কুঞ্জবাড়ি,পর্ব-৩
মাহফুজা মনিরা
নেহাল বাড়ি ফিরে এলো ১৫ মিনিটের মাথাতেই। গুড়িগুড়ি বৃষ্টিতে কাকভেজা হয়ে আছে সে। মূক ফটকের দরজা কতক্ষণ টাকালো। কিন্তু চন্দ্রিকার কোনো সাড়াশব্দ নেই। বাধ্য হয়ে দেয়াল টপকে বাগান দিয়ে ঢুকে বাড়িতে গেলো সে। দরজা টা হা হয়ে খুলে আছে। মাটিতে অগোছালো ভাবে পড়ে আছে চন্দ্রি। গাল দুটো শুকনো পানির দানায় ভরা।
.
নেহাল অফিসে ফোন করে জানালো সবটা। দুদিনের ছুটি নিয়ে নেয় সে। চন্দ্রিকাকে পাজাকোলে করে বিছানায় এনে শোয়ায়। মাথায় পানি ঢেলে দেয়। বিকেলের দিকে চন্দ্রিকার হুশ ফিরে আসে। পিটপিট করে চোখ খুলে নেহাল কে দেখে স্বস্তি পায় সে। নেহাল বলে,
-” এখন কেমন লাগছে?”
-” হু ভালো।”
-” কি হয়েছিল চন্দ্রি? আমাকে খুলে বলো।”
চন্দ্রিকা সমস্ত ঘটনা একে একে মনে করে। তারপর ভাবে নেহাল কে কি এসব বলবে? আর বললেই বা নেহাল কি বিশ্বাস করবে? তবুও নেহাল কে মিথ্যে বলারও কিছু নেই…
চন্দ্রিকা বলল,
-” এইবাড়িটা কেমন জানি নেহাল। আমার সাথে অদ্ভুত অদ্ভুত কিসব ঘটতেছে!! চোখের সামনে জিনিস রেখেও সারা ঘর খুঁজেও পাইনা। আবার আজকে দুপুরে,রান্নাঘরের দেয়াল থেকে কার যেন গোঙানি শোনা যাচ্ছিল।”
নেহাল চোখ কপালে তুলে প্রশ্ন করে,
-” রান্নাঘর এর দেয়াল থেকে? ”
-” হু। এরপরই তো ভয়ে পেয়ে তোমাকে ফোন করছিলাম। তুমি রিসিভ করো নি। এরপরেই একটা গর্ভবতী মেয়ে এলো আমার বাসায়। মণিকা নাম। অনেকক্ষণ গল্প করার পর হঠাৎ দেখি মেয়েটা নেই।”
-” দেখো হয়তো চোর ছিল,সুবিধা করতে না পারায় চলে গেছে।”
-” কিন্তু নেহাল…মূল ফটকের দরজা বন্ধ ছিল। তাহলে ও আসলো কীভাবে? আর…আর আমার ঘরের দরজা ভেতর থেকেই বন্ধ ছিল তাহলে ও গেলো কিভাবে? বলো…”
কথাগুলো শুনে নেহালও কম চিন্তিত হলো না। কিন্তু চন্দ্রিকাকে বোঝাতে বলল,
-” চোরদের কাছে দেয়াল টপকে আসা যাওয়া তেমন কোনো ব্যাপার বলো? আমিও তো দেয়াল টপকে এসেছি! যাইহোক তুমি এসব চিন্তা করো না। আমি চা বানাচ্ছি। খেয়ে একটু ফ্রেশ হও তুমি। তারপর পুকুর পাড়ে গিয়ে বসবো চলো।”
চন্দ্রিকা কিছুই বললো না। গুমোট মুখে উঠে গিয়ে ফ্রেশ হলো। নেহাল যত্ন সহকারে চা বানালো দুজনের জন্য। তারপর চন্দ্রিকাকে চা দিয়ে বলল,
-” পুকুরের কাছে বসে খাবো। কেমন হবে?”
চন্দ্রিকা দায়সারাভাবে বলল,
-” ভালোই।”
.
ওরা বসে আছে পুকুর থেকে ৭-৮ হাত দূরে,নরম ঘাসের উপর। চন্দ্রিকা চুপচাপ বসে থেকে চায়ে চুমুক দিচ্ছে একটু পর পর। তাকে দেখতে মন মরা লাগছে। নেহাল বলল,
-” এখনো ওসব ভাবছ চন্দ্রি?”
-” আমার একা একা ভালো লাগেনা এখানে নেহাল!”
-” অফিস থেকে দুটোদিন ছুটি নিয়েছি। দুটোদিন তোমার সাথে থাকবো আমি।”
-” দুদিন চোখের পলকেই ফুরিয়ে যাবে। কিন্তু এরপর?”
নেহাল নিশ্চুপ হয়ে কিছু একটা ভাবলো। তারপর বলল,
-” তোমার মাকে আসতে বলি? কিছুদিন থেকে যাবে…”
চন্দ্রিকা সায় জানায়।
-” হুম। আসতে বলো।”
বেলা শেষের মৃদুমন্দ বাতাসে দুজনে চুটিয়ে গল্প করলো কতক্ষণ। তারপর বাসায় এসে পড়ে। রাতের রান্নাটা নেহালই করলো…খাওয়া দাওয়ার পাট চুকিয়ে দ্রুতই শোবার ঘরে চলে যায় তারা…
.
দুদিন কেটে যায়। এই দুদিনে কোনো অদ্ভুত ঘটনাই হয়নি চন্দ্রিকার সাথে। চন্দ্রিকার মনের ভয় দূর হয়ে গেছে। হতে পারে আসলেই সব তার মনের ভুল ছিল। কিন্তু সেই মেয়ে….
মণিকা একটা প্রশ্নই রয়ে গেলো!
কথা ছিল,কালকে রাতের গাড়িতেই চন্দ্রিকার মা গাড়িতে উঠবেন। কিন্তু আবহাওয়ার কারণে উঠতে পারলেন না।তাই সকালে গাড়িতে উঠেছেন। পৌঁছাতে সন্ধ্যা হয়ে যাবে। নেহাল অফিস শেষ করে শ্বাশুড়ি কে নিয়ে একেবারে বাড়ি ফিরবে।
.
নেহাল অফিস চলে গেলে চন্দ্রিকা গোছানো ঘর আবার গোছালো। গরুর মাংস ঝাল করে রান্না, পাতলা ডাল, বরবটি আলু দিয়ে ভাজি। রান্না শেষ করে গোসল সেড়ে ক্লান্ত শরীর এলিয়ে দিলো বিছানায়। ঘড়িতে দুপুর তিনটা। সময়ের সাথে সাথে চন্দ্রিকার চোখ লেগে আসে….
.
সেই গোঙানোর শব্দ টা আবারো হচ্ছে! রান্নাঘরের থেকে আসছে। চন্দ্রিকা হালকা পায়ে সেদিকে আগায়। রান্নাঘরের দেয়াল গুলো নেই। দেয়ালের জায়গায় অন্য রুমের দরজা। চন্দ্রিকা কাঁপা পায়ে দরজার দিয়ে ভেতরে ঢোকে। সেই নগ্ন মেয়েটি! হাত পা বাধা অবস্থায় পড়ে আছে খাটের উপর। দুটো ছেলে তার জরায়ু করে তুলছে ক্ষতবিক্ষত!!
চন্দ্রিকা পেট মুচড়ে উঠে। হরহর করে বমি করে দেয় সে। ছেলে দুটো চন্দ্রিকার দিকে তাকালো। ভয়ে চন্দ্রিকার চেহারা পাংশুটে বর্ণ ধারণ করেছে। পেছন ফিরে যে দৌড়ে পালাবে সেটুকু শক্তি যেন নেই! থরথর করে কাঁপছে সে। ছেলে দুটো এবার চন্দ্রিকার দিকে এগিয়ে আসে। বহুকষ্টে ভারী পা দুটো তুলে এক কদম পেছনে যেতেই ছেলে দুটো হুরমুর করে এসে চন্দ্রিকার হাত খাঁমচে ধরে। এবার গগণবিদারী চিল্লানী মারে চন্দ্রিকা। বাচাও বাচাও…অথচ কেউ বাঁচাতে এলো না। চন্দ্রিকাকে ফ্লোরে শুইয়ে ফেলে পশু দুটো। একটান দিয়ে পাজামা খুলে ফেলতেই চন্দ্রিকা চোখ মেলে তাকায়। উফ কি ভয়ংকর স্বপ্ন!
চন্দ্রিকার ঘাম ছুটে গেছে। লাফিয়ে বিছানায় উঠে বসে সে। মোবাইল হাতে নিতেই আরো চমকে যায়। বেলা তিনটা! সে তো শুয়েছিল তিনটার দিকে। এতক্ষণ কেটে গেলো অথচ সময়ের নড়চড় নেই! কি অদ্ভুত!!
চন্দ্রিকা ডায়াল লিস্টে গিয়ে নেহালের নাম্বার বের করে। এমন সময় শুনতে পায় কারো গোঙানীর আওয়াজ। ঠিক যেমনটা স্বপ্নে শুনেছিল। গায়ের রক্ত হিম হয়ে আসে চন্দ্রিকার। তবুও কোনো এক অজানা আকর্ষনের বলে এগিয়ে চলে রান্নাঘরের দিকে। দেয়াল গুলো থেকে আসছে শব্দটা।
সেদিনের মতো চন্দ্রিকা আবারো জিজ্ঞেস করে,
-” কে?”
-” আমার বাচ্চাকে মেরো না। আমাকে ছেড়ে দাও। আল্লাহ! বাচাও কেউ আমাকে। প্লীজ, আমাকে ছেড়ে দাও রবিন….”
পুরো রান্নাঘর জুড়ে কথা গুলো ছড়িয়ে পড়ে। চন্দ্রিকা বিষ্ময়ে হতবিহ্বল। রোবটের মতো কতকক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে এক ছুটে বাগানে চলে এসেই মাটিতে লুটিয়ে পড়ে….
.
.
-” মিঃ নেহাল,কনগ্রাজুলেশন। আপনি বাবা হতে চলেছেন।”
নেহাল আর তার শ্বাশুড়ি সন্ধ্যার দিকে বাসায় ফিরে দরজায় কড়া নাড়ে অনেকক্ষণ। অথচ চন্দ্রিকা খুলছে না দেখে নেহাল টেনশনে পড়ে যায়। দেয়াল টপকে বারান্দায় আসতেই চক্ষু চড়কগাছ!! চন্দ্রিকা মাটিতে বেহুশ হয়ে আছে। তখনি তাকে নিয়ে হাসপাতালে আসা হয়। আর ডক্টর রা তাকে শোনায়,চন্দ্রিকা প্রেগন্যান্ট। এইজন্যেই এত ঘনঘন অজ্ঞান হওয়া….!
নেহাল স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে।চন্দ্রিকার একহাত মুঠোয় ভরে কেবিনে বসে আছে সে। চন্দ্রিকা চুপচাপ শুয়ে আছে মুখ ঘুরিয়ে। একদিক থেকে খুশি লাগলেও আবার টেনশন হচ্ছে তার। ও বাসায় কিছু একটা তো নিশ্চয়ই আছে!
কিন্তু কী?
চন্দ্রিকার মা স্বরবানু বললেন,
-” বাবা নেহাল,তোমার আর চিন্তা করতে হবে না। আমি আছি তো। আমি চন্দ্রিকার পুরোপুরি খেয়াল রাখবো এখন।”
চলবে….