শুভ্র_রঙের_প্রেম
পর্বঃ০৯
#রুবাইদা_হৃদি
মোবাইল হাতে নিয়ে ছুটে যাচ্ছি স্নিগ্ধ স্যারের কাছে৷ শরীরের প্রত্যেকটা উপশিরা গুলোতে রক্ত দ্রুত গতিতে ছড়াচ্ছে৷ হাত-পা কাপছে! নীতি রাহাত আমার পিছনে আসছে কিনা সেটা জানি না৷ তবে আমার উত্তর চাই! শাড়ির কুঁচি ধরে জোরে হাটতে গিয়েও বারবার হোঁচট খেয়ে পড়ছি ৷ ক্যাম্পাসের পুরো চত্ত্বর ঘুরে বা পাশের ভবনে যেতে আজ বড্ড দেরি হচ্ছে ৷
গত তিন বছরের আগে ছবি সে পেলো কোথায় ভাবতেই ভড়কে যাচ্ছি বারেবারে! তার সাথে আমার সম্পর্ক নেই, আর কখনো দেখাও হয়নি তবে??
স্নিগ্ধ স্যারের কক্ষের সামনে যেতেই জলদি ঢুকে পরি৷ আশেপাশে চোখ বুলিয়ে কাওকে পেলাম না৷ রুমের পাশে দিয়ে দারোয়ান চাচা যেতেই আমি উচ্চস্বরে ডেকে তার সামনে গিয়ে অনুনয় করে বললাম,
–‘ চাচা,স্যার কোথায়?? ‘
–‘ হে তো চইলা গেছে! ‘
–‘ চলে গেছে মানে?? ক্লাস টাইম তো শেষ হয় নি৷ ‘
চাচা সামনে এগিয়ে গিয়ে রুমে তালা ঝুলিয়ে পানের পিক ফেলে বললেন,
–‘ মুই অতো জানি না আম্মাজান,যাওনের আগে মোর লগে দেহা হইছিলো শুধু কইলো,চাচা গেলাম রুমে তালা লাহায় দিয়ো৷ ‘
আমি হতাশ কন্ঠে বললাম,
–‘ কখন আসবেন বলেছেন?? ‘
–‘ জানি না! তোমার দরকার থাকলে ফোন লাগাও৷’
চাচার কথা শুনে টনক নড়লো আমার ৷ কিন্তু আফসোস উনার নাম্বার তো নেই! আর উত্তর না জানলেও হবে না ৷ সে আমার তিন বছর আগের ছবি পেলো কোথায়??
আমি আবারো ছুটে চললাম মাঠ প্রান্তরে৷ নীতি আর রাহাত আমাকে দেখে ছুটে এলো ৷ আমি নিরাশ কন্ঠে বললাম, ‘ উনি তো চলে গেছেন৷ ‘
–‘ চলে গেছেন মানে?? ‘ নীতি প্রশ্ন করতেই রাহাত কথার মাঝে বলল,
–‘ চইলা গেছে আলহামদুলিল্লাহ ক৷ ব্যাটা বহুত জ্বালাইছে৷ এতো প্যারা মনে হয় আমি জন্মাইবার সময় আমার মা-বাপেও নেয় নাই ৷ ‘
–‘ দোস্ত,ফাজলামোর সময় না এইটা৷ ‘ নীতির ঝাঁঝ মিশ্রিত গলার আওয়াজে রাহাত দমে গেলো৷ আমার দিকে অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে দুইজনেই ৷ আমি ফিক করে হেসে দিয়ে বললাম,
–‘ চিল ইয়ার! উনি আসলেই ক্লিয়ার হয়ে যাবে আমার ছবি পেলেন কোথায় ৷ তার আগে উনার সম্পর্কে সম্পূর্ণ ডিটেইলস বের করতে হবে আমাদের ৷ তিন বছর আগে প্রথম পরা শাড়ির ছবি এইটা আর এই ধরণের ছবি আমি তুলি নি না সোশ্যাল মিডিয়ায় দিয়েছি ৷ তারমানে উনি চিনেন আমাকে আগে থেকেই! ‘
–‘ আমি প্রথম দিন বলেছিলাম উনি তোকে চিনেন৷ ‘
আমি মোবাইলের সেই ছবিটার দিকে তাকিয়ে বললাম, ‘হয়তো! ‘
বুক চিরে হঠাৎ করেই প্রশান্তির হাওয়া বেরিয়ে এলো৷ কেন সেটা জানি না৷ তবে সে যদি শুভ্র প্রেমিক হয় মন্দ হবে না ব্যাপারটা৷ তবে আদেও সেটা না হলে?? আমি কি অজান্তেই ভালোবেসে ফেলছি সেই মানুষটাকে??
___________
বিষন্ন বিকেল! চারদিকে সূর্যের রক্তিম আভা৷ দমকা হাওয়া বইছে৷ হাওয়ার তালে স্থির পাতা গুলো দুলে উঠছে কেঁপে কেঁপে৷ শুভ্র শিমুলের অবাধ্য তুলো গুলো ছুটে বহুদূরে হারিয়ে যাচ্ছে৷ শুভ্র বাতাসে শুভ্র শিমুলের ছুটোছুটি৷ অবাধ্য শিমুল তুলো গুলো আমার চোখেমুখে আছড়ে পরলো কোমল ভাবে৷ অলস হাতে চোখের উপর থেকে তুলো সরাতেই এক ফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়লো গাল বেয়ে৷ বড্ড মন কাঁদছে আমার৷ কেন কাঁদছে জানি না তবে সব কিছুতে কাওকে খুজে বেড়াচ্ছি আমি৷ নীতি আমার পাশে এসে দাঁড়ালো দু মগ কফি হাতে৷ কার্ণিশে নামাতেই আমি চোখ তুলে তাকালাম৷ নীতি কার্ণিশে পিঠে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে ধোঁয়া উঠে কফিতে চুমুক দিয়ে বলল,
–‘ স্নিগ্ধ স্যারের কথা ভাবছিস?? ‘
–‘ উঁহু! ‘
–‘ মুড অফ কেন তাহলে?? ‘
আমি ঘুরে কফির মগ হাতে নিয়ে নিরলস ভাবে আকাশের দিকে তাকালাম৷ ধীর কন্ঠে বললাম,
–‘ জানি না! তবে কেমন স্থির উত্তেজনা কাজ করছে৷ আমি মনে মনে যাকে কল্পনা করছি সে যদি উনি না হয় তাহলে আমার কষ্ট হবে৷ কিন্তু সেই কষ্টটা কেন হবে সেটার কারণ বের করতে পারছি না যে! ‘
–‘ তুই ভালোবেসে ফেলেছিস তাকে৷ ‘
নীতির সোজাসাপ্টা কথাটা শুনে বড় বড় চোখ করে তাকালাম ওর দিকে ৷ হেসে উঠে বললাম,
–‘ তোর ক্রাশ তো, কষ্ট হবে না?? ‘ আমার কথা শুনে নীতি বিষম খেলো৷ নিজেকে সামলিয়ে সিরিয়াস হয়ে বলল,
–‘ আমার সে তাহলে সদ্য জাগ্রত প্রেমে ঠাস করে ছ্যাঁকা খেয়ে একদম বাকা হয়ে যাবে ৷ এই অবিচার আমি কি করে হতে দিই বল?? ‘
–‘ বাসায় জানাবি কবে?? ‘
আমার প্রশ্ন শুনে নীতিও বিষন্ন হয়ে পরলো৷ নিঃশব্দে কফির মগে চুমুকে উদাস চোখে তাকিয়ে রইলাম দুজনে৷ নীতি কিছুক্ষণ পর হাফ ছেড়ে বলল,
–‘ জানি না দোস্ত,মেনে না নিলে?? সেই ভয়ে চুপসে যাই৷ এতোদিনে মনের কথা লুকিয়ে বেঁচে ছিলাম আর এখন যখন সামনে এসেছে তখন সম্পর্ক লুকাতে ব্যাস্ত৷ ‘
আমি পরিস্থিতি সামলাতে বললাম, ‘ জিজুকে দেখাই কবে?? ‘
আমার কথা শুনে নীতির মুখে হাসি ফুঁটে উঠলো৷ বলল,
–‘ তোর আর তোর শুভ্র প্রেমিকের দেখা সাক্ষাৎ তারপর আমাকে খালাম্মা ডাকার জন্য পুচকে হোক তারপর দেখাবো৷ ‘
ওর কথা শুনে বিষন্ন বিকেলটা হঠাৎ করেই রঙিন হয়ে উঠলো৷ বিভিন্ন কথায় মেতে উঠলাম আমরা৷ ছোট ছোট বিষয় গুলো বড় বানিয়ে সিরিয়াস আলোচনার মতো সুখ বোধহয় আর কোথাও নেই৷
.
.
ফেব্রুয়ারীর মাঝামাঝি সময়েও গরম পড়েছে হালকা৷ কপালে বিন্দু বিন্দু ঘামের আভাস পাচ্ছি৷ একহাতে মুছে সামনে তাকালাম আবার৷ ব্যাস্ত ভাবে ঘড়িতে সময় দেখলেও ঘড়ির কাঁটা যেন আগাচ্ছে না৷ আমার অস্থিরতা দেখে রাহাত ঝালমুড়ি ঘাসের মতো চিবুচ্ছে আর
কপাল কুঁচকাচ্ছে৷ আমার সামনে মুড়ি এগিয়ে দিয়ে বলল,
–‘ ঝাল মুড়ি খেয়ে ঝাল মাথা ঠান্ডা কর৷ ‘
আমি ওর কথায় উত্তর দিলাম না৷ আজ দুটো দিন কেটে গেছে এখনো স্নিগ্ধ স্যার আসলেন না৷ নীতি বাসায় গেছে কাল বিকেলে ওর আব্বু হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পরায়৷ সব কিছু অসহ্য লাগছে ৷ একটু আগে পরশ স্যারের কাছে থেকে জানতে পারলাম এগারোটার দিকে স্নিগ্ধ স্যার আসবেন৷ এগারোটা বেজে সাতচল্লিশ মিনিট আর এখনো উনার আসার খবর নেই৷ উফফ! আমার দরকারের সময় কাওকে পাওয়া যায় না৷ ছবি রহস্য আর কে সেই শুভ্র প্রেমিক বের বের করতে না পারলে শান্তি হবে না একদম৷
ব্রেক আওয়ার শেষ হয়ে গেলেও উনার দেখা নেই৷ রাহাত তাড়া দিলো ক্লাসে যাওয়ার জন্য৷ বিরক্ত হয়ে ক্লাসে যেতেই কান্না উঁপচে আসলো হঠাৎ করেই ৷ উনার কিছু হয় নি তো?? এই একটা কথা ঘুরেফিরে বেড়াচ্ছে ৷ এইদিকে ক্লাস ছেড়ে যেতেও পারছি না ৷ এসাইমেন্ট সাবমিট করতে হবে প্রেজেন্টেশনের মাধ্যেমে ৷ আর সেইটা পাঁচটায়৷
হঠাৎ করেই শরীর খারাপ লাগতে শুরু করলো৷ রাতের মাথা ব্যথা বেরে বিশ্রী অবস্থা আমার৷ কপালে হাত দিয়ে দেখলাম টেম্পারেচার অনেক৷ বাসায় যাওয়া দরকার৷ অতিরিক্ত টেনশনের জন্য এমনটা হয়েছে মনে হচ্ছে৷ রিফ্রেশমেন্টের জন্য হলেও বাসায় যাওয়া দরকার ৷
আশেপাশে খুজে দেখলাম রাহাত নেই৷ এই ছেলেটাকে দরকারের সময় পাওয়া যায় না ৷ ক্লান্ত পায়ে উঠে দাঁড়ালাম ভিসি স্যারের রুমে যাওয়ার জন্য৷
স্যার পার্মিশন দিতেই আমি ছুটে বেরিয়ে এলাম ৷ এই সকল অহেতুক টেনশন থেকে মুক্তি পেতে চাই৷ যাওয়ার আগে আরেকবার স্নিগ্ধ স্যারের কক্ষের দিকে তাকালাম৷ বরাবরের মতো তালা ঝুলছে৷ আচ্ছা? উনি কি চিরতরে চলে গেলেন আমাকে গোলক ধাঁধায় রেখে ৷ হঠাৎ করে উড়ে আসা পায়রার মতো??
তপ্ত নিঃশ্বাস ফেলে বাসায় যাওয়ার জন্য ছুটলাম ৷ অবাধ্য চোখ গুলো আরো একবার সেই বন্ধ ঘরে ছুটে গেলো ঝাপসা চোখ গুলো ঘুরিয়ে বাসে উঠে বসলাম ৷ ব্যাগ হাতে একদম পেছনের সারিতে গিয়ে বসতেই চোখে নেমে এলো রাজ্যের ঘুম৷ হাজার চেয়েও চোখ দুটো খোলা রাখতে পারছি না ৷ একা আসা বড্ড বোকামি হয়ে গেছে৷ বাস ইতিমধ্যে চলতে শুরু করেছে৷ হলে ফিরে যাওয়া দরকার মনে হলেও সিটে হেলান দিয়ে বসে থাকলাম৷
–‘ আফা ভাড়া দেন! ‘ ছোট একটা পিচ্চির ডাকে সোজা হয়ে উঠে বসে ঘুম চোখে তাকিয়ে আইডি কার্ড দেখালাম ৷ পিচ্চি বিরক্তিতে চোখ-মুখ কুঁচকে গলা খাকারি দিয়ে বলল,
–‘ টিকেট দেন আফা ৷ টিকেট নেন নাই?? না নিলে দুইশো টেহা ভাড়া দেন৷ আর আপনে কার্ড দেহান ক্যান?? ‘
পিচ্চির কথা শুনে ভ্রু কুঁচকে গেলো আমার৷ ভার্সিটির স্টুডেন্টদের জন্য বাস ভাড়া ফ্রি আর লোকাল ভাড়া বিশ টাকা৷ আর সেখানে একশত আশি টাকা বেশি?? জ্বর ভুলে আমিও তেজ দেখিয়ে বললাম,
–‘ ফাজলামো পেয়েছিস?? মিরপুরের লোকাল ভাড়াও তো এতো না৷ তোর সিনিয়র কে আছেন উনাকে ডাক ৷ ‘
আমার কথা শুনে পিচ্চি খ্যাঁক করে বলে উঠলো,
–‘ মিরপুর পইড়া আছেন কে? মিরপুর ছাড়াইছি আরো তিনঘন্টা আগে ৷ ‘
–‘ মানে?? ‘ আমার উচ্চস্বরের চিৎকারে বাকি প্যাসেঞ্জার আমাদের দিকে তাকালো ৷ আমি বাইরর তাকিয়ে দেখলাম সন্ধ্যা নেমে গেছে ৷ ব্যাস্ত হাতে মোবাইল উঠিয়ে দেখলাম ৭ঃ১৯ বাজে ৷ পিচ্চির কথা ঠিক৷ পাশে থেকে একজন ভদ্রমহিলা আদুরে সুরে বললেন, ‘ কোথায় যাওয়ার জন্য উঠেছিলে?? ‘
আমি উনার কথা শুনে কাঁদো কাঁদো গলায় বললাম,’ মিরপুর৷’
আমার কথা শুনে চারদিকে গুঞ্জন সৃষ্টি হলো ৷ আমি ব্যাগ থেকে দুইশো টাকা বের করে পিচ্চির হাতে দিয়েই চলন্ত বাসে সামনে এগিয়ে ড্রাইভার কে বাস থামাতে বলে নেমে পড়লাম ৷ পেছন থেকে মহিলা বারবার মানা করলেও আমার হিতাহিত জ্ঞান শূন্য ৷ আমার শুধু মনে হচ্ছে,নেমে গেলেই বাসায় পৌছাতে পারবো ৷
সেকেন্ড ভুলটা বাস থেকে নেমেই করি আমি৷ চারদিকে অন্ধকার ৷ আর বাসটাও শা করে আমাকে ছাড়িয়ে চলে গেলো৷ কোথাও কোনো আলো নেই৷ ভয়ে গলা শুকিয়ে এলো ৷ নামার আগে জায়গা কোনটা সেটাও জানা হয় নি ৷ মোবাইল অন করতেই আরেকদফা অবাক হই ৷ চার্জ তিন পার্সেন্ট অবশিষ্ট ৷ জ্বরের ঘোরে মাথা আরো চক্কর দিয়ে উঠলো ৷ বাসায় ফোন করা যাবে না কারণ আব্বু নেই বাসায় ৷ রাহাতের কথা মনে হতেই ফোন দিতেই মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে! রাহাতের মোবাইলও অফ৷
যাবো কোথায় আমি?? আশেপাশে কোথাও বাড়িঘর চোখে পড়ছে না ৷ চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছা হচ্ছে৷ ভয়ে সিটিয়ে গেলাম একদম৷ এই অবস্থায় কি করা উচিৎ সেটা একদম মাথায় আসছে না আমার৷
আশেপাশে ঝোপঝাড়! ঢাকায় অত্যন্ত শেয়ালের ডাক শোনা যাবে না! কিন্তু এখানে যাচ্ছে, মনে হচ্ছে আমার থেকে কিছুটা দূরেই ডাকছে ৷
ভয়ে কান্না করছি ৷ মোবাইলে ফ্ল্যাশ জ্বালিয়ে সামনে এগিয়ে যেতেই ভয়ে আত্মা কেঁপে উঠে ৷ পেছনের দিকে দৌড় দিতেই……..
চলবে…