কাগজের_তুমি_আমি
দ্বিতীয়_অধ্যায়,১৩তম_পর্ব,১৪তম_পর্ব
মুশফিকা রহমান মৈথি
১৩তম_পর্ব
ধারার প্রতিটা কথা চুপ করে শুনেছে অনল। ধারা কথাগুলো বলে এগিয়ে যেতে নিলে হ্যাচকা টানে তাকে নিজের কাছে নিয়ে আসে অনল। ঘটনার আকর্ষিকতায় ধারা টাল সামলাতে না পেরে ওর বুকে আছড়ে পড়ে। অনল ও সুন্দর ভাবে তাকে সামলে নেয়। মাথা তুলে অনলের দিকে তাকাতেই বজ্রের মতো কঠিন কন্ঠে তাকে শুনিয়ে দেয়,
– ঠিকভাবে দু কদম চলতে পারে না আসছে একা একা হাসপাতালে যাবে। বেশি পাকামো করিস না। আমি যখন বলেছি আমি দিয়ে যাবো, মানে আমি নিয়ে যাবো। আর একটা কথা শুনলে কান লাল করে দিবো।
অনলের চোখের দিকে তাকিয়ে রয়েছে ধারা। অনল এখনো তার বাধন হালকা করে নি। অনলের দৃষ্টি ধারার আখি বরাবর। কোনো অজানা আকর্ষণে চোখ সরাতে ইচ্ছে হচ্ছে না ধারার। এই লোকটার সমস্যাটা কি সেটাই সে বুঝে উঠতে পারছে না। একবার কুকুরের মতো দূর দূর করে তাড়িয়ে দেয় আবার অধিকার দেখায়। এই অনুভূতির উত্থান পতনে ধারা বুঝে উঠতে পারছে না তার কি করা উচিত। কতোক্ষণ অনলের বাহুডোরে ছিলো সেই হিসাবটা সে লাগাতেও যায় নি। সেদিনের রুমের ব্যবহারটা মনে পড়তেই ঝট করে সরে আসলো অনলের কাছ থেকে। ধারার এই আচারণটাই স্বাভাবিক এতে অস্বাভাবিকের কিছুই নেই। চোয়াল শক্ত করে ধারা বললো,
– কি প্রমাণ করতে চাইছো? খুব মহৎ তুমি? যথেষ্ট মহত্বের পরিচয় তো দিয়েছো। এবার আমাকে আর ঋণী করো না। নিজের কাছে নিজে প্রতিনিয়ত ছোট হয়ে যাচ্ছি। আবার তুমি দয়া দেখিয়ে এসব করবে, তারপর আমি আবার পেয়ে বসবো। বলা তো যায় না। আমার মতো মেয়ে
কথা শেষ করার আগে ধারার বাহু চেপে ধরলো অনল। শক্ত হাত দিয়ে বেশ শক্তি প্রয়োগ করেই ধরেছে সে। বেশ অগ্নিদৃষ্টি ধারার দিকে প্রয়োগ করে পূর্বের ন্যায় কড়া কন্ঠেই বললো,
– আর একটা শব্দ যাতে তোর মুখ থেকে না বের হয়। আমি রাস্তায় কোনো সিন ক্রিয়েট চাই না। আমার সময়ের একটা দাম আছে।
– তাই তো বলছি একা চলে যেতে চাচ্ছি।
– বেশি লায়েক হয়ে গেছো তুমি, একটা থাবা দিবো সব লায়েকি ছুটিয়ে দিবো। বুজেছি তোমার আমার কোনো প্রয়োজন নেই। আর আমি তোমার জন্য কিছুই করছি না। আমার নিজের জন্য করছি। সুতরাং আমাকে আমার কাজ করতে দাও।
কড়া ভাষ্যে কথাগুলো বলেই ধারার কোমল হাতটা নিজের মুঠোতে নিয়ে হাটা শুরু করলো। ধারা চেষ্টা করেও পারলো না কিছু করতে। এবার অসম্ভব রাগ হতে লাগলো তার। অনলের খবরদারি স্বভাবে খুবই বিরক্ত সে। অনল নিজেই তাকে তার থেকে দূরে থাকতে বলেছে। অথচ এখন সে আবার নিজেই ধারার জন্য এসব করছে। ধারা নিজের মনকে এই এক মাসে খুব সুন্দর করে বুঝিয়ে নিয়েছে মোটেই সে অনলের প্রতি দূর্বল হবে না। তাই নিজেকে ব্যস্ত রাখার জন্য পড়াশুনাও শুরু করে দিয়েছে সে। অথচ আবারো নিজের মস্তিস্কের প্রহরীগুলোকে পরাজিত করে হৃদপ্যের মাঝে কবজা করে নিবে অনল। আর অপমানিত হওয়ার মতো সাহস তার নেই। অনল গাড়িতে উঠার আগ অবধি তার হাত ছাড়ে নি। শুধু তাই নয়, সি.এন.জি তে উঠার পর ও ধারা হাত নিজের মুঠোছাড়া করে নি সে। যেনো ছেড়ে দিলেই কোথাও পালিয়ে যাবে ধারা। গাড়িতে একটা কথাও বলে নি ধারা। সে জানে অনলের সাথে কথা বলা মানে অরণ্যে রোধনছাড়া কিছুই হবে না। পাশাপাশি বসা দুজন মানব-মানবীর মাঝে যোজন যোজন দূরত্ব। তারা চাইলেও হয়তো এই দূরত্ব মিটাতে পারবে না, এখন শুধু সময়ের অপেক্ষা____
ডাক্তারের কেবিনে বসে রয়েছে ধারা এবং অনল। গাইনি চিকিৎসক ডা.ইশরাতের তাদের মুখোমুখি বসা। ডা.ইশরাত অনলের ম্যাডাম। হাসপাতালে সবথেকে ভালো ডাক্তারদের মধ্যে একজন। তিনি খুব যত্ন করে সব টেস্ট করে ধারার। ধারার ওয়েটটা বেশ কম। এই ব্যাপারটা ডাক্তারকে বেশ ভাবাচ্ছে। বাচ্চার গ্রোথ দেখতে আলট্রাসোনোগ্রাফি করাটাও প্রয়োজন। তাই ডা.ইশরাত অনলকে জানালেন,
– অনল, বেবির এখন সাত উইক চলে কিন্তু ধারার ওয়েটটা বেশ কম। আমি তাই আলট্রাসোনো করে দেখবো। তুমি ওকে নিচে নিয়ে যাও। আলট্রাসোনো করে রিপোর্টটা আমাকে দেখিয়ে নিও।
– ম্যাম, আপনি কি খারাপ কিছু এস্যুম করছেন?
– আই ইম নট শিওর। যদি বেবুর হার্ট রেট ঠিক থাকে দেন টেনশনের কিছু নেই। তবে ধারার খাবার দাবার একটু বাড়িয়ে দাও। যদি ওর সাইজ এমন থাকে তাহলে কিন্তু প্রবলেম হবে। আর মেয়ে একটু বেশি খাওয়া দাওয়া করবা। যা খেতে চাবে অনলকে বলবে ও কিনে দিবে। এই সময়টাই সুযোগ। হাসবেন্ডদের নিয়ে খাটিয়ে নেওয়ার। হাহা
ডা.ইশরাতের কথায় মনের মাঝে এক ঝাক শুন্যতা তৈরি হয়। শুধুমাত্র আবেগের বশে সে যে ভুল করেছে সেইটার কারণে আজ সে আশ্রিতা হয়ে রয়েছে অনলের কাছে। কোন অধিকারে কিছু চাইবে। এই বাসার খাবারও গলা থেকে নামে না তার। কিন্তু কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই। বাবা-মার কাছে যাবে না কারণ তারা তাকে মেনেই নিয়েছে অনলের উদারতার জন্য। এই ছাদটা ব্যতীত কোথাও যাওয়ার সুযোগটাও নেই ধারার। ধারার চিন্তায় ছেদ পড়ে অনলের একটা কথায়,
– ধারার কোনো অযত্ন হবে না ম্যাডাম। ওর খাবারের দায়িত্ব এখন থেকে আমার ম্যাম। চিন্তা করবেন না।
অনলের কথাটা শুনে বেশ অবাক ই হলো। কিছু প্রশ্নের হয়তো উত্তর পাওয়া যায় না। এখন ধারার ক্ষেত্রেও সেটাই হচ্ছে। অনল যত্ন সহকারে তাকে দাঁড় করিয়ে নিচে নিয়ে গেলো। ধারা বাধা দিলেও সে শুনে নি, আলট্রাসোনোগ্রাফী রুমে সে প্রবেশ করেছে। ওখানের কর্মরত মহিলা যখন স্ক্রিনে বাচ্চার অবস্থান দেখছিলো, তখন একটি ক্ষুদ্র ডটের মতো লাগছিলো ভ্রুণটিকে। মাত্র তো সাত উইক,, তবুও বেশ জোড়ালো তার হার্ট বিট। গ্রোথ আশানুরুপ না হলেও বাচ্চাটি সুস্থ আছে। ধারা অশ্রুসিক্ত চোখে ছবিটিকে দেখেই যাচ্ছিলো। হ্যা, এটাই তার বাচ্চা। হোক না অবৈধ, কিন্তু মা-বাচ্চার সম্পর্ক তাও বৈধতা অবৈধতা মানে না। এটা একটা অন্যরকম টান। যা সকল সম্পর্কের উপরে। হঠাৎ খেয়াল করলো অনল এক দৃষ্টিতে ওই ছোট বলটির দিকে তাকিয়ে আছে। অনল নিজেও জানে না এই আকর্ষণটাকে কি বলে। এই ক্ষুদ্র মাংসপিন্ডের হার্টবিট যেনো সরাসরি তার হৃদস্পন্দন দিয়ে অনুভব করতে পারছে। তার সাথে তো বাচ্চাটার কোন যোগসূত্র নেই, তবুও কেনো যেনো মনে হচ্ছে এই বাচ্চাটি তার অনেক কাছের। অনল চোখ যেনো খুশিতে ভরে যাচ্ছে। পাঁচ বছরে এতোটা সুখ তার কখোনোই অনুভব হয় নি। আজ ধারা যতটা বাচ্চাটিকে অনুভব করেছে, অনল ও ততোটাই অনুভব করেছে। হয়তো এইটা তাদের সম্পর্কের যোগ সূত্র____
বিকেল ৪.৪৫টা,
সূর্য পশ্চিমে ঢেলে পড়েছে। এখোনের রোদে সাধারণত কোনো উত্তাপ থাকে না। আজ ও তেমন কোনো কোন উত্তাপ নেই রোদের। নদীর ধারে উত্তাপ আরো কম, মিষ্টি রোদ সাথে ঠান্ডা বাতাসের উত্তাল। এর মাঝে বসে আছে অনল ধারা। দুপুরের পর থেকেই জোর করে এখানে নিয়ে এসেছে অনল। ধারা বারণ করেছিলো কিন্তু কে শোনে কার কথা। আধঘন্টা ধরে এখানেই বসে রয়েছে তারা। এখানে আসার পর অবশ্য ধারার আর যেতে ইচ্ছে হয় নি। প্রকৃতির কাছে নিজেকে সপে দিতে ইচ্ছে হচ্ছে।
– এই জায়গাটা আমার খুব প্রিয় জানিস?
অনলের কথাটা কানে আসতেই পাশ ফিরে তাকায় ধারা। অনলের চোখজোড়ায় একরকম শূন্যতা ভর করেছে। চাপা কষ্ট গুলো চোখে ভিড়েছে। পুরুষের কাঁদতে মানা, তাই অশ্রুরুপেও বের হতে পারছে না। কেনো যেনো ধারার ইচ্ছে হলো অভিমান গুলো পিছে রেখে আজ অনলকে শান্তনা দিতে। নদীর দিকে তাকিয়ে স্বাভাবিক ভাবেই জিজ্ঞেস করলো,
– কেনো? জায়গাটা সুন্দর বলে?
– এই জায়গাটা অনন্যার খুব প্রিয় ছিলো।
অনন্যার কথাটা শুনেই অনলের দিকে অবাক নয়নে তাকায় ধারা। অনল তখন ও নদীর দিকেই তাকায়ে আছে। ধারার দিকে না তাকিয়ে বলতে লাগে…….
চলবে
কাগজের_তুমি_আমি
দ্বিতীয়_অধ্যায়
১৪তম_পর্ব
অনন্যার কথাটা শুনেই অনলের দিকে অবাক নয়নে তাকায় ধারা। অনল তখন ও নদীর দিকেই তাকায়ে আছে। ধারার দিকে না তাকিয়ে বলতে লাগে,
– এই জায়গায় অনন্যার স্মৃতি নিবিড়ভাবে জড়িত। আমি প্রতিটি কণায় অনন্যার উপস্থিতি টের পাই, অনুভব করি। প্রতিটি নিশ্বাসে যেনো ওর মিষ্টি ঘ্রাণ অনুভব হয়। এই জায়গাটায় আসলে অনন্যাকে আমি খুব কাছে পাই। এতোটা পছন্দের আগে এই এই জায়গাটা ছিলো না, কিন্তু যখন ও আমার কাছে নেই তখন এই জায়গাটাই আমার কাছে সবচেয়ে শান্তির জায়গা হয়ে গেছে।
– অনন্যা আপু কোথায়?
অনলের কথার মাঝেই কথাটা বলে উঠে ধারা। ধারার প্রশ্নে চুপ হয়ে যায় অনল। শব্দগুলো গলাতেই আটকে আছে। নীরবতা ভেঙ্গে বলে,
– একটা গল্প শুনবি? একটু বোরিং, একটু কষ্টের কিন্তু গল্পটা বলতে ইচ্ছে হচ্ছে।
– গল্পটা বললে হালকা হবে তুমি?
– হয়তো, জানি না। তবে বলতে ইচ্ছে করছে খুব।
– হুম শুনবো।
ধারার সম্মতি শুনে ঠোটের কোনায় মলিন হাসি টেনে অনল বলতে শুরু করে। ধারাও মুগ্ধ হয়ে অনলের কথা শুনছে। পড়ন্ত বিকেলের মিষ্টি আলোতে অনল অনলের অতীতের একটি অধ্যায় ধারার সামনে তুলে ধরে। মনের গহীনে এই পাঁচটা বছর এই অধ্যায়টা চেপে রেখেছিলো সে।
সাত বছর আগে,
বর্ষার সকাল, অঝর ধারে বৃষ্টি পড়ে যাচ্ছে। বৃষ্টির অক্লান্ত বর্ষণে মিরপুরের রাস্তায় নদী তৈরি হয়েছে। এই বৃষ্টির মাঝে ছাতা মাথায় দাঁড়িয়ে আছে অনল। চেষ্টা করে যাচ্ছে একটা সি.এন.জি পাওয়ার জন্য। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজে ইন্টার্ণশীপ করছে সে। তাই বৃষ্টি মাথায় নিয়েও এই সকালবেলা তাকে জয়েন করতে হবে। এই বৃষ্টির মাঝে সি.এন.জি একে তো পাওয়াই যায় না আর যদি সেটা পাওয়া ও যায় তবুও চড়া তার ভাড়া। প্রায় আধাঘন্টা যাবৎ এই নির্দয় বৃষ্টির মাঝে সে ভিজে যাচ্ছে। হঠাৎ একটা সি.এন.জি আসতে দেখে হাত দিয়ে ইশারা করলো সে। আর রাস্তায় দাঁড়াবে না সে। যা ভাড়া চাবে তাই দিয়ে যাবে। সি.এন.জি ঠিক করে যেই না উঠতে যাবে অমনি একটা মেয়ে ফট করে উঠে বসলো সি.এন.জি তে।
– একি একি, আমার সি.এন.জি তে আপনি উঠছেন কেনো? নামুন বলছি। আমি পুরোটা ভাড়া করেছি।
অনল বেশ ভড়কেই কথাটা বললো। অনলের রাগান্বিত দৃষ্টিকে উপেক্ষা করে মেয়েটাও চড়াও হয়ে বললো,
– তো? আপনি কি সি.এন.জিটা কিনে নিয়েছেন? দেখুন এমনেই আমি ভিজে গেছি বৃষ্টির জন্য। আর ছাতাটাও ছিড়ে গেছে। আমি এলিফ্যান্ট রোডের সামনেই নেমে যাবো। আমার ভাড়াটাও আমি দিয়ে দিবো। মামা আমাকে ওখানে নামিয়ে দিয়েন।
মেয়ের এমন ভাবলেশহীন আচারণে অনলের মেজাজ আরোও বিগড়ে গেলো। খানিকটা উলটা ঘুড়তে হবে এখন তার। হাতির ঝিল হয়ে যদি যেতে হয় তাহলে এমনেই একটু বেশি সময় লাগবে। অনল মেয়েটাকে বেশ থমথমে গলায় বললো,
– আমি মেডিকেলে নেমে যাই তারপর আপনি যেয়েন যেখানে যাবার
– আজিব তো সোজা ভাত না খেয়ে আপনি ঘুরে কেনো খাবেন। বেশি তো সময় ও লাগবে না। আমাকে নামিয়ে আপনাকে পৌছে দিবে মামা।
– আজিব তো একে তো আমার ভাড়া কড়া সি.এন.জি তে উঠে বসেছেন উপরে দাপট দেখাচ্ছেন।
– আজিব আমি কি আপনার টাকায় যাচ্ছি?
এক পর্যায়ে ঝগড়াই লেগে গেলো তাদের মধ্যে। কেউ দমে থাকার মতো নয়। শেষমেষ সি.এন.জি এর ড্রাইভার বাধ্য হয়ে বললেন,
– ঝগড়া কইরেন না, একই জায়গায় তো। আপনারা উঠে বসেন আমি পৌছায় দিতাছি। জ্যামে পড়লে আরো দেরি হবে।
অনল আর ঝগড়া চালাতে পারলো না, পরাজিত সৈনিকের মতো, ফুসতে ফুসতে সি.এন.জি তে বসলো। বৃষ্টির কারণে একটু সরে বসলো মেয়েটা। অনলের একটু কাছাকাছি বসাতে অনল খেয়াল করলো একটা মিষ্টি গন্ধ তার নাকে আসছে। পরমূহুর্তে বুঝলো মিষ্টি গন্ধটা মেয়েটার চুল থেকে আসছে। এতোক্ষণে অনল খেয়াল করলো মেয়েটা অপরুপ সুন্দরী। গায়ের রঙটা চাঁপা হলেও মুখটা মায়ায় ভরা। কাজলটানা চোখ জোড়ার প্রেমে যেকোনো ছেলে পড়বে। বৃষ্টির স্নিগ্ধতার মাঝেও মেয়েটির স্নিগ্ধতা অনলের মনকে নাড়িয়ে দিচ্ছে। পঁচিশ বছরের যুবকের মনে এ যেনো অন্য অনুভূতির আবির্ভাব ঘটলো। পরমূহুর্তেই চোখ সরিয়ে নিলো অনল। এই অবাস্তব অনুভূতিকে মোটেও প্রশ্রয় দিবে না সে। জীবনের মাকে দেখে একটা জিনিস শিখেছে সে ভালোকরে। ভালোবাসা নামক অবাস্তব অনুভূতি তোমাকে শুধু নিঃস্ব ব্যাতীত কিছুই করবে না। সুতরাং এই অনুভূতির কোনো উপস্থিতি তার জীবনে রাখবে না সে। এই সাময়িক মোহকে মোটেও আশ্রয় দিবে না সে। মেয়েটি ক্ষণিকে জন্য তার বসে আছে এটাই বাস্তব। হঠাৎ সি.এন.জি চালকের কথায় ধ্যান ভাঙে অনলের। মেয়েটা নেমে ভাড়া চুকিয়ে অনলের উদ্দেশ্যে বললো,
– আমি কারোর ধার রাখা পছন্দ করি না, আপনার ভাড়াটা সহ দিয়ে দিয়েছি। বিপদে না পড়লে সি.এন.জি নিয়ে মারপিট করতাম না।
– নিজের টাকার গরম দেখাচ্ছেন?
– উহু, টাকার গরম না। এটা আমার আত্নসম্মানে লাগে কারোর ঋণ রাখলে। আর একটা কথা, সাদা কোট পড়ে আছেন পেশায় হয়তো ডাক্তার। একটু হাসতে শিখেন, ভালো লাগবে আপনার রোগীদের।
বলেই ভাঙ্গা ছাতাটা মাথায় দিয়ে ছুটতে লাগে মেয়েটি। অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে অনল। হৃদপিন্ডটা যেনো মাত্রাতিরিক্ত জোড়ে বিট করছে। এটাকেই হয়তো প্রথম দেখার ভালোলাগা বলে_______
দেখতে দেখতে মাস পার হয়ে যায়, অচেনা মেয়েটি এখনো তার মন এবং মস্তিষ্ক থেকে বের হয় নি। নিঝুম রাতে চখ বুঝলেই মেয়েটার ছবিটা ভাসে তার চোখে অথচ আফসোস মেয়েটির নাম অবধি জানে না সে। অনল ভাবতে শুররু করে মেয়েটাকে হয়তো সে কখনো খুজে পাবে না। কিন্তু সংযোগ বলে একটা জিনিস থাকে। অনল জানতো না যাকে তার মন পাগলের মতো খুজছে সে নিজেই তার সামনে দাঁড়াবে। অনলের এক বন্ধু রবিনের বিয়েতে আবারো মেয়েটির দেখা পায় সে। কৌতুহলের বশে রবিনকে সে জিজ্ঞেস করে,
– রবিন মেয়েটা কে?
– কোন মেয়ে?
– ওই যে লালপরী।
রবিন বেশ কিছুক্ষণ খুজে মেয়েটাকে খুজে পায়। হাসতে হাসতে বলে,
– ও অনন্যা। সীমার বান্ধবী। এক নম্বরের খচ্চর মেয়ে।
– খচ্চর কেনো?
– আসলে খচ্চর হবার কারণ আছে। মামার বাড়িতে মানুষ, মামীটা বেশ দজ্জাল। নিজের পড়াশুনার খরচ নিজেই চালিয়েছে সবসময়, টিউশন করিয়ে। এখন একটা ছোট কম্পানিতে কাজ করে এই সমাজে সারভাইভ করার জন্য যতটা কঠোর হতে হয় ততোটাই কঠোর। মেয়েটার জন্য মাঝে মাঝে করুণা হয়, কিন্তু কেউ সিম্প্যাথি দেখাতে গেলে ধুয়ে দিবে একেবারে।
রবিনের কথাগুলো মন দিয়ে শুনছিলো অনল। সেদিন কেনো তার ভাড়াটা সহ অনন্যা দিয়ে দিয়েছিলো সেটার ব্যাখ্যা খুব ভালোভাবেই বুঝেছে সে। মেয়েটিকে কেনো যেনো আরো ভালো লাগতে লাগলো অনলের। নিজ থেকেই তার কাছে গিয়ে দাঁড়ায়। অনন্যার মুখোমুখি হয়ে বলে,
– মিস. সি.এন.জি ভালো আছেন?
কথাটা শুনে অনন্যা বেশ চমকে যায়। অবাক নয়নে অনলের দিকে তাকাতেই সে বলে,
– চিনতে পারছেন না হয়তো?
– আপনাকে চিনবো না? আপনার মতো হুলোমুখোকে কেউ ভুলে?
– আপনি কিন্তু আমাকে অপমান করছেন
– সত্য বচন বললেই মানুষের অপমান লাগে
বলে পাশ কাটিয়ে যেতে নিলে রাস্তা আটকায় অনল। অনলের পথ আটকানো দেখে অনন্যা চোখ মুখ কুচকে বলে,
– কি চাই?
– এখনো জানি না, আপাতত পরিচিত হতে চাই?
– আপনি কি বুদ্ধিটা হাটুতে নিয়ে বয়ে বেড়ান?
– কেনো?
– দেখছেন আমি আপনাকে ইগনোর করছি তবুও আপনি পরিচয় চাচ্ছেন! আপনার মনে হয় আমি দিবো?
– চেষ্টা করতে ক্ষতি নেই, চেষ্টা করলে এভারেস্ট পাওয়া যায় এতো শুধু নাম-ঠিকানা। আমি কিন্তু বেশ অধ্যবসায়ী।
কথাটা শুনে অনন্যা পাশ কাটিয়ে চলে যায়। অনল হার মানে না, রবিনের সাহায্যে অনন্যার পুরো ডাটা বের করে রীতিমতো স্টক করা শুরু করে। কেনো করছে জানে না, শুধু এটা জানে অনন্যাকে দেখতে ভালো লাগে তার। অনন্যার মুখটা দেখলে সারাদিনের ক্লান্তি ভুলে যায় সে। অনন্যাও ব্যাপারটা খেয়াল করতে লাগলো। প্রথমে বিরক্ত লাগলো, অনেকবার অনলকে কড়া ভাষ্য ও শুনায় ও সে। কিন্তু লাভের লাগ কিছুই হয় না। এবার একটা হেস্তনেস্ত করতেই হবে তাকে______
বিকেল ৫টা,
পড়ন্ত বিকেলে সেই জায়গাটায় মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছে অনন্যা এবং অনল। হঠাৎ এখানে দেখা করতে বলার কারণটা কি সেটা ভেবে পাচ্ছে না অনল। অনন্যার চোখে আজ অন্যরকম প্রশ্ন ঘুরছে। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে সে অনলের দিকে তাকিয়ে আছে। অনল কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই অনন্যা কড়া কন্ঠে প্রশ্ন ছুড়ে দেয়,
– ভালোবাসেন আমাকে?
অনন্যার প্রশ্নটা খুব কঠিন না কিন্তু অনলের গলা শুকিয়ে যায়। মাথায় বিন্দু বিন্দু ঘাম জমতে লাগে। কি বলবে বুঝে উঠতে পারছে না সে। চুপ করে মাথা নিচু করে থাকে অনল। অনলের নীরবতা দেখে বেশ স্পষ্ট কন্ঠে অনন্যা বলে,
– আমি বিগত দু মাস ধরে দেখছি আপনি আমাকে স্টক করে যাচ্ছেন, কেনো? যদি বলেন ভালোবাসেন তবে বলবো আমার বাসায় বিয়ের প্রস্তাব দিন। আমার বাবা-মা নেই, মামা বাড়িতে মানুষ। অন্য সব মেয়ের মত ভালোবাসা নামক খেলাতে মত্ত হবার মত সুযোগ কিংবা ইচ্ছে আমার নেই। তাই যদি আমাকে মন থেকে ভালোবেসে থাকেন এবং আমাকে বিয়ে করার ইচ্ছে থাকে তবে বলে দিন। আমার তাতে আপত্তি নেই। কোথাও না কোথাও আমারও আপনাকে ভালোলাগে। কিন্তু আমি যদি আপনার টাইমপাস হয়ে থাকি তবে বলবো টাইম নষ্ট করবেন না। আমার মনকে আমি সামলে নিবো, কিন্তু আপনার এসব কাজে আমার নামে দূর্নাম ছড়াক সেটা আমি চাই না।
অনন্যা এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে দিলো। অনল শুধু মাথা নিচু করে কথাগুলো শুনছিলো। বেশ কিছুক্ষণ কোনো জবাব না পেয়ে অনন্যা বেশ ঠান্ডা গলায় বললো,
– আমি আপনার উত্তর পেয়ে গেছি। আর কখনো আমাকে স্টক করবেন না। আমি যেনো আপনার মুখ ও না দেখি।
বলেই হাটা দিলো অনন্যা। অনল বেকুবের মতো শুধু তার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে ছিলো। মনটা যেন হাহাকার শুরু করে দিলো অনলের। কিন্তু ভালোবাসা নামক অনুভুতিকে সে স্বীকার করতে নারাজ। হয়তো অনন্যার সাথে পথচলাটা এতোটুকুই ছিলো। তখন……
চলবে
মুশফিকা রহমান মৈথি