাবী তার ভাইটা। এই মুহুর্তে তানভীরের কাছে তারুণকে সেই ছোট্টবেলার তারুণ মনে হচ্ছে, যে একা ঘুমাতে ভয় পেতো আর মাঝরাতে এসে তার দরজায় নক করে এভাবেই বলতো, ভাই ক্যান আই স্লিপ উইথ ইউ? আর তানভীরের সেই একই জবাব,
—হোয়াই নট….
তারুণ বালিশ নিয়ে বিছানায় ভাইয়ের পাশে শুয়ে পড়ে।তানভীর মুচকি হেসে দেয়,তারুণ কখনোই অন্যের বালিশে শুতে পারে না।একবার তো ট্যুরেও এই ছেলে মাথার বালিশ নিয়ে গেছে…. তা নিয়ে সবাই হাসাহাসি করলে তারুণ পুরাই নির্বিকার ছিলো….
—-ভাই তোমার বিরক্ত লাগে না?
—-কোন বিষয়ে?
—-ওই যে রুমের বাহিরের আজব চিড়িয়াটাকে।
—-হা হা হা… না বিরক্ত লাগে না, বরং এখন না দেখলেই বিরক্ত লাগে।
—-ব্যাখ্যা করো ভাই…..
—-শোন এটা খুবই সিম্পল বিষয়।অভ্যাস হয়ে গেছে তাই।প্রথম প্রথম বিরক্ত লাগতো,একটা ছেলে অলটাইম আমায় ফলো করছে, আমার সাথে সাথে থাকছে তখন ভালো লাগতো না কিন্তু এখন ও না থাকলেই বরং হাসফাঁস লাগে। আর রাজু খুবিই ভালো ছেলে তারুণ।
—- বুঝলাম ভাই….তারপরও বিষয়টা আমার ভালো লাগে না।
—-বিষয় টা নয়, তোমার রাজুকে পছন্দ নয় তা বলতে পারো।তারুণ ইউ নো… ভাই অলওয়েস লাভ ইউ…..
তারুণের চোখ ভিজে আসে, সে তার ভাইকে খুবই ভালোবাসে।সে তার ভাইয়ের জন্য সব করতে পারে…..
তারুণ তানভীর উভয়ই খাটে শুয়ে সিলিং এর দিকে তাকিয়ে আছে…দু ভাই পাশাপাশি শুয়ে থাকলেও দুজনের মনের অবস্থা এখন পুরাই ভিন্ন…..
—-ভাই তুমি বাবাকে কেন পছন্দ করো না?
—কারণ সে মানুষের দূর্বলতায় আঘাত করে.…..
—ভাই বাবা তোমাকে খুব ভালোবাসে….
—-ভালোবাসা কি তা হায়দার হোসেন জানে না তারুণ।এসব বিষয় তোমার জানার দরকারও নেই।তুমি কম বুঝবে তত তোমার জন্য ভালো…তবে তোমার বড় ভাই হিসেবে এতটুকু বলতে পারি, কখনো কারো কাছে নিজের দূর্বলতা প্রকাশ করবে না।
—-ভাই, বাবা বুবুকে মেনে নেয়নি তাই কি তুমি তাকে ভালোবাসো না…..বুবুকে কেন তুমি সব থেকে বেশি ভালোবাসো? তার কারণেই যত কষ্ট আমাদের….
—-তারুণ তুমি সবচেয়ে কাকে বেশি ভালোবাসো? বাবা কে নাকি আমাকে?
তারুণ জবাব দেয় না….তানভীর উত্তরের আশাও করে না।সে তার ভাইকে ঘুমিয়ে পড়তে বলে পাশ ফিরে চোখ বুজে।
তারুণ মনে মনে বলে ওঠে, ভাই আমি বাবাকে সবচেয় বেশি ভালোবাসি কিন্তু তোমাকেও ভালোবাসি তার সমান..
—-বাই দা ওয়ে ভাই,মেয়েটা কিন্তু শুধুই বন্ধু আমার, নাথিং ইলস….
তানভীর চোখ বুজেই বলে ওঠে,
—আমি কি জানতে চেয়েছি তারুণ?
—কিন্তু ভাই আমি বলতে চেয়েছি…..
*******************************
রাতের সময়ে এখন তিনটা দশ বাজে।সুমনের হাতে জলন্ত সিগারেট। রাস্তায় পায়চারি করছে আর সিগারেট ফুঁকছে সুমন। পকেটে একটাই সিগারেট ছিল…সেহরির সময় এখন কিছু খাওয়া দরকার।কিন্তু কি খাবে? পকেটে যে টাকা আছে তা দিয়ে শুধু সিগারেটেই সেবন করা যাবে। এই ব্যাপারটা খুব ইউনিক হবে,সেহরিতে সিগারেট দিয়ে কেউ রোজা রেখেছে কিনা সন্দেহ আছে।সুমন তাদের বাসার সামনের রাস্তায় দাঁড়িয়ে চিন্তা করছে এসব। বাসায় বাজার বলতে কিছুই নেই।থাকবে কি করে? ভাইজান আর ভাবি নেই তাই বাসার বাজার সদায়ও সব বন্ধ। কি আজব ব্যাপার! ছোটবেলায় সুমন খাবার নিয়ে কত বায়না করতো।এটা খাবেনা তো ওটা খাবে।তখন মা বিরক্ত হয়ে বলতো,যখন আমি থাকবোনা দেখবো তখন কাকে এত জ্বালাস?
সুমন আকাশের দিকে তাকিয়ে সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়ে, বিড়বিড় করে বলে ওঠে, মা তুমি কি দেখতে পাচ্ছো তোমার ছেলে এখন আর কোন বায়না করে না।সে এখন নিজে জ্বলতে শিখে গেছে মা।…তুমি কি দেখতে পাচ্ছো মা?…..
ঠিক ওই মুহুর্তে সুমনে ফোনে টেক্সট আসে।কেউ একহাজার টাকা পাঠিয়েছে তাকে।সুমনের কপালে চিন্তার ভাজ পড়ে। কে দিতে পারে এই টাকা? পাবনী নাকি পুনম?
সুমন ভাবাভাবি বন্ধ করে হাটা শুরু করে,টাকা উঠিয়ে তাকে রাস্তার মোড়ে একটা হোটেল আছে সেখান থেকে ভাত খেতে হবে। তারপর সোজা বাস ধরে ঢাকা…. অনেক দিন হলো পুনমদের ফুল গাছগুলো দেখা হয় না,সাথে ফুল গাছের মালিনীকে না হয় এক নজর দেখা হবে…… তাতে কি খুব বেশি ক্ষতি হবে………?
*****************************
সেহরিতে খেতে বসেছে পুনম।ডানপাশে বাবা আর বাম পাশে সেজ আপা বসেছে।আর অপর পাশে লাবণ্য, মা,বড় আপা আর মরিচা বসেছে।রান্নার আইটেম হলো কলমি শাক ভাজি, ডাল চচ্চরি আর বেগুন ভাজি।চিংড়ি মাছ অবশ্য ভুনা করা হয়েছিল দুলাভাইদের জন্য আর বাচ্চারা ও মেজ আপার জন্য। বাড়ির জামাইকে কি এসব শাকপাতা দিয়ে খেতে দেওয়া যায়….
পুনম কলমি শাক ভাতে মেখে কাচা মরিচে কামড় বসায়।তার কাছে খারাপ লাগে না।পরিবারের সবাই একসাথে বসে পান্তা ভাত খেলেও শান্তি! পুনম খেয়াল করে বড় আপা নাক মুখ কুঁচকে খাবার খাচ্ছে, তারমানে এসব খাবার খেতে কষ্ট হচ্ছে বড় আপার।কিন্তু পুনমই বা কি করবে।পুনম মরিচাকে ইশারা করে উঠতে বলে, মরিচা দৌড়ে রান্নাঘরে চলে যায়,আবার সাথে সাথেই ফিরে আসে একটা বাটি নিয়ে।পুনম অবাক হতে গিয়েও অবাক হয় না। এই মরিচা সকল কাজ করে দৌড়ের উপর!যেন এখনই না করলে কেউ ওর গর্দন নিয়ে যাবে…..
পুনম বাটিতে অল্প একটু চিংড়ি মাছ আলাদা করে রেখেছিল সেই মাছ পুনম বাবা আর মায়ের প্লেটে তুলে দেয়।নিয়াজ উদ্দিনের চোখ ভিজে ওঠে। এই মেয়েটা তাদের এত খেয়াল কেন রাখে…..
পাবনী মাথা নত করে খেয়ে যাচ্ছে। বরাবরের মত শান্ত চুপচাপ। একটা মানুষ এতটা অভিযোগ বিহীন হয় কিভাবে?
মা বাবর উদ্দেশ্যে বলে ওঠে, কাল একবার একটু গরুর কলিজা আনতে পারবে।মেয়েটা সন্তানসম্ভবা, ওকে তো আর এসব খাবার দিতে পারি না।
নিয়াজ উদ্দিনের রাগ লাগে কিন্তু কিছু বলে না।
পুনম জবাব দেয়, মা তোমার জামইকে বলো কাজ করে তার বউয়ের আবদার গোচাতে…..
নিয়াজ উদ্দিন গোপন দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। কেউ না জানুক সে জানে কাল তার বাজার করার আগে পুনম কলিজা নিয়ে বাসায় আসবে।সে মুখে যাই বলুক তার কাছে তার পরিবার আগে…দায়িত্ব আগে।
পুনম বাবার উদ্দেশ্যে বলে ওঠে, বাবা কাল সুমন ভাই আসতেছে।
বড় আপার কপাল কুঁচকে রেখে বলে ওটা, কই আমি তো জানি না কিছু।
—মনে হয় বড় আপা তোমাকে বলার প্রয়োজন বোধ করে নি।
পুনম সুমনের নম্বরে টেক্সট পাঠায়, কিছু জরুরী কাগজপত্র নিয়ে আসতে বলে সাথে….
ফজরের নামাজ পড়ে ওঠে দেখে পুনম, তার মোবাইলে তানভীর কল দিচ্ছে।সে রিসিভ করে সালাম দেয়।
তানভীর জানতে চায়,
—–পুনমি যদি কোন দূর্বলতা কারো জীবনে পথের কাঁটা হয় তখন তার কি করা উচিত?
পুনম মৃদু হেসে জবাব দেয়,
—-মিঃ তানভীর দূর্বলতাকে ভালোবাসতে শিখুন, দেখবেন তখন তা আপনার কাছে আর দূর্বলতা না হয়ে শক্তি হয়ে ফিরে আসবে…..
চলবে,
#পুনম
#আয়েশা_সিদ্দিকা
পর্বঃ১৩
আকাশের দিকে তাকিয়ে পুনম ওড়না দিয়ে কপালের, ঘাড়ের ঘাম মুছে।সাড়া শরীর ঘামে চিটচিট করছে। পুনম কপাল কুঁচকে হাতের ফাইল মাথার কাছে ধরে হাটা শুরু করে….ক’দিন ধরেই আবহাওয়া গরম।রোদ যেন শহরটাকে পুড়িয়ে ছাড়খার করে দিবে এমন অবস্থা।
পুনমের ক্লান্ত লাগে…..শরীর অসার হয়ে আসতে চায়। তারপরও হাটতে থাকে।শরীরটাকে কয়েক মণ ভারী মনে হয়।যাত্রী ছাউনিতে এসে বসে পড়ে পুনম।ওকে বাসে উঠতে হবে কিন্তু এই মিনি বাসগুলোতে এত ভীর! ঠেলে ঠুলে বাসে ওঠার শক্তি নেই এখন ওর। তাই বাসে না ওঠে বসে থাকে।
যাত্রী ছাউনিতে দু তিন জন লোক দাঁড়িয়ে আছে। তারা বার বার ঘুরে ফিরে পুনমের দিকে তাকাচ্ছে। পুনমের অসহ্য লাগলেও রা করে না।ওর মাথায় এলোমেলো চিন্তা ঘুরপাক খায়।শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে ব্যস্ত শহরটার দিকে।মানুষের এত ব্যস্ততা কিসের জন্য? নিজের জন্য নাকি কাছের মানুষগুলোর জন্য?
পুনমের হুট করে কান্না পায় কিন্তু বরাবরের মত কান্না সংবরণ করে।পুনম ভেবে পায়না কোথায় গেলে একদণ্ড স্বস্তি পাওয়া যাবে…কোথায়?
এইমাত্র ও একটা ইন্টারভিউ থেকে বের হলো। ইন্টারভিউ ভালো হলেও তারা অভিজ্ঞতা সম্পন্ন লোক চাচ্ছে। এরমানে এই হলো,এই চাকরিটাও হবে না কিন্তু পুনমের এখন একটা চাকরির খুবই দরকার।খুব!
পুনম ব্যাগ থেকে পানির পট বের করে মুখে পানির ছিটা দেয়।হাতের তালুতে পানি নিয়ে মাথায় ঢালে।কন্ঠনালী শুকিয়ে কাঠ হয়ে আছে একটু পানি পান করতে পারলে শান্তি পেত….কিন্তু রোজা রাখায় তাও সম্ভব না। পুনম বুঝতে পারছে ওর শরীর আবার খারাপ হতে শুরু করেছে।ঘাড় ব্যাথা করছে,মাথা ঘুরাচ্ছে….হয়তে প্রেসার ফল করেছে।এই সমস্যা কিছুদিন যাবত দেখা দিয়েছে। পুনম বুঝতে পারছে ওর শরীর রেষ্ট চায় কিন্তু তা আদোও সম্ভব না।
টুং টুং করে ফোনের রিং বেজে ওঠে, স্ক্রিনে বল্টু নামটা ভেসে ওঠে।পুনমের একমাত্র বন্ধু আহসান, যাকে ক্যাম্পাসে সবাই ওর পেটুক স্বভাবের জন্য বল্টু বলে ডাকে।দীর্ঘশ্বাস চেপে পুনম কল রিসিভ করে,
—-হ্যা বল…
—-দোস্ত কোথায় রে তুই?
—-যেখানেই থাকি এখন আবার তুই কল করছস কেন? সকালেই না তোর সাথে দেখা হলো…
—–কেন তুই কোন দেশের মিনিস্ট্রি যে তোকে কল দেয়া যাবে না….আহসানের কন্ঠে ক্ষোভ প্রকাশ পায়।
পুনম বুঝতে পারে তার বন্ধুটি কোন কারণে রেগে আছে তাই কোমল স্বরে বলে ওঠে,
—-স্যরি দোস্ত, আমার চিন্তা হচ্ছিল। ভাবলাম কি না কি হলো আবার..….
—-তুই কি জানিস? তুই একটা জড় পদার্থে পরিণত হয়েছিস।সকালে তোকে দেখে আমি চিনতেই পারিনি। এ কোন পুনম? আমার বন্ধু পুনম এই মেয়েটি হতে পারে না।
পুনম কিছু বলে না, কি বলবে এ প্রশ্নের উত্তরে। বল্টু ফের বলে ওঠে,
—-দেখ নখরা করবি না, কোথায় আছিস ঠিকানা বল। সকাল থেকে গার্লফ্রেন্ডের নখরা সামলিয়ে আমি ক্লান্ত, এখন তোর নখরা সহ্য করবো না।সোজা ঠিকানা বল আমি আসছি, আর তোর ছোট ছোট স্টুডেন্টের মাদারদের বলে দে আজ তুই পরাবি না। ক্লিয়ার!
পুনম ঠিকানা বলে কল কেটে দেয়।আজ আর রেহাই নেই বুঝতে পারে।আর কত? বন্ধু দেরও সময় দিতে হয়।সকালে বল্টুর সাথে রিমি ছিল বলে রেহাই পেয়েছিলো তারপরও ওকে দেখতে পেয়ে বল্টু চোখ রাঙিয়ে তাকিয়ে ছিল।এর স্পষ্ট মানে হলো তোর খবর আছে…..
বল্টু বাইকে নিয়ে পুনমকে সোজা দিয়া বাড়ি চলে এসেছে। নিরিবিলি জায়গা দেখে পুনমকে সাথে নিয়ে বসে পড়ে। দুজনেই চুপচাপ, চারদিকে বিশুদ্ধ বাতাসের আনাগোনা। পুনম চোখ বন্ধ করে অনুভব করে প্রকৃতির ছোঁয়া। ওর ভালো লাগতে শুরু করে। অনেকক্ষণ পর বল্টু বলে ওঠে,
—-তোকে দেখতে পেত্নির মত লাগছে, নিজের যত্ন নিতে ভুলে গেছিস নাকি? আয়না দেখিস না কতদিন বলতো?আজ একমাত্র তোর কারণে রিমি আমার সামনে তার মেকাপ চেহারা নিয়ে অহংকার করতে পেরেছে।বলে কিনা দেখেছো পুনমের থেকে এখন আমাকেই বেশি সুন্দর দেখায়।ন্যাচারল বিউটি আর মেকাপ বিউটি কি এক? যদি ওই গাধি বুঝতে পারে তা…..
পুনম হেসে বলে ওঠে, আমি কিন্তু রিমিকে বলে দিবো।
বল্টু ভয় পাওয়ার ভান করে বলে ওঠে, কোন জনমের শত্রুতার প্রতিশোধ নিবি রে….
পুনম আবার খিলখিল করে হেসে ওঠে।বন্ধুরা বুঝি এমনই হয়। বল্টু নরম কন্ঠে জিজ্ঞেস করে,
—কি হয়েছে পুনম তোর? কতদিন ধরে দেখা করতে চাই কেন দেখা করছিস না…. কেন নিজেকে এভাবে গুটিয়ে নিচ্ছিস সবকিছু থেকে।তুই হাসতে ভুলে গিয়েছিস। কেন? পরিবার কি একার তোরই আছে আমাদের নেই।বল? আজ তোর সবকথা আমায় বলতেই হবে।বন্ধুত্বের কসম করে বলছি….আজও যদি কথা চেপে রাখিস আমি আর জীবনে তোর সাথে দেখা করবো না।
—-বলতো আর কত? ছোট বেলা থেকেই সংগ্রাম করে আসছি।বাবা রিটায়ার্ড করবে একবছর পর,এর মধ্যে আমায় একটা ভালো চাকরি যোগার করতে হবে।জানিস বল্টু মা যখন বলে ওঠে, তার একটা ছেলে থাকলে আর এত কষ্ট করা লাগতো না।তখন মায়ের পায়ের নিচে সারা দুনিয়া এনে রাখতে মনে চায়।বাবার বয়স হয়েছে,মা ইদানিং অসুস্থ থাকে বেশি।ঝুমা আপার বেবি হবে।তার জন্য খরচ,মাস শেষে গাইনী ডক্টর দেখাতে হয়।আর জানিসই তো ডাক্তার কাছে গেলে এই টেষ্ট সেই টেষ্ট! দুলাভাইটা যদি কোন কাজ করতো…..এত অলস! জিজ্ঞেস করলেই বলে চেষ্টা করছি….বলতে বলতে পুনম কেঁদে দেয়।
বল্টু চরম আশ্চর্য হয়ে তাকিয়ে থাকে, কতটা সহ্য করলে পুনমের মত এত শক্ত একটা মেয়ে এভাবে ভেঙে পড়ে!
—-তোকে ধন্যবাদ রে বল্টু, অনেকদিন ধরে বুকের ভিতর গুমোট হয়ে রয়েছে,একটু মন খুলে কথা বলার কেউ নেই!
জানিস তো আমার পরিবারে বাবার পর আমিই শক্ত থেকে কাজ করার চেষ্টা করছি।নইলে বাবা শেষ হয়ে যেত। পাবনী মানে সেজ আপা ভাবে কি আমি কিছু বুঝতে পারি না।সেজ আপা পায়ের ব্যাথায় রাত হলে ছটফট করে। কিছু বলে না আমাকে।আপাকে ডাক্তার দেখানো দরকার।রাত হলে চোখ বুঝে খিচ মেরে শুয়ে থাকে যাতে আমি বুঝতে না পারি।পায়ের ব্যাথায় বাথরুমে গিয়ে কান্না করে। আমার তখন দমবন্ধ হয়ে আসে।আপার কষ্টে নিজেকে শেষ করে দিতে মনে চায়।বড় আপারা বেড়াতে এসেছে, ইষ্টি মিষ্টি তাদের নানা নানুর কাছে ঈদ করতে চায়।জানিসই তো বড় দুলাভাই কেমন মানুষ।বাবা যখন তাদের জন্য ভালো বাজার করতে পারে না তখন বাবার মন খারাপ হয় তাই আমায় বেশি খাটতে হয়।যাতে বাবা তাদের কাছে ছোট না হয়ে যায়… সেই সকাল সাড়ে ছয়টায় বাসা থেকে বের হই আর আসি রাত সাড়ে আটটার পর তারপর রাত জেগে পড়াশুনা করি।যদি বিসিএস টা হয়ে যায়। রাতে মাত্র তিন চারঘন্টা ঘুমাই।ইদানীং নিজেকে আয়নায় দেখার সাহস হয় না। আয়না দেখলেই মনে হয় প্রতিবিম্বের পুনম আমায় কটাক্ষ করছে। উপহাস করছে! এমন কেন হয় বলতো? কেনই বা এত সংগ্রাম করে বেঁচে থাকতে হয় আমাদের মত মধ্যবিত্তদের?
ি
কাছের বন্ধুটির এমন কথা শুনে বল্টুর বুকের ভিতর হু হু করে ওঠে।এই যে এই মেয়েটি যে ওর পাশে বসে আছে তার জন্মগ্রহণ করা উচিত ছিল কোন বনেদি ঘরে।যার চারিপাশে সবসময় দাস দাসী ঘুরে বেড়াবে,যার এক হুকুমে সব তার সামনে চলে আসবে এমন ঘরে। কোন শক্তপোক্ত বিছানা নয় নরম তুলতুলে বিছানা তার নিদ্রার জন্য আকুলতা করবে।কিন্তু বিধাতার ইচ্ছা অন্যরকম! পুনম নামের এই অপূর্ব সুন্দর মেয়েটিকে বিধাতা সংগ্রাম করার জন্য পাঠিয়েছে এই ধরনীতে। আল্লাহ নিজ হাতে পরম যত্নে গড়েছে তার বন্ধুটিকে নাহলে এত সুন্দর কি করে হয় মানুষ?পানপাতার মত গোল মুখশ্রী, গায়ের রঙ দুধে আলতা,আদুরে চিবুক, টিকালো নাক আর অসম্ভব মায়াবী দুটো চোখ। ওই চোখের চাহনিতে ক্যাম্পাসের কত যুবক যে খুন হয়েছে তার হদিস নেই….কিন্তু কখনো পুনম ফিরে তাকায়নি।কত মেয়েদের ঈর্ষার কারণ তার বন্ধু পুনম নিজেই হয় তো জানে না। এমনকি ওদের ডিপার্টমেন্টের আনোয়ার স্যার তো পুনমের উপর চরম ফিদা। পুনম যেদিন ক্লাস করে সেদিন আনোয়ার স্যারের পা দুটো হালকা কাঁপা কাঁপি করতে দেখা যায়, অযথাই বিষম খায় বারবার কিন্তু পুনম ফিরে তাকায় না। আর আজ সেই পুনমের চুল রুক্ষ, চোখের নিচে কালি পড়ে গেছে,ঘুমহীন চোখ দুটিতে অজস্র বিষন্নতা তবু লড়াকু এই পুনমকে বল্টুর কাছে অসাধারণ মানবী মনে হয়!
—-আর তানভীর ভাই?
—-জানি না!
—–তুই কি তানভীর ভাইকে ভালবাসিস?
—–ভালোবাসি কিনা জানি না কিন্তু মি.তানভীরকে আমি সম্পূর্ণ উপেক্ষা করতেও পারি না।ভোতা এক অনুভূতি কাজ করে…..তার কথা ভাবতে না চাইলেও সে আপনা আপনি আমার ভাবনায় চলে আসে।আমি নিজেকে নিয়ে ভাবার সময় পাই না সেখানে ভালোবাসার মত কঠিন বিষয় নিয়ে কিভাবে ভাবি, বলতো? আর তাছাড়া সে নবাবপুত্র আর আমি ঘুটেরাণী আমার কি তাকে ভালোবাসা সাজে বল? কোথায় সে আর কোথায় আমি? তবে……
—–তবে কি?
—–ইদানিং তোদের তানভীর ভাই আমাকে খুব জালাচ্ছে, আগে ছিল পাঁতিহাস আর এখন সে রাজহাঁস হতে চাইছে….
বল্টু হেসে দিয়ে বলে,তোর সকল পানীপ্রার্থীকে উপেক্ষা করতে পারলেও তানভীর ভাইকে পারবি না।এ বড় শক্ত চিজ! ঠিক কচ্ছপের মত, ধীরে ধীরে আগাচ্ছে তোর প্রতি। এতে তোর মায়াও বাড়বে আর তাকে দূরেও ঠেলতে পারবি না। বুঝছস আন্ধার রাইত? পুনম নামের অর্থ পূর্ণিমার রাত আর বল্টু মজা করে ডাকে আন্ধার রাইত…..
বল্টু খেয়াল করে পুনম কপাল কুঁচকে ওর সাথে কথা বলছে। হয়তো পুনমের মাথা ব্যাথা তাই এরকম কপাল কুঁচকে কথা বলছে।তাই বল্টু বলে ওঠে,….
—আয় আমার কাঁধে মাথা রেখে কতক্ষণ চোখ বুজে থাক দেখবি তোর মাথা ব্যাথা কমে গেছে। সত্যিই সত্যি
পুনম বল্টুর কাঁধে মাথা রাখে।চোখ বুজে রেখেই জিজ্ঞেস করে পুনম,….তুই কি আগের জন্মে আমার ভাই ছিলি? বল্টুও মৃদুস্বরে জবাব দেয়, হুম!
**************************
রাজু গাড়ির সাথে হেলান দিয়ে দাড়িয়ে এলোমেলো চিন্তা করছে। রাজু নিশ্চিত তার চাকরি এবার বড় স্যার কাটআউট করে দিবে।তার বড় স্যার আছে এখন ইন্দোনেশিয়া, আগে সে যদি বাহিরে যেত তবুও রাজুর সাথে যোগাযোগ করে তানভীর স্যারের সকল আপডেট জানতো।কিন্তু এবার না বড় স্যার কল করছে না তার কল যাচ্ছে….. আর এদিকে তানভীর স্যার তার মনমতন সব কাজ করে বেড়াচ্ছে। সে বাধা দিলে তাকে উল্টো ধমক দিচ্ছে। বড় আশ্চর্যের বিষয়! তানভীর স্যার যে জোরে কথা বলতে জানে তাইতো সে জানতো না,তারপর তো ধমক..প্রথম যেদিন ধমক দিলো সেদিন সে পাক্কা আধা ঘন্টা বাথরুমে বসে থেকেছে কিন্তু বাথরুম ক্লিয়ার হয়নি।তার এটা বদঅভ্যেস, ছোটবেলা থেকেই মা ধমক দিলে আর বাথরুম হতো না।আর এটা বড় বেলায়ও রয়ে গেছে!পুরাই অশান্তি!
রাজুর হাতে ইফতার আর বিশ মিনিটের মধ্যে আজান দিবে।তানভীর স্যার ডাক দিলেই তার কাছে যেতে হবে।রাজুর ডাক পড়ে, রাজু ইফতার রেখে আসার সময় দেখতে পায়, তার তানভীর স্যারের উরুর উপর মাথা দিয়ে পুনম ঘুমিয়ে আছে আর স্যার পরম মমতায় পুনমের মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে আর মাঝে মাঝে পুনমের কানের কাছে মুখ নিয়ে তৃষ্ণার্ত প্রেমিকের মত আদুরে গলায় ডাকছে,
—পুনমি, এই পুনমি……পুনমি….
রাজুর এই দৃশ্য দেখে কান্না পায়, এই পুনম তার চাকরি খাবে……..নিশ্চিত….১০০% নিশ্চিত।
চলবে