কাগজের তুমি আমি দ্বিতীয় অধ্যায়,সূচনা_পর্ব
মুশফিকা রহমান মৈথি
প্রেগ্ন্যান্সি কিট হাতে বসে আছে ধারা, কিটে দুটো দাগ স্পষ্ট। মাথাটা বেশি ফাঁকা ফাঁকা লাগছে তার। এখন কি করবে বুঝে উঠতে পারছে না। আবেগের তাড়ণায় একটা ভুল করে ফেলেছে। ডান হাত দিয়ে মুখটি চেপে চাপা আর্তনাদ করতে লাগলো ধারা। চোখ থেকে পানি যেনো থামতেই চাচ্ছে না। এতো বড় কিভাবে করে ফেললো। বাবা-মা জানলে জ্যন্ত কবর দিয়ে দিবে তাকে। একজন অবিবাহিত মেয়ে যদি হুট করেই প্রেগ্ন্যান্ট হয়ে যায় ব্যপারটা সমাজ কিংবা ধর্ম কোনো কিছুই মেনে নিবে না। সে তখন হয়ে যাবে কলঙ্কিনী। এখন কি করবে বুঝে উঠতে পারছে না ধারা। কয়েকদিন থেকেই মাথা ঘুরাচ্ছিলো তার, বমি বমি ভাব হচ্ছিলো। পিরিয়ড মিস হলে সন্দেহ হতে থাকে। ধারার সবথেকে ভালো বান্ধবী সারাকে ব্যাপারটা জানালে সে প্রেগ্ন্যান্সি কিট কিনে দিয়ে বলে টেস্ট করে দেখতে। এখন সেটাই করছিলো ধারা। মনের ভয়টাই সত্য হলো, তার মাঝে একটা রক্ত মাংসের মানুষ বেড়ে উঠছে। দুহাতে মাথা চেপে ধরলো ধারা, এখন কি করবে? হুট করেই মনে হলো তার, দিগন্তকে একবার বললে হয়তো মন্দ হবে না। আর এমনিতেও ওকে জানানোটা এখন খুব বেশি দরকার। তার একটি অংশ ধারার গর্ভে বেড়ে উঠছে। এটা তো তাদের ভালোবাসার প্রতীক, আবগের বশে হলেও তারা একে অপরকে ভালোবেসেই কাছে এসেছিলো। চোখ মুছে উঠে দাঁড়ালো ধারা। বসে থাকলে হবে না, একটা ব্যবস্থা তো করতেই হবে। এখন ভেঙ্গে পড়লে কিভাবে চলবে! এখনও তো অনেক পথ চলা বাকি, না জানি কত পরীক্ষা বাকি হয়েছে তার জন্য, আর তাকে তো লড়তে হবে তার ভালোবাসার জন্য, নিজের জন্য, নিজের অনাগত সন্তানের জন্য_______
সকাল ৯টা,
ভার্সিটির বটগাছের নিচে বসে আছে ধারা। বিগত আধা ঘটা ধরে অপেক্ষা করছে দিগন্তের জন্য। অপেক্ষার প্রহর যেনো পার ই হতে চাচ্ছে না। এটা যেনো তার জীবনের সবথেকে দীর্ঘ আধা ঘন্টা। মানুষ যখন নির্বিকার হয়ে বসে থাকে, তখন অতীত বারবার চোখের সামনে হানা দেয়। যেমনটা হচ্ছে ধারার ক্ষেত্রে। ধারা তখন বাংলা বিভাগের প্রথম বর্ষের একজন ছাত্রী। এমনই একটা কুয়াশা ঢাকা সকালে ভার্সিটির গেটে দেখা হয়েছিলো দিগন্তের সাথে। দিগন্ত তখন ভূগোলের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র। হঠাৎ বাইকের ধাক্কায় অন্যমনস্ক ধারা খানিকটা ছিটকে পড়েছিলো। এটা অবশ্য, ধারার অন্যমনস্ক হয়ে চলার আর দিগন্তের বাইকের হাই স্পিডের কারণেই হয়েছিলো। অনুশোচনার বশে তাড়াতাড়ি হেলমেট খুলে ছুটে গিয়েছিলো দিগন্ত ধারার কাছে। ধারা তখন নিজের পায়ে ক্ষত সামলাতে ব্যাস্ত ছিলো। পায়ে কি ব্যাথাটাই না পেয়েছিলো। প্রথম দেখাতে সাদা কামিজ, গোলাপি ওড়না পরিহিত গোলগাল পুতুলের মতো দেখতে মেয়েটিকে মনে ধরেছিলো দিগন্তের। কোমল গলায় তখন তাকে জিজ্ঞেস করে,
– বেশি ব্যাথা লেগেছে? আই এম সরি। তাড়াতে ছিলাম খেয়াল করি নি।
মাথাতুলে সামনে হাটু গেড়ে থাকা শ্যামলা ছেলেটাকে এক নজরে দেখে যাচ্ছিলো ধারা। এতো সুন্দর করেও কি কেউ কথা বলতে পারে? প্রথমে ভেবেছিলো বেশ কড়া করে কটা কথা শুনিয়ে দিবে ধারা। কিন্তু দিগন্তের চোখের দিকে তাকাতেই কেমন যেনো সব গবলেট হয়ে গেছিলো। বকা তো দূরে থাক একটা কড়া কথাও মুখ থেকে বের হয় নি ধারার। উলটো কোনো অজানা কারণে হৃদস্পন্দন বেড়ে যাচ্ছিলো, লোকটার মুখ থেকে চোখ ই সরছিলো না ধারা।
– এতো কিসের জরুরি তলব তোমার? এই সাতসকালে দৌড়াতে দৌড়েতে আসতে হলো। জানোই শীতের সকালে আমার ঘুম ভাঙ্গতে চায় না।
দিগন্তের হিনহিনে গলার কাটকাট কথা শুনে কল্পনার থেকে বের হয় ধারা। হ্যা তার সামনে আড়াই বছর আগের দিগন্ত ই দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু আফসোস একটাই, এখনের দিগন্ত আর তখনের দিগন্তের মাঝে বেশ পার্থক্য। ধারা সেটা বুঝতে যে পারে না সেটা না, তবে এখনও সে দিগন্তকে পাগলের মতোই ভালোবাসে। ধারাক হা করে নিজের দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে ভ্রুজোড়া একত্রিত করে টিটকারির স্বরেই বলে,
– আমাকে কি প্রথম দেখছো নাকি? এমন হা করে দেখার মতো রুপ গজিয়েছে নাকি?
– নিজের সন্তানের বাবাকে দেখছি, যে লোকটা কিনা নয় মাস পর একটা জ্বলজ্যান্ত বাচ্চার বাবা হবে তাকে হয়তো হা করে দেখাটা খারাপ কিছু না, তাই না?
ধারার নির্লিপ্ত কন্ঠের কথাটা শুনে দিগন্তের চোখগুলো বড় বড় হয়ে যায়। নিজের কানকে বিশ্বাস করে উঠতে পারছে না দিগন্ত। অনেকটা ভুত দেখার মতো ঘাবড়ে যায় সে। অস্পষ্ট স্বরে ধারাকে বলে,
– সকাল সকাল কি ফাযলামি করছো তুমি? পাগল টাগল হয়ে গেছো নাকি?
– আমি ফাযলামি করছি না দিগন্ত। আজ সকালেই এক করেছি, আমার মাথায় কিছুই আসছে না। অনেক বড় ভুল অয়ে গেছে দিগন্ত। এখন কি করবো কিছুই বুঝতে পারছি না, তাই তোমাকে ফোন করে এখানে আসতে বলেছি
– কি আর করবো, এবোর্শন ছাড়া আর কি উপায় আছে। আমরা কালকে ডাক্তারের কাছে যাবো
দিগন্তের নির্বিকার উত্তরে মাথায় বাজ পড়ে ধারার। কি বলবে কথা হারিয়ে ফেলেছে সে, যতই হোক বাচ্চাটা তাদের দুজনেরই অংশ। তাদের ভালোবাসার নিশানী। দিগন্ত কোনো চিন্তা না করেই কিভাবে বলে দিলো সে বাচ্চাটিকে নষ্ট করে দিবে। দিগন্তের কথাটি শুনে অজান্তেই চোখজোড়া ভিজে আসে ধারার। যদিও কেবল একটি ভ্রুণ তার গর্ভে আছে কিন্তু সেত মা, কিভাবে নিজের জানা সত্ত্বে মেরে ফেলবে বাচ্চাটিকে, আর পাপ তো তারা করেছে; বাচ্চাটি তো নির্দোষ। অনেক কষ্টে ভাঙ্গা গলায় বলে,
– দিগন্ত, কি বলছো তুমি? বাচ্চা নষ্ট করার কথা আমি ভাবতেও পারি না। ও আমাদের
– ধারা বি প্রাকটিক্যাল, আমি তো জানতাম তুমি খুব প্রাকটিক্যাল একজন মানুষ। এখন এমোশোনাল ন্যাকামি করার সময় নয়। আমি এখন মাস্টার্স করছি, চাকরি পাই নি। এখন এই বাচ্চাটাকে রাখা মানে নিজের পায়ে নিজেই কুড়াল দেওয়া। বুঝতে পারছো তুমি? আমাকে এখনই তোমার পরিবারের কাছে বিয়ের প্রস্তাব দিতে হবে। আমি বিয়ের জন্য প্রস্তুত নই ধারা। আমার ক্যারিয়ার আছে ভবিষ্যৎ আছে। আর তুমিও একটু ভেবে দেখো তুমি কি রেডি এই বাচ্চার জন্য?
– আসলেই আমার ভাবা উচিত ছিলো
– তাহলে কাল সকালে আমরা ডাক্তারের কাছে যাব, ওকে?
দিগন্তের কথা শুনে স্মিত হেসে ধারা বলে,
– আমার তোমাকে নিয়ে ভাবা উচিত ছিল দিগ, আবেগের বশে নিজের ভালোবাসার প্রমাণ দিতে গিয়ে কি ভুলটাই না করে ফেলেছি। ইশ তখন যদি একটু ভাবতাম
– ধারা
– ব্যাপার না, তোমার এই বাচ্চাকে নিয়ে ভাবতে হবে না। আসি
বলেই ধারা সামনে পা বাড়ায়, পেছনে ফিরে দিগন্তের অনুতাপে ঘেরা মুখটা একবার দেখার ইচ্ছে হলেও নিজেকে সংযত করে। সামনে তার অনেক চলা বাকি, এখন পেছনে তাকালে হয়তো আবার দূর্বল হয়ে পড়বে। চোখের পানি অঝরেই পরছে, কি ভুলটাই না করেছে সে।
রাস্তায় হাটছে ধারা, শরীর যেনো চলতেই চাচ্ছে না ধারার। শরীর ছেড়ে দিয়েছে, মাথাতা ঘুরোচ্ছে। বমিও পাচ্ছে। রোদটা বেশ চড়া হয়ে উঠেছে বেলা বাড়ার সাথে সাথে। শরীরটা গুলিয়ে আসছে। হঠাৎ বেশ বমি আসায় রাস্তার ধারেই গরগর করে বমি করলো ধারা। যাকে বিশ্বাস করেছিলো, সে আজ বিশ্বাসটাকে এতো নিষ্ঠুরের মতো ভেঙ্গে দিলো এটা যেনো মেতে নিতেই পারছে না ধারা। রাস্তার ধারে একটা পানির বোতল কিনে সেটা দিয়ে মুখটা ধুয়ে নিলো ধারা। ক্লান্ত পরিশ্রান্ত শরীরটাকে নিয়ে রাস্তা পার হতে নিলে চোখ দুটো ঝাপসা হয়ে যায়, সামনে যেনো অন্ধকার ছেয়ে আসে। গাড়ির হর্ণ কানে আসছে, পাশে তাকাতেই দেখে খুব স্পিডে একটি গাড়ি এগিয়ে আসছে। ধারার পা থেমে গেলো, হয়তো এটাই তার পরিণতি। এই ভালো বাবা-মার মুখে কালি মাখার থেকে এই পরিণতিটাকে মাথা পেতে নেওয়াটা হয়তো ঢের ভালো। চোখ দুটো বন্ধ হয়ে এলো ধারার, তলিয়ে যাচ্ছে সে অন্ধকারের কোঠরে____
বিকেল ৫টা,
ধারার যখন চোখ খুলে তখন সে সাদা বিছানায় নিজেকে আবিষ্কার করে। সে মরে নি, এখনো বেঁচে আছে। সমাজের নিম্মজীব হয়ে সারাটাজীবন অতিবাহিত করার জন্য সে বেঁচে আছে। পরমূহুর্তেই নিজের কাজে নিজের উপরেই রাগ উঠে ধারার। কি করছিলো সে। একে এক পাপ করেছে, এখন আরো বড় পাপ করতে যাচ্ছিলো। অজান্তেই পেটে হাত চলে গেলো তার।
– সমস্যা নেই, বেঁচে আছে। কোনো ক্ষতি হয় নি
কারোর কড়া কন্ঠ কানে এলে পাশে ফিরে তাকায় ধারা। পাশের ব্যাক্তিটিকে দেখে অটোমেটিক গলা শুকিয়ে যায় তার। যেখানে বাঘের ভয় সেখানেই সন্ধ্যা হয়। কপাল খারাপ থাকলে যা হয়। পাশে থাকা ব্যাক্তিটিকে দেখে কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমতে লাগে ধারার। কিছু বলতে যাবে তার আগেই…………
চলবে