নীলকণ্ঠ,সূচনা_পর্ব

নীলকণ্ঠ,সূচনা_পর্ব
নুসরাত_তাবাস্সুম_মিথিলা

আপনাকে বিয়ে করা আমার পক্ষে সম্ভব নয় , স্যার ।
কেন বলোতো ? আমার মাঝে কিসের কমতি আছে ? টাকা-পয়সা , বাড়ি -গাড়ি কি নেই আমার বলো ?
চরিত্র বলে কিছু নেই আপনার । শুধুমাত্র টাকা-পয়সা থাকলেই ভালো মানুষ হওয়া যায় না । একজন ভালো মানুষ হতে হলে সুন্দর-সচ্ছ চরিত্রের অধিকারী হতে হয় , বুঝতে পারলেন । যার ছিটেফোঁটাও আপনার মাঝে নেই ।
তুমি কিন্তু বড্ড বেশি বাড়াবাড়ি করছো কণ্ঠ ।
বাড়াবাড়ি আমি না আপনি করছেন , স্যার । আর খবরদার আমাকে কণ্ঠ বলে ডাকবেন না ।
কেন এই নামে আমি ডাকতে পারব না তোমায় ? কি সমস্যা ?
এই নামে আমার আপনজনেরা আমায় ডাকে তাই । আপনি কেন বুঝতে চাইছেন না ?
আমি কিছু শুনতে বা বুঝতে চাই না । তুমি আমায় বিয়ে করছো ব্যাস্ ।
আমি পারবো না । তাছাড়া আপনার লজ্জা করে না ? আপনার পরিবারের কথা তো অন্ততপক্ষে ভাববেন । আপনার ওয়াইফ আছেন , ছেলে-মেয়ে আছে । আর আপনি ? ছিহ ..
মেলিহাকে আমি ডিভোর্স দিয়ে দেব । তুমি চিন্তা করো না । তোমার কোনো অসুবিধা হবে না ।
আপনার কিভাবে মনে হলো যে আমি অন্যকারো ঘর ভেঙে সেই ঘরে সংসার করব ? আমার কি বিবেকবোধ লোপ পেয়েছে ? আমাকে এতোটা নিচ মন মানসিকতার ভাবেন আপনি ?
ওহ ! আমি বললেই দোষ ।
হ্যাঁ , দোষ । আমি আগামীকালই আমার রেজিগ্নেশন লেটার জমা দিয়ে দিব ।
তুমি রিজাইন নিলে ওই সৈকত এর চাকরিও থাকবে না । ওর জন্যই তুমি আমায় বিয়ে করছো না ।
মানেটা কি ? কি শুরু করেছেন আপনি ? মি. সৈকত সাহেব আমার একজন কলিগ আর ভালো বন্ধু । আমার চাকরি ছাড়ার সাথে উনার চাকরি যাবার কি সম্পর্ক ?
কারণ তুমি ওকে ভালোবাসো ।
কারো সঙ্গে হেসে কথা বললেই বুঝি তাকে ভালোবাসা ?
আমি ওত সব জানি না । তোমাকে আমার চাই ব্যাস্ ।
আমার আগের স্বামীর সাথে আমার সংসার করা কেন হয়নি জানেন ? সেও আপনার মতো লম্পট , দুশ্চরিত্র ছিল । আপনি ভাবলেন কি করে যে ওই একই চরিত্রের অধিকারীকে আমি বিয়ে করব ?
তাহলে সৈকত চাকরিটা হারাচ্ছে নিশ্চিত থাকো ।
আপনি আমার রাগ উনার ওপর মেটাবেন না । প্লিজ স্যার । উনার বাসায় বৃদ্ধা অসুস্থ মা , একটা ছোট বোন আছেন । তার পুরো পরিবার ওনার উপার্জনের ওপর নির্ভরশীল । আপনি এমনটা করতে পারেন না ।
বাহ ! সৈকতের জন্য দরদ উতলে উঠছে । আর আমার কথা ভাববার সময়ই হয় না তোমার ।
দয়া করুন মি. শোভন । আমি আর কিছু শুনতে চাই না । এই চাকরিটা না থাকলে হয়তো আমি এই বিলাসবহুল ভাবে জীবনটা কাটাতে পারবো না কিন্তু আমি প্রাণ খুলে বাঁচতে পারব । হয়তো মানিয়ে নিতে একটু কষ্ট হবে কিন্তু রোজ রোজ এসব নোংরা কথাগুলো তো শুনতে হবে না । ভালো থাকবেন আপনি আর কালকেই সব ডকুমেন্টস পেয়ে যাবেন । আসছি স্যার ।
আরে কণ্ঠ , শুনো । দাঁড়াও বলছি । শিট , ড্যামিট ।
চোখ মুছতে মুছতে রেস্টুরেন্ট থেকে বেরিয়ে আসলাম । এই এককথা আর ঘটনা রোজ রোজ আর ভালো লাগে না । লাগবে না আমার এই চাকরি । তবুও তো আমার ইজ্জত ওই লম্পটের হাত থেকে রক্ষা পাবে ।
আমি সায়রী আজাদ কণ্ঠ । একটি মাল্টি-ন্যাশনাল কোম্পানিতে জব করছি । আমার বয়স ২৭ বছর । এই চাকরির বয়স ১১মাস । আর এতোক্ষন যার সাথে কথা বলছিলাম সে কোম্পানির এমডি । জয়েনিং এর সময় থেকে তার এসব আচরণ মুখ বুজে সহ্য করে আসছি । কিন্তু আজ তিনি সব সীমা অতিক্রম করে ফেলেছেন । আর সম্ভব নয় । ও বলে রাখা ভালো আমি ডিভোর্সি । দুবছর আগে আমার স্বামীর সাথে আমার সম্পর্কের ইতি ঘটে । তার সাথে ৪বছর ঘর করেছি । সে অনেক আগের কথা । সে এখন তার নতুন সংসারে খুব ভালোই আছে । তারপর থেকে জীবনে সংগ্রাম করতে করতে আজকের এই অবস্থানে পৌঁছেছি । কিন্তু ওই লোকটার জন্য আমার বহুল কষ্টে অর্জিত অবস্থান খোঁয়াতে হবে । বুকের ভেতরটা ভীষন কষ্টে ভারী হয়ে আসছে । পৃথিবীর সব ছেলেরাই কি এমন ? প্রতিটি মেয়ের জীবন কি এভাবেই ধ্বংস করা হবে ? জানি না এসবের উত্তর । তবে এটা জানি যে কিছু ছেলের জন্য পুরো পুরুষজাতিটাকেই আমরা ভুল বুঝতে বাধ্য হই । এইযে ধরুন আমার জীবন । কোনো ছেলেকেই আমি আর বিশ্বাস করতে পারি না । শুধুমাত্র একজন ব্যতীত । অনেক কথা বলে ফেলেছি । বাকিটা আস্তে আস্তে জানতে পারবেন । বাড়িতে পৌঁছেছি , কলিং বেল বাজাতেই আম্মু দরজা খুলে দিল ,
কিরে মা ? আজ এতো তাড়াতাড়ি ? শরীর ঠিক আছে তো ?
আরে আম্মু এতো টেনশন করো না । অসুখ করবে । আজকে অফডে না ? একটু কাজ ছিল তো । তাই বেরিয়ে ছিলাম । কাজ শেষ তাই ফিরে এসেছি ।
কিন্তু মা তোর চোখ-মুখের একি অবস্থা ?
আম্মু বাইরে অনেক গরম তো ! তাই টায়ার্ড হয়ে গেছি আরকি । আচ্ছা আম্মু তুমি খেয়েছো ?
নারে মা ।
মানে কি এখন বাজে বিকেল সাড়ে তিনটা অথচ তুমি খাওনি । তোমার ওষুধ আছে না ? এমন করলে কিভাবে চলবে ? যাও তুমি টেবিলে গিয়ে বসো । আমি ফ্রেশ হয়ে আসছি ।
আচ্ছা মা । তুই তাড়াতাড়ি আয় । আমি অপেক্ষা করছি ।
হুম ।
ফ্রেশ হয়ে এসে মা-মেয়ে খেয়ে নিলাম । আমি ছাড়া আমার মায়ের আর কেউ নেই । একটা বড় ভাই আছেন আমার । কিন্তু সে তার পরিবার নিয়ে ব্যস্ত । বৃদ্ধা মাকে দেখার সময় তার হয় না । আর আমার আব্বু , সেতো আমায় নিয়ে চিন্তা করতে করতে স্টোক করে মারা গেছেন আজ দেড় বছর । আর আমারও আমার মা ছাড়া আর কেউ নেই । খাওয়া শেষ করে আম্মুকে ওষুধ খাইয়ে রুমে চলে এলাম ।
রুমে এসে শুয়ে রয়েছি । কিচ্ছু ভালো লাগছে না । কিন্তু আমার যোগ্যতায় আমি হয়তো আরও ভালো কোনো চাকরি পেতে পারি । তবে কিসের মায়ায় আমার ভেতরটা ছারখার হয়ে যাচ্ছে । আমি কি সত্যি সত্যিই নীল সাহেবের প্রেমে পড়েছি ?
আমার মতো এমন ডিভোর্সি , অপয়া মেয়ের কপালে কখনো এতো ভালো মানুষের সান্নিধ্য জুটবে না । কেন মিছে মায়ার বাধনে নিজেকে জড়াতে চাইছি ? উনি অনেক ভালো কাউকে ডিজার্ভ করেন । আমাকে চাকরির পাশাপাশি নীল সাহেবের মায়াকেও ছাড়তে হবে । তার জীবনে আমার মতো অপয়ার কোনো স্থান নেই ? আর ওই অফিসে থাকা মানেই একটা জানোয়ারকে প্রতিনিয়ত সহ্য করা , তার কুনজরে থাকা , কুপ্রস্তাব শোনা । এর চেয়ে মরে যাওয়াই শ্রেয় । আর কালকে নীল সাহেবকে স্যারের ব্যাপারে সবটা জানাতে হবে । কেননা বলা যায় না , আমার ওপরে জমে থাকা ক্ষোভ থেকে যদি নীলের কোনো ক্ষতি করে দেয় । তাই নীলকে শতর্ক করাটা আমার কর্তব্যের মাঝেই পড়ে ।
অনেক কষ্টে নিজের মনকে শান্ত করলাম । কালকেই রিজাইন লেটার জমা দিয়ে চাকরিতে ইস্তফা দেব । চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছি । এসব ভাবতে ভাবতেই চোখ লেগে এলো । আর আমি ঘুমের দেশে তলিয়ে গেলাম ।
ঘুম ভাঙার পর রেজিগ্নেশনের লেটারটা রেডি করে নিলাম । আর কিছুক্ষণের মাঝেই অতিতের পাতায় ডুব দিলাম । হারিয়ে গেলাম সেসকল স্মৃতিতে ।

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here