মেঘসন্ধি,পর্ব-১৩
লেখনীতে:সারা মেহেক
বউভাতের পরেরদিন আয়ান নিজের বাড়ি চলে গেলেও মৌ যায়নি। সে জেদি মেয়ের মতো নিজের বাসাতেই পরে রইলো। তার বাসায় থাকার কারণ আর কেউ না জানলেও আয়ান ঠিকই জানে৷ মৌ যে তার উপর মানঅভিমান করেই নিজের বাসা হতে আসতে চায়নি তা সে জানে। সে এ কথা, ও কথা বলে মৌ কে মানানোর চেষ্টা করেছে। কিন্তু মৌ মানেনি৷ আয়ানের মন বলছে, মৌ এর মাথায় নিশ্চয়ই ভূতে ভর করেছে। এমনটা না হলে এতো শান্তশিষ্ট, চুপচাপ মেয়ে এমন হয়ে গেলো কি করে! গভীর ভাবনার ব্যাপার।
মৌ আয়ানের সাথে বাড়িতে আসেনি বলে আয়ান সবার কাছে এই বলেছে যে, বাবার বাড়ি খুব থাকতে মন চাইছিলো মৌ এর। এজন্য আয়ান তাকে রেখেই চলে এসেছে। তবে আজ বিকেল অথবা আগামীকাল সকালের মধ্যে সে মৌ কে নিয়ে বাসায় ফিরবে। এমনটা সে মুখে বললেও করতে পারবে কি না তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ আছে তার। তবে মৌ যেমন ঢিট, আয়ানও এখন তেমন ঢিট হতে প্রস্তুত। সে মনে মনে এঁটে নিয়েছে, আজ সন্ধ্যা পর্যন্ত সে আগেকার মতোই শান্ত এবং নরম হয়ে মৌ এর রাগ, অভিমান ভাঙানোর চেষ্টা করবে। এতে মৌ স্বাভাবিক হলে ভালো। এমনটা না হলে সে জোরজবরদস্তি করতেও রাজি আছে। কেননা তার পক্ষে এসব সহ্য করা আর সম্ভব হচ্ছে না। তার ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে গিয়েছে প্রায়। একজন মানুষ আর কতোটা সহ্য করবে!
বিকেলের দিকে আয়ান, মাহতাবসহ অফিস হতে ফিরে এলো। মৌ কে অপমান করার ঘটনায় সকলেই আয়ানকে ক্ষমা করে দিয়েছে। শুধুমাত্র মৌ বাদে। যেহেতু মৌ বাদে সকলেই আয়ানের দিকে আছে সেহেতু মৌ এর অভিমান ভাঙাতে আয়ানের পক্ষ সবাই নিবে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে আয়ান, মাহতাবকে বললো, মৌ এর রাগ ভাঙাতে তাকে সাহায্য করতে হবে। মাহতাব একবারেই রাজি হয়ে গেলো। তাদের দুজনের সাথে পরে আবার জান্নাত এবং অহনাও যোগ দিলো। চারজনে মিলে মৌ এর রাগ ভাঙানোর জন্য প্ল্যান বানালো। প্ল্যান মোতাবেক, জান্নাত মৌ কে তাদের ছাদে নিয়ে আসবে। মৌ কে দেখে আয়ানদের বাসার ছাদ হতে আয়ান ‘সরি’ লেখা বেলুন উড়াবে এবং ‘সরি’ বলবে। পরে মৌ এর বাসায় ‘সরি’ লেখাসহ একটি কেক পৌঁছে যাবে। এরপর জান্নাত মৌ কে মৌ এর রুমের ব্যালকনিতে নিয়ে এলে আয়ান একটি গান শুনাবে। এই এতো কিছুর পরও যদি মৌ এর মান-অভিমান না ভাঙে তাহলে আয়ান আরেক প্ল্যান করবে। অবশ্য ইতোমধ্যে প্ল্যানিং করে রেখেছে সে। এ প্ল্যানিং এর ব্যাপারে কাউকেই কিছু বলেনি সে। এটা একান্তই তার নিজের মধ্যকার প্ল্যানিং।
.
বিকেল পাঁচটার দিকে জান্নাত এ কথা সে কথা বলে মৌ কে ছাদে নিয়ে এলো। সে ছাদে আসবার পর পরই আয়ান, মাহতাব এবং অহনা তাদের বাসার ছাদ হতে একযোগে অনেকগুলো বেলুন আকাশে উড়িয়ে দিলো। গোলাপি রঙের বেলুনের উপর কালো রঙ দিয়ে ‘সরি’ লেখা ছিলো।
হঠাৎ এমন ঘটনার সম্মুখীন হয়ে মৌ থ বনে যায়। আকাশসম বিস্ময় চোখে রেখে সে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। বিস্মিত নয়নে প্রতিটা বেলুনের উর্ধ্বমুখী গতি পর্যবেক্ষণ করছে সে। সবটাই অবিশ্বাস্য লাগছে তার কাছে। বেশ কয়েকটা বেলুন নিচে আকাশে থাকতে থাকতেই আয়ান হাঁটু গেঁড়ে দু কান ধরে কিছুটা উচ্চস্বরে বললো,
” সরি মৌ….এবার তো আমাকে মাফ করে দে।”
আয়ানের কণ্ঠস্বর শুনতে পেয়ে মৌ চট করে সামনের দিকে তাকালো। এ ছাদ হতে ঐ ছাদ পর্যন্ত সে স্পষ্ট দেখতে পারছে আয়ানের অসহায় চেহারা। নিজের কাছে একটু খারাপ লাগছে তার। সে এক ধ্যানে আয়ানের দিকে চেয়ে আছে। এই মানুষটাকেই তো সে ভালোবাসে! আর আজ সেই মানুষটা তার স্বামী, অতি আপনজন! নিজের ভালোবাসা উজাড় করে দেওয়া যাবে তার কাছে। সে তো এটাই চায়। তবে সময়ের পরিবর্তনে তার এ চাওয়া প্রায় মুছে গিয়েছিলো। অথচ আজ ভাগ্যের সে চাকা ঘুরে আবারো অতীতের চাওয়াকে সতেজ করে তুলেছে। একজন মেয়ে হয়ে মৌ কিভাবে সে চাওয়াকে পাশ কাটিয়ে যেতে পারে!
মৌ কখনও কল্পনা করেনি আয়ান তার কাছে এভাবে এতোবার ক্ষমা চাইবে। প্রথম প্রথম সে আয়ানের প্রতি কঠোর হয়েছিলো৷ কিন্তু দিন যেতে যেতে সে কঠোরতা কোমলতায় পরিণত হয়৷ আর আজ আয়ানের এমন সরি বলার ধরণে মৌ পুরোপুরি গলে যায়। তার সম্পূর্ণ রাগ যেনো গলে পানি হয়ে যায়।
মৌ বেশ কিছুক্ষণ যাবত নির্বাক ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে থেকে আয়ানকে দেখে চলছিলো। জান্নাত, মাহতাব এবং অহনা বিষয়টা খেয়াল করে। তখনই হুট করে মাহতাব ঘড়িতে সময় দেখে জান্নাতকে ইশারায় বলে, মৌ কে নিয়ে নিচে যেতে। কেক ডেলিভারি দেওয়ার সময় হয়ে গিয়েছে।
মাহতাবের ইশারা মোতাবেক জান্নাত এগিয়ে গিয়ে মৌ এর কানে ফিসফিস করে বললো,
” একটু নিচে চলো। কেউ একজন এসেছে।”
মৌ এতে খানিকটা অবাক হয়। তবে স্বাভাবিক হয়ে কোনো কথাবার্তা না বলেই সিঁড়ির দিকে পা বাড়ায়। জান্নাত পিছন থেকে বললো,
” এদিকের জবাবটা দিয়ে যাও মৌ।”
মৌ এর পা থমকে গেলো। সে ঘাড় ঘুরিয়ে একনজর আয়ানের দিকে তাকালো। আয়ান এখনও হাঁটু গেঁড়ে বসে আসে। অসহায় চাহনি নিয়ে অপেক্ষায় আছে মৌ এর ঠোঁটে হাসি দেখার জন্য৷ যা তাকে নিমিষেই বলে দিবে, মৌ তাকে ক্ষমা করে দিয়েছে। কিন্তু মৌ এমন কিছুই করলো না৷ সে অত্যন্ত স্বাভাবিক ভঙ্গিতে আয়ানের দিকে কয়েক সেকেণ্ড তাকিয়ে থেকে জান্নাতের দিকে তাকালো। ফিসফিস করে জান্নাতের উদ্দেশ্যে সে কিছু বললো। তবে জান্নাত তা শুনতে পেলো না৷ মৌ কিছু বলার পর জান্নাতের প্রত্যুত্তরের অপেক্ষায় না থেকে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে এলো। সে বাসায় ঢুকে যাওয়ার পর পরই ডেলিভারি ম্যান এলো। মৌ কোনো চিন্তাভাবনা ছাড়াই স্বাভাবিকভাবেই দরজা খুললো। তবে ডেলিভারি ম্যানের হাতে কেকের বক্সের মতো বক্স দেখে সে কিছুটা বিস্মিত হলো। তার বিস্ময়ের মাত্রা আরো বেড়ে গেলো যখন ডেলিভারি ম্যান তার দিকে কেকের বক্সসহ এক বুকে এগিয়ে দিয়ে বললো,
” ম্যাম, আয়ান স্যার আপনার জন্য পাঠিয়েছে এটা।”
মৌ কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। ডেলিভারি ম্যানের ডাকে সে হুঁশ ফিরে পেলে কেক আর বুকেটা হাতে নিয়ে দরজা আটকে দিলো। নিজের রুমে এসে সে কেকের বক্সটা রেখে বুকে হতে চিরকুটটা নিলো। আয়ান সে চিরকুটে সুন্দর করে লিখেছে,
” এবারের মতো মাফ করে দে আমাকে। জীবনে কখনও এমনটা করবো না। কান ধরেছি আমি৷ লাইফের সবচেয়ে বড় ভুলে সবচেয়ে বড় সাজাটা পেয়েছি। আর সাজা দিস না আমাকে। আমি অসহায় পথিক রে মৌ৷ তোর হৃদয়ে কি এই পথিকের বসত গড়বার সুযোগটা আরেকবার দিবি? আমি জবাবটা কিন্তু চাই।
ইতি,
আয়ান।”
চিরকুটটা পড়ে মৌ মুচকি হেসে দিলো। তারপর চিরকুটটা বিছানায় রেখে কেকের বক্স খুললো। কেকের উপর যতটুকু জায়গাজুড়ে ‘সরি’ লেখা যায়, আয়ান ঠিক ততোটা জায়গা জুড়েই ‘সরি’ লেখিয়েছে। আয়ানের এমন ‘সরি’ লেখার ধরণে মৌ ফিক করে হেসে দিলো। বিড়বিড় করে সে বললো,
” পুরোই পাগল হয়ে গিয়েছে।” এই বলে সে বুকেটা হাতে নিয়ে সেখানকার প্রতিটা ফুল আলতো হাতে ছুঁয়ে দিলো।
” এই মৌ, বারান্দায় আয় একটু। ” এই বলে হাঁক ছাড়লো আয়ান।
আয়ানের ডাক শুনে মৌ চমকে উঠলো। তবে সাথে সাথে নিজেকে ধাতস্থ করে বিছানা ছেড়ে উঠে এসে তার রুমের ব্যালকনিতে দাঁড়ালো। মৌ কে দেখতে পেয়ে আয়ান মুচকি হেসে দিলো। এরপর কয়েক সেকেন্ড মৌ এর দিকে চেয়ে থেকেই মাহতাবকে গিটার বাজাতে ইশারা করে সে গান শুরু করলো,
“Mere samne wali khidki mein
Ek chaand ka tukda rehta hai
Mere samne wali khidki mein
Ek chaand ka tukda rehta hai
Afsoos yeh hai ke woh humse
Kuch ukhda ukhda rehta hai
Mere samne wali khidki mein
Ek chaand ka tukda rehta hai”
গান শেষেই আয়ান আবারো দু কান ধরে অসহায় চেহারা বানিয়ে বললো,
” সরি, সরি, সরি। তিন সরি। এবার তো ক্ষমা পাবো?”
আয়ানের এমন কাণ্ডে মৌ এর প্রচণ্ড হাসি পেলো। তবে সে হাসলো না। বেশ কষ্টে নিজের হাসি চাপিয়ে রাখলো। আয়ানের এমন কিউট কিউট কাজকর্ম দেখে মৌ এর মন পুরোপুরি গলে গেলো। বলেকয়ে নয়, মনে মনেই সে আয়ানকে ক্ষমা করে দিলো। তবে ঘটা করে বলেকয়ে সে তখনই আয়ানকে ক্ষমা করবে যখন আয়ানের কাছ থেকে কয়েকটা ওয়াদা করিয়ে নিবে সে। এই মতলব নিয়েই সে কোনো প্রকার জবাব না দিয়ে ব্যালকনির দরজা বন্ধ করে রুমে চলে গেলো।
মৌ এর এমন কাণ্ডে আয়ান প্রচণ্ড অধৈর্য হয়ে পরলো। ফলে রাগে তার মাথা দপ করে জ্বলে উঠলো। সে কান ছেড়ে দাঁতে দাঁত চেপে বললো,
” আজ তোর একদিন কি আমার একদিন। ”
এই বলে সে ব্যালকনি হতে রুমের দিকে পা বাড়ালো। এদিকে বোনের চিন্তায় চিন্তিত হয়ে পরা মাহতাব পিছন থেকে আয়ানের হাত ধরে মিনমিন করে বললো,
” ও আমার বোন লাগে দোস্ত। উল্টাপাল্টা কিছু করে বসিস না।”
আয়ান কোনোরূপ প্রত্যুত্তর না দিয়ে মাহতাবের হাত ঝামটা মেরে সরিয়ে দিলো। এরপর বড় বড় পা ফেলে রুম হতে বেড়িয়ে এলো। এদিকে মাহতাব নিজের বোনের চিন্তায় অতিষ্ঠ হয়ে পরলো। কারণ সে আয়ানের রাগ সম্পর্কে অবহিত। এ রাগের বশে আয়ান উল্টাপাল্টা কিছু করে বসবে না কি এ ভয়েই আছে সে।
প্রচণ্ড জোরে দরজা ধাক্কানোর শব্দে চমকে উঠলো মৌ। ফলে কোনো প্রকার চিন্তাভাবনা ছাড়াই বিছানা ছেড়ে উঠে গিয়ে দরজা খুলে দিলো সে। সাথে সাথেই আয়ান রুমে ঢুকে মৌ কে হালকা ধাক্কা দিয়ে দরজা আটকে দিলো। দরজা আটকানোর আগে মৌ বাইরে তার বাবা-মা, ভাবী এবং অহনাকে দেখতে পেলো। প্রত্যেকের চোখমুখ ভয়ে আড়ষ্ট হয়ে আছে। সে এর কারণ খুঁজে পেলো না৷
আয়ান দরজা লাগিয়েই মৌ এর দিকে এক পা দু পা করে এগিয়ে যেতে লাগলো। আয়ানের আকস্মিক এমন কাজে মৌ খানিকটা ভড়কে গেলো। সে এক দু পা করে পিছিয়ে যেতে লাগলো।
আয়ানের রাগান্বিত চেহারা দেখে মৌ খানিকটা ঘাবড়ে গেলো। আমতাআমতা করে বললো,
” কি হয়েছে আপনার? এভাবে এগিয়ে আসছেন কেনো?”
আয়ান, মৌ এর প্রশ্নের জবাব না দিয়ে চিবিয়ে চিবিয়ে বললো,
” বড় বাড় বেড়েছে তোর তাই না? ”
মৌ শুকনো একটা ঢোক গিলে বললো,
” কি করলাম আমি?”
” নিজেকে কি ভেবেছিস তুই? এক ঘটনার জন্য আর কত সরি বলবো আমি? একজন মানুষের ধৈর্য ক্ষমতা থাকে, বুঝছিস? সে ক্ষমতা পেরিয়ে গেলে সে চাইলেও নিজেকে ঠিক রাখতে পারে না। তুই-ই বল….দু সপ্তাহের মতো একজন মানুষ উঠতে বসতে তোকে সরি বলছে৷ কিন্তু তুই তাকে ক্ষমা করছিস না৷ তাহলে সে মানুষটার অবস্থা কেমন হয়েছে তা ভাবতে পারছিস? আবার আজকে তোর জন্য কান ধরলাম, বেলুন উড়ালাম, কেক আনলাম, গান গাইলাম। এতোকিছুর পরও তোর মন গললো না! আমার উপর কি মায়াদয়া হয় না তোর? ”
মৌ পিছিয়ে যেতে যেতে ব্যালকনির দরজার সাথে পিঠ ঠেকিয়ে দিলো। সেই ঘটনার পর থেকে সে আয়ানের রাগ দেখেনি বললেই চলে। কিন্তু আজ যখন সে মনে মনে সবটা ঠিক করার উদ্দেশ্য নিয়ে বসে ছিলো, তখন আয়ানের রাগ মোটেও আশা করেনি সে। সে শুকনো একটা ঢোক গিললো। আয়ানের উদ্দেশ্যে কিছু বলতে যাবে এর আগেই আয়ান, মৌ এর দু’বাহু চেপে ধরে বললো,
” এখন ভয় পাচ্ছিস আমাকে দেখে? কেনো? এতোদিন ভয় লাগেনি? মনে পরেনি আমার রাগের কথা?” এই বলে সে মৌ এর চোখ বরাবর তাকিয়ে নিচু তবে শক্ত কণ্ঠে বললো,
” আমি জীবনেও কোনো মেয়ের পিছনে এতোটা ঘুরিনি যতটা তোর পিছনে ঘুরেছি। তুই সেই মেয়ে যাকে আমি শাসন করতাম। অথচ একটা ঘটনা আমাকে এমন বানিয়ে দিয়েছে যে তোকে এখন মাথায় তুলে রাখতে হয়৷ যে আমি দু -একবার হলেই সরি বলে হাল ছেড়ে দেই সে আমিই তোকে অগণিতবার সরি বলেছি। আর তুই আমাকে মাফ করার বদলে উল্টো দিনকে দিন তোর পিছনে ঘুরিয়েছিস! এতে তোর কি লাভ হলো? বল আমাকে। ”
মৌ নিশ্চুপ। কিছুই বলার মতো সাহস বা শক্তি সে পাচ্ছে না৷ বেশ কিছুক্ষণ যাবত আয়ানের চোখ বরাবর তাকিয়ে থেকে আর সহ্য করতে না পেরে সে চোখ নামিয়ে ফেলে। ভালোবাসার মানুষের সাথে এতোক্ষণ চোখে চোখ রাখা সম্ভব না কি! অন্যান্যদের দ্বারা হয়তো সম্ভব। তবে মৌ এর দ্বারা তা সম্ভব নয়।
বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পরও মৌ এর কাছে কোনো জবাব না পেয়ে আয়ান মৌ এর দিকে এগিয়ে এলো। মাথা নিচু করে মৌ এর ডান গালে টুপ করে একটা চুমু দিয়ে ফেললো। আচমকা এমন হওয়ায় মৌ যেনো আকাশ থেকে পরলো। এমন কিছুর জন্য সে মোটেও প্রস্তুত ছিলো না৷ হতবুদ্ধি হয়ে পরলো সে। ফলস্বরূপ তার চোখ দুটো আপনাআপনি বড় হয়ে এলো। সে মুখ ফুটে কিছু বলতে যাবে কিন্তু এর আগেই আয়ান তার কানের কাছে ফিসফিস করে বললো,
” কিন্তু আমার লাভ হয়েছে। ”
এই বলে সে মৌ কে ছেড়ে দিয়ে রুমের দরজা খুলে বেড়িয়ে গেলো। এদিকে মৌ এখনও পূর্বাবস্থায় বজায় থেকে বিড়বিড় করে বললো,
” এটা কি হলো!”
.
আয়ান এবং মৌ এর মধ্যে সবটাই মোটামুটি স্বাভাবিক। তবে সেদিনকার পর থেকে মৌ আয়ানের থেকে একটু দূরত্ব বজায় রেখে চলে৷ আচমকা আয়ানের অমন স্পর্শ পেয়ে মৌ যে স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিলো, তা হতে নিজেকে সামলে নিতে খানিকটা সময় লেগেছিলো তার৷ এরপর যখন আয়ান তার সামনে এসেছিলো তখন সে একপ্রকার দৃষ্টি চুরি করে এদিক ওদিক ঘুরে বেড়িয়েছে। কারণ আয়ানের সামনে যাওয়ার সাহস নেই তার৷
এরপর রাতে অবশ্য আয়ান কোনো এক কারণে মৌ এর দিকে এগিয়ে আসতে আসতে জিজ্ঞাস করেছিলো,
” আমাকে এখনও ক্ষমা করতে পারিসনি?”
মৌ তখন আয়ানকে এগিয়ে আসতে দেখে খানিকটা ভয় পেয়ে গেলো। আয়ানের সে স্পর্শের কথা মনে পড়তেই সে আমতাআমতা করে বলেছিলো,
” না না….ক্ষমা করে দিয়েছি আপনাকে।”
মৌ এর এমন অবস্থা দেখে আয়ান নিশ্চুপে বেশ কিছুক্ষণ হেসেছিলো। অতঃপর স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে সে নিজেকে বলেছিলো,
” এই টোটকাটা আগে জানা থাকলে এতো ঘুরতে হতো না আমাকে। ”
আজ মৌ একা একাই ভার্সিটি গিয়েছে। অহনার সাথে রোজ রোজ গেলেও আজ অহনার শরীর অসুস্থ থাকায় সে যেতে পারেনি। এজন্য মৌ কে একাই যেতে হয়েছে।
ভার্সিটি শেষে রিকশার জন্য অপেক্ষা করতে করতে পরে রিকশা না পেয়ে মৌ হাঁটা শুরু করে দিলো। ভার্সিটি হতে তার বাসায় যেতে এক ঘণ্টার একটু বেশি সময় প্রয়োজন হয়। মৌ এই উদ্দেশ্যে হাঁটা শুরু করলো যে, কিছুদূর যাবার পর রিকশা পেলে সে রিকশায় চড়ে বসবে। কিন্তু পনেরো বিশ মিনিট হাঁটার পরও সে কোনো রিকশা পেলো না৷ অতঃপর বিরক্ত হয়ে সে পুরো রাস্তা ধীরেধীরে হেঁটে যাওয়ার সিদ্ধান্তই নিলো। আজকের আকাশ মেঘলা বলেই সে নিশ্চিন্তে আরামসে হেঁটে যেতে পারবে।
আরো কিছুদূর যাওয়ার পর মৌ একটা গলি ধরে হাঁটা শুরু করলো। যানবাহনের কোলাহলে মেইন রোড দিয়ে হেঁটে যেতে প্রচণ্ড অস্বস্তিবোধ করছিলো সে। এজন্যই সামনের গলি ধরে হাঁটা শুরু করলো সে৷ কিছুদূর যাওয়ার পর সে লক্ষ্য করলো, এ গলিটা অন্যান্য দিনের চেয়ে আজ বেশি সুনসান দেখাচ্ছে। দুপুর বলে না কি? মৌ ভেবে পেলো না। তবে এ নিয়ে আর না ভেবে সে হাঁটতে লাগলো।
দু মিনিট হাঁটার পর সে লক্ষ্য করলো তার পিছন পিছন দুটো লোক আসছে। সে যে গতিতে হাঁটছে, লোক দুটোও সেই একই গতিতে হাঁটছে। আরো কিছুদূর যাওয়ার পরও লোক দুটো যখন তার সামনে না গিয়ে পিছনেই রইলো তখনই তার বুকটা ধক করে উঠলো। অজানা এক আতঙ্কে তার গলা শুকিয়ে এলো। হাত দুটো ঘেমে-নেয়ে একাকার হয়ে এলো। প্রচণ্ড ভয়ে সে যেনো হতবুদ্ধি হয়ে পরলো। তার পা দুটোও এ মূহুর্তে তার সাথে বেইমানি করে বসলো। কারণ খুব কষ্টেসৃষ্টে তাদের এগিয়ে নিতে হচ্ছে।
মৌ চোখ বুজে শুকনো একটা ঢোক গিলে দোয়াদরুদ পড়তে লাগলো। এ মূহুর্তে সে ঠিক কি করবে তা সে ভেবে পাচ্ছে না৷ দৌড়াবে? না… দৌড়ানো সম্ভব নয়৷ বোরকা পরে দুটো লোকের সাথে দৌড়ে পেরে উঠা সম্ভব নয়৷ তাহলে কি চিৎকার করবে সে? কিন্তু গলিটা তো জনবসতিপূর্ণ নয়৷ বেশ কিছুদূর পর পর দু একটা বাড়ি। সে এখন সে জায়গায় আছে তার এক পাশে দেয়াল এবং অপর পাশে জমির মতো জায়গা। তবে তা বড় বড় গাছগাছালি এবং আগাছায় তা পূর্ণ। কয়েক সেকেন্ড শূন্য মস্তিষ্ক নিয়ে হাঁটার পর হুট করে তার ফোনের কথা মনে পরলো। সে দেরি না করে তড়িঘড়ি নিজের ব্যাগ হতে ফোন বের করলো। এ মূহুর্তে আয়ানকে ফোন করা তার জন্য সুবিধা হবে। এজন্যই সে কন্ট্যাক্ট লিস্ট হতে আয়ানের নাম্ব খুঁজতে লাগলো। কিন্তু হায়, আয়ানের নাম্বার তো তার ফোনে নেই! প্রপোজের ঘটনার পর মৌ রাগের ফলে আয়ানের নাম্বার ডিলিট করে দিয়েছিলো। এরপর আর আয়ানের নাম্বারের প্রয়োজন হয়নি, তাই সে আয়ানের নাম্বার আর সেভও করেনি। নিজের এ কাজের উপর তার নিজেরই প্রচণ্ড রাগ হলো। এখন একমাত্র মাহতাবই তাকে সাহায্য করতে পারবে। এজন্য সে কল লিস্ট হতে মাহতাবের নাম্বার বের করে কল করলো। একবার, দুইবার….এভাবে সে পাঁচবার কল করার পরও যখন মাহতাবকে পেলো না তখন ভয়ে তার দু চোখ বেয়ে অঝোর ধারায় জল গড়িয়ে পড়তে লাগলো। সে তো আর জানে না, মাহতাব এ মূহুর্তে জরুরি মিটিংয়ে ব্যস্ত আছে। এজন্য ফোন সাইলেন্ট রেখে দিয়েছে।
এখন কি করবে তা ভেবে পেলো না মৌ। এদিকে পথও যেনো শেষ হচ্ছে না৷ লোক দুটোও তার অনেকটা কাছে চলে এসেছে। এবার পর পর দুটো কাজ করবে সে৷ প্রথমত অহনাকে ম্যাসেজ করে তার লোকশন জানিয়ে দিয়ে বলবে আয়ানকে বলতে। দ্বিতীয়ত সে তার বাবাকে কল করতে থাকবে। প্ল্যান মোতাবেক সে অতিদ্রুত ম্যাসেজ টাইপ করে অহনাকে নিজের লোকেশন জানিয়ে দিয়ে বললো যে সে বিপদে পরেছে। যেভাবেই হোক, আয়ান যেনো অতিদ্রুতই চলে আসে। এ ম্যাসেজ দিয়ে সে জহির ইসলামকে কল করতে লাগলো। কিন্তু জহির ইসলামের ফোন বন্ধ!
‘বিপদ যখন আসে তখন চারপাশ থেকেই আসে’, এ প্রবাদবাক্যটা মৌ জানলেও আজ হাড়েহাড়ে টের পাচ্ছে সে। এই এতোকিছুর পরও তার যখন আর কিছুই করার রইলো না তখন ফোনটা ব্যাগে রেখে বড় বড় পা ফেলে দ্রুততার সহিত হাঁটতে লাগলো সে। তার পিছনের লোক দুটোও তার পিছুপিছু আরো জোরে হাঁটতে লাগলো। শেষ পর্যন্ত আর না পেরে মৌ দৌড়ানো শুরু করলো। কিন্তু এতেও তার শেষ রক্ষা হলো না৷ কিছুদূর যাওয়ার পরই লোক দুটো তাকে ধরে ফেললো। সে এতে চিৎকার করতে চাইলো। তবে এর আগেই তাদের মধ্যে একজন তার মুখ চেপে ধরলো। নিকাবের উপর মুখ চেপে ধরায় তার শ্বাস নিতে প্রচণ্ড কষ্ট হচ্ছে। তবুও সে যতটুকু পারছে নিজেকে তাদের থেকে ছাড়িয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছে। তার এ প্রচেষ্টা দেখে লোকটা আরো জোরে চেপে ধরলো তাকে। এতো বাঁধা পেয়েও সে চেষ্টা করে যাচ্ছে। এ দেখে অপর লোকটা বিরক্ত হয়ে মৌ এর পা দুটো চেপে ধরে তাকে টেনেহিঁচড়ে কাছের একটা পরিত্যক্ত জায়গায় এনে ফেলে দিলো। পরার সাথে সাথেই কোমড়ে বেশ জোরেশোরে ব্যাথা পেলো সে। ফলে ব্যাথায় ককিয়ে উঠলো সে।
মৌ এর মুখ থেকে আওয়াজ বের হওয়ার শব্দ শুনে একজন লোক নিজের হাতে প্যাচানো গামছা খুলে নিলো। একটানে মৌ এর নিকাব খুলে গামছা দিয়ে তার মুখ বেঁধে দিলো। এবার মৌ পুরোপুরি নিশ্চুপ হয়ে পরে রইলো। সে জানে, এখন হাজার চিৎকার করেও লাভ হবে না৷ তবুও সে শেষ চেষ্টা স্বরূপ তার হাত পা চারটা ইচ্ছামতো ছুড়াছুড়ি করতে লাগলো সে। মৌ এর এমন বাঁচার প্রচেষ্টা দেখে লোক দুটো পৈশাচিক হাসি দিলো। তাদের মধ্যে একজন বললো,
” এই, তোর শার্টটা খুলে ওর হাত বাইন্ধা দে। সুবিধা হবো।”
অপর লোকটা মাথা ঝাঁকিয়ে সম্মতি দিয়ে বললো,
” ঠিক কইছোস। যেমন লাফাইতাছে এই মাইয়া…..”
এই বলে সে তার শার্টটা খুলে মৌ এর হাত বেঁধে দিলো। লোক দুটোর ঠোঁটের কোনে আবারও খেলা করলো পৈশাচিক হাসি। অপর লোকটা মৌ এর দিকে তাকিয়ে শার্ট খুলতে খুলতে বললো,
” বহুত দিন পর একটা মাইয়া বাগে পায়ছি। ”
অপর লোকটা বললো,
” ঠিক কইছোস।”
লোক দুটোর চোখে এ মূহুর্তে খেলা করছে পশুত্ব আর মৌ এর চোখে খেলা করছে বাঁচার আকুতি। লোক দুটোর দিকে সে চেয়ে থেকে চোখ দিয়ে অঝোর ধারায় নোনাজল ফেলছে। কিন্তু এতে তাদের মনে বিন্দুমাত্র মায়া হচ্ছে না৷ বরং নিজেদের ক্ষুধা মেটাতে তারা মৌ এর দিকে এগিয়ে যেতে লাগলো। এদিকে মৌ…….. চোখ খুলে, বন্ধ রেখে নিজের সতিত্ব হরণ, নিজের অন্ধকার ভবিষ্যত দেখতে পেলো।
চলবে