অন্তর্দহন প্রণয়,পর্ব-১১,১২
লিখনীতে_সুরাইয়া সাত্তার ঊর্মি
১১
সেদিন আমি কেঁদে কুঁটে বাসায় চলে যাই। সাত দিন পর আবার ফিরে আসি মনের সাথে লড়াই করতে করতে। ঠিক সেই দিনেই ঘটলো অদ্ভুত ঘটনা…।আমি ক্লাসে যাচ্ছিলাম। দুতলার শেষের দিকটায় আমাদের ক্লাস। ডান পাশ পুড়োটাই খালি রুম গুলো পড়ে আছে। আমি হেঁটে যাচ্ছিলাম। বর্ষাকালের স্ব স্ব হীম শীতল বাতাস বইছে। মিষ্টি বাতাস। ওরনা, জমা সব কিছুই এলো মেলো করে দিচ্ছিলো আমার। আমি ওরনা ঠিক করতে করতেই চোখে পড়ে গেল এক পরিচিত মুখ। উষ্কখুষ্ক চুল। কত দিনের অবহেলায় ভরাট দাড়ি-গোঁফ শক্ত চোয়াল জুড়ে। চোখের নিচে রাতের পর রাতে জেগে থাকার ক্লান্তির দাগ। ডা. অভিনবকে খানিকটা রোগা মনে হচ্ছিলো আমার কাছে। ললাটে চিন্তার ভাঁজ ফুঁটিয়ে খুঁজে যাচ্ছেন কিছু! তাকে কিছুটা বিভ্রান্ত দেখালো। আমি চাইনা তার সামনে পড়তে৷ দু হাত সমান পিলেরের পিছনে লুকিয়ে পড়লাম। বুকে ভিতর ধ্রীম ধ্রীম শব্দকরে হৃদপিণ্ড বেড়িয়ে আসতে চাইলো। আমার মনে হলো, স্টুডেন্টদের গুঞ্জন থেকে আমার বুকে বা পাশের শব্দটাই বেশি হচ্ছে?
আমি শুকনো ঢুক গিললাম। এতক্ষণে চলে গেছেন হয়তো উনি! ভেবেই পা বাড়ালাম ক্লাসের দিক। ঠিক তখনি থমকে গেলো আমার পা, এক পুরুষলী শক্ত হাত আমার হাত চেপে ধরলো। ভয়, বিস্ময়, হতবাক হয়ে গেলাম আমি। কিছু বুঝার আগেই লোকটি টেনে নিয়ে গেল বদ্ধ একটি রুমে। ঠেসে ধরলো ধুলোমাখা দেয়ালে। অনেক দিন বন্ধ থাকায় শ্যাত শ্যাত ভাব রুমটিতে। এক পাশে ঠেলে রেখেছে বেঞ্চ। বেঞ্চ গুলো উপর ধুলোবালির স্তুপ। ভ্যাপসা এক গন্ধ ঠেলে ছড়িয়ে পড়লো সুগন্ধী। পরিচিত মানুষের শরীরের ঘ্রান ঘরময় ঘুরো ফিরা করতে লাগলো। আমি ভয়ে কাঠ। গলা শুকিয়ে গেছে। সাত দরিয়ার পানি খেলেও যেন তৃষ্ণা মিটবে না আমার। আমি পিট পিট করে তাকিয়ে দেখলাম ডা. অভিনব নিষ্প্রভ চাহনি মেলে এগিয়ে এসে মুখো মুখি দাঁড়ালো আমার। মনে হলো সেই মুহূর্তে আমার মাথা ফাঁকা, বুকে তীব্র চিন চিন ব্যথা, শিরশিরানি। উফ অসহ্য অনুভূতি।
ডা. অভিনব আমার মুখোমুখি দাঁড়ালো। পার্থক্য ইঞ্চি সমান। দুহাত দু দিকে দিয়ে আটকে ফেললো । লম্বা দেহখানি নিয়ে ঝুঁকলো। প্রতিটি নিশ্বাস আছড়ে পড়লো মুখ-মন্ডলে আমার। সময় যেন সেখানেই থেমে গেলো আমার। শ্বাস আটকে দাঁড়িয়ে আছি। কাঁপাচ্ছে আমার শরীর, হাত-পা, ঠোঁট। ডা. অভিনব আমার ঠোঁটের দিকে তার দৃষ্টি নিবন্ধ করলো। শীতল বরফ অথচ ধারলো কন্ঠে বলল,
“হোয়াই ডো ইউ ওয়ান্ট টু কিল মি?”
আমি চমকে তাকালাম। আগের থেকে শ্বাসপ্রশ্বাস দ্রুত বেগে দৌড়াতে লাগলো। কানের মাঝে চরকির মতো ঘুরতে লাগলো কথাটি। পরক্ষণেই উপলব্ধি করলাম আমার হাত পা ঠান্ডা হয়ে আসচ্ছে। তাকে আমি কেন মারতে চাইবো? কি বলছেন উনি?এই মুহূর্তে উনিই হয়তো মারতে চাইছেন আমাকে? আমি ভয়ে তোতলানো কন্ঠে বলে উঠলাম,
“কি ব-ল-ছে-ন?”
উনার ঠোঁটে এবার হাসির রেখা ফুঁটে উঠলো। থমথম মুখে মেদুর ছায়া দূরে ঠেলে সূর্যের মতো এক ফালি আলো দেখা গেলো। উনি আরো ঘেঁসে দাঁড়ালেন আমার সাথে। আমি চোখ নামিয়ে নিলাম। কি হচ্ছে বুঝে উঠতে পারছি না এ মুহূর্তে।
ডা. অভিনব এবার আমার নত মুখ ডান হাতের দুই আঙুল থুতনি রেখে মুখটি উঁচু করলেন। না চাইতে চোখের বাঁধ ভেঙ্গে গড়িয়ে পড়লো দু ফোঁটা জল। ডা. অভিনব শীতল দৃষ্টিতে এখনো তাকিয়ে, বলল,
“এবার পালালে! আই উইল কিল ইউ!”
আমি আরেকদফক চমকালাম। অসাড় হয়ে আসা শরীরটা সামলে ঠেলে সরিয়ে দিলাম ডা. অভিনবকে। জোড়ে জোড়ে শ্বাস বের হবো তখনি শোনা গেলো আবার তার কন্ঠ। আমার পা সাথে সাথে থমকে গেলো।থমকে গেলো সময়, থমকে গেলো বাতাস। থমকে হেলো নিশ্বাস। অবাকতার শেষ চুড়ান্তে আমি। বন্ধঘর ময় বাড়ি খেয়ে যাচ্ছে এখনো সেই কথাটি,
“আই লাভ ইউ রূপ। আই লাভ ইউ। ”
~জয়নব পেইজ উল্টালো। এর পরের বেশ কিছু পেইজ পোড়া। জয়নব হতাশ হয়। কি উত্তর দিয়েছিলো তার বোন? জানা নেই। তবে লিখা গুলো পড়তে পড়তে সে হারিয়ে গেছিলো। নিজরকে রুফাইদার জায়গায় আর ডা. আদরকে ডা. অভিনবের জায়গায় অজান্তেই কল্পনা করে বসলো। লজ্জায় টুকটুকে লাল গাল গুলো আরোও লাল হয়ে গেলো। নিজের ভাবনাকে ঠেলে দিলো দূরে৷ কয়েকটি পেইজ উল্টাতেই চোখে পড়লো কিছু অদ্ভুত লিখা~
আমাদের মেডিকেল কলেজে ইললিগ্যাল কাজ চলছে। কে বা কারা করছে? এখনো জানা যায়নি। তবে আজ বিষয়টি আমার চোখে পড়েছে। আজ সকালে একজন রোগী আসে। লোকটি স্পট ডেড। মর্গে রাখা হয়েছিলো তাকে। আমি সেদিক দিয়ে আসার সময় দেখলা দুটো ওয়ার্ড বয় চুপি সারে লাশটি নিয়ে ঢুকছে পুরোতন ওটিতে। আমি কিছু বলতেই চাইছিলাম তখনি কেউ পিছন থেকে মুখ চেঁপে সাইডে নিয়ে আসে। আমি চমকে তাকাতেই দেখতে পাই পরিচত এক দেবীমূর্তি। যার চোখ গুলো ডাগর ডাগর প্রতিমার মতো। ঢেউ খেলানো চুল পিঠময় ছেড়ে রেখেছে। পড়নের সুতির জলপাই কুর্তি লতানো দেহে চেপে আছে। অামি অবাক চোখে তাকে দেখছিলাম, মুহূর্তেই রাজ্যের বিস্ময় নিয়ে ভ্রু কুচকে বলে উঠলাম,
“পূজা তুই!”
পূজার চোখে ভয়, অস্থিরতা। এদিক ওদিক তাকিয়ে কিছু একটা দেখে চাঁপা কন্ঠে বলে উঠলো,
“মরার শখ না থাকলে ওখানে যাইস না। ”
আমি হতবুদ্ধি। প্রশ্নবিদ্ধ চোখে তাকিয়ে বললাম,
“কি বলতে চাইছিস?”
পূজা স্বগতোক্তির মতো বলল,
“এখানে অনেক ইললিগাল কাজ চলছে। আমি আরো নোটিশ করেছি। ইনফ্যাক্ট ৩০৩ নাম্বার রুমটিই হচ্ছে সব নষ্টের মুল। কে বা কারা করছে? ধরতে পারছে না কেউ!”
আমি কিছুই বুঝলাম না। পূজা আমার বন্ধু। দেখকে প্রায় একই রকম আমরা। মাঝে মাঝে হোস্টেলের খালা মামারা আমাদের বোন ভেবেই ভুল করে বসে। আমি অবিশ্বাস্য গলায় বললাম,
“কি যা তা বলছিস?”
“যাতা নয়। এখানে ইললিগাল কাজ চলে, মৃত রোগীদের চোখ, হৃদপিণ্ড, কিডনি এমনকি শরীরের ইম্পর্টেন্ট পাটর্স কেউ বেআইনী ভাবে সেল করে যাচ্ছে।”
“তুই এত কিছু কিভাবে জানলি?”
“তুই ছিলিনা। দুদিন আগে পুলিশের একটি দল আসে হসপিটালে। এক রোগীর পরিবার কমপ্লেন করেছিল। রোগীর সার্টিফিকেটে ছিল নর্মাল ডেড। কিন্তু লোকটির শরীরে কাঁটা ছেঁড়া করা হয়েছে। যেখানে তার অপারেশন হইনি। তারা অন্য হাস্পাতালের ডাক্তারদের দিয়ে পরীক্ষা করেই জানতে পারে লোকটি শরীরে ইম্পরট্যান্ট পার্টস গুলো গায়েব।”
শিউরে উঠলাম আমি। থরথর করে কাঁপতে লাগলাম। কম্পিত কন্ঠে বললাম,
“এসব কিভাবে সম্ভব? ”
পূঁজা আসলো। পান মাতার মতো মুখ খানায় বিদ্রপের হাসি,
“টাকার জন্য আজ কাল সন্তানকে বেঁচে দিচ্ছে, আর এটা তো সামান্য ব্যাপার!”
স্পষ্ট দেখতে পেলাম পূজার চোখে, মুখে মেদুর ছায়া। সে আবার বলল,
“তুই এসব ঝামলেয় পরিস না এখান থেকে যা।”
“আমি কেন ঝামেলায় পড়ব? আর এসব হচ্ছে প্রন্সিপাল স্যার জানেন? বোর্ড এসবে কোনো পদক্ষেপ কেন নিচ্ছেন না?”
পূজা বলল,
” ইনভেস্টিগেশন চলছে। কারা করছে ধরতেই পারছে না। এই যে ৩০৩ নং রুম হাজার তল্লাশি করেও কিছুই পাওয়া যায় নি। কীংবা তুই এখন গেলেও কিছুই খুঁজে পাবি না। সব হাওয়া!”
আমরা মাথায় কিছুই ঢুকছিলো না। ৩০৩ নং রুমটি পুরোনো ওটি ছিলো। কোনো কারণবশত সেটি বন্ধ করে দেয়া হয়। ইনফেক্ট কারো যাওয়া আসা নিষেধ। তাহলে কিভাবে কেউ হসপিটাল ভর্তি মানুষের অগোচরে ভয়ানক তান্ডব লিলা খেলা?এর জন্য পিছনে অবশ্যই বড় কোনো মহানায়ক আছে?
সেদিন আরো জানতে পারলাম পুলিশ পক্ষ আমাদের কলেজে সকলের অগোচরে গোয়ান্দাগিরির জন্য বেঁছে নিয়েছে কিছু লোাক। এবং তার মাঝে আমাদের গ্রুপের মাঝে আছে আয়ান, আঞ্জুমান, পূঁজা। আমি নিজেও তার সাথে যোগ দিলাম। এই ভয়ংকর কর্মকান্ড দূর করার জন্য। সেদিনের পর আরো কিছুদিন কেঁটে যায়। হাসপাতালে সব কিছু রোজকার মতোই চলছে। এর মাঝেই পূজা খবর আসে তার মাসিমা আর নেই। তাকে দ্রুত যেতে হবে তার শহরে। বাবা-মা মরে যাওয়ার পর এই মাসিটিই সব ছিলো তার। মাসি নেই শুনেই ভেঙে পড়ে সে। কলেজের ফর্মালিটি শেষ করে রওনা করে। কিন্তু অবাক করা বিষয় হলো তখন যখন পূজার যাওয়ার ১৫ দিন পার হয়ে গেছিলো তার কোনো খোঁজ ছিলো না। উপর থেকে ফেন বন্ধ আসচ্ছিলো। আমাদের সবার মাঝেই ছিলো চিন্তার ছাপ। ১৫ দিয়ে ২০ দিনের মাথায় একটি ফোন কলে শিউরে উঠে আমরা। পূজার মাসিমা ফোন করে আয়ানের কাছে।তখন আমরা মাঠের উপর বসে। একজন মৃত ব্যক্তি কিভাবে ফোন দিয়েছে? ভাবতেই সকলে ভয় পেয়ে গেলাম। পরবর্তীতে জানতে পারলাম পূজার মাসি মরে নি। আর পূজাকেও কেউ গুম করে দিয়ে ছিলো। এই খবর শোনার পর আতঙ্কে সাদা হয়ে গেলো সবার মুখ। পিছিয়ে গেলো মিশন থেকে আয়ান, আঞ্জুমান। রয়ে গেলাম আমি। ঠিক করে ফেললাম আমিই করবো সব।
জয়নব অস্তির হয়ে পড়লো। এর পরের পেইজ গুলো খালি। আর যা লিখা বেশির ভাগ পুড়ে ছাই।
জয়নব কি করবে এখন? তার মাথা ফাঁকা লাগছে। তবে এই হসপিটালের রহস্য কিছুটা সামনে এসেছে। ইলিগ্যাল কাজের জন্যই এত এত মানুষের প্রাণ যাচ্ছে? জয়নব দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। সে ঠিক করলো ৩০৩ নং রুমটিতে সে একবার টু মেরেই আসবে। কি আছে সেই রুমটিতে? কেনোই বা সেখানে ঢুকলেই সব হাওয়া হয়ে যাচ্ছে?
চলবে,
আশা করছি কিছুটা ক্লিয়ার হয়েছেন? 🙆♀️🙆♀️
অন্তর্দহন_প্রণয়
লিখনীতে_সুরাইয়া সাত্তার ঊর্মি
১২
নিঃস্পৃহ, নিস্তব্ধ আরেকটি দিন কেঁটে গেলো অভিনবের জীবন থেকে। ক্যারিয়ারের পাঁচটি বছর কেঁটে গেলো অগোচরে। ছোট থেকেই ডাক্তার হওয়ার প্রতি ঝোঁক ছিল । বাবা ডাক্তার, মা ডাক্তার। ডাক্তারী পরিবেশেই বেড়ে উঠা। এক সময় শখ তার পর প্রফেশন। অনেকটা রবোটিক্সদের মতো, টাইম মাফিক চলছিলো সব। টাকা, পয়সা, পাওয়ার থাকা শর্তেও কি জানি ছিলো না তার জীবনে। বড্ড রুক্ষ সুক্ষ্ম জীবন। মনে হচ্ছিলো সে এক জন্তু যার হাত পায়ে বেঁধে দেয়া হয়েছে ভাড়ী বন্ধনে। গন্ডিতে টেনে দিয়া হয়েছে অদৃশ্য রেখা৷ রেখা পার কার শক্তিটুকু যেন কেউ কেড়ে নিয়েছে। ঠিক এই বাধ্যবাধকতার জীবনে ভাঁটা ফালিয়ে উদ্দীপ্ত হলো রুফাইদা নাওরিন। লাগামহীন জীবন, হাসোজ্জল মুখ, সরু নাক, পিঠে ঢেউ খেলানো কালো চুল। শুভ্র রং আর ঘন ভ্রু যুগলের নিচে কালো কুচকুচে চোখ জোড়া। কত মায়া, কত গম্ভীর সেই চোখ জোড়ায়। হাসলে মনে হতো তার চোখ জোড়াও হাসচ্ছে। মেয়েটি সব সময় তার থেকে পালিয়ে বেড়াতো। অভিনব এক পলক তার দিকে তাকাতেই সে যেন মুর্ছা যেত। লজ্জাবতী গাছে যেমন স্পর্শ করলেই লজ্জায় গুটিয়ে নেয়? ঠিক তেমনি ছিলো তার রুফাইদা। ডা. অভিনবের বুক চিঁড়ে দীর্ঘ শ্বাস বেড়িয়ে এলো। ঝংকার ময় কন্ঠ আজ গম্ভীর, আহত, ব্যাথাতুর, কন্ঠনালি বাক্যহীন।
ডা. অভিনব দাঁড়িয়ে আছে তার সুবিশাল প্রকন্ড বাড়ির, দোতালার গোল বারান্দায়৷ দক্ষিণা মুখ রুমটি। নিস্তব্ধ ঘুটঘুটে অন্ধকার রাতে দাড়িয়ে আছে বারান্দার কার্নিষ ঠেষ দিয়ে। পড়নে তার কালো টাউজার আর গায়ে ছাই রঙ্গা গেঞ্জি। উষ্কখুষ্ক চুল। হাতে তার একটি রুপোলী কারুকার্য সম্পন্ন ছবি ফ্রেম। রুমের মাঝে থেকে ভেসে আসা কম আলোয় ঝিলিক দিচ্ছে একটি তরুণীর খিল খিল কিশোরী হাসি। ডা. অভিনব আজওয়াদ এই ছবিটি ক্যাপচার করেছিলেন রুফাইদার অগোচরে। সব সময় গম্ভীর আর রোবট মানুষটিকে প্রাণ দিয়ে গেছিলো এই হাসিটি। চোরা চোখে পর্যবেক্ষন করে যেতে এই রমনীকে। বুঝতেই পারেনি কবে, কখন, কিভাবে এই রমণীর ভালোবাসায় হাবুডুবু খেতে শুরু করে দিয়েছিলেন। সেবার রুফাইদা সাতদিনের গায়েব হওয়াতে পাগল পাগল হয়ে গেছো অভিনব। অথচ আজ একটি বছর এ মেয়েটি নেই। কিভাবে দিন পারি দিচ্ছে অভিনব? তা শুধু সেই জানে?দিন ফুরিয়ে যাচ্ছে মাস গড়িয়ে বছর পাড় হলো দুয়েক। আজকেই তো নাকি মেয়েটি প্রথম এ পৃথিবীতে প্রথম চোখ খুলে ছিলো? সেতো চাইতো? রুফাইদার প্রতিটি জম্মদিনে তার মুখে দেখেই হবে। সবার আগে জানাবে সে। কিন্তু হায়? চাইলেই কি সব পাওয়া যায়? শুনেছে মরার পরে যাকে বেশি ভালোবাসে পৃথিবীতে সেই রূপ নিয়েই নাকি সাথী হয় কেউ? সত্যি এমন হলে, অভিনব দোয়া করে প্রতিটি নামাজের পর, রুফাইদাই যেন তার সঙ্গী হয়।
এক দমকা হামকা হাওয়ায় বারান্দায় থাকা উইনজারটি নাড়িয়ে দিলো টং টং করে বেঁজে সেটি। দোল খেলে গেলো তার ঝাঁকড়া চুল গুলো। নিস্তব্ধ ঘরটিতে তখন ঢং ঢং শব্দ রাজ্য করতে লাগলো ঘড়ির কাঁটা। ডা. অভিনবের সেদিকে কোনো খেয়াল, ধ্যান নেই। রুফাইদা তার থেকে সব সময় পালিয়ে বেড়াতো, আড়াল করতো নিজেকে। সত্যি সত্যি সে আড়াল করে ফেললো একে বারে। অশ্রুশিক্ত, নিষ্প্রভ চোখে চেয়ে, ছবির ফ্রেমটিতে চুমু খায়। ছবিটিতে অতি আদরে ছুঁয়ে যায় তার হাত। অস্পষ্ট, ধরে আসা গলায় বলে উঠে,
“হেপি বার্থ ডে রূপ! মেনি মেনি হ্যাপি রিটার্নস অফ দা ডে? সুখে থাকো তুমি। যেখানেই থাকো। মনে রেখো। আই লাভ ইউ। আই মিস ইউ!”
দু ফোঁটা গরম নোনা জল গড়িয়ে পড়ে ছবির ফ্রেমটিতে থাকা রুফাইদার হাস্যোজ্জ্বল মুখে।
——————
“হেপি বার্থ ডে বড়পু!”
সিক্ত চোখ আর ভাঙ্গা হৃদয় নিয়ে তাকিয়ে আছে জয়নব, তাদের বাসার বসার ঘড়টিতে খুব বড় করে টানানো রুফাইদা আর তার বাবা-মার ছবিটির দিকে। কত প্রাণবন্ত এই ছবিটি। ঘরময় যেন গুঞ্জন হচ্ছে খিল খিল করে রুফাইদার হাসি। এই ঘরের প্রতিটি ছবিতে তিন জন ব্যক্তি উপস্থিত। কোনো ছবিতে জয়নব নেই। কেনো নেই? এ প্রশ্নটি সে জানে। আগে না জানলে আজ জানা হয়েছে। আজ রুফাইদা জম্মদিন। নাজমা আজ নিজ থেকে ফোন করে ডেকে এনেছেন জয়নবকে। রুফাইদা মরে যাওয়ার পর তিনি কথা বলতেই যেন ভুলে গেছিলেন। ভুলেগেছিলেন স্বামীর কথাও। সাইফ মরে যাওয়ার পর যেন একে বারে নেতিয়ে গেছেন নাজমা। কিন্তু আজ এত বছর পর মায়ের কন্ঠ শুনে হল ছেড়ে এক প্রকার ছুটেই চলে আসে বাসায়। কিন্তু এখানেই যে তার পুরো দুনিয়া উল্টে যাবে জানা ছিলো না জয়নবের। নাজমার ছোট বাই ওয়াহিদ এসেছেন বিদেশ থেকে। নাজমাকে তার সাথে নিয়ে যাবে। নাজমা নিজেও সায় দিয়েছে। যেখানে মেয়ে আর স্বামী নেই? সেখানে একা পড়ে থেকে কি লাভ? জয়নব এসব শুনে থমকালো কিছুক্ষণ। মাথার নার্ভে নাড়া দিয়ে গেলো একটি প্রশ্ন,” আমি কে তাহলে? মা কি আমাকে ভুলে গেছে? ”
কথাটি কোনো মতেই হজম হলো না জয়নবের এক আকাশকুসুম বিস্ময় আর সঙ্কা নিয়ে জিগ্যেস করলো,
“মা আমি কি তোমার কেউ না? আমাকে একা করে কেন চলে যেতে চাইছো?”
“নাহ্ তুমি আমার সন্তান না। ”
আকাশের বুক ফেঁটে আচমকা এক বাজ যেন পড়ে গেরো জয়নবের মাথায়। ফ্যালফ্যাল চোখে চেয়ে রইলো। হাসার চেষ্টা করে বলল,
” মা.. মা তুমি আমার সাথে দুষ্টামি করছো তাই না? আমার ভালো মা প্লিজ এ…এমন দুষ্টামি করোনা। কেন মিছে মিছি এসব বলছো?”
নাজমার চোয়াল শক্ত। স্থীর তার দৃষ্টি। শ্যামকায় এই মেয়েটির উপর তাকালেই রাজ্যের ক্রোধ ভর করে তার মাঝে। ছোট বেলায় যখন সাইফ মেয়েটি এনে তার কোলে দিয়েছিলো? নাজমা তখন বড্ড অবাক। ভেবে ছিলো কুঁড়িয়ে পাওয়া মেয়ে। কিন্তু পরক্ষণেই সাইফের কথা পুরো দুনিয়া উল্টে পাল্টে গেছে। ভেঙে গেছিলো তার মন, বিশ্বাস, সংসার। তবুও সামলে নিয়েছিলো নিজেকে সে। নাজায়েজ বাচ্চাটিকে যতবার চোখের সামনে ঘুরঘুর করতে দেখলে পিত্তি জ্বলে যেতে। কিন্তু কিছুই বলতেন না তিনি। কিন্তু আজ? আজ বলতে বাধ্য। এই মেয়েটির মা তার এককালের বান্ধবী ছিলেন ঘনিষ্ঠ। সাইফকে সেও নাকি চাইতো। কিন্তু সাইফ তার হৃদয় দিয়ে চেয়েছে নাজমাকে। কিন্তু জয়নবের মা ছলচাতুরী করে একরাতে সাইফকে ড্রাগ দিয়ে দেয়। এবং নিজের কার্য হাসিল করে ফেলে। যার ফল এই জয়নব। কিন্তু কখনো নাজমা বুঝতে দেয়নি এক মাত্র সাইফের জন্য। সে সব সময় এক কথাই জপে গেছে,
“দোষ না হয় ওর মা করেছে। কিন্তু ও তো আমারো সন্তান। সে যেভাবেই হোক!”
এই কথার পর মুখের রং পাল্টে যেত। রাগে গজগজ করতে করতে বিনা কারণে দু ঘা বসিয়েও দিতেন জয়নবের পিঠে। ছোট জয়নব ব্যথায় গোঙানির শব্দ নাজমা যেন পৈশাচিক সুখ পেতেন। এভাবেই দিন যেতে লাগলো। এক ঘঠনায় ধপ করে মনের আগুন নিভে গেছিলো নাজমার। রুফাইদাকে আগুনে পুড়ার হাত থেকে বাঁচিয়ে মেয়েটি তার মনের কোনে এক শীতল স্পর্শ করেছিলো ঠিকি কিন্তু আজ সব পাল্টে গেলো এক উইলে। সাইফ তার সকল সহায় সম্পত্তি জয়নবের নাম করে দিয়েছে। ওয়াহিদ এটা জানার পর আরো কান পড়া দিয়েছে। সব শুনে নাজমা অগ্নিমূর্তি ধারণ করেছে। তার সকল সহায় সম্পত্তি রুফাইদার নামে ছিলো, রুফাইদা নেই বলেই জয়নবের নাম হয় গেছে এটা তিনি হজম করতে পারছেন না। তার মন চাইছে সব বেঁচে অনাথালয় নয়ত মসজিদ মাদ্রাসায় বিলিয়ে নিঃস্ব করে দিতে মেয়েটিকে। কিন্তু তার হাতে কিছু নেই। সে না চাইতে মেয়েটিকে সহ্য করতে পাড়ছে না। মেয়েটি কেঁদে যাচ্ছে। লাল নাক মুখ। কিন্তু কি সুশ্রী মুখ মেয়েটির ঠিক তার মায়ের মতো যেন। নাজমার রাগ নিভু নিভু হয়েছিলো খানিকটা। জয়নবের মার কথা মনে আসতেই ধাক্কা মেরে জয়নবকে সরিয়ে দেয় তার থেকে। আর কোনো ভনিতা ছাড়াই বলে উঠে,
“না আমি তোমার মা আর না তুমি আমার মেয়ে। আমার মেয়ে একজন ছিলো যে মরে গেছে। আর তার সহায়সম্পদে ঘাপটি মেরে বসে আছো তুমি! আমি এসব কিছুই চাইনি। বাঁচতে চেয়েচিলাম আমার মেয়ে, স্বামী নিয়ে, যখন তারাই নেই তো এখানে আর থেকে কাজ নেই।”
নাজমা উঠে পড়লো। জয়নব হাউ মাউ করে কাঁদছে। এত এত সত্যের ভিতরে মরে যেতে চাইছে সে। বাঁচতে চায় না কোনো রকম। সে নাজমার পা জড়িয়ে ধরলো। হেঁচকি তুলে কাঁদতে কাঁদতে বলল,
” ও মা। ওমা যেয়ো না। আমি মরে যাবো আমাকে একা রেখে যেয়ো মা প্লিজ যেয়ো না।”
নাজমা শুনলেন না। যেন কানের মাঝে তুলো গুঁজে আছেন। পা ছাড়িয়ে যখন পাচিল ছাঁড়াবে তখনি জয়নব চেচিয়ে উঠলো বললো,
“বড়পু বেঁচে আছে মা। আমার জন্য না হয়। বড়পুর জন্য থেকে যাও মা!”
নাজমা থমকালো। পা থেমে গেলো। কিছু মুহূর্ত সময় নিলো বোঝার বুঝতে পেড়েই চকিতে তাকালেন তিনি। উপলব্ধি করলেন তার গা কাঁপছে। তীব্র ব্যাথা অনুভব করছেন বুকে৷ হাহাকার জীবনে এক ফুঁটো সুখে ছোয়া খেলে গেলো নাজমার চোখে মুখে। নাজমা দৌঁড়ে এগিয়ে এলো। জয়নবের সামনে বসে পড়লো। টলমলে চোখে বলল,
“আমার মেয়ে কই জয়নব? কই আমার মেয়ে? নিয়ে আয় ওকে৷ নিয়ে আয়?”
জয়নব বুক ভরা ব্যথা নিয়ে মায়ের মুখে চাইলো। আহ্ কত ব্যাকুলতা তার মায়ের নিজ সন্তানের জন্য। আর তার জন্য? এই মায়ের বুকে নেই ভালবাসা, নেই মায়া, নেই স্নেহ। আছে শুধু অঢেল ঘৃণা। জয়নব বেড়িয়া আসে দীর্ঘশ্বাস সপ্তপর্ণ গিলো নিলো। মায়ের চোখ জোরা মুছে দিয়ে আবেগী গলায় বলল,
“মা তোমার রূপ তোমার কোলে জলদি ফিরে আসবে। আর তার সহায়সম্পদ সব তারই থাকবে। চিন্তা করো না মা। আমি তোমার সন্তানকে তোমার বুকে ফিরিয়ে দিবো। খুব জলদি!”
নাজমা কাঁদতেই লাগলেন। তার মেয়ে বেঁচে আছে এটিই যে বড় শান্তি।
——————
নাজমা ঘুমিয়ে আছেন। ওয়াহিদ অনেক কটু কথা বলে চলে গেছেন। বলে গেছেন সে আবার ফিরবে নিয়ে যাবে তার বোনকে। কিন্তু সেদিকে কোনো খেয়াল নেই জয়নবের। সে বসে আছে রুফাইদার রুমটিতে। হাতে তার একটি চিঠি। ঠিকানা হী। রুফাইদাকে আটকে রাখা হয়েছে। কে বা কারা করেছে কিছুই লিখেনি রুফাইদা।রুফাইদা গোটা গোটা অক্ষরের লিখা তার চেনা। হাতে চিঠিটি সে আবার খুললো। সুঘ্রাণ ছড়িয়ে পড়লো যেন রুফাইদার শরীরের। জয়নব চিঠিতে নাম লাগিয়ে ঘ্রান নিলো৷ কান্নায় জড়জড়িত হয়ে আবারও পড়লো চিঠিটি,
প্রিয় বাবা,
তুমি হয়তো জানো আমি মারা গেছি। নেই অস্তিত্ব এই দুনিয়ায় আমার। কিন্তু বাবা আমি বেঁচে আছি মরার মতোই। নিত্যদিন মরছি। জানো বাবা? এখানে সবাই মরে প্রতিদিন রাতে। আমিও মরি। আমার গায়ের প্রতিটি আঘাত মরণের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেয়। আমি প্রতিদিন ভিক্ষা করি মরণের কিন্তু হয় না। আমাকে বাঁচাও বাবা। রক্ষে করো আমাকে। আমি আবারো তোমার কোলে মাথা রাখতে চাই বাবা। মায়ের হাতে রান্না কত দিন খাই না। যানো বাবা এখানে দু, তিন চলে যায় তারে খেতেও দেয় না।বাবা তোমাকে খুব মনে পড়ে। মাকেও মনে পড়ে। মনে পড়ে সেই ভয়ানক রাতের কথা। বিশ্বাস করো বাবা আমি জানতাম না তারা আমার সাথে ডাবল ক্রস করবে। ভাবিনি বাবা তারা আমাকে এমন এক পৃথিবীর সদস্য করে দিবে যেখানে আলো বাতাসের দেখাও মিলে না। বাবা আমাকে মুক্ত করো। আমি বাঁচতে চাইম মুক্তি চাই এই নরক যন্ত্রনা থেকে। মুক্তি চাই মানুষ খেকো মানুষদের থেকে। মুক্তি চাই!
ইতি,
তোমার রূপ
চলবে,
পরের পর্বে রুফাইদাকেও দেখতে পারবেন। কেমন লাগছে জানাবেন।