মেঘসন্ধি,পর্ব-০৩
লেখনীতে:সারা মেহেক
আয়ান দ্রুত মৌ এর সামনে বসে পরলো। ততক্ষণে ভার্সিটির কয়েকজন শিক্ষার্থী আয়ান,মৌ এবং অহনাকে ঘিরে ধরলো। সকলেই বলাবলি করছে, ‘হুট করে মেয়েটা এভাবে অজ্ঞান হয়ে পরে গেলো কেনো?’
এদিকে কারোর কোনোরূপ কথাবার্তাই অহনার কানে আসছে না। সে এ মূহুর্তে মৌ কে নিয়ে প্রচণ্ড ভীত-সন্ত্রস্ত। তার মাথায় একটা কথাই ঘুরপাক খাচ্ছে, ‘মৌ জ্বরের কারণে এভাবে মাথা ঘুরে পরে গেলো! তাহলে কত ভয়ানক জ্বর বাঁধিয়েছে সে!’
প্রচণ্ড চিন্তার মধ্যেও অহনা কাঁপা-কাঁপা গলায় আয়ানকে বললো,
” ভাইয়া…..জলদি একটা সিএনজি ডাক। ওর অবস্থা হয়তো ভালো না।”
এই বলে অহনা দ্রুততার সহিত ব্যাগ থেকে পানির বোতল বের করে মৌ এর চোখেমুখে পানির ছিটা দিতে লাগলো। আয়ান ততক্ষণে সিএনজি আনতে চলে গিয়েছে।
পানির ছিটায় পিটপিট করে চোখের পাতা খুললো মৌ। মুখের উপর গুটিকয়েক মানুষজনকে ঝুঁকে থাকতে দেখে খানিকটা ভড়কে উঠে সে। দ্রুত উঠতে নিলেও শরীরে শক্তির স্বল্পতা অনুভব করে সে। অহনা তা দেখে মৌ কে বললো,
” ধীরে ধীরে উঠার চেষ্ট কর। ভাইয়া সিএনজি আনতে গিয়েছে। ”
অহনার কথা শেষ হতে না হতেই আয়ান এসে হাজির হলো। মৌ এর দিকে ভ্রুকুটি করে চেয়ে থেকে বললো,
” তাহলে ম্যাডাম উঠেছে। ভেবেছিলাম, মনে হয় হসপিটালেই নিয়ে যেতে হবে ওকে। শেষমেশ, সময় থাকতেই উঠে পরেছে। ভালো…..”
অহনা আর মৌ আয়ানের কথার গুরত্ব দিলো না। বরং অহনা আয়ানকে স্বাভাবিক কণ্ঠে বললো,
” ভাইয়া, মৌ কে গেট পর্যন্ত নিয়ে যাবো কিভাবে?ওর শরীর তো দূর্বল। বাহিরের গেট পর্যন্ত তো আমি একা হাতে কিভাবে নিয়ে যাবো?”
আয়ান একনজর আশেপাশে তাকিয়ে বললো,
” তোদের আর ফ্রেন্ড নেই আশেপাশে? ”
” আপাতত না। এই ভীড়ের মধ্যে থেকেই একজনকে বলো আমাকে সাহায্য করতে। ”
মৌ ততক্ষণে আস্তে আস্তে করে উঠার চেষ্টা করছে। অহনা যতটুকু পারছে তাকে সাহায্য করছে। আয়ান ভীড়ের মধ্যে থেকেই একটা মেয়েকে বললো, মৌ কে একটু সাহায্য করতে। মেয়েটাও বিনাবাক্যে মৌ এর কাছে চলে এলো।
সিএনজির কাছে এসে আগে থেকেই দাঁড়িয়ে ছিলো আয়ান। অহনা আর সেই মেয়েটি মৌ কে সিএনজির কাছে আনলে মৌ অহনার হাত ধরে কষ্টেসৃষ্টে সিএনজিতে উঠে বসে। তারা উঠার পরপরই সিএনজি স্টার্ট হয়ে গেলো। খানিকটা বিরক্ত আর অনিচ্ছা নিয়েই সে সিএনজির পিছু পিছু বাসার উদ্দেশ্যে রওনা হলো।
.
” এই৷ মেয়েটার তো এক কথা কানে যায় না। এতো ঢিট! গতকাল বললাম,বৃষ্টিতে ভিজিস না। জ্বর বাঁধতে সময় লাগবে না। কিন্তু এ কি শোনার পাত্র! ”
প্রচণ্ড তেজে কথাগুলো বলে ফোঁস করে এক নিঃশ্বাস ছাড়লো আয়ান। অবন্তিকা ইসলাম, জহির ইসলাম, মাহতাব, জান্নাত এবং অহনা চুপচাপ বসে আয়ানের কথাগুলো শুনে যাচ্ছে। ফাঁকে ফাঁকে একনজর মৌ এর দিকে তাকাচ্ছে।
এ মূহুর্তে বালিশে হেলান দিয়ে মাথা নিচু করে বসে আছে মৌ। কান দিয়ে কথা শোনা ছাড়া আর কোনো কাজ না থাকায় হাতের আঙ্গুলগুলোর চামড়ার ভাঁজ দেখছে সে। অনিচ্ছা সত্ত্বেও আয়ানের প্রতিটা ধমক মুখ বুজে সহ্য করে নিচ্ছে সে। প্রতিবার এমনটাই করে সে। কোনো ভুল করে থাকলে আয়ান আর মাহতাব তাকে ইচ্ছামতো ধমকাতে পিছপা হয়না। যেখানে ছোটখাটো ভুলেই সে ধমক শুনে, সেখানে রীতিমতো অসুখ বাঁধিয়ে ফেলেছে সে!
মৌ কে বাসায় আনা হলে পরিচিত এক ডক্টর দিয়ে তাকে দেখানো হয়। কিছু ওষুধপত্র লিখে ডক্টর চলে যেতেই মাহতাব আগুনের গোলার মতো বর্ষিত হতে থাকে মৌ এর উপর। পরে সে চুপ হয়ে বসে থাকলে আয়ান ধমকানো শুরু করে। এক্ষেত্রে মৌ এর মা অবন্তিকা ইসলাম এবং মৌ এর বাবা জহির ইসলাম নিরব দর্শকের ভূমিকা পালন করছেন। কারণ তারা জানেন মৌ এর ভুল হয়েছে। সেক্ষেত্রে তাকে প্রশ্রয় দেওয়া মানেই দ্বিতীয়বার একই ভুলের পুনরাবৃত্তি হওয়া। যদিও মৌ কে দুজনেই খুব ভালোবাসেন।
কিছুক্ষণ থেমে থেকে আয়ান মৌ এর দিকে তাকিয়ে তেজি সুরে বলতে লাগলো,
” এখন মাথা নিচু করে বসে আছিস কেনো? বৃষ্টিতে ভেজার সময় তো ধেই ধেই করে নাচছিলি! আবারো বললি কি? ‘আমার জ্বরে আসবে না আয়ান ভাইয়া। গত দুইবার আসেনি, এবারও আসবে না।’ অথচ এখন কি হলো? জ্বর বাঁধিয়ো রীতিমতো অজ্ঞান হয়ে পরেছিলি! উফ,, মাথাটাই খারাপ করে দিলি তুই। তোর আর অহনার মত ত্যাড়া মেয়ে আমি এ জীবনেও দেখিনি।”
অহনা এবার তেড়ে গিয়ে বিস্ময় নিয়ে বললো,
” এর মধ্যে আবার আমি কি করলাম! শুধু শুধু আমাকে টানছো কেনো ভাইয়া? ”
” তোকেও টানা উচিত এর মধ্যে। দুটো আস্ত এক ঝামেলার গোডাউন। ঠিক বলেছি না মাহতাব?”
মাহতাব তীক্ষ্ণ চোখে একবার মৌ এর দিকে এবং একবার অহনার দিকে চেয়ে বললো,
” একদম ঠিক। ”
আয়ান এবার অবন্তিকা ইসলামকে বললো,
” আন্টী, মৌ কে একটু বকবেন। অনার্স সেকেন্ড ইয়ারে পড়ে অথচ এখনও ওকে বকতে হয়! এতো বড় মেয়েকে বকা দেওয়া উচিত না। তবুও বকতে হয়। এই যে, এখন জ্বর বাঁধিয়ে ফেললো, এই সারতে সারতে দুই-তিনদিন পার হয়ে যাবে। জুলুম হয়ে যাবে আপনার আর জান্নাত ভাবীর।”
এই বলে আয়ান চুপ করে রইলো। অবন্তিকা ইসলাম শান্ত দৃষ্টিতে মৌ এর দিকে তাকিয়ে বললেন,
” সবসময় একটা না একটা ঝামেলা বাঁধিয়েই চলিস। তোদের ঝামেলায় কোনো না কোনোভাবে ছেলে দুটোকে টেনেই আনিস। কবে যে শুধরাবি! গতকাল আয়ানের কথা শুনে বৃষ্টিতে না ভিজলে এই জ্বর আসতো না। আর তোকে নিয়েও এতো টেনশন করতে হতো না। কিন্তু তুই শুনলে তো…..” এই বলে অবন্তিকা ইসলাম চেয়ার ছেড়ে উঠে গেলেন। স্ত্রীর পিছুপিছু জহির ইসলামও ছুটে চললেন। তারা চলে যেতেই আয়ান মৌ এর সোজাসুজি বিছানায় বসে মিষ্টি স্বরে বললো,
” মৌ…..আর কি কোনো সমস্যা ক্রিয়েট করা বাকি আছে? বাকি থাকলে আজকের মধ্যেই করে ফেল।” এই বলে আয়ান কয়েক সেকেন্ড চুপ রইলো। পরমূহুর্তেই দ্বিগুণ তেজে বললো,
” আমার আর ধৈর্য নেই প্রবলেম সলভ করার। আমাকে আর মাহতাবকে কি সব প্রবলেম সলভ করার মেশিন মনে হয়? সেই ক্লাস ফাইভ থেকে তুই আর অহনা একসাথে আছিস। সেই থেকে যে তোদের প্রবলেম সলভ করা শুরু করলাম…..এই যাত্রা আর শেষই হচ্ছে না। একটা কথা বলে রাখি…..এখন থেকে তুই আর অহনা মিলে নিজেদের প্রবলেম সলভ করবি। খবরদার আমাদের ডিস্টার্ব করবি না।” এই বলে চট করে উঠে মৌ এর রুম থেকে বেরিয়ে গেলো আয়ান। তার পিছুপিছু মাহতাবও বেরিয়ে গেলো। রুমে রইলো মৌ, অহনা এবং জান্নাত।
আয়ান আর মাহতাবকে এতো রাগারাগি করতে দেখে জান্নাত পুরোটা সময় চুপ করে ছিলো। কারণ সে জানে, এর মধ্যে সে যদি কিছু বলে তাহলে মাহতাব তাকেও কয়েকটা কথা শুনিয়ে দিবে। সুতরাং, চুপচাপ থাকাটাই শ্রেয়।
অহনা মৌ এর সামনে বসে অসহায় সুরে বললো,
” দুজনে শুধু শুধু এতো বকলো কেনো আমাদের? আমরা আজকে কি প্রবলেম ক্রিয়েট করলাম, বুঝলাম না। তোর তো শুধু জ্বরই এসেছে। অথচ দেখ, কত কথা শুনিয়ে দিলো আমাদের।”
মৌ কিছু না বলে চুপচাপ বসে রইলো। জান্নাত এবার বললো,
” দুজনেই মৌ এর অসুস্থতার জন্য চিন্তায় আছে। মৌ আয়ানের কথা শুনেনি বলেই তো জ্বরটা বাঁধালো। আর বারবার ঝামেলা করার কথা বলতে আমার মনে হয়, সেদিনকার ঐ ছেলেটার কথা বলছিলো। কয়দিন আগেই ঐ ছেলেটার ঝামেলা শেষ হলো। হয়তো আগেকার ঝামেলার কথাগুলোই রাগের কারণে আজকের কথায় টেনে এনেছে।”
এই বলে জান্নাত একটু থামলো। ছোট্ট একটা শ্বাস ফেলে আবারো বলা শুরু করলো,
” সেদিন যদি তোমরা দুজনে ছেলেটা সাথে ভদ্রতার খাতিরে কথা না বলে মুখের উপর দু চারটা কথা শুনিয়ে দিতে, তাহলে পরবর্তীতে ছেলেটা তোমাদের ডিস্টার্ব করার সাহস পেতো না। এ ব্যাপারে কিন্তু আয়ান আগে থেকেই তোমাদের সতর্ক করেছিলো। তবুও তোমরা পাত্তা দাওনি। আবার গতকাল ওর নিষেধ করা সত্ত্বেও মৌ বৃষ্টিতে ভিজেছিলো। পরে ঠিকই জ্বর এলো। সো বুঝতেই পারছো, দোষটা তোমাদেরই।”
অহনা আর মৌ চুপচাপ বসে সবটা কথা শুনলো। নিজেদের ভুল নিয়ে তারা প্রতিবারই পস্তায়। মনে মনে ঠিক করে আয়ান আর মাহতাবের কথা মেনে চলবে তারা। কিন্তু কিছুক্ষণ পরই তারা নিজেদের ঠিক করা ব্যাপারই বেমালুম ভুলে বসে। এজন্য পরে তারা সমস্যাতেও পরে আর প্রতিবারের মতো সেই সমস্যা থেকে উদ্ধার করতে আয়ান নয়তো মাহতাবকেই ছুটে আসতে হয়।
চলবে