কুঞ্জবাড়ি,পর্ব-৫
মাহফুজা মনিরা
নেহালের পেট ব্যথা দিনকে দিন বাড়ছিল। এভাবেই কাটলো দীর্ঘ একমাস। এই একমাসে চন্দ্রিকা বা তার মা আর কিছুই দেখেনি বা শুনেনি। একদম স্বাভাবিক ভাবে কেটেছে তাদের জীবন। আর তাই, তিনদিন আগে চন্দ্রিকার মা গ্রামের বাড়ি চলে যায়। যাওয়ার আগে বলে গেছেন একমাস পর আবার আসবেন তিনি। একেবারে চন্দ্রিকার ডেলিভারি পর্যন্ত থাকবে। তিনদিন পর,হঠাৎই প্রচন্ড পেটে ব্যথায় কাতর নেহাল কে নিয়ে চন্দ্রিকা ভয় পেয়ে যায়। নেহালের কোনো কথা না শুনে হাসপাতালে নিয়ে আসে তাকে। আর হাসপাতালে এসে কি শুনলো? সে প্রেগন্যান্ট? হাসপাতাল থেকে বাসায় আসার পর থেকেই চন্দ্রিকা কেঁদে যাচ্ছে একনাগাড়ে। নেহাল বলল,
-” চন্দ্রি,এভাবে কাঁদা টা তোমার বাবুর জন্য ভালো না। এফেক্ট পড়তে পারে বাচ্চার উপর। প্লীজ বি স্ট্রং। কিছুই হয়নি। আমরা কালকেই অন্য হাসপাতালে যাবো।”
চন্দ্রিকার কান্না তবু থামলো না তবে কমলো। সে উঠে গিয়ে ফ্রেশ হয়। মুখে চোখে পানি দেয়। তারপর দুপুরের রান্না করতে রান্না করতে ঢুকে। গরম ভাতের সাথে মাছ ভাজা…ব্যস এটুকুই…
রান্না শেষে চুলো মুছার সময় চন্দ্রিকা কান খাড়া করে শোনার চেষ্টা করে কিছু একটা। আবারো সেই গোঙানোর শব্দ! তবে এবার শব্দটা খুবই প্রকট ভাবে হচ্ছে। চন্দ্রিকার ভয়ার্ত মন আরো ভয় পায়। জোর গলায় নেহাল কে ডাকে। নেহাল আসতেই চন্দ্রিকা বলল,
-” কথা বলিও না। কান খাড়া করে শুনো।”
নেহাল কিছুই বুঝলো না। তবুও দেয়ালের কাছে কান খাড়া করে শোনার চেষ্টা করে। শব্দটা সেও এবার শুনতে পেলো। নেহাল হতভম্ব। এটা কি সত্যিই নাকি তার মনের ভুল? প্রশ্নবিদ্ধ চোখে চন্দ্রিকার দিকে তাকাতেই চন্দ্রিকা বলল,
-” শুনছো? দেখলা আমি বা মা কেউই মিথ্যা কথা বলিনাই। প্রথম থেকেই এমন একটা শব্দ শোনা যেত।”
নেহাল প্রতিত্তরে বলল,
-” ক্ষিদা লাগছে চন্দ্রি। ভাত বাড়ো। আমি তোমার কাছেই দাঁড়িয়ে আছি।”
.
.
সারা বিকেল রাত কাটলো স্বাভাবিক ভাবে তবে অস্বাভাবিক পেটে ব্যথা নিয়ে। রাতের বেলা,
চন্দ্রিকা নেহাল গভীর ঘুমে। হঠাৎ একটা খুটখুট শব্দে নেহালের ঘুম ভেঙে যায়। নড়েচড়ে উঠে বসে সে। শব্দটার উৎস সামনের বারান্দা থেকে। নেহাল ড্রিম লাইটের আলোতে স্পষ্ট দেখতে পেলো বারান্দার দরজার কাছে একটা ২-৩ বয়সী বাচ্চা দাঁড়িয়ে। সেই দরজায় কিছু একটা দিয়ে আঘাত করে করে শব্দ টা সৃষ্টি করছিল। নেহাল বিষ্মিত চোখে কতক্ষণ তাকিয়ে থাকে সেদিকে। ধীরে ধীরে তার পুরো শরীর ভয়ের শিকলে বাঁধা পড়ে। হৃদযন্ত্র অত্যন্ত দ্রুত গতিতে চলছে। নেহাল পাশ ফিরে চন্দ্রিকাকে যে ডাক দিবে সেটাও ভুলে গেছে যেন! হঠাৎ, বাচ্চাটা তাকায় নেহালের দিকে। তারপর এক ছুটে দৌড়ে নেহালের দিকে আসে। নেহাল ভয়ে জমে যায়। পাথরের মতো জমাট হয়ে তাকিয়ে থাকে চুপচাপ। বাচ্চাটা যখন নেহালের পেট বরাবর ঢুকে যায় নেহাল সেন্সলেস হয়ে পড়ে। সকালে ঘুম ভাঙে চন্দ্রিকার চেঁচামেচি তে।
-” নেহাল,উঠো নেহাল। প্লীজ উঠো নেহাল।”
নেহাল ধড়মড় করে উঠে বসে।
-” কি হইছে?”
-” তোমার পেট….”
নেহাল পেটের দিকে তাকাতেই আৎকে উঠে৷ তার পেট এতটা ফুলে গেছে যেন দেখে মনে হচ্ছে ৮ মাসের বাচ্চা ভেতরে! চন্দ্রিকা একনাগাড়ে কেঁদে চলেছে। নেহাল দ্রুত ফোন নিয়ে ডক্টর আদিত্য কে ফোন করে। সবটা জানায় তাকে। তিনি বললেন,
-” আমি নিজেই আজকে ফোন করতাম আপনাকে। বোর্ড মিটিং বসেছিল কালকে। আপনার পেট থেকে বাচ্চা টাকে সিজারের মাধ্যমে বের করা হবে। তারপর তাকে নিয়ে গবেষণা করবো আমরা। আমরা জানতে চাই যে একজন পুরুষ কিভাবে প্রেগন্যান্ট হয়! আপনি আজকে দুপুরে হাসপাতালে চলে আসুন।”
নেহাল ফোন কেটে দেয়। কি জানি কি হচ্ছে এসব তার সাথে! কিন্তু আদিত্য যা বলেছে তাই করা ঠিক হবে। আপাতত এই বোঝা সে সইতে পারছে না। এতবড় পেট নিয়ে দম ফেলাটাও যেন কষ্টকর। বাচ্চাটাকে বের করতে হবে যেভাবেই হোক। তারপর আস্তে আস্তে এসবের ব্যাখ্যা খোঁজা যাবে।
দুপুরের পরে হাসপাতালে যায় একা চন্দ্রিকা। নেহাল এত বড় পেট নিয়ে আসার সাহস পায়নি। মানুষ হয়তো তাকে ঘিরে রাখতো! তবে চন্দ্রিকা বলেছে সে আসার সময় ডক্টর আদিত্য কে নিয়ে আসবে।
রিসিপশনে গিয়ে ডক্টর আদিত্যর সাথে এপয়েন্টমেন্ট করাতে গিয়ে বড়সড় চমক খায় চন্দ্রিকা। দ্রুত প্যাসেজে এসে ফোন করে নেহাল কে বলে,
-” ডক্টর আদিত্য আজকে সকালে নাকি ছাদ থেকে লাফ দিয়ে সুইসাইড করেছে।”
নেহাল বাকরুদ্ধ হয়ে পড়ে। ঠিক তখনি একটা তীব্র কান্নার আওয়াজ কানে এসে লাগে। নেহাল চন্দ্রিকাকে বলল,
-” তুমি দ্রুত বাসায় আসো চন্দ্রিকা। কেউ কান্না করছে!”
-” তুমি রুম থেকে বের হয়ো না। আমি আসছি।”
-” প্লীজ দ্রুত আসো।”
চন্দ্রিকা ফোন রেখে দ্রুত নিচে যায়। পাঠাও নেয়। গাড়িতে বসে কল করে তার শ্বাশুড়ি কে। আগাগোড়া সব কিছু বলে। নেহালের মা ফাতিমা বেগমের শ্বাসকষ্ট হলো যেন সব শুনে। হাসফাস করতে করতে বলল,
-” এতদিন আমাদের কিছু জানাও নি কেনো? আমি আসছি। এক্ষুনি আসছি।”
চন্দ্রিকা বাড়ি ফিরে আসার ২০ মিনিটের মাথায় নেহালের মা আর ছোট ভাই চলে আসে। নেহালের বাবা নেই! ৬ বছর আগেই তিনি মারা গেছেন। নেহালের বিশাল পেট দেখে ফাতিমা বেগম কেঁদে ফেলেন। আর নেহালের ছোট ভাই শিমুল স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। কিছুক্ষণ পর আরো একজন আসে বাসায়…
যাকে নেহালের মা-ই আসতে বলেছেন। তিনি হুজুর। খুবই নামকরা একজন…
বাড়িটায় ঢুকতেই হুজুর বলল,
-” এখানে ও আছে। নেহালের ঠিক পেছনে।”
নেহাল চমকে পেছনে তাকায়। কাউকেই দেখে না। হুজুর বলল,
-” এখন দেখবে না তোমরা। কিন্তু আমি তার উপস্থিতি বুঝতে পারছি।”
হুজুর চোখ বন্ধ করেন। বিড়বিড় করে কিছু একটা পড়ে বাড়ির আনাচে কানাচে ফুঁ দেন। নেহালের পেটে ফুঁ দেন। তাতে পেট ব্যথা কমে একেবারে শূন্যের কোঠায় আসে।
হুজুর বললেন,
-” কে তুমি? সামনে আসো। বলো কি চাও? কেনো এই ছেলেটাকে কষ্ট দিচ্ছো?”
কথার মাঝেই বেল বেজে উঠে। মূল ফটকে কেউ একজন দাঁড়িয়ে আছে। হুজুরের মনোনিবেশে বাধা পায়। চন্দ্রিকা গেট খুলে দিয়ে আসে। দূরের বাসার জাবেদা খালা এসেছে। সাহস করে উনিও ঘরে ঢুকেন আজ। কেননা ভেতরে হুজুর আছেন!
হুজুর কে সালাম প্রদান করে নেহালের দিকে তাকাতেই আৎকে উঠলো।
জাবেদা খালা বললেন,
-” আমি জানতাম এমন কিছুই হবে। আর তাই চন্দ্রিকা কে সেদিন সাবধানে থাকতে বলেছিলাম। যদি মণিকা আমাদের কিছু করে,সেই ভয়ে চন্দ্রিকাকে সবসত্যি টা বলতে পারিনি। কিন্তু চন্দ্রিকার জন্য আমার টেনশন হতো সবসময় তাই আজকে দেখতে আসছিলাম ওকে…”
হুজুর বললেন,
-” বিনা ভয়ে আপনি বলুন। কি জানেন আপনি?”
জাবেদা বলতে শুরু করেন,
-” ১২ বছর আগের কথা। আমার স্বামী তখন নতুন নতুন আমাদের বাসা বানিয়েছেন এখানে। এই বাড়িটা তখন পুরোপুরি বানানো হয়নি। কোনোমতে বাউন্ডারি দিয়ে রুম তুলা ছিল। বাড়িওয়ালার ছেলে রবিন একটা মেয়ে নিয়ে এখানে উঠেছিল। মেয়েটার নাম ছিল মণিকা। আমি প্রায় দেখতাম মেয়েটা মনমরা হয়ে বাগানে হাটাহাটি করতো। একদিন সাহস করে এগিয়ে আসি। এই সেই নানান কথায় জানতে পারি,মেয়েটা প্রেগন্যান্ট। অথচ রবিনের সাথে তার এখনো বিয়ে হয়নি। মণিকার কথা রবিনের ফ্যামিলি জানতো না। রবিনকে বারবার বললেও নাকি সে আজ বলবে কাল বলবে এসব বলে বলে পার করে দিত। মণিকার ফ্যামিলি মেয়ের গর্ভবতী হওয়ার কথা জেনেই মণিকাকে বের করে দেয়। তাই মণিকা রবিনের এই বাড়িতে এসে আশ্রয় নেয়। রবিন নাকি বারবার প্রেশার দেয় বাচ্চাটাকে নষ্ট করার জন্য। কিন্তু মণিকা করতে চাইতো না। এরপরের একদিন…
আমি হঠাৎ করেই খেয়াল করি, মণিকাকে আর দেখিনা৷ বাগানেও দেখি না। একদিন সকালে হাটতে বের হচ্ছিলাম,দেখি রবিন কাচুমাচু হয়ে কোথাও যাচ্ছে। তাকে মণিকার কথা জিজ্ঞেস করলে সে বলল, মণিকা নাকি গলায় দড়ি দিয়ে ফাঁস দিয়েছে। আমার কেন জানি কথাটা বিশ্বাস হলো না। তবুও কিছু বললাম না। রবিন সেই যে গেলো আর এবাড়ির মুখোমুখি হতে দেখিনি। তারপর বাড়িওয়ালারা এসেছিল। বাড়ি কমপ্লিট করে। তারা কয়েকমাস থাকার পর চলে যায়। কেনো যায়,আমি জানিনা। এরপর যে কয়টা পরিবার এখানে এসেছে,ভাড়া থেকেছে সবাই-ই এই বাসায় মণিকাকে দেখেছে। তাদের পুরুষদের প্রেগন্যান্ট জনিত এরকম সমস্যা হয়েছে। এরপর তারা সেই বাচ্চা কি করতো,কি হতো আমি জানিনা হুজুর।”
জাবেদা থামেন। সবার ভেতরেই টান টান উত্তেজনা। এরই মাঝে চন্দ্রিকা বলল,
-” মণিকাকে আমি দেখেছি। নীল শাড়ি পড়নে,গর্ভবতী অবস্থায় এসেছিল সে। তার বাচ্চা যে তার প্রেমিক মানতে চায়না সে ব্যাপারেও বলেছিল। কিন্তু তখন আমি বুঝিনি সে মানুষ নয়,একজন আত্মা! আমি যখন নেহালের সাথে ফোনে কথা বলার জন্য অন্যরুমে যাই,ফিরে এসে তাকে আর পাইনি। আর নেহাল আর আমি ভেবেছিলাম সে চোর। কোনো সুবিধা করে উঠতে পারেনি তাই চলে গেছে…”
হুজুর কিছুক্ষণ চুপ থেকে উঠে দাঁড়ালেন। বললেন,
-” আমি রাতে আসবো। কিছু জিনিসের প্রয়োজন আমার। ততক্ষণ আপনারা সুস্থ থাকুন। সাবধানে থাকুন।”
শিমুল হুজুর কে এগিয়ে দিতে বেরিয়ে যায়। আর নেহালের হঠাৎ করেই আবার ব্যথা শুরু হলো…..
চলবে….