হঠাৎ ঝড়ো হাওয়া,২য় পর্ব
হেমন্ত হাসান
পাশের বাড়ির ছাদে ব্যাপক গান-বাজনা হচ্ছে।গায়ে হলুদ।আকাশে মেঘ মেঘ, যেকোন সময় বৃষ্টিতে গায়ে হলুদ পন্ডু হয়ে যেতে পারে।
এমন সময় একটা ডাক এলো,”এই যে এক্সকিউজ মি।”
গায়ে হলুদ যেই ছাদে সেই ছাদ থেকে ডাকছে।তাকাতেই দেখলাম সেই মেয়ে।যে সকালে আমার কাছে ঠিকানা জিজ্ঞেস করেছিল।অনুষ্ঠানের জন্য হলুদ শাড়ি পরেছে মেয়েটা।
এতো অপরুপ সুন্দর মেয়ে আমি আগে কখনও দেখে নি।আমাকে ডেকেই চলছে।
২.
আমি হাত নেড়ে মেয়েটাকে স্বাগত জানালাম।হাসি হাসি মুখ নিয়ে কি যেন বলছে।বোঝা যাচ্ছে না।হাত দুটো মুখের সামনে গোল করে এনে জোরে জোরে বলছে।তাও বোঝা যাচ্ছে না।আমি ইশারায় বুঝিয়ে দিলাম উচ্চস্বরে গান বাজছে তাই বুঝতে পারছি না।
মেয়েটা হাতের ইশারায় একটু অপেক্ষা করতে বলল।আমি দাঁড়িয়ে আছি আর ভাবছি মেয়েটা আমাকে মনে রাখলো কিভাবে?
ভাবতে ভাবতে মেয়েটা এসে পরেছে।এরপর ইশারায় আমার ফোন বের করতে বলল আর বুঝিয়ে দিলো একটা নাম্বার লিখতে।
এই ব্যাপারটা আমার সাথে কখনও হয় নি।ইশারায় কারো নাম্বার নেয়া।
প্রথমে মেয়েটা ডান হাত গোল করে শুন্য বুঝালো। এরপর হাতের আঙুল দিয়ে বাকী নাম্বারগুলো বোঝালো।আমার খুব ভালো লাগলো।মুখের ভাষা ব্যাবহার না করেও কত সহজে দূর থেকে যোগাযোগ করা যায়।
মেয়েটা আমাকে ফোন দিতে বলে ছাদের ভেতর দিকে চলে গেল।
আমি ফোন দিলাম সাথে সাথেই।
ফোন রিসিভ করলো।গান-বাজনার শব্দ একটু কম লাগছে হয়তো বাসায় ঢুকেছে মেয়েটা।
আমিই কথা প্রথমে বললাম,
“হ্যালো,আমি পাশের ছাদের ছেলেটা।”
ও পাশ থেকে মেয়েটার হাসির শব্দ শোনা গেল।কি সুন্দর হাসি।ভেতরটা নাড়া দিয়ে যায়।
মেয়েটা বলল,
“আমি পাশের ছাদের মেয়েটা।”
বলেই আবার একটু হাসলো।
“আমার নাম, হেমন্ত।ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ি।অপরাধ বিজ্ঞান বিভাগে।”
“আমি সূচনা। পড়ি ময়মনসিংহ মেডিকেলে।”
“বাহ, ডাক্তার। এই জন্যে মুখটা মনে রাখতে পেরেছেন আমার।”
“নাহ, আসলে এই জন্যে না।আপনার কপালে একটা তিল আছে।আমার খুব কাছের একটা বান্ধবীর মাথায় ও তিল আছে। আর আপনার মুখটা কেমন জানি বিষন্ন লাগছিল।বিষন্ন মুখের মানুষ সহজে আমি ভুলতে পারি না।”
আমি একটু হাসলাম।বাকি কথা শোনার জন্য চুপ করে আছি।
মেয়েটা বলে চলেছে,
“এই জন্যে আপনার মুখটা ভুলি নি।আচ্ছা,আপনি আমাকে কিভাবে মনে রেখেছেন।”
এখন আমি যদি বলি আপনি সুন্দর তাই, ব্যাপারটা বাজে দেখায়।তবে আরেকটা কারন অবশ্যই আছে।সেটা বলা যায়।
বললাম,
“আপনি যেই ঠিকানা জিজ্ঞেস করেছিলেন সেই ঠিকানাটা আমার পাশের বাসার ছিল, তাই মনে আছে। আর একটা কারন আছে সেটা পরে বলবো।”
মেয়েটা আবার হাসলো।কি মনে করে হাসলো কে জানে?
এরপর বলল,
“আচ্ছা পরেই বইলেন। তবে আপনাকে সবসময় এমন লাগে কেন?মনে হয় রাজ্যের চিন্তা মাথায়।”
“আপনি আমাকে দেখলেনই মাত্র দুইবার।এতেই কিভাবে বলেন সবসময় চিন্তিত থাকি?আচ্ছা, একটু সমস্যায় আছি তাই।ব্যাপার না।”
“আচ্ছা, এখন রাখি পরে কথা হবে। উপর থেকে ডাকছে।নাচতে হবে।আপনারা আসলেন না কেন, হলুদে?”
“মা, আর ছোট দুই ভাই-বোন গেছে।শরীর খারাপ নাহলে আসতাম।”
“আচ্ছা পারলে আসবেন। আমি একটু পর নাচবো।”
আমি হাসলাম। হেসে হেসে বললাম,
“আচ্ছা আসবো। এখন রাখি।খোদা হাফেজ।”
“আল্লাহ হাফেজ।”
.
ফোনটা রাখার পর একটু হালকা হালকা লাগছে। এতক্ষণ যে একটা চাপা টেনশন ছিল একটু কমে এসেছে মেয়েটার সাথে কথা বলার পর।জানি না এই চিন্তাহীন কতক্ষণ থাকতে পারবো।
আরেকটু ভাল লাগলে মেয়েটার নাচ দেখে আসবো।মায়াবী মেয়েদের নাচ মিস করা পাপ।
সাথে গায়ে হলুদে দেয়া বিরিয়ানিও পাওয়া যাবে।গন্ধ আসছে সুস্বাদু বিরিয়ানির।পেটে থাকা সুপ্ত ক্ষুধাটা বিরিয়ানির কথা মনে করতেই নাড়া দিয়ে উঠছে।
.
মেসেজের চিন্তাটা একটু মাথা থেকে নেমেছে এখন সেখানে মেয়েটার চিন্তা।নীচে নেমে দেখলাম মা এখনও যায় নাই। ছোট-ভাই বোন গেছে।
নীল একটা পাঞ্জাবি ছিল।গত ঈদে কিনেছিলাম।সেটা তাড়াতাড়ি পরে নিলাম।রুম থেকে বের হতেই মা বলল,”কিরে কোথায় যাস?”
“চলো তোমার সাথে হলুদে যাবো।”
“আমি তো যাবো না।”
“কেন যাবা না কেন?রেহান আর সুস্মিতা কই?”
“ওরা তো ওদের বন্ধুর জন্মদিনে গেছে।”
নিরাশ হলাম।মনে হয় গায়ে হলুদে আমাদের আমন্ত্রণ জানায় নি।লজ্জা লাগছে।এভাবে হুটহাট পাঞ্জাবি পরে ফেললাম।তীব্র মাথা ব্যাথাটাও এক পাশে এসে পরেছে।সূচনা,পাশের ছাদের সেই মেয়ে, ওর নাচ দেখতে খুব ইচ্ছে করছে।
কি করা যায়?
হঠাৎ ফোনে টুং করে শব্দ হলো।বুকের ভেতরটা নাড়া দিয়ে ওঠে এই শব্দে।আস্তে আস্তে তাকাচ্ছি।চিন্তাটা একটু কমেছিল
আবার যদি মেসেজ দেয়।
নাহ, ওই নাম্বার না।মেসেজ দিয়েছে সূচনা।পাঁচ মিনিটের মধ্যে নাচ শুরু করবে।পারলে তাড়াতাড়ি সেখানে যেতে বলছে।
আম্মাকে বললাম আমাদের কি হলুদে দাওয়াত দেয় নি।
আম্মা না বললো।বিয়েতে দিয়েছে।হলুদে বেশি মানুষ তারা জানায় নি।
পাশের বাসার সাদিককে ফোন দিলাম।ওর সাথে একই স্কুল আর কলেজে পড়েছি।সম্পর্ক অনেক ভালো।
“কিরে সাদিক। কি অবস্থা।”
“এইতো ভাই, খোজ খবর নেস না।”
“বন্ধু, তোদের ছাদে যে যাইতে হয় একটু।”
“আজকে তো অনুষ্ঠান হচ্ছে।”
“এই জন্যেই তো যাবো। একটা কাজ আছে, বন্ধু।সাহায্য কর।”
“ভাইয়া পেকে গেছো। কাকে পছন্দ হয়েছে।”
“আরে ভাই এমন কিছু না। নীচে নামি তুই আয়।”
.
নীচে নামতেই দেখলাম সাদিক হাজির। ও সাদা রং এর একটা পাঞ্জাবি পরেছে। আমাকে দেখেই মুচকি হাসা শুরু করলো।সাদিকের সাথে আরও দুটি ছেলে ছিল, চিনি না।
সাদিক দুই ছেলের দিকে তাকিয়ে আমাকে দেখিয়ে বলল, “আমার বন্ধু, হেমন্ত।”
এরপর আমার দিকে তাকিয়ে বললো, “উনারা হচ্ছেন কনের কাজিন।চট্টগ্রামে থাকে।আমার সাথে ভাল সম্পর্ক হয়ে গেছে।”
আমি হাত মেলালাম। সাদিক এরপর একটা মিথ্যা কথা বলল,
“কত করে বললাম হেমন্ত হলুদে আয়। তিনি আসবেন না।এখন কই যাচ্ছে? ”
বুঝলাম উপরে নেয়ার ধান্ধা করছে।আমি বললাম,”এই তো সামনে। কাজ নেই। কেমন জানি বোরিং লাগছে।”
ব্যাস বলতেই কাজ হয়ে গেল।
দুই ছেলের মধ্যে একজন বললো,”ভাই,আমাদের সাথে আসেন।খুব মজা হবে।”
চট্টগ্রামের লোক তো কেমন যেন নাকা নাকা সুর।
আমি বললাম,”নাহ, শুধু শুধু ঝামেলা।”
আরে চলেন বলে একজন আমাকে হাত ধরে টান দিল।আমি আর না করতে পারি? এতো করে যখন বলছে।
.
উপরে ওঠার সাথেই সাথেই আমার চোখ সূচনাকে খুঁজে বেড়াচ্ছে।একটু খুঁজতেই পেয়ে গেলাম।হলুদের স্টেজের পেছনে আরও কিছু মেয়ের সাথে রেডি হচ্ছে।নাচার জন্য অন্যরকম একটা ড্রেস পরেছে।ড্রেসটার নাম জানি না।একটু লজ্জা লজ্জা লাগছে।আমার সাথে কখনও এমন হয় নি।একটা মেয়েকে দেখার জন্য আমি এতো কিছু করে এলাম।
শুধু আমি বললে হবে না।মেয়েটা মেসেজ না দিলে হয়তো আসতাম না।
.
এক পায়ে দু পায়ে একটু সামনে গিয়ে চেয়ারে বসলাম।একবারে সামনে না আবার একবারে পেছনেও না।
সূচনা স্টেজের সামনে এসে একবার চেয়ারে বসা লোকদের দিকে চোখ ঘুরালো।সূচনার দৃষ্টি আমার দিকে পরতেই ওর চেহারায় একটা পরিবর্তন লক্ষ্য করলাম।এতো মানুষের সামনে হয়তো হাত তুলে অভিবাদন জানাতে পারছে না।শুধু মুখ টিপে একটু হাসলো আর চোখ দুটো আস্তে করে বন্ধ করে আমাকে স্বাগত জানালো।
.
রবীন্দ্রনাথের পাঁচটা গান রিমিক্স করে সূচনা এবং তার দল নাচলো।সূচনার নাচ দেখার সময় আমি আসলে হারিয়ে গিয়েছিলাম।সেই সময়ের বর্ননা ভাষায় দেয়া সম্ভব না।শুধু আমার মনে হচ্ছিল এর থেকে সুন্দর রাত,অনুষ্ঠান আমি আর হয়তো পাবো না।কোনদিনও না, কোথাও না।
.
অনুষ্ঠান থেকে এসে গা এলিয়ে দিয়ে একটু শুয়েছি। তখনই টুং শব্দ।সেই অপরিচিত নাম্বার।অস্বস্তিটা আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠলো।
এবার একটু বড় মেসেজ মনে হচ্ছে।লিখেছে,
“মানুষের জীবনে সবচেয়ে বড় পরিবর্তন আনে ভালোবাসা। মানুষ যখন কারো প্রতি তীব্র প্রেমে পরে তখন সব কিছু তার কাছে সহজ হয়ে যায়।প্রথম দেখায় যদি কারো প্রতি অনেকটা দূর্বল হয়ে যায় তাহলে সেই দূর্বলতা ভয়ানক রূপ নিতে পারে।কিছু দিনের সম্পর্ক অনেকসময় হাজার দিনের কষ্টের কারণ হয়ে দাঁড়ায়।”।
এইবার এই মেসেজের কিছুই বুঝলাম না।প্রত্যেকবারই আমার কোন সাম্প্রতিক বিষয় নিয়েই মেসেজ এসেছে।এবার ভালোবাসা নিয়ে কেন এলো?
সূচনা? ওর প্রতি কি আমি দূর্বল?নাহ এতো তাড়াতাড়ি কিভাবে?
আর অপরিচিত নাম্বারের মালিক,সে বলে সব অনুমান করে কথা বলে। এইসব কিভাবে অনুমান করে?নাহ আমাকে কেউ ফলো করছে।সারাক্ষণ আমার আশাপাশেই আছে কেউ একজন। আমি তাকে দেখছি না কিন্তু সে আমাকে দেখছে।আমার প্রতিটা মুহুর্ত খুব কাছ থেকে দেখছে।
ঘুম যা আসছিল, আবার চলে গেছে। এই ভাবে আর হয় না। কিছু একটা বিহিত করতে হবে।আগামীকাল থানায় যাবো।কে এই লোক?
কিন্তু থানায় কি বলবো?এই মেসেজগুলো তো একটাও আক্রমনাত্মক না।তাছাড়া সহজ হিসেব, বিরক্ত লাগলে তারা আমাকে নাম্বার ব্লক করতে বলবে।আমার সব কিছু একজন দেখছে এটা কোনমতেই তাড়া বিশ্বাস করবে না।
আচ্ছা নাম্বারটা ব্লক দিয়ে দেই।
টুং…
আবার মেসেজ এসেছে।
” আমাকে কি ব্লক দিয়ে আসলে থামানো যাবে?”
ভয় পাবো নাকি অবাক হবো বুঝতে পারছি না।ভয় পাওয়ার আর অবাক হওয়ার বাধ ভেঙে যাচ্ছে।
ফোন দিবো? দিলেই বা কি?দেখা যাবে ফোন বন্ধ।তাও আরেকবার ফোন দিয়ে দেখি। সমস্যার সামনাসামনি দাঁড়ানো প্রয়োজন।
ফোন দিলাম। এক.. দুই… তিন.. সেকেন্ড
রিং হচ্ছে।গলাটা শুকিয়ে গেল এক অজানা ভয়ে।বুকের ভেতরটা উত্তেজনায় ফেটে যাচ্ছে।বুকের ঢিপঢিপ শব্দ মনে হয় বাহিরে এসে পরবে।
[চলবে…..]