কুঞ্জবাড়ি,৬ (শেষ পর্ব)
মাহফুজা মনিরা
হুজুর এলো সন্ধ্যার একটু পর। নেহাল পেটে ব্যথায় কাতর তখন। চন্দ্রিকা আর নেহালের মা কেঁদে কেটে অবস্থা খারাপ করে ফেলেছেন। হুজুর এসে তাদের শান্ত হতে বললেন। সোফায় বসে বিড়বিড় করে কিছু একটা পড়ে সারা রুম হেটে হেটে ফুঁ দিতে লাগলেন। একটা কাপড়ের থলিতে গুড়ো মাটির ন্যায় কিছু একটা এনেছিলেন উনি। সেটা বিছিয়ে দিতে লাগলো পুরো বাড়িটায়। তারপর আবার গিয়ে শান্ত ভঙ্গিতে সোফায় বসলেন।
-” মণিকা, সামনে আসো। আমি তোমার সাথে কথা বলতে চাই মণিকা। সামনে আসো…..”
বারান্দায় হঠাৎই কেউ হু হু করে কেঁদে উঠলো। নেহাল দু’ হাত দিয়ে চন্দ্রিকা আর তার মায়ের হাত শক্ত করে চেঁপে ধরে আছে। মণিকা ধীরে ধীরে বারান্দা থেকে রুমের ভেতর এলো। নীল শাড়ির আঁচল টা মাটিতে অগোছালো ভাবে পড়ে আছে। দেয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়ায় সে। চোখমুখ দেখে মনে হচ্ছে সে না জানি কত কষ্টের মাঝেই বসত গড়ছে….
মণিকাকে কোনো প্রশ্নই করতে হলোনা। তার আগেই সে বলা শুরু করলো,
-” আমার বিশ্বাস ছিল রবিন আমাদের সন্তান কে মেনে নিবে। সেই বিশ্বাসের জোর নিয়েই ওর সাথে সংসার পাতছিলাম। অথচ একদিন,আমার সাথে অনেক কথা কাটাকাটি করতে লাগলো রবিন। তার চাওয়া একটাই, হাসপাতালে গিয়ে বাচ্চাটাকে এবোর্ট করতে হবে। কোনোভাবেই যখন রাজী হচ্ছিলাম না,রবিন আমার চোখের সামনেই পুরো পরিবর্তন হয়ে গেলো! আমাকে ধরে বেধে খাটে বেধে ফেললো। এখন যেখানে রান্নাঘর তখন ওখানে আরেকটা রুম ছিল! সেই রুমেই বাধা অবস্থায় পড়ে ছিলাম আমি। রবিন কাউকে ফোন করে আসতে বলে। কিছুক্ষণ বাদেই ওর একটা ফ্রেন্ড আসে যে ডাক্তার। রবিন তাকে বলল, আমার বাচ্চা এবোর্ট করাতে। ছেলেটা রবিন কে বলেছিল, এসব করে কি লাভ? তার চেয়ে ভালো বাচ্চাটাকে পৃথিবীতে আনা হোক। রবিন তখন তার উপরেও চেতে যায়। সে নিজেই আমার জরায়ুর মধ্যে কাচি দিয়ে ক্ষতবিক্ষত করে তুলছিল। আমার মুখে কাপড় বাধা ছিল, তাই হাজার চিল্লানোর পরেও সে চিল্লানি কারো কানে গেলো না। একটা চাপা গোঙানি হয়ে রইলো।”
মণিকা থামলো। ওর গাল বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ে। চোখ মুছে চন্দ্রিকাও। তার কেন জানি মণিকার জন্য খুব কষ্ট হচ্ছে….খুউউব।
মণিকা আবার শুরু করলো,
-” যেই মানুষ টাকে ভালোবেসে আমার সব তাকে বিলিয়ে দিয়েছিলাম। যাকে নিয়ে স্বপ্ন গড়তে শুরু করেছিলাম সেই মানুষ টা আমাকে এভাবে ঠকাবে, আমার স্বপ্ন ভেঙে ফেলবে! আমি বুঝতেই পারিনি। আমার বাচ্চাটাকে কেটে কুটে একেবারে শেষ করে ফেললো। একদিকে প্রচুর যন্ত্রণা অন্যদিকে চোখের সামনে বাচ্চা শেষ হওয়ার শোক,মানতে পারিনি। তাই আমিও পাড়ি জমায় ওপারে….
আমার মৃত্যুর পর রবিন আর তার বন্ধু ভয় পেয়ে যায়। আমাকে কই ফালাবে? কই লুকাবে? ভাবতে ভাবতে পেছনের পুকুরটার কথা মাথায় আসে ওদের। মৃত্যুর দিন আমি এই নীল শাড়ি পড়েই ছিলাম। আর সেই শাড়িসহ আমাকে কলসি বেধে ডুবিয়ে দেওয়া হয় পুকুরে….”
মণিকা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। চন্দ্রিকা বলল,
-” এইজন্যেই কি পুকুরের রং এত নীল?”
মণিকা উত্তর না দিয়ে মৃদু হাসলো। হুজুর বললেন,
-” তাহলে এরা কি দোষ করেছে? কেন এদের শাস্তি দিচ্ছো?”
-” আমি এদের শাস্তি দিতে চাইনি। কিন্তু এছাড়া আর উপায় ছিল না আমার। রবিন আমাকে মারার পরেও এবাসায় কয়েকদিন থাকে। তখন আমার অস্তিত্ব দেখে ও ভয় পেয়ে যায়। হুজুর এনে পুরো বাড়িটাকে বন্ধ করে ফেলে। তারপর ও এখান থেকে চলে যায়। আমি চাইলেও এই বাড়ির বাহিরে যেতে পারিনা!! আমার ওকে চাই….তাই এই বাসায় যারাই আসতো সবাইকে দেখা দিতাম। কিন্তু তারা আমাকে কখনো ডাকেনি। আমার ইচ্ছেটা শুনেনি। বরং হুজুর ডেকে আমার ক্ষতি করতে চাইতো!”
হুজুর বললেন,
-” কি চাও তুমি?”
-” এই বাড়ি থেকে মুক্তি পাওয়া। আমি রবিনের কাছে যেতে চাই। ও আমার সাথে আর আমার সন্তানের সাথে যা করেছে তার হিসেব ওকে দিতেই হবে….”
-” তাহলে তাই হবে।এই বাড়ির চারকোনায় চারটা পেরেক গাথা আছে। সেসব আমি তুলে ফেলবো। আর নেহালের পেটে যে বাচ্চা?”
-” সেটা রবিনের পেটে চলে যাবে।”
মাঝ দিয়ে চন্দ্রিকা বলল,
-” তাহলে ডাক্তার আদিত্য কে কেনো মারলে?”
-” যদি না মারতাম,ও অপারেশন করে বাচ্চাটাকে বের করে ফেলতো। তখন আর তোমরা হুজুর ডাকতা না। আর না আমার আশা সম্পূর্ণ হতো।”
মণিকা হাওয়ায় মিলিয়ে গেলো। হুজুর ফোন করে তার দুজন ছাত্র কে ডেকে আনলেন। তারপর তারা দোয়া পড়ে পেরেক গুলো তুলে নিলো। সাথে সাথেই নেহালের পেট হালকা হয়ে এলো। একেবারে স্বাভাবিক….আগের মতো।
হুজুর একটা জানালায় পানি ছিটিয়ে দিলেন। বললেন,
-” কাল সকালে যদি জানালার রং নীল দেখো তবে ভাববে মণিকা এখনো আছে। আর যদি নীল না দেখে সাদাই দেখো তবে বুঝবে সে আজীবনের জন্য চলে গেছে।”
পরেরদিন সকালে জানালার রং সাদাই দেখা গেলো। বোঝা গেলো মণিকা নামের মেয়েটা আজীবনের জন্য এই বাড়ি ছেড়ে চলে গেছে।
.
.
মাস দুয়েক পরে চন্দ্রিকার চেকাপের জন্য তাকে নিয়ে হাসপাতালে আসে নেহাল। কিন্তু ডাক্তারের দেখা মিললো না। ওয়েটিং রুমে অনেকক্ষণ ওয়েট করার পরেও যখন ডাক্তার দেখাতে পারলো না তখন চন্দ্রিকা বিরক্ত হয়ে বলল,
-” নেহাল। বাসায় চলো তো। আর কতক্ষণ?”
নেহাল দ্বিগুণ বিরক্তির গলায় বলল,
-” তুমি একটু বসো। আমি দেখে আসি। কি হইছে। আজকে ডাক্তার রা সব কই?”
নেহাল রিসিপশনে গিয়ে খোঁজ নেয়।
-” ডক্টর মিথিলা কোথায়? এপয়েন্টমেন্ট ছিল উনার সাথে।”
-” তাকে পাবেন না। সে আজকে প্রচুর ব্যস্ত আছে। একটা রোগী মারা গেছে আমাদের এখানে। লোকটা প্রেগন্যান্ট ছিল।”
নেহাল ভ্রু কুঁচকে ফেলে।
-” মানে? লোক আবার প্রেগন্যান্ট হয় কিভাবে?”
-” জানিনা। তবে সে দুইমাসের অন্ত সত্তা ছিল। আজকে সকালে বাচ্চা সিজার করার সময় মারা গেছে।”
নেহালের কেমন যেন অংক মিললো মিললো টাইপ ফিলিং হলো। জিজ্ঞেস করে,
-” রোগীর নাম কি ছিল?”
-” রবিন। রবিন মাহমুদ।”
নেহাল দীর্ঘশ্বাস ফেললো। মণিকা তার বদলা তাহলে নিয়েই নিলো।
-” বাচ্চা কি হয়েছে?”
-” নাহ। সিজার করার পর তার পেটে কোনো বাচ্চাই পাওয়া যায়নি।”
নেহাল একদমই অবাক হলো না। এমনটাই যেন হওয়ার ছিল!!
(সমাপ্ত)