অন্তর্দহন প্রণয়,পর্ব-৯,১০

অন্তর্দহন প্রণয়,পর্ব-৯,১০
লিখনীতে_সুরাইয়া সাত্তার ঊর্মি

রিসোর্টের কামড়ায় নিয়ন আলো জ্বলছে। মোমবাতি দিয়ে সাজানো হয়েছে দখিনা জানালার পাশটি। খোলা জানালার বাহির দাম্ভিক পূর্ণ চন্দ্রটির আলেখ্য ভেষে আসচ্ছে। ঘরটির কোনোয় কোনোয় আলোকিত করে খেলা করছে দীপ্তি। আর তাতেই দেখা যাচ্ছে, বিছানার দুই প্রান্তে দুই মানব সটান করে শুয়ে আছে। মাঝে খানে দিয়ে রাখা হয়েছে বালিশের পাহাড়। কাজটি অবশ্যই জয়নবের। কামড়াটি বিশাল, মাঝামাঝি রাখা বিছনা, ঠিক তার উল্টোদিকে ড্রেসিংটেবিল। তার পাশেই রাখা কেবিনেট। জয়নব তাকিয়ে আছে খোলা জানালার দিকে। বাতাসে ফরফর করে উড়ছে সাদা লাল পর্দা। পিনপতন নিরবতা ঠেলে ভেসে আসচ্ছে ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক। থেকে থেকে তাল মিলিয়ে ডাকছে হুতুম পেঁচা আর শিয়াল। এদের ডাকে কেঁপে উঠছিলো জয়নব। কিন্তু পাশে গুমরো মুখে বসে থাকা ডক্টরকে বুঝতে দিতে চায় না। লোকটিকে এমনিতেই তেতো মুখের করকরে কথা শুনিয়েছে সে। আদর মুখ গোঁজা করে রাখেছিলো বৈকি। কিন্তু লাল রক্তিম ঠিকি ফুটে উঠেছিলো চোখে,মুখ। সেদিকে পাত্তা না দিয়ে মুখ বাঁকিয়ে বলে উঠেছিল,

“আমার থেকে দূরে থাকুন।”

আদর এর পর ওর দিকে তাকিয়েও দেখেনি। জয়নব ছোট শ্বাস ছাড়লো লোকটি ইগনোরনেস ভালো লাগচ্ছে না। চারদেয়ালের মাঝে মুখ বন্ধ করে বসে থাকতেও রাগ গা কেঁপে উঠছে। বীপ বীপ করে ভাইব্রেশন শব্দ হতে লাগলো বালিশের নবচে চাঁপা পড়া ফোনটি। ফোনটি হাতে নিয়ে এক প্রকার ছিটকে চলে এলো বারান্দায় জয়নব। তার যাওয়ার দিক ভ্রু কুচকে থমথমে মুখে চেয়ে আছে ডা. আদর। জয়নব ফোন তুলেই ফিসফিস করে বলল,

“দোস্ত বাঁচাইছোস তুই আমারে। ”

ওপাশ থেকে বলে উঠলো কুয়াশা কাঁদো কাঁদো কন্ঠে,

“আমি না হয় তোরে বাঁচাইলাম আম্রে কে বাঁচাইবো। বাচ্চা গর কাউ কাউ আমারে পাগল কইরে দিতাছে দোস্ত। আমি মইরা জামু। আমার লিলায় তোর দাওয়াত।”

জয়নব হেসে ফেললো। আফসোস হওয়ার হচ্ছে এমন ভাব করে বলল,

“আহরে আমার বইনাটা কি খাটুনি করতাছে। ইশশ!”

কুয়াশা জয়নবের মজা ধরতে পেরে আরো খেপে গেলো। গাল ফুলিয়ে বলল,

“হইছে আর মজা লওয়া লাগবো না। ভুলিস না তোর জন্যই আমি ভুক্তভোগী। তা কিভাবে বাঁচাইলাম তা কয়!”

জয়নব বলল,

“আর কইছ না, আমি আর আদর স্যার এক লগে,এক রুমে, এক বিছানায়!”

কুয়াশা আকাশ থেকে পড়লো। এমন ভাব করে অার্তনাদ করে উঠলো,

“কি কস দোস্ত? তোগোর মাঝে কিছু হইছে? এবার কি হবে?”

জয়নব ধমকে উঠলো,

“বাজে কথা কম কয়। তার সাথে কিছুই হয় নাই। বেটা খাইশটার সাথে জীবনেও আমার কিছু হইতো না।”

“তাইলে?”

“আর কইছ না। হাসপাতালে পিয়নরে দিয়া এখানে একটা রেসর্টে বুকিং করাই ছিল দুইটা রুম। আইয়া শুনি একটা রুম বুকিং করছে। মাথায় আকাশ ভাইঙা পরছে দোস্ত। অবশ্য ডক্টর আদর, মি. বাঁদর চেষ্টা করছে অন্য রুম নিতে বাট হয়নি। আবার অন্য রেসোর্টে এ যাইতে চাইছিলো কিন্তু বাহিরের অবস্থা বেশি একটা ভালো না।”

হতাশ শুনালো এ পর্যায়ে জয়নবের কন্ঠ। সব শুনে কুয়াশা ওই প্রান্ত থেকে খ্যাঁক করে উঠে বলল,

” এইখানে এত টেনশন নিতাছোস কেন তুই? আদর স্যার রগচটা হলেও ভালো মানুষ কিছুই করবো না তরে। আর সে তো বাঘ, ভালুক না ভয় পাইতেছিস কেন!”

জয়নব অসহায় ভাবে বলল,

“জানি না দোস্ত কেমন জানি লাগতেছে খালি!”

কুয়াশা ওই প্রান্ত থেকে বুঝাবার মতো করে বলল,

“চিন্তা করিস না দোস্ত। এখন গিয়া সটান হইয়া চুপটি মাইরা শুয়া পর। আজেবাজে চিন্তা বাদ দিয়া!”

জয়নব সুপ্তপর্ণে শ্বাস টুকু গিলে বলল,

“আচ্ছা থাক তাহলে কাল দেখা হবে!”

“হুম আল্লাহ হাফেজ! ”

ফোন কেঁটে গেলো। নিশাচর রাতের আধারে তাকিয়ে রইলো জয়নব কিছুক্ষণ। মনে মনে নিজেকে কটক্ষ রুমে প্রবেশ করতেই চোখ কঁপালে উঠে গেলো। ঘরময় কোথাও বিচরণ নেই ডা. আদরের। ভ্রু জোরা কুঁচকে গেলো। মাথায় চিন্তার দুখানা ভাজ-ও পরলো। পায়চারি করতে লাগলো ঘরের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত। লোকটি গেলো কই? বলেও গেলো না! কি করবে জয়নব ঘুমিয়ে পড়বে কি?এসব চিন্তায় কেঁটে গেলো ঘন্টা খানেক। জয়নব ক্লান্ত হয়ে বিছানা পিঠ ছায়ালো। তন্দ্রা এসে যাচ্ছে তার। চোখের পাতা এক করতেই খটখট করে শব্দ হলো দরজায়। জয়নব ধড়ফড়িয়ে উঠে বসলো। দরজার আওয়াজ আবার হতেই দৌড়ে দরজা খুলে দিলো।

ঢুলু ঢুলু শরীরে হেলেদুলে রুমে প্রবেশ করতেই হেলে পড়লো আদর জয়নবের দিকে। জয়নব বিস্ময়ে হতভম্ব। ডা. আদর সুরার ঢেলেছেন গলায়। তার মুখ থেকে তীব্র গন্ধ ধেয়ে আসচ্ছে। ভেসে আসচ্ছে আবার কিছু টুকরো কথা,

“আমাকে কেউ ভালোবাসা না..! মা না বাবা না। তুমিও না.. কেউ না। হোয়াই নো ওয়ান্স লাভ মি?হোয়াই?”

জয়নব কি বলবে বুঝে উঠতে পারছিলো না। লোকটি তাকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরে আছে। অস্তিত্বে কাঠ হয়ে যাচ্ছে তার শরীর। কোনো রকম ডাকলো তোতলানো কন্ঠে,

“স্যার.. আর ইউ ওকে!”

অস্পষ্ট স্বরে ভেসে এলো,

“নো আম নট ওকে। আই নিড ইউ। আই নিড ইউ সো মাচ! ডোন্ট গো। ডোন্ট!”

জয়নব কাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। মাথা কিছুই কাজ করছে না। ফাঁকা ফাঁকা লাগচ্ছে। কোনো এক নাবিককে মাঝ নদীতে কোনো সাহায্য ছাড়াই ছেঁড়ে দিলে যেভাবে হাবুডুবু খায়, ঠিক তেমন হাবুডুবু খাচ্ছে জয়নব। তার যৌবনে শুরুতেই তার লতনো শরীরের পেঁচিয়ে আছে কোন পরপুরুষ। মনের মাঝে জেগে উঠছে অবাধ্য কিছু অনুভূতি। আচ্ছা জয়নব কি ডা. আদরের মায়া পড়ে গেছে? এমন হলে কি করে হবে? তার এখন কত কাজ বাকি? সে কি গন্তব্য ভুলে যাচ্ছে? পরক্ষণেই আবার উঁকি মারে আদরের মুখখানা।বিছানায় শুয়ে দিলো জয়নব। অজান্তে হাসে দিলো কি সুন্দর বাচ্চাদের মতো মুখ করে শুয়ে আছে লোকটি।কত নিষ্পাপ, কত মায়া মায়া তার মুখ। নিজের অজান্তেই ডক্টর আদরের গালে স্পর্শ করে বসলো জয়নব।

——————–

সেদিনের পর কেঁটে গেছে দুদিন। চৈত্রের বিষন্ন দিন গুলোতে খা খা মাঠ, ঘাটের সাথে জয়নবের বুক খা খা করছে। দুটো দিন অকারণেই পালিয়ে বেড়িয়েছে জয়নব ডা. আদরের কাছ থেকে। এদিকে শ্যামার দিয়া ডায়রির কথা বেমালুম ভুলে বসে আছে সে।

এখন টিফিন আওয়ার চলছে। কেন্টিনে চলছে হৈ-হুল্লোড়। আসড় জমেছে বন্ধু-বান্ধবদের। জয়নব আর কুয়াশা বসে আছে একটি টেবিলে কেন্টিনের এক পাশেই ৪২ ইঞ্চির টিবিতে চলছে বাংলা সিনেমা প্রেমের সমাধি চলছে। কেন্টেনের মামা খুব মগ্ন হয়ে সিনেমাটি দেখে যাচ্ছে। তা নিয়ে হাসা হাসি করছে সবাই।

দুদিন পর নবীন বরণ অনুষ্ঠান হবে। সে নিয়েও চলছে গুটুরপুটুর। কুয়াশা বলেই দিলো,

“আমিতো শাড়ি পরমু দোস্ত। সেই মাঞ্জা মারমু। দেখিস এবার বয়ফ্রেন্ড দুই তিনটা পকেটে ভরমু!”

জয়নব খিল খিল করে হেসে দিলো। দূর থেকে তার কিশোরী হাসি দেখে মুগ্ধ হলো কেউ বুঝতেই পারলো না জয়নব। জয়নব বলল,

“দোস্ত তোর কয়ডা বফ লাগরে? আগের দুইটা কি করছোস?”

কুয়াশা কাঁদো কাঁদো ভাবে বলল,

“বলিস না মামা কেডায় জানি পকেট কেটে নিয়া গেলো!”

এবার দুজনেই হেসে উঠলো। কুয়াশা বলল,

“বয়, আমি চা আর সিঙ্গারা নিয়া আসি। মামা যে ধ্যায়ানে পড়ছে আমা গো উপস থাকতে হইবো পরে!”

বলতে বলতে উঠে পরলো চেয়ার ছেড়ে কুয়াশা। আর জয়নব তাকালো টিভির স্ক্রিনে। নিউজ শুরু হয়েছে। জয়নব ছোট থেকেই নিউজের প্রতি ইন্টারেস্ট কম। সে চোখ ফিরিয়ে নিবে ঠিক সেই মুহূর্তেই ভেসে উঠলো হাস্যজ্জল চেনা পরিচিত মুখ। জয়নব অবাক হয়ে তাকালো। নিউজ বলা মেয়েটি গরগর করে বলে যাচ্ছে,

“আজ সকালে ট্রাকের সাথে সিএনজির সংঘর্ষনে নিহত হলে মেডিকেল স্টুডেন্ট সাজিয়া শ্যামা!”

জয়নব ভুত দেখার মতো তাকিয়ে রইলো। চোখ দুটি থেকে উপচে পরলো নোনাজল। চেয়ার ছেড়ে উঠে দৌঁড় লাগালো জয়নব। পিছন থেকে কুয়াশার ডাক তার কান পর্যন্ত পৌঁছালো না। শ্যামাপু এভাবে মরতে পারে তার বিশ্বাস হচ্ছেই না। এটা হত্যাকান্ড কিন্তু সে কিভাবে প্রুভ করবে জানা নেই। জয়নব তার হোস্টেলের রুমটিতে এসে দরজা লাগিয়ে ফুপিয়ে কাঁদতে লাগলো। মরণফাঁদে আর কত মানুষ মরবে বুঝতে পারছে না সে। শ্যামাপু মুচকি আসি, আদর মাখা কন্ঠ, স্নেহময় ভালোবাসা সব একে একে মনে পড়তে লাগলো জয়নবের। মনে পরলো সেই প্যাকেটটির কথা। সময় ব্যয় না করে প্যাকেটটি হাতে নিলো জয়নব। প্যাকেটি খুলতেই দেখতে ফেলো একটি আধা পোড়া ডায়েরি। জয়নবের কঁপাল কুঁচকে গেলো৷ ডায়রিটি খুলতেই চকচক করে উঠলো গোটা গোটা অক্ষরের নামটি।

“রুফাইদা নাওরিন”

জয়নব এবার শব্দ করে কেঁদে উঠলো। ছোট থেকেই রুফাইদার ডায়েরি লিখার অভ্যেস ছিলো। এটি যে তার বোনের ডায়েরি বুঝতে এক মুহূর্ত লাগলো না। জয়নব পরের পেইজ উল্টালো। অনেক লেখা মিটে গেছে। কোথাও কোথাও থেকে অক্ষর উঠে গেছে। জয়নব চোখের জলটুকু মুছে পড়তে লাগলো।

*রুফাইদা*

আজ আমার মেডিকেল কলেজের প্রথম দিন। ফুললেল শুভেচ্ছা দিয়ে বরণ করা হয়েছে। অনেক বন্ধু বান্ধব জুটেছে আমার। আয়ান, যুথি, মিফতা, মুশফিক, আঞ্জুমান, পূঁজা। আরো অনেকেই। এরা আমার ঘনিষ্ঠ তাই এদের নাম তুলে ধরলাম।

~জয়নব পেইজ উল্টালো~

আজ আমার মনে মাঝে নতুন অনুভূতি অনুভব করেছি। কিন্তু তা ভালো লাগা না মন্দ ঠিক বুঝতে পারছি না। তবে ডা. অভিনবের ব্রাউনিশ চোখ জোরা ঘায়েল করার মতো। তার্কিশ হিরোদের যেন হার মানাবেন উনি। কলেজের সবাই নাকি তার উপর মরে মরে যায়। কিন্তু আমার তেমন হচ্ছে না। মনে হচ্ছে ডা. অভিনবকে দেখলে শ্বাসকষ্ট হয় খুব।

~জয়নব অজান্তাতেই হাসলো। মনে হচ্ছে তার বোন তার সামনে বসেই কথা গুলো আওড়ায় যাচ্ছে। পাতা উল্টালো আবার।~

আজ আমাদের মর্গে মানবদেহের উপর ক্লাস চলছিলো। ডা. অভিনব স্যার ক্লাস নিচ্ছিলেন। উনি খুব সুন্দর কথা বলেন। মন ছুঁয়ে যায়। আমি মন্ত্র মুগ্ধের মতো তার ঠোঁট নাড়া দেখি। তার সাথে আমার কখনো কথা হয়নি। কিন্তু খুব ইচ্ছে করে ডা. অভিনব আজওয়াদকে বলতে,

“এই ডক্টর, আমাকে কি তোর চোখে পড়ে না। সবার দিকে তাকাস আমার দিকে তাকালে কি হয়? তোকে কি খেয়ে ফেলবো আমি?”

কিন্তু মুখ ফুটে বলতে পাড়িনা। বুকে ভিতর ব্যথা হয়। রাতে ঘুমাতে পাড়িনা। খেতে পাড়িনা। পড়াশোনায় মনোযোগ দিতে পাড়িনা। ডা. অভিনবকে নিয়ে অশ্লীল চিন্তা আসে। লজ্জায় তখন মরে যেতে ইচ্ছে করে উফ…!

~জয়নব হতবিহ্বল। রুফাইদা ডা. অভিনবকে পছন্দ করতো? ভাবতেই অবাক লাগছে! তাহলে বিজয় ভূঁইয়াকে?~

চলবে,

অন্তর্দহন_প্রণয়
লিখনীতে_সুরাইয়া সাত্তার ঊর্মি
১০

সন্ধ্যা ৭ টা বেজে কুঁড়ি মিনিট। লাল, নীল, হলুদ, সবুজ, আরো না রঙ্গে রাঙ্গানো হয়েছে কলেজ। কলেজের ভিতরেই অডিটোরিয়াম রুমে বিশাল আয়েজন করা হয়েছে। সারি সারি স্টুডেন্ট বসে আছে তাদের আসনে। সবারই গায়ে লাল-সাদা শাড়ি আর ছেলেদের গায়ে লাল-,সাদা পাঞ্জাবি। একের পর এক পারফরম্যান্স হচ্ছে।দূর থেকে দেখা যাচ্ছে ডা. আদর আর ডা. অভিনবকে। দুই রাজপুত্র সবার সামনে বসে আছেন। কি সুনরদর লাগচ্ছে তাদের। মনে হচ্ছে আধারের মাঝে, ঝিলিক মারা দুটি তারা পদর্পন করেছে অনুষ্ঠানে। তারা যদি পা না ফেলতো অনুষ্ঠান যেন ফিকে লাগতো। বোনের ডায়রি পরে ডা. অভিনবকে আরো বেশি পর্যবেক্ষন করছে ইদানীং জয়নব। এরই মাঝে উপস্থিত হয়েছে শহরের মেয়র জীবন তালুকদার। পরনে ফর্মাল ড্রেসস কোড। বয়সে ৪০/৪৫ এর কাছাকাছি। জীবন তালুকদারের বক্তৃতা শেষেই উপস্থিত হলেন কলেজের প্রিন্সিপাল সাহির আজওয়াদ। তিনি কিছু ঘন্টা আগেই আমেরিকা থেকে ফিরেছেন। জীবন তালুকদার সাহির আজওয়াদকে দেখেই এগিয়ে এসে কুশলাদি বিনয় পর্ব শেষ করে বসে পড়লেন তাদের নির্দিষ্ট আসনে। জয়নবের কাছে সাহির আজওয়াদকে বড্ড চেনা মনে হচ্ছে। বয়স পঞ্চাশের কোঠায়। অভিনব স্যারের মুখখানার মতোই মুখের গঠন। কিন্তু চোখ জোড়া ডা. আদরের মতো। কিন্তু লোকটিকে কোথায় দেখেছে কিছুতেই মনে পরছে না জয়নবের।

“ওই বুইড়া বেটাগো দিকে চাইয়া কি দেখোস?”

কুয়াশার কথা জয়নবের ভাবনা ছেদ পড়ে, সে অবাক হয়ে বলে,,

“উল্টা পাল্টা বকস কেন? আমি তো ওই লোকটারে দেখতাছি। চেনা চেনা লাগতাছে বইলা!”

কুয়াশা জহুরির মত দেখলো একবার জয়নবকে। পরমুহূর্তেই হাতে তালি বাজাবার মতো করে বলল,

“বাহ্ বইন বাহ্ তুই আমার থেকে ২০০ কদম এগিয়ে গেলি!”

জয়নব ভ্রু কুচকে বলল,

“কি কইতাছোস! ”

কুয়াশা মুখ ভঙ্গি গম্ভীর করে ফেললো। জয়নবের দিক ঝুঁকতেই জয়নবও হালকা পিছনের দিক হেলে পড়লো। কুয়াশা ফিসফিস করে বলল,

“পোলারে পছন্দ হয় না তোমার, খাইশটা ডাকো। এখন বাপের উপর নজর দাড়ি করো। মাইনশে কি কইবো দোস্ত?”

কথাটি প্রথমে ধরতে পাড়লো না জয়নব। পরে বুঝতে পেরে কুয়াশার মাথা গাট্টা মেরে বলল,

“গাধী! আমি কইছি ওই ব্যাটরে পছন্দ করি? এত দুই লাইন বুঝোস কেন?”

“আমি ভাবছি..”

কথার মাঝেই কথা থামিয়ে দিলো জয়নব। দু হাত তুলে মাফ চাওয়ার মতো ভঙ্গিমা করে বলল,

“মাফ কর আম্মা। তুই আর ভাবিস না কিছু!”

কুয়াশার মুখ চুপসে যাওয়া আমের মতো হয়ে গেল।
অনুষ্ঠান বক্তৃতার পর্ব শেষ করে আবার শুরু হলো। কুয়াশা নিজেও ভালো ডান্স পারে। সেও একক ভাবে নাচবে। তার পালা আসতেই এক ছুট। জয়নব হেসে দিলো।

জয়নব হঠাৎ করেই প্রকৃতিক ডাকে ওয়াশরুম যাওয়ার প্রয়োজন পড়তেই বেড়িয়ে পড়লো। ওয়াশরুম এসে তার কাজ সেরে, শাড়ি ঠিক করতে লাগলো। ঠিক সেই মুহূর্তে ভেসে এলো কারো আত্মচিৎকার। জয়নব হন্তদন্ত হয়ে বের হতেই দেখতে পায় আয়ান ভাইয়াকে সেই কালো কাপড় পরিহিত লোকটি ছুঁড়ি মারার চেষ্টা করছে। জয়নব দৌড়ে তাদের মাঝে এসে পড়লো। চিৎকার করে বলল,

“এই কি করছো? মারতে চাইছো কেন?”

আয়ান ভাইয়া ভয়ে আদমরা। কেঁদেই দিয়েছে। লোকটির সাথে পেরে উঠতে পারছে না। জয়নব নিজেই লোকটিকে ধাক্কা দিতে চাইলো। উল্টো কালো পোশাক পরিহিত লোকটি ওকেই ধাক্কা মেরে দিলো। জয়নব শরীরের ব্যালেন্স সামলাতে না পেয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়লো নিচে। তবুও সে থেমে নেই। আবার সামনে এসে দাঁড়িয়ে লোকের মুখের কাপড় খুলে নিতে চাইলো সে। ঠিক তখনি জয়নবের হাত পোঁচ মেরে লোকটি পালিয়ে যায়। জয়নবের মুখ দিয়ে বেড়িয়ে আসে আর্তনাদ।

————-

“আমার জান বাঁচানোর জন্য থ্যাঙ্ক ইউ ছোট আপু!”

আয়ান জয়নবের হাতে ব্যান্ডেজ করে দিতে দিতে বলল কথাটুকু। জয়নব তাচ্ছিল্যের স্বরে বলল,

“আমি আপনাকে আগেই বলেছিলাম ভাইয়া আপনি পাত্তা দেন নি আমার কথার!”

আয়ান গাল ফুলিয়ে শ্বাস ছেড়ে বলল,

“আমাকে কেন কেউ মারতে চাইবে বুঝতে পারছি না!”

“রুফাইদা আপু ও জানতো না তাকে মরতে হবে!”

এক প্রকার চমকে তাকালো আয়ান। রুফাইদা নামটি তার বুকে গিয়ে লাগলো। তোতলানো গলায় বলল,

“রু ফাই দা!”

“হ্যাঁ রুফাইদা, যাকে খুন করা হয়েছিলো নির্মম ভাবে!”

আয়ান বিস্মিত কন্ঠে বলল,

“তুমি তার..”

কথাটুকু কেড়ে নিয়ে জয়নব বলল,

“বোন!”

আয়ান আবেগে আপ্লূত হয়ে কেঁদে ফেললো। জয়নবকে জড়িয়ে ধরে বলল,

“তুমি রূপের বোন আগে বলবা না? জানো ওকে কত মিস করি। ওকে কত ভালোবাসাতাম আমি। কিন্তু ও আমার কথাই শুনলো না। কতবার না করেছি ওকে ওই পথে পা বাড়াতে কিন্তু সে…”

আবারো কথার মাঝে ফোঁড়ন কাঁটলো কারো গগনবিদারী চিৎকার। জয়নব আর আয়ন তাকালো সদর দরজার দিকে। ডা. আদর দাঁড়িয়ে আছে। রক্তিম চোখে ভস্ম করে দিচ্ছে যেন তাদের। বড় বড় পা ফেলে এগিয়ে এলেন উনি। জয়নব ভয়ে সিটিয়ে গেছে। বার বার মন বলছে, “এখন কি হবে?”

ডা. আদরের ভয়ংকর সুন্দর চোখ দুটি মেলে তাকিয়ে আছে জয়নবের দিক। অত্যান্ত ঠান্ডা গলায় বললেন,

“এই জন্যই বুঝি পালিয়ে বেড়াচ্ছো আমার থেকে?”

জয়নব কিছু মূহুর্ত কথা খুঁজে পেলো না। আয়ান তখনি বলে উঠলো,

“স্যার আপনি ভুল ভাবছেন। ও আমার বোনের মতো!”

ডা. আদর এই মুহূর্তে কিছুই যেনো শুন্তে রাজি না। আয়ানকে সেখানে থেকে যেতে বলে, জয়নবের বাহু চেপে ধরে হিসহিসিয়ে বলে,

” আমি কম কিসে মেয়ে? আমাকে কেন ফিরিয়ে দিচ্ছো? কেন ইগনোর করছো?”

জয়নব ব্যথায় রাগে হিতাহিতজ্ঞান শূণ্য হয়ে পড়লো। আদরের চোখে চোখ রেখে বলল,

“আমি আপনাকে পছন্দ করি না। প্লিজনদয়া করে আর বিরক্ত করবেন না।”

কথাটি আদরের বুকে গিয়ে লাগে। জয়নবের হাত ছেঁড়ে দিয়ে এলোমেলো দৃষ্টিতে তাকায়। ম্লান গলায় বলে,

“ঠিক আছে। আমি তোমাকে আর বিরক্ত করবো না!”

আর দাঁড়ায় না আদর যেভাবে এসেছিলো সেভাবেই ফিরে যায়। জয়নব সেখানেই বসে পরে ডুকরে কাঁদতে লাগে।

——–

বিষন্ন আরো একটি রাত কেঁটে যেতে লাগলো। নিশাচর নিশ্চুপ পাখিদের মতো চুপচাপ জয়নব নিজেও। বোনের ডায়রিটি আবারো খুলে বসলো সে।

~

আজ অনেক দিন পর ডা. অভিনব আমার দিকে তাকালেন। ভালোবাসা ছিলো না দৃষ্টিতে কিন্তু কিছু একটা ছিলো যেন আমার মনে ঘায়েল করার জন্য। আমি তার চাহনিতে স্থির হয়ে গেছিলাম। মনে হচ্ছিলো তিনি আমাকে কন্ট্রোল করতে চাইছেন। আমি হারিয়ে যেতে চাইছিলাম তার সেই চাহনিতে। কিন্তু তা বেশিক্ষণ রইলো না। পাশ থেকে একজন মেয়ের কথা শুনে সেদিন আমার স্বপ্ন চুরমার হয়ে গেলো। ডা. অভিনবের নাকি গার্ল ফ্রেন্ড আছে। তাউ তাদেরই ব্যাচমেট। কিন্তু কে? তা কেউ আজো জানতে পারেনি। এইটুকু কথা আমার মনে ঝড় তোলার মতো হয়েছিলো। সেদিন আমি কেঁদে কুঁটে বাসায় চলে যাই। ঠিক সাত দিন পর আবার ফিরে আসি মনের সাথে লড়াই করতে করতে। ঠিক সেই দিনেই ঘটলো ঠিক অদ্ভুত ঘটনা…

চলবে,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here