অন্তর্দহন প্রণয়,পর্ব-১৭
লিখনীতে_সুরাইয়া সাত্তার ঊর্মি
লাস্যময়ী ভঙ্গিতে হাসলো। দেবাশীষ স্তম্বিত হলো। তার মনে হলো, কোনো দেবী তার সামনে একটি লাল ওয়েস্টার্ন ড্রেস পড়ে বসে আছে। জয়নব প্রথমে হাত বাড়ালো। দেবাশীষ সম্মোহিতর মতো ওর তালে তাল মিলাতে লাগলো। দেবাশীষ প্রতিরাতে এখানে আসে। তার জন্য একটি রুম বরাদ্দ থাকে সব সময়। সে রুমটির দিকে এগিয়ে গেলো জয়নবকে নিয়ে।রুমে ঢুকেই বসে পড়লো বিছানার উপর। বিশালতা ভরপুর এই কামরা। নিয়ন আলো জ্বলছে। রুমটির ঠিক মাঝ বরাবর গোল বিছানাটিতে বসে কামুকতা দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখছে জয়নবকে।জয়নব এক অদ্ভুত হাসি হেসে ফেললো,
“আর ইউ আফ্রাইড অফ ডেড পিপল?”
দেবাশীষ চমকে গেলো। এমন এক পরিস্থিতিতে বেমান লাগলো কথাটুকু। কিন্তু তবুও মস্তিষ্ক কেমন অস্থির হয়ে গেলো । জয়নব আবার বলল,
“জানেন? এই পুরো বিল্ডিং গড়ে উঠেছে পুরোনো শ্মশানের উপর!”
দেবাশীষ এবার ঘামতে লাগলো। ছোট থেকেই ভয় পায় এইসবে। এমনকি, নিজের স্ত্রী মারা যাওয়ার পরে দেখাতো দূর, মুখাগ্নি করেন-নি পর্যন্ত।এমনকি মেডিকেলে বরাবরই লাশ ঘটিত ব্যাপার থেকে দূরে থাকতে চায়। এই ভার থাকে সব সময় সাহিরের উপর। জয়নব এ কদিনে এদের উপর নজর রেখেছে। খুঁজে বের করেছে দূর্বলতা। আর তাইতো এই টোপ টাই ফেলেছে। তার জন্য সবচেয়ে বড় ভুমিকা রাখছে মৌ পোকার সংগ্রহীত করা ধুতরা ফুলের বিষ। ভয়ংকর সেই বিষ হল a very powerful haducinating drug যা মানুষের চিন্তায় কাজ করে। চেতনাকে পাল্টে দেয়। রিয়েলিটির ভুল ব্যাখ্যা করে।
জয়নব পড়েছিল একটি বই। বইটার নাম The crystad door, বইটার লেখক কিংস কলেজের একজন বিখ্যাত সাইকিয়াট্রিস্ট-James Hauler, তিনি এই বইটিতে বললেন-মানুষের মনের কিছু দরজা আছে যা সহজে খোলে না। মানুষ যদি কোনো কারণে ভয়ঙ্কর কোনো চাপের মুখোমুখি হয় তখনি দরজা খুলে যায়। তিনি এই দরজার নাম দিয়েছেন crystal door.
জেমস হাউলার বলছেন–এই স্ফটিক দরজার সন্ধান বেশির ভাগ মানুষ সমগ্র জীবনে কখনো পায় না। কারণ বেশির ভাগ মানুষকে তীব্র ভয়াবহ মানসিক চাপের মুখোমুখি হতে হয় না। জেমস হাউলার মনে করেন মানুষের কাছে দুধরনের বাস্তব আছে। একটি দৃশ্যমান জগতের বাস্তবতা, আরেকটি অদৃশ্য জগতের বাস্তবতা। স্বপ্ন হচ্ছে সে রকম একটি অদৃশ্য জগত এবং সেই জগতও দৃশ্যমান জগতের মতোই বাস্তব। স্ফটিক দরজা বা crystal door হল অদৃশ্য বাস্তবতার জগতে যাবার একমাত্র দরজা। এই সাইকিয়াট্রিষ্ট মনে করেন যে কৃত্রিম উপায়ে মানুষের মনে চাপ সৃষ্টি করে অদৃশ্য দরজা খোলা যেতে পারে। তিনি একটি কৃত্রিম উপায় বেরও করেছেন। তার উপর গবেষণা করছেন।
মনের উপর কৃত্রিম চাপ সৃষ্টির জন্যে তিনি উৎসাহী ভলেন্টিয়ারকে একটি সাত ফুট বাই সাত ফুট এয়ার টাইট ধাতব বাক্সে ঢুকিয়ে তালাবদ্ধ করে দেন। বাক্সের ভেতরটা ভয়ংকর অন্ধকার। বাইরের কোনো শব্দও সেখানে যাবার কোনো উপায় নেই। পরীক্ষাটা কী, কেমন ভাবে হবে তার কিছুই ভলেন্টিয়ারকে জানানো হয় না। সে কোনো রকম মানসিক প্ৰস্তৃতি ছাড়াই বাক্সের ভেতর ঢোকে। তারপর হঠাৎ লক্ষ করে বাক্সের ভেতর পানি জমতে শুরু করছে। আস্তে আস্তে পানি বাড়তে থাকে। ভলেন্টিয়ার বাক্সের ভেতর দাঁড়ায়। ডাকাডাকি করতে শুরু করে। বাক্সের ডালায় ধাক্কা দিতে থাকে। কোনো উত্তর পায় না। এদিকে পানি বাড়তে বাড়তে তার গলা পর্যন্ত চলে আসে। সে প্ৰাণে বাঁচার জন্যে পায়ের আঙুলে ভর করে উঠে দাঁড়ায়। পানি বাড়তেই থাকে। পানি নাক পর্যন্ত যাবার পর পরীক্ষাটা বন্ধ হয়। তীব্র ভয়ে ভলেন্টিয়ার দিশাহারা হয়ে যায়। পরীক্ষায় দেখা গেছে শতকরা ত্রিশভাগ। ভলেন্টিয়ার পরীক্ষার শেষ পর্যায়ে হঠাৎ নিজেকে বাক্সের বাইরে অ্যালো ঝলমল একটা জগতে দেখতে পায়। যে জগতের আলো পৃথিবীর আলোর মতো না। সেই আলোর বর্ণ সোনালি। সেই জগতের বৃক্ষরাজি বৃক্ষরাজির মতো না। সেই জগত অদ্ভূত অবাস্তব এক জগত। যেখানে অস্পষ্ট কিন্তু মধুর সঙ্গীত শোনা যায়। শতকরা দশভাগ। ভলেন্টিয়ার নিজেদের আবিষ্কার করেন। অন্ধকারে ধূম্রময় এক জগতে। সেই জগত আতঙ্ক এবং কোলাহলের জগত। বাকি ষাট ভাগ কিছুই দেখে না। তারা আতঙ্কময় এক অভিজ্ঞতা নিয়ে বাক্স থেকে বের হয়ে আসে।
জয়নব এবার ঠিক তেমনি টেকনিক প্রয়োগ করলো। দেবাশীষের মস্তিষ্কে ঘুর ঘুর করতে লাগলো প্রতিটি কথা। জয়নব এবার দেবাশীষের মাথা খুব সুক্ষ্ম ভাবে ঢুকিয়ে দিলো কিছু কথা,
“জানেন? এই বিলাশময়ী রুমিটতে একটি মেয়ে মারা গিয়েছে। রোজ রাতে নাকি মেয়েটি এই পরো বিল্ডিং-এ উল্টো হয়ে ঘুরে বেড়ায়?”
দেবাশীষের শ্বাসপ্রশ্বাস ঘন হয়ে এলো। খুব কষ্টে যেন দম ফালছে। হুট করেই কান দুটি যেন গরম হয়ে গেছে। দেবাশীষ যেন স্পষ্ট দেখতে পেলো বড় পর্দার পিছনে একটি নগ্ন মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মেয়েটি মাথা ঘন কালো কুচকুচে চুল। সারা অঙ্গ চুলে ঢাকা। মাথা নত করে আছে যেন। জয়নব দেবাশীষের চোখে মুখ ভয় দেখতে পেল। জয়নব বাঁকা হাসলো। বুঝতে বাকি নেই, ধুতরাফুল মধু কাজ করছে। দেবাশীষের চিত্রবিভ্রম
, দৃষ্টিবিভ্রম,দিকবিভ্রম হচ্ছে। জয়নব আরো একটু তেল মশলা ঢাললো। দেবাশীষের কানের কাছে ফিসফিস করে বলল,
“আরো কি হয় জানেন…. রাত যত গভীর হয়, শ্মশানে পরিণত হয় এই হোটেল। শিকার খুঁজে নেয় শ্মশানের অশুভ আত্মারা। ”
চোখ ভর্তি ভয় নিয়ে তাকালো দেবাশীষ। মুখের কথা গুলো বন্ধ হয়ে গেলো অটোমেটিক। বিছনা থেকে উঠে এক ছুটে রুম থেকে পালিয়ে যেতে চাইলো সে। কিন্তু কে যেন আটকে দিয়েছে পা জোড়া। মনে হচ্ছে! মনে হচ্ছে যেন পা দু’টো আটকে গেছে ইট পাথরের ফ্লোরটিতে। দেবাশীষ চিৎকার করতে চাইলো। জয়নবের দিকে তাকিয়ে ধাপাধাপি করতে লাগলো উঠার জন্য কিন্তু নাহ্… পারলো না। মনে হলো কোনো অদৃশ্য অশরীরী তার পা জোড়া বেঁধে দিয়েছে। দেবাশীষ তাকালো পর্দার আড়ালে থাকা মেয়েটির দিকে। হুট করে মেয়েটি চোখ মেলে তাকালো। দেবাশীষের গায়ের লোম দাঁড়িয়ে গেলো। এই যে তার মেয়ে শোভা…। যাকে সেদিন পালানোর পরেও খুঁজে বের করেছে। এবং ধরে এনেছিলো। নির্মম ভাবে সপে দিয়ে ছিলো ড্রাগ দিয়া শিবপাঞ্জির কাছে। কিন্তু সেদিন তার মেয়ে বাঁচে নি। সাহির তাকে পুতে দিয়ে ছিলো কোনো এক শ্মশানে। শুকনো ঢুক গিললো দেবাশীষ। কাঁদো কাঁদো মুখে দাঁড়িয়ে রইলো শোভা। অসহায় কন্ঠে বলল,
“আমাকে কেন মারলে বাবা? আমি তো তোমার মেয়ে ছিলাম। তোমার শরীরের ছোট অংশ! জানো.. আমি সবাইকে বলে বেড়াতাম। ‘মাই ফাদার ইজ দ্যা বেস্ট ফাদার ইন ওয়ার্ল্ড। কিন্তু তুমি… তুমি আমাকে এভাবে মেরে দিলে? জানো বাবা? কত কষ্ট হয়ে ছিলো আমার। খুব কষ্ট। জানো এই অন্ধকার জগতেও খুব কষ্ট। কেউ নেই আমার সাথে। কার সাথে খেলবো? কথা বলবো? কিন্তু তুমি আছো তো। তাই তোমাকে নিতে এসেছি বাবা। এসো…!”
হাত বাড়িয়ে দিলো শোভা। দেবাশীষ আর্তনাদ করে উঠলো,
“নাহ্ নাহ্, আমি যাবো না, কোথাও যাবো না দূর হউ!”
মেয়েটি হাসতে লাগলো। হাসলে আরো যেন বিশ্রী রকমের ভয়ংকর লাগে। দাঁত দিয়ে রক্ত বের হচ্ছে যেন।দেবাশীষের গা গুলিয়ে এলো। সে অন্য দিকে ফিরলো। সাথে সাথে ভয়ংকর চিৎকার করলো। তার ডান পাশেই শতশত লাশ দাঁড়িয়ে আছে নগ্ন ভাবে। কারো বুকের ভিতরে হৃদপিণ্ড নেই, কারো চোখ নেই, নেই কারো কিডনি। দেবাশীষ পালাতে চাইলো। কিন্তু জয়নব তার আগেই রুম থেকে বেড়িয়ে দরজা আটকে দিলো। বাহিরে পার্টি হচ্ছে। লোউড সং বাজাচ্ছে। কেউ শুনতে পেলো না দেবাশীষের আর্তনাদ। জয়নব বেড়িয়ে গেলো রেস্টুরেন্ট থেকে। কেউ জানলোও না, বুঝলোও না। একটি রুমের মাঝে নিজের মস্তিষ্কের স্নায়ুকোষের চিত্রবিভ্রম ভস্ম করে দিলো দেবাশীষকে……
——————————
দেবাশীষ মারা গেছে আজ সাত দিন হলো। সবাই সেদিন দেখতে পেয়েছিলো সেই হোটেলের বদ্ধ ঘরটিতে ফাঁস লটকে ঝুলছিল দেবাশীষ। নিজের মস্তিষ্কের উত্তেজনা হয়তো সইতে পারেনি সে..! দেবাশীষের মৃত্যু সবচেয়ে ভাবায় সাহিরকে। কিছু তেই বুঝতে পারে না। এমন কেন করলো দেবাশীষ? সব তো ছিলো তার জীবনে। কিসের দুঃখ ছিলো তার? যা জানতো না সাহির? কিছুটা ভেঙ্গে পড়েছে কলেজ জীবনের এই বন্ধুটির জন্য।
——————————-
জয়নবের মন আজ বেশ ফুরফুরে। গুন গুন করতে করতে সে গোসল করছে। তখনি টোকা পড়ে বাহির থেকে। জয়নব একটু ফাক করে দেখে অগ্নিমূর্তি হয়ে দাঁড়িয়ে আছে যুথি। জয়নব মনে মনে হাসে। এর জন্যেও একটি টোপ রেডি করেছে অবশ্য। জয়নব মিষ্টি করে হেসে বলে,
“আপু কিছু বলবেন?”
অগ্নিমূর্তি যুথি গর্জে উঠে বলল,
“তুমি আমার হেড ফোন ছিঁড়ে ফেলেছো! ভর্তি কে করবে শুনি?”
জয়নব তার হাসিটুকু বরাদ্দ রেখে, বিনয়ী কস্ঠে বলল,
“সরি আপু ঘর পরিস্কার করতে গিয়ে বিছানা ঝুরতে থাকতে দেখি, আমি উঠিয়ে রাখতে নেই তখনি টান লেগে ছিঁড়ে যায়। আমি অনেক সরি তার জন্য। ইচ্ছেকৃত ভাবে করিনি।”
যুথি নাছোড় বান্দা। পায়ে পা মারিয়ে ঝগড়া করতে চাইছে সে। বলল,
“সরি বললে আর হয়ে গেলো? জানো কত দাম এটির? লশ তো আমার হলো! ক্ষতি পূরণ টা দিবে টা কে শুনি?”
জয়নব কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল,
“আমি বরং কিনে দেবো? আজ বিকেলে তো ছুটি আছে। আমরা বরং দোকান থেকে নতুন কিনে আনবো?”
যুথি খুশিই হলো। নতুন জিনিস আর টাকার প্রতি বড্ড লোভ তার। সে সম্মতি দিয়ে চলে গেলো। এবং জয়নব দরজা আটকে চোখ বুঝে ঝরনার দিকে মুখ করে হাসলো। ঝড়নার পানি স্নিগ্ধ মুখটাকে ধুয়ে আরো শীতল করে ছুঁয়ে ছুঁয়ে যাচ্ছে। জয়নব মুচকি হেসে বলল,
” পাখি তুমি হবে বন্দী খাঁচার ভিতরে খুব জলদি…! যেভাবে আমার বোনকে তুমি মরণযন্ত্রনা ভোগ করাচ্ছো? এখন তুমি করবে। খুব শখ না.. বিশ্বাস নিয়ে খেলার এবার কি হবে তোমার…….!”
চলবে