মেঘসন্ধি,পর্ব-১১
লেখনীতে:সারা মেহেক
জহির ইসলাম নির্বাক বসে রইলেন। আফসার খান খানিক সময় পর বললেন,
” আমি ভেবেচিন্তেই প্রস্তাবটা দিলাম জহির ভাই। যেহেতু আয়ান আর মৌ কে নিয়ে বদনাম ছড়িয়ে পরার সম্ভাবনা আছে। সেহেতু বিয়ের মাধ্যমেই একে আটকানো সম্ভব৷ আর মুখে বলে কয়জনের মুখ বন্ধ করা যায় বলুন? আমরা হাজার সাফাই গাইলেও তারা কোনো না কোনো খুঁত ধরবে। এমন পরিবেশে একজন মেয়ে হিসেবে বেঁচে থাকা খুব কষ্ট। আমরা যত যা-ই বলি না কেনো, যে এমন পরিস্থিতির সম্মুখীন হয় সেই হাড়ে হাড়ে টের পায়। ”
এই বলে আফসার খান কিছুক্ষণ থামলেন। হালকা হেসে বললেন,
” মৌ কে ছোট থেকেই চিনি। ওর মতো নম্র, ভদ্র মেয়েকে যে কেউ নিজের বাড়ির বউ করতে চাইবে। যেখানে আমি ওর সম্পর্কে সবটা জানি সেখানে এ বিয়ের প্রস্তাব দেওয়াটা ঠিক বলেই মনে করে আমি৷ মৌ এর বিয়ে যদি হৃদয়ের সাথে ঠিক না হতো তবে কোনো না কোনো একদিন আমি আয়ানের জন্য মৌ এর হাত চাইতে আসতাম। এই দুজনার মধ্যকার প্লাস পয়েন্ট হলো, এরা একে অপরকে চিনে-জানে। এক্ষেত্রে দুজনের বিয়ে হওয়াটা লাভজনক। বুঝতে পারছেন ভাই?”
জহির ইসলাম চিন্তিত মুখে বললেন,
” বুঝতে পেরেছি৷ মৌ এর মামা, খালু আর চাচাকে ডাকি এখানে। ওদের সাথেও এ বিষয়ে সলাপরামর্শ করা দরকার।”
” হুম। ঠিক বলেছেন। সবাই ব্যাপারটা নিয়ে কথাবার্তা বলে একটা সিদ্ধান্তে আসা যাবে। আপনি উনাদের ডাকুন।”
জহির ইসলাম জান্নাতকে নিজের রুমে ডেকে বললেন, মৌ এর মামা, খালু, চাচাকে যেনো এ রুমে আসতে বলে সে। শ্বশুরের আদেশ পেয়ে জান্নাত তৎক্ষনাৎ রুম থেকে বেড়িয়ে গিয়ে সবাইকে ডেকে আনলো। সবাই রুমে এলে প্রায় আধ ঘণ্টার আলাপ-আলোচনা শেষে সকলেই আফসার খানের প্রস্তাবের সাথে মত প্রকাশ করলেন। এরপর আয়ান এবং মৌ এর বিয়ের ব্যাপারে কিছু প্রস্তুতিমূলক কথাবার্তা বলেই আফসার খান উঠে পড়েন৷
আফসার খান চলে যাওয়ার কিছুক্ষণ পর জহির ইসলাম বাসার বাকি সদস্যদের নিজের রুমে ডেকে পাঠালেন। আয়ান এবং মৌ এর বিয়ের কথা বলতেই মৌ স্তব্ধ চাহনিতে জহির ইসলামের দিকে তাকালো। বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞেস করলো,
” সবকিছু জানার পরও আয়ান ভাইয়ার সাথে আমার বিয়ে ঠিক করলে কি ভেবে আব্বু?”
জহির ইসলাম ক্লান্ত কণ্ঠে বললেন,
” সবকিছু জেনেই তো এ সিদ্ধান্ত নিলাম। আর আয়ান তোকে সেদিন অপমান করেছিলো ঠিকই৷ পরে তো সেই অপমানের জন্য তোর কাছে ক্ষমাও চেয়েছে। তুই ওকে ক্ষমা করে এ বিয়েতে রাজি হয়ে যা।”
মৌ কিছু না বলে মুখ ঝামটা মেরে নিজের রুমে চলে এলো। রুমে এসেই সে দরজা বন্ধ করতে নিলো। তবে তার আগেই জান্নাত, মাহতাব, অবন্তিকা ইসলাম এবং মৌ এর খালা ও চাচি এসে উপস্থিত হলেন তার রুমে। তাদেরকে রুমে দেখেই মৌ ক্ষুব্ধ হয়ে বললো,
” তোমাদের কোনো কথাই শুনতে চাই না আমি। আমাকে একটু একা একা থাকতে দাও।”
অবন্তিকা ইসলাম নরম স্বরে বললেন,
” আমাদের কথাবার্তা শোনার পর যা মন চায় তাই করিস। ”
মৌ কিছু বলতে যাবে তার আগেই মাহতাব বললো,
” আমাদের মতামত আগে শুনে নে। ”
মৌ ধপ করে বিছানায় বসে শক্ত কণ্ঠে বললো,
” যা বলার দ্রুত বলো। আমার কিছুই ভালো লাগছে না৷ ”
মৌ এ কথার প্রেক্ষিতে মাহতাব কিছু কথা শুনিয়ে দিতে চেয়েছিলো তাকে। তবে পরিবেশ পরিস্থিতি ভালো নেই বলে সে মূল কথায় চলে এলো। বললো,
” আয়ানকে বিয়ে করতে তোর সমস্যা কোথায়?”
মৌ ক্ষুব্ধ হয়ে বললো,
” সমস্যা কি জানো না? আমি আমার মনে কথা আয়ানকে ভাইয়াকে বলেছিলাম বলে উনি আমাকে সবার সামনে ওভাবে অপমান করে দিলেন। ভাইয়া, তুমি জানো, এভাবে অকারণে কারোর অপমান আমি সহ্য করি না। ”
” সে তো নিজের কাজের জন্য গিল্টি ফিল করেছে। তোর কাছে ক্ষমাও চেয়েছে। ”
” এতো সহজে আমি উনাকে ক্ষমা করে দিবো ভাবলে কি করে! আমি কি কষ্টের মধ্যে দিয়ে চলছি তা আমিই জানি। ছোট থেকেই উনাকে একটু একটু করে পছন্দ করতে করতে একপর্যায়ে উনাকে ভালোবেসে ফেললাম। এটা যে শুরু থেকে বুঝতাম তা নয়৷ ধীরেধীরে এটা উপলব্ধি করেছি। যখন থেকে বুঝতে শুরু করেছি আমি উনাকে ভালোবাসি, তখন থেকেই উনার প্রতি ভালোবাসা তীব্র হতে থাকে, গাঢ় হতে থাকে। এর মাঝে উনি আমাকে এভাবে অপমান করে বসে! আমি যে এখনও উনাকে ভুলিয়ে দিতে পেরেছি তা নয়। উনাকে এখনও ভালোবাসি আমি। কিন্তু আমার নিজের সেল্ফ রেসপেক্ট আছে। যে আমাকে অপমান করেছে তার সাথে আমি সারাজীবন কিভাবে কাটাতে পারি? ভরসা নেই, ভবিষ্যতেও পরিস্থিতির শিকার হয়ে উনি রেগে আমাকে অপমান করে বসলেন৷ তখন কি কষ্টের হবে আমার ভাবতে পেরেছো?” এই বলে মৌ নিঃশব্দে দুফোঁটা চোখের জল ফেললো। মাহতাব দীর্ঘশ্বাস ফেলে নরম সুরে বললো,
” স্বাভাবিক সময় হলে এ বিয়েতে আমিই সবচেয়ে খুশি হতাম। একজন ভাই কি চাইবে না তার বোন সারাজীবন সুখী থাকুক? সে কি চাইবে না তার অনুপস্থিতিতে কেউ একজন তার বোনকে সবসময় বিপদ হতে আগলে রাখুক? আয়ান এর সবটা করতে পারবে। ওর কাছে তোকে দিয়ে আমরা সবাই নিশ্চিন্তে থাকতে পারবো। এতোটা বছর ওর সাথে থেকেছি। ওকে কি আমি চিনি না?”
মৌ কিছু বলতে চাইলো। তবে মাহতাব তার দিকে হাত উঁচিয়ে চুপ থাকতে বললো। খানিক বাদে সে বললো,
” তুই নিজেই চিন্তা কর, আয়ান তোর খেয়াল রাখেনি? যখন আমি শহরের বাইরে থাকতাম তখন তোর প্রতিটা প্রয়োজন নিজের সামর্থ্য অনুযায়ী পূরণ করেছে ও। তোর ভুলের জন্য সুযোগ বুঝে তোকে শাসনও করেছে আবার তোর খেয়ালও রেখেছে। হ্যাঁ, মানছি ওর রাগটা বেশি। রাগের মাথায় সে অনেক কিছু বলে ফেলে। তবে সময়মতো নিজের ভুল বুঝতে পেরে ক্ষমাও তো চায় সে…….. তাহলে তোর এতো সমস্যা কোথায়?”
মাহতাবের কথা শেষ হতে না হতেই অবন্তিকা ইসলাম কাতর গলায় বললেন,
” মৌ? তোর বাবার অবস্থা দেখেছিস? আল্লাহর রহমতে আজকে হার্ট এটাক হতে হতে বেঁচে গিয়েছেন উনি৷ এরপর আল্লাহ না করুক যদি উনার কিছু হয়ে যায় তখন?”
বাবার কথা চিন্তা করতেই ভয়ে মৌ এর বুক ধক করে উঠলো। কয়েক সেকেন্ডের জন্য শ্বাস নেওয়াও ভুলে গেলো সে। বাবা মা’র মধ্যে সে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসে নিজের বাবাকে। বাবার কিছু হয়ে গেলে সে কি করে টিকে থাকবে!
অবন্তিকা ইসলাম আবারো বললেন,
” এই ঘরের মধ্যেই হৃদয়ের বাবা মায়ের কথার তীর উনার বুকে কিভাবে বিঁধেছে খেয়াল করেছিস? তাহলে আগামী শুক্রবার তোর ঠিক হওয়া বিয়ে না হলে মানুষজনের কটু কথা উনি কিভাবে সইবেন? তুই জানিস, মানুষজন উনাকে কথা শোনাবেন, এমনটা উনি কিছুতেই চান না। যেখানে উনার কোনো দোষ নেই তারপরও তুই আমাদের মেয়ে হওয়ার খাতিরে উনাকে কথা শুনতে হবে। বুঝতে পারছিস পরিস্থিতিটা?”
মৌ নির্বাক বসে রইলো। তার কিছু বলার নেই। অবন্তিকা ইসলামের প্রতিটা কথা যে সত্য তা সে জানে৷ তাহলে এখন কি করবে সে?
অবন্তিকা ইসলাম মৌ এর দিকে তাকিয়ে আবারো বললেন,
” এ ঘটনার পর থেকে অন্য কোনো ছেলের সাথে তোর বিয়ে দেওয়াটা খুবই কঠিন কাজ হয়ে পড়বে আমাদের জন্য। এমনও হতে পারে যে, তোর বিয়ের বয়স ফুরিয়ে আসছে, অথচ তোর বিয়েই হচ্ছে না৷ তখন আমরা কি করে সহ্য করবো এটা? সব বাবা মা-ই চায় তার মেয়ে ভালো পরিবারের বিয়ে করে সুখী হোক। সেখানে তোকে আমরা একা দেখবো কি করে?”
অবন্তিকা ইসলামের কথা শেষ হতেই জান্নাত বললো,
” এ বিয়ের ক্ষেত্রে তোমাকে কোনো ধরণের এডজাস্টমেন্ট করতে হবে না৷ কারণ আয়ানের পরিবার তোমার সকল পরিস্থিতি সম্পর্কে জানবে। আর ভালোবাসার কথা বললে বলবো, এ বিয়ের ক্ষেত্রে তোমার সবচেয়ে বড় প্লাস পয়েন্ট হচ্ছে, তুমি আয়ান ভাইয়াকে ভালোবাসো। হ্যাঁ, এখন পরিস্থিতির সাপেক্ষে সে ভালোবাসায় হয়তো ক্ষণস্থায়ী কিছু ধুলোময়লা এসে পড়েছে৷ এর মানে এই নয় যে সারাজীবন এমনটা থাকবে। কোনো না কোনো একদিন এ মান অভিমান ঘুচবেই। আর এমনটা হতেও সময় লাগবে না যে, আয়ান ভাইয়াও তোমাকে ভালোবেসে ফেলবেন!”
মৌ মাথা নিচু করে কিছু ভাবছে। গভীর চিন্তায় মগ্ন সে। মৌ এর খালা অবন্তিকা ইসলামের কানের কাছে ফিসফিস করে বললেন,
” আপা, মৌ কে কিছু সময় দেওয়া উচিত। এতক্ষণ সবাই যা যা বললো, সবটাই তো ও শুনেছে। এবার ওকে একটু ভাবনাচিন্তা করার জন্য সময় দেওয়া হোক।”
বোনের কথায় অবন্তিকা ইসলাম উঠে এলেন। বাকি সবাইকে চোখের ইশারায় উঠে আসতে বললেন। রুম থেকে বেড়িয়ে যাওয়ার সময় অবন্তিকা ইসলাম মৌ এর উদ্দেশ্যে বললেন,
” একটা মেয়ের সঠিক সময়ে সঠিক জায়গায় বিয়ে সমাজের সামনে তার বাবা মায়ের মাথা তুলে দিতে পারে। আবার একটা মেয়ের বিয়ে ভাঙা, ডিভোর্সি হওয়া সমাজের সামনে তার বাবা মায়ের মাথা একদম নিচু করে দিতে পারে। আমাদের মেয়ে হিসেবে তোর যেটা ভালো মনে হয় সেটা করিস।”
চলবে