অন্তর্দহন প্রণয়,পর্ব-১৩,১৪

অন্তর্দহন_প্রণয়,পর্ব-১৩,১৪
লিখনীতে_সুরাইয়া সাত্তার ঊর্মি
১৩

প্রতিটি চাবুকের শব্দে কুঁকড়ে যাচ্ছে রুফাইদা।ভয়ে সিটিয়ে গুটি শুটি মেরে দাঁড়িয়ে আছে ক্ষীণ আলোর ঘরটিতে। এটিকে বলা হয়, টর্চার রুম। কেউ নিয়ম ভাঙ্গলেই শাস্তি দিতে নিয়া আসা হয় গুহার মতো, দরজা জানলাবিহীন ঘরটিতে। রুফাইদার থরথর করে কাঁপচ্ছে। সামনেই বসা ভয়ংকর সুদর্শন যুবকটি মুহূর্তেই হিংস্র হয়ে উঠেছে। রুফাইদার দিকে ভয়ংকর দৃষ্টিতে তাকিয়ে পাশে দাঁড়ানো মুশফিকের উদ্দেশ্য বলল,

” নিয়ে আসো!”

এইখানের দেখাশোনা দায়িত্ব ছিলো খাদিজা। বয়সে ২৮ এর কোঠায়। ভয় ভয় মুখে এগিয়ে এলো মুশফিকের পায়ে পায়ে। রুমে তখন পিনপতন নিরবতা। সামনের সোফার উপর রাজা, মহারাজদের মতো ভাব করে বসে থাকা যুবকে দেখে বুঝতে বাকি নেই সে যা করছে তার শাস্তি আজ তাকে পেতেই হবে। খাদিজা আড় চোখে রুফাইদাকে দেখলো। মেয়েটির ফ্যাকাসে মুখ। বড্ড মায়া হলো। মেয়েটির জন্যই আজ বেঁচে আছে সে। সেদিন সময় মতো আগুনে পুড়ার হাত থেকে না বাঁচালে তার বুক সন্তান হারা হয়ে যেত।তাইতো রুফাইদাদের চিঠি পোষ্ট করার কথা না করতে পারেনি সে। খাদিজা ছোট শ্বাস ছাড়লো। মাথা নত করে বলল,

“আমি মানছি স্যার আমি দোষ করেছি। যা শাস্তি দিবেন মাথা পেতে নিবো। ”

যুবকটি হাসলো বিদ্রোপের হাসি। বরাবরই প্রেম প্রীতি তার অসহ্য লাগে। যুবক গা এলিয়ে দিলো সোফায়। হাত ইশরায় দুটি মেয়েকে ডেকে আনলো। ঘর ভর্তি মানুষের সামনে খাদিজার পরনের কাপড় কেঁড়ে নিয়া হলো।বন্ধ করা হলো রুফাইদাকে খাচায়। আর চাবুক নিয়ে উদম শরীরে বেদম পেটাতে লাগলো। নিস্তব্ধ খাদিজা টু শব্দটি করতে পাড়লো না। শুধু কেঁপে কেঁপে উঠলো। রুফাইদা আর্তনাদ করে উঠলো। চিৎকার করে বলল,

“দোস আমি করেছি আমাকে মারেন। উনাকে ছেঁড়ে দেন। দয়া করুন। আল্লাহকে ভয় করুন!”

কথা গুলো ঘরময় গুঞ্জন হতে লাগলো। তাতে কোন ভ্রুক্ষেপ নেই যুবকটির মুখে, নেই ঘর ভিতরের মানুষ গুলোর মুখ। নির্বিকার চেয়ে রইলো যুবকটি খাঁচায় বন্দি রুফাইদার দিকে। মেয়েটি কাঁদছে। খাঁচা ভেঙ্গে উড়াল দেয়ার চেষ্টা চালাচ্ছে। যুবকটি ভালো লাগছে। মনে শান্তি লাগছে। সে গুন গুন করে গাইলো,

“হামে তুমসে পেয়ার কিতনা হে হাম নেহি জানতে,
মাগার জি নেহি সাকতে তোমহারি বিনা! ”

—————-

আজ অনেক দিন পর হাসপাতালে রাতে থাকছে জয়নব। সেদিনের ঘটনার পর বাড়ি থেকেই ক্লাস করে যেতে শুধু। কিন্তু আজ রাতে তার ডিউটি পড়েগেছে লেবার ওয়ার্ডে । আগত থাকতেই হচ্ছে। এখন রাত ১২ টা পায় ছুঁই ছুঁই৷ রোগীদের আনাগোনা কম এদিকটায়। সমানেই হচ্ছে বড় পার্কিং লট দেখা যাচ্ছে হাতে গোনা কজনকেই।

এর মাঝে একটি রোগী এলো। রোগীর সেন্স নেই। লোকটা মাথা ফেঁটে গেছে। সাথে এসেছে তার বউ আর দুবছরের বাচ্চা। লোকটির বউকে একনজর দেখলো জয়নব। বয়স কতটুকু হবে? ২০/২১ বছরে মেয়ে।চাপা গায়ের রঙে ঢেকে রেখেছে ফিনফিন শাড়ি।গোল গাল মুখ আর ছোট ছোট চোখ জোড়া ছলছল করছে! জয়নব বাহিরে ওয়েটিং রুমে বসে ছিলো। এখান থেকে টিকেক কাউন্টার দেখা যায়। মেয়েটি কাঁদছে। বাচ্চাটিও হাউমাউ করে কাঁদচ্ছে। জয়নবের বড্ড মায়া হলো। কৌতূহল ও হলো প্রচুর। সে এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করলো,

“আপু কি হয়েছে? তুমি কাঁদছো কেনো?”

মেয়েটি আঁচল টেনে মুখে চাঁপলো। কাঁদতে কাঁদতে বলল,

“আমার স্বামীর মাথা ফাইটা গেছে আফা। উনি রিকসা চালায়। উনার ভর্তি করার জন্য টাকা লাগবো আমার কাছে নাই। টাকা নাই বইলা তারা ভর্তি করতাছে না। আর দেখেন উনার মাথা থাইক্কাই রক্ত পইড়া ভাইসা যাইতেসে। আমি করি কন তো? আমার স্বামী ছাড়া কেউ নাই! কই জামু, কি করমু? বাচ্চাটার কি হইবো?”

মেয়েটি মাটিতে বসে কাঁদতে লাগলো। জয়নবের বড্ড কষ্ট হলো। তারও তো বাবা নেই। বাবা-মা ছাড়া ছন্নছাড়া জীবন কেমন তা সে হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে। জয়নব আজ টিউশনির বেতন পেয়েছে। কয়েক মাস যাবত নিজের খরচ নিচেই চালাচ্ছে । বেতনের অর্ধেক দিয়ে দিলো মেয়েটিকে। মেয়েটি খুশিতে আত্মহারা হয়ে জয়নবের পায়ে ধরে ফেললো। জয়নব পুরাই ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেলো। নিজেকে সামলে মেয়েটিকে তুলে যাবতীয় সাহায্য করে দিলো । এক বার রোগীকেও দেখে নিলো।
তারপর আবার তার কাজে ফিরে এলো।

মাধ্য রাতে আবারো হাউমাউ করে কাঁদার শব্দ হকচকিয়ে উঠলো জয়নব। মাত্রই চোখ জোড়া লেগেছিলো তার। বাহিরে এসে সেই মেয়েটিকে দেখে মাটি গড়াগড়ি করে কাঁদছে। জয়নব হতবাক হয়ে চেয়ে রইলো। কয়েক কদম এগিয়ে যেতেই বুঝতে পাড়লো রোগীটি মারা গেছে। জয়নব থমকালো। লোকটির অবস্থা এতটাও ক্রিটিকেল ছিলো না যে মরে যাবে! আচ্ছা বাহে কিছু হলো নাতো আবার? জয়নব মেয়েটির হাতের রিপোর্ট ভালো করে পর্যবেক্ষন করলো। এখানে স্পষ্ট লিখা লোকটির দুটো কিডনি ডেমেজ হয়ে গেছে। জয়নবের মাথা আকাশ ভেঙ্গে পড়লো। চটজলদি ফোন করলো আয়ানকে। আয়ান তখন ল্যাবেই ছিলো। জয়নবের ফোন পেয়ে ছুটে এলো এক প্রকার। জয়নব হাতে রিপোর্ট দেখেই তার চোখ কঁপালে উঠে যায়। বিস্ফোরিত চোখ আর বিস্ময় বুঁদ হয়ে ঝুলে আসে মুখখানা৷ বলল,

” এটা.. এটা কিভাবে সম্ভব রোগীটিকে তো আমিই ব্যান্ডেজ করিয়ে ১০২ নং রুমে সীট নিতে বলেছিলাম। আর রিপোর্ট তো করাই হয় নি!”

জয়নবের মাথা কাজ করা বন্ধ করে দিলো। এই মুহূর্তে একটি প্রুফ পেয়ে ছুটে গেলো হাসপাতালের প্রধান অর্থাৎ ডা. সাহির আজওয়াজের কেবিনে। নক না করেই ডুকে পড়লো সে। ডা. সাহির মাঝ রাতে একটি সার্জারি ছিলো। সেটি শেষ করে মাত্রই রোলিং চেয়ারে গা এলিয়েছেন। আজ কাল তিনি শরীরে আগের মতো জোর পান না। বোঝা যাচ্ছে বাহির থেকে না হলেও ভিতর থেকে বার্ধ্যকের লক্ষণ দেখা দিচ্ছে। তিনি চোখ বুঝলেন। ঠিক তখনি একটি পুচকে মেয়ে হুড়মুড় করে ঢুকে গেলো কেবিনে। সচিকতে তাকালেন তিনি।

” হাসপাতালে দিনে-দুপুরে বেআইনী কাজ চলছে আর আপনরা তার কিছুই জানেন না বলে গা ঝাড়া দিচ্ছেন বার বার? তাহলে এসব কি?”

ডা. সাহির ক্ষিপ্ত পুচকে মেয়েটিকে দেখলেন। ভ্রু কুচকে আছে তিনি। পঞ্চাশ বছর বয়সে এমন নাছোড় বান্দা মেয়ে দ্বিতীয়টি দেখেছেন বলে মনে হয় না। শ্যামবর্ণের গোলকার মুখে ছোট নাকে পাটা রাগে ফুলছিলো জয়নবে। পরনের ডিলা ডিলা এক পোশাকেও শুঁকনো জয়নবকে সুন্দর লাগছে। চোখ দুটি রাগে বড় বড় করে রেখেছে। অথচ এত কিছুর পরেও মুখের মায়া বিন্দু পরিমাণ কমেনি। তিনি তার বুদ্ধিদীপ্ত চোখ জোড়া দিয়ে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি তাকিয়ে রইলেন।এমন দৃষ্টিতে অন্য সময় হলে ভয় পেতো জয়নব। কিন্তু এখন? ডরভয়ের সময় নেই। লোকটিকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে রাগ আরো বাড়লো। হাতে রিপোর্ট এগিয়ে দিয়ে বলল,

“এসবের মানেটা কি বলবেন?”

ডা. সাহির ধারালো দৃষ্টিতে চেয়ে থেকে বললেন,

“তোমার ভিতরে বড়-ছোট মান্যগণ্য বলে কি কিছু আছে?”

জয়নব থমকালো। কিন্তু কেন জানি এই লোকটিকে বিন্দু পরিমাণ সম্মান দিতে ইচ্ছে করে না জয়নবের। সবসময় মনে হয়। এই অভিজ্ঞ চোখ জোড়ার পিছনে রয়েছে কোনো ভয়ানক সত্য। যতটা দয়ালু সবাই ভাবে ততটা মোটেও নয়। জয়নব ছোট শ্বাস ফেলে। মাথানত করে বিনয়ের সুরে বলে,

“আমি দুঃখীত স্যার। এভাবে কথা বলা উচিত হয়নি। আমি হাইপার হয়ে গেছিলাম। এসন হলে মাথা ঠিক থাকে না! সরি স্যার!”

ডা. সাহির হাসলেন। তাচ্ছিল্যের হাসি। তিনি জানেন। মেয়েটি তাকে কোনো কারণ ছাড়াই পছন্দ করেন না। আর সরি বলছে? মনে হচ্ছে বড্ড উপকার করলো যেন ডা. সাহিরের উপর। মাঝে মাঝে তার মনেই হয় মেয়েটিকে কসিয়ে দু চার থাপ্পড় মেরে দিতে। কিন্তু তিনি চাইলে এটি পাড়বেন না। ডা. সাহির এক পলক নজর বোলালো রিপোর্টস গুলোতে। বাম হাতটি থুতনিতে রেখে প্রতিটি পাতা পরখ করে দেখলেন। কিছু মুহূর্তে পর জয়নবের মুখের উপর ছুঁড়ে মারলেন রিপোর্ট, ধমকের সুরে বললেন,,

“ইউজলেস প্রুফ। এখানে স্পষ্ট লিখা লোকটির কিডনি ডেমেজ হয়েগেছে। সেখানে তুমি কিভাবে বলছো এই গুলো ফেইক?”

“রোগীকে আমি দেখেছিলাম স্যার যাষ্ট মাথায় প্রব ছিলো। কিন্তু কে যেন তার দুটো কিডনি বের করে নিলো। ”

লোকটি আবার হাসলো। টেবিলে উপর আঙ্গুল নাচিয়ে বলে উঠলো,

“হোয়ার’স দ্যা ডেড বডি? নিয়ে এসো যাও। আমি নিজেই চেক করবো!”

জয়নব সম্মতি দিল। দ্রুত বেড়িয়ে এসে বিনা ঝড়ে বাতাসে বাজ পড়লো। করিডোর যেখানে মেয়েটি আর তার বরকে রেখে গেছিলো তারা কেউ নেই।আয়ান ও নেই। জয়নব স্তম্বিত হল। পকেট থেকে ফোন বের করে লাগাতার ফোন করলো আয়ানকে রিং বাঁজতেছে কিন্তু কেউ তুলতেছে না। এই ভোর রাতে জয়নব পাগলের মতো এদিক সেদিক ছুটতে লাগলো। না লাশ পেলো, না সেই মেয়েটিকে না তার বাচ্চাকে। দারওয়ানকে জিজ্ঞেস করে জানা গেলো কোনো লাশ বের হয়নি গেট দিয়ে। তাহলে? কই গেলো তারা? আয়ানি বা কোথায় গেলো? তার সব প্ল্যান এভাবে মাঠে মারা গেলো? ভাবতেই কান্না চলে আসচ্ছে জয়নবের।

জয়নব হতাশ হয়ে বসে পড়লো ৩০৩ নাম্বার রুমের সামনে। ঠিক তখনি কানের মাঝে ভেসে এলো কিছু টুকরো কথা।

“মাইয়াটা খাসা মাল। স্যার কইছে দুদিন ফুর্তি কইরা বেইচা দিতে পাড়ায়।”

জয়নব কান খাড়া করে এগিয়ে এলো। ৩০৩ নং রুমের পাশের গলিটা অন্ধকার। সেখানে আগাগোড়া সাদা কাপড়ে দুটি লোক দাঁড়িয়ে কথা বলছে। পাশের জনের কথায় গদগদ হয়ে দ্বিতীয় লোকটি বলল,

“আমারে ভাগ দিবি না? আমি কত সাহাইয্য করলাম।”

“আরে দেবো দেবো।”

“কিন্তু বাচ্চাটিরে কি করবি?”

লোকটি পান খাচ্ছিলো। পানের ডাটা থেকে চুন জিবে লাগিয়ে বলল,

“কি আর করবো? ভিক্ষায় বসাবো।”

জয়নবের গায়ে রোমশ সঙ্গে সঙ্গে দাঁড়িয়ে গেলো।মেয়েটিকে তারাই গুম করে ফেলেছে বুঝতে বাকি নেই এদের। রাগে দুঃখে হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হয়ে পড়লো। সামনেই পড়ে থাকা স্যালাইনের স্টিক দ্বারা আঘাত করলো প্রথম লোকটিকে। চেঁচিয়ে বলল,

“পশুর বাচ্চা। কোথায় রেখেছিস তাদের?”

অাচমকা আঘাত আসতেই দুজনেই সামলাতে পাড়লো না। জয়নবকে ধাক্কা মেরে পালিয়ে যেতে লাগলো তারা। কিন্তু জয়নব থামার পাত্র নয়। স্টিকটি ওদের শরীরে নিক্ষেপ করতেই দুম করে পড়লো নিচে৷ জয়নব রাগে রণচণ্ডী । এগিয়ে এসে পরপর বাড়ি বসালো লোকগুলো শরীরে। লোক একটি লাথি মারলো জয়নবের পেটে। জয়নব কুঁকড়ে উঠলো। তবুও নিজেকে সামলে হাতের নখ ধারা খামচে ধরলো। বড় বড় নখ খুবলে নিতে লাগলো খারাপ লোক দুটির চামড়া। জয়নব ফোঁস ফোঁস করতে লাগলো। গুছোনো কোঁকড়াচুলো গুলো খুলে পড়লো পিঠময়। লোক দুটি নেতিয়ে পড়ছে। একটি মেয়ে এভাবে তাদের মেরে যাচ্ছে ভেবেই গা শিউরে উঠছে। যেন কোনো অশরীরী ভর করেছে তার শরীরে। ঠিক তখনি সেখানে থাকা একটি লোক হাত জোড় করে ভিক্ষা চাইলো। লোকটি হিন্দু বার বার দূর্গা দূর্গা বলছিলো। জয়নবের দিক তাকিয়ে তার মনে হলো যে মা কালি ভর করেছে।পান খাওয়া লোকটি প্রায় বেহুশ। লোকটি তা দেখে কাঁদতে লাগলো, জয়নবের পায়ে পড়ে বলল,

“মা ক্ষমা করো মা ক্ষমা করো!”

এদিকে তেমন মানুষ জন না থাকায় কেউ তাদের ধস্তাধস্তির আওয়াজ পেল না। জয়নব চোখ বড় বড় করে খ্যাঁক করে বলে উঠে,

“বাচ্চা আর মেয়েটিকে কথায় রাখছোস? বল! নয়তো আজ এখানেই শেষ করে দিবো তোদের কাহিনি। ”

লোকটি ভয় সিটিয়ে আছে। মার খাওযার মত শক্তি আর নেই শরীরে। এবার মুখ খুললো সে,

“বেসমেন্ট..”

পুরোটি বলার আগেই জয়নবের মাথায় আঘাত করলো কেউ। ভয়ংকর বাঘিনী মুহূর্তে লুটি পড়লো মাটিতে। দেখতে পেলো সেই কালো পোশাকধারী লোক এগিয়ে আসচ্ছে তার দিকে। তারপর…. তারপর… চোখের সামনে সব অন্ধকার……..

চলবে,

অন্তর্দহন_প্রণয়
লিখনীতে_সুরাইয়া সাত্তার ঊর্মি
১৪

একটা তীব্র পারফিউমের ঘ্রাণ লাগছে নাকে। তির তির করে ঘ্রাণটি নাকের ভিতর প্রবেশ করছে। চেনা পরিচিত একটি ঘ্রাণ। হাত-পা বাধা অবস্থায় চেয়ার বসে আছে জয়নব। অজনা, অচেনা ভয় নাড়াচাড়া দিয়ে উঠছে শরীরের রন্ধ্রে রন্ধ্রে । চোখ দুটি-ও বাঁধা। জয়নবের মনে হচ্ছে, তার বুঝি দিন ফুরিয়ে এলো? পৃথিবীর বুকে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করছে কি সে? শরীর কাঁপছে জয়নবের। মাথা, কঁপাল ভর্তি ঘাম। মুখ দিয়ে বলে যাচ্ছে,

“হেল্প…..হেল্প, কেউ আছেন? সামবডি হেল্প মি…. প্লিজ!”

কথা গুলো বাড়ি খেয়ে যেন ফিরে ফিরে এলো জয়নবের কাছেই। বন্ধ ঘরে কথা বললে যেমন আওয়াজ হয় ঠিক তেমন শোনাচ্ছে এই মুহূর্তে! আচ্ছা সে কোথায় আছে? লাষ্ট মুহূর্তে ওই কালো পোশাকধারী লোকটিকেই দেখেছিলো জয়নব। তীক্ষ্ণ কালো কুচকুচে চোখ তাকিয়ে ছিলো তার দিকে। আজ লোকটি মুখ ঢাকা ছিলো না। ঠোঁটে ছিলে শ্লেষের হাসি। আবছা আবছা মনে আছে জয়নবের। লোকটি কে সে চিনে। খুব ভালো করে চেনা। মাথার মাঝের নার্ভ গুলোতে আরো পেশার দিলো জয়নব। ঠিক তখনি চোখে বাঁধন খট করে খুলে গেলো। জয়নব পিটপিট করে তাকালো। একটি ঘরের মাঝ বরাবর চেয়ারে বাঁধা জয়নব। ক্ষীণ,রাশ ভরী আলো জ্বলছে। খট করে আওয়াজ হলো। জয়নবের সামনে ভেসে উঠলো তিনটি অভিমূর্তি। ঘরটির ও প্রান্তে কাচের দেয়াল ভেদ করে ঠিক ওপাশে চেয়ারে বসে আছে। আয়ান আর ওই দুটি ওয়ার্ড বয় বসে আছে চেয়ার। জয়নবের চোখ বড় বড় হয়ে গেলো। সে ডাকলো,

“আয়ান ভাইয়া… আয়ান ভাই.. আ… য়া….ন ভা…ইয়য়য়া”

নাহ্ আয়ন নিশ্চুপ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে জয়নবের দিকে। স্থীর চাহনি। চোখের পাতা নড়ছে না, চোখের মনি গুলো চুপ। জয়নবের শরীরে ঠান্ডা হাওয়া বয়ে গেলো মুহূর্তে। কি হয়েছে তাদের?

ঠিক তখনি শোনা গেলো পায়ের শব্দ। বন্ধ ঘরে শব্দ হচ্ছে, খট খট খট। থেমে গেল জয়নবের পিছনে। জয়নব উপলব্ধি করতে পারল। এক বিশালদেহী মানব। জয়নব পিছনে ঘুরতেই জয়নবের চোখ জোড়া বড় বড় হয়ে গেলো। কন্ঠ নালিতে কথা গুলো টুপ করে বসে রইলো। কম্পিত কন্ঠে বলল,

“ডা… সা.. হি.. র!”

লোকটি মুহূর্তেই ঘর ফাটানো হাসি দিলো। বলল,

“আই হেইট ইউ ডিয়ার।”

বলেই চোখ টিপলো লোকটি। কালো পোশাকধারী লোকটি যে এই ব্যক্তি বুঝতে বাকি নেই জয়নবের। কিন্তু কি অদ্ভুত! কালো পোশাকে আগাগোড়া মোড়ানো লোকটি বয়স পঞ্চাশ এ মুহূর্তে ধরা যাচ্ছে না। জয়নব শুকনো ঢুক গিললো। নিজেকে শান্তু করতে চেষ্টা করলো। কন্ঠে যথাযথ স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করে বলল,

“এ সব কিছুর পিছনে আপনি ছিলেন! আগেই বোঝা উচিত ছিলো।”

লোকটি দৈত্যের মতো কেঁপে কেঁপে হাসলো। বলল,

“ও মাই মাই লিটিল বেবি, তুমি এত চালাক হবে ভাবতে পারিনি!”

জয়নব চুপ করে দেখতে লাগলো লোকটিকে। ভদ্র মানুষের আড়ালে একটি হিংস্র পশু। জয়নব ঘৃণিত দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো। ডা. সাহির আবার বলল,

” তোমার বোন এত দূর কিন্তু আসতে পারেনি জানো। তার আগই.. মাঠের বাহিরে! তোমার বাবার প্লেন সব ভেস্তে গেল। কিন্তু তুমি? ইউ ক্লেভার গার্ল। আই লাইক ইট। ”

কথাটুকু শুনে জয়নব চমকালো। বলল,

“বাবার প্ল্যান মানে?”

সাহির ভ্রুকুচকে জয়নবের দিকে ঝুঁকল। হিসহিসিয়ে বলল,

“হে তোমার বাবারই প্ল্যান সব। ওই শালার জন্যই আজ ধরা আমাদের রহস্য প্রকাশ পেতে চলল। নয়তো আজ ৫০ বছর ধরে আমাদের কাজ সম্পর্কে কাক পক্ষীও টের পাই নি।”

জয়নব বিস্ময়ে বুঁদ। সাহির হেসে বলল,

“সুইটহার্ট! তুমি কিছু জানো? না জেনে লড়তে নেমে গেলে?”

সাহির এবার হেটে কাঁচের দেয়ালে দাঁড়িয়ে স্বগতোক্তির মতো বলল,

” তোমার বাবা একজন গোয়ান্দা বিভাগের সদস্য ছিলেন। তার প্ল্যানেই রুফাইদা এই হসপিটালে আগমন ঘটেছে। আর বেচারি… নরগ যন্ত্রনা ভোগ করছে!”

জয়নবের কিছুই বুঝতে পারলো না প্রথমে। দুইয়ে দুইয়ে চার মিলাতে লাগলো সে। তারপরই প্রশ্ন করে বসে,

“আপনি.. আপনি এসব আগে থেকেই জানতেন?”

“অফকোর্স লিটিল বেবি। আমি না জানলে জানবে কে? তোমার বাবা চুনোমাছ ভাবে ধরতে চেয়েছিল আমাদের। কিন্তু আমরা??? বোয়ালমাছ! তবে হে বেচারা রুফাইদা ভাল চেষ্টা করেছিলো। আমার ছেলের মাথাটাও খেয়ে দিয়েছে একবারে। বেচারা অভিনব বিয়ে করেও বুকে পেলো না কাছে…!”

বলেই মুখ “চ” শব্দ করল। সাহির আবার বলল,

“জানো তোমার বাবাকে মারতে চেয়েছিলাম নিজ হাত। বাট শালা আগেই পটল তুললো।”

জয়নবের রাগে, দুঃখ কান্না পেলো। হাত পা বাঁধা না থাকলে এবার হয়তো একে এখানেই শেষ করে দিতো। জয়নবের কন্ঠে ধরে এলো,

“আমার বোন কই!”

ঠোঁট কামড়ে কেঁদে উঠলো জয়নব। লোকটি ফিচেল হাসলো,

“আছো নরকে আছে!তবে বেশি দিন দুনিয়ায় মেহমান নয় সে।”

এ পর্যায় জয়নব চেঁচিয়ে উঠে বলল,

“আমার বোনের কিছু হলে তোকে আমি মেরে কুত্তাকে খাওয়াবো!”

লোকটি হো হো করে হেসে উঠলো,

“তাই নাকি? তোমার মতো পুচকে আমার কি করবে শুনি?”

জয়নব হাত পা খোলার চেষ্টা করতে লাগলো। লোকটিকে বিশ্রী গালি দিয়ে বলল,

“নারীর বলে নরম ভাবিস না। একটা সুযোগ পেলে তোর মাথা কেঁটে আমি ফুটবল খেলবো!”

সাহির ভরকে গেলো। পিত্তি একটা মেয়ে তাকে শাসাচ্ছে! এটি খুব অপমান জনক সাহিরের কাছে। সে হাত তালি দিলো। একটি লোক আসতেই সাহির জয়নবের হাত খুলে দিতে ইশরা করলো। বন্ধন থেকে মুক্তি পেয়েই জয়নব হামলে পড়লো সাহিরে উপর। সাহির ঠিক তখন স্ব জোড়ে চর বসালো জয়নবের গালে।এতে কিছুটা বাঁধা পড়লো। তাতেও খেন্ত হলো না জয়নব। সাহিরের মুখেও চড় বসিয়ে দিলো ওর গালে। সাহির স্তম্ভিত হলো। একটি পিচকে মেয়ের এত তেজ তার সহ্য হলো না। আরেক হাতে জয়নবের চুলের মুঠি ধরে হেলিয়ে নিলো পিছনের দিক। এতই জোড়ে টানলো চুল! জয়নব চিৎকার করে কেঁদে উঠলো। সাহির দাঁতে দাঁত চেপে বলল,

” শোন মেয়ে আমার কাছে এখনো তুমি পিঁপড়ে। আমি কি করতে পাড়ি? তা এক পলক না হয় স্বচোখে দেখে নাও,?”

বলে কাচের দেয়ালে ঠেসে ধরলো জয়নবকে। জয়নব আপ্রাণ চেষ্টা করেও ব্যর্থ হচ্ছে। সাহির তাকে এমন ভাবেই চেপে ধরেছে কাচের দেয়ালের সাথে যেন এখনি ভেঙ্গে কাচের ওপাশের রুমটিতে ঢুকে যাবে। জয়নব পিছন থেকে লোকটিকে ধাক্কা দিতে লাগলো। সাহির তখনি আরেক হাতে দুটি আঁটকে নিলো। তারপর মুশফিক বলে কাউকে ডাকলো। জয়নবের মাথায় তখন মুশফিক নামটি কেচ করলো। এটি যে তারই বোনের বন্ধু একজন? কাচের ওপাশের রুমটিতে প্রবেশ করলো মুশফিক, খাটো, মোটা একটি ছেলে। চোখে চশমা গায়ে ডাক্তারি এপ্রন।লোকটি হাতে তিনিটি সিরিজ। জয়নব প্রথমে কিছুই বুঝলো। সাহির তা ভালোমতোই বুঝেছে। তাই জয়নবকে বলল,

“ছোট বাবু আমার জানো? ওই সিরিজ গুলোতে কি আছে?”

জয়নবের নড়াচড়া থেমে গেলো। ভয় ভয় চোখে তাকালো সাহিরের দিক। সাহির বাঁকা হাসছে। জয়নবের উদ্দেশ্যে আবার বলল,

“ড্রাগ… এলএসডি!”

জয়নবের পিলে চমকে উঠলো। সাহিরকে ধাক্কা দিয়ে সরাতে চাইলো। আয়ান ভাই আয়ান ভাই বলে আর্তনাদ করতে লাগলো। কিন্তু লাভ হলো না। জয়নব এবার মুশফিককে উদ্দেশ্য করে বলল,

“আয়ান ভাই না আপনার বন্ধু? তাকে কেন মারতে চাইছেন? ভাইয়া উনাকে ছেড়ে দিন, উনার কোনো দোষ নেই! আল্লাহর দোহাই লাগে! প্লিজ আয়ান ভািকে কিছু করবেন না? তার কি দোষ??”

সাহির ভাবলেশহীন ভাবে বলল,

“তার দোষ? সে বেইমানি করেছে আমার সাথে। তাকে তো মরতেই হতো!”

জয়নব থমকালো,

“মানে… আয়ান ভাই আপনাদের সাথে?”

সাহির মাথা নাড়লো। জয়নবের এবার পাগল পাগল লাগলো নিজেকে৷ ছল ছল চোখর তাকিয়ে রইরো ওই পাশের রুমটিতে। মুহূর্তের মাঝে আয়ান নিজের গলা কেঁটে ফেলেছে। পাশের দুটো লোকও তাই করলো। পুরো রুম রক্তে লাল হয়ে গেলো। জয়নব সেখানেই বসে পড়লো। পুরো দুনিয়া এখন তার গুরছে। সাহির তার সামনে বসলো। এক আগুল দিয়ে মুখ উঁচিয়ে ধরলো জয়নবের। হেসে বলল,

“আমার ক্ষমতা কতটুকু তা তোমার ধারণার বাহিরে মেয়ে। শুধু শুধু নিজের জান খোয়াতে চেয়েও না। পড়তে এসেছো পড়ে, ভালো ডাক্তার হয়ে বেড়িয়ে যাও। পাকনামি আর করো না! ”

জয়নব তাৎক্ষণিকভাবে বলে উঠলো,

“এর শেষ আমি দেখে ছাড়বো। আপানাকে জেলের ভাত না খাওয়াতে পাড়লে আমার না জয়নব নয়!”

সাহির হেসে দিলো,

“চ্যালেঞ্জ করছো?”

জয়নব চোখের পানি মুছে নিলো। বলল,

“তেমনিই ভেবে নিন!”

লোকটির চোখে মুখে অহংকার ফুটে উঠলো। জয়নবের কথা তাচ্ছিল্য করে বলল,

“ওকে দেখা যাবে, তোমার দৌড় কতটুকু। যদিও আমার কাছে নিছক এক মশা সমতুল্য তুমি? তবে এই খেলাটা আমি পুরোপুরি উপভোগ করতে চাই!”

জয়নব হাসলো। বলল,

” যখন জানতাম না এই খেলাটা অপরপ্রান্ত থেকে খেলছে কে? তখনি নেমে পড়েছিলাম খেলতে। আর এখন তো জানি, খেলোয়াড়টা কে? ”

জয়নব রুমটি থেকে বেড়িয়ে এলো। পিছনে এক পলক তাকিয়ে দেখলো, “৩০৩ নং রুম!”

—————-

রুফাইদা শুয়ে আছে। খাটের দু প্রান্তে বাঁধা দুটি হাত। ঠিক তখনি দুটি ডাক্তার ভিতর ঢুকলো। রুফাইদা ভয়ে কেঁপে উঠলো। আর্তনাদ করে উঠলো,

“নাহ্………!”

চলবে,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here