অন্তর্দহন_প্রণয়,পর্ব-৪
লিখনীতে_সুরাইয়া সাত্তার ঊর্মি
নির্জন করিডোর ধরে পা টিপে টিপে ভিরু পায়ে এগিয়ে যেতে লাগলো জয়নব। এই হাসপাতালে করিডোর দিনের বেলা হাজার বার হেটে ক্লাস করতে যায়। কিন্তু এখন অবস্থা ভিন্ন রাতের আধারে লুকিয়ে, চুরিয়ে যাচ্ছে মর্গের দিকে। পর পর আর দুটি লাশ পাওয়ার খবর শুনে মনের সন্দেহ দূর করতে চায় সে। ভয়ে থরথর করে কেঁপে যাচ্ছে জয়নব। বিন্দু বিন্দু ঘামে বেয়ে পরছে কঁপাল চুয়ে গলা ঘারে।
“উম..উম..উম!”
নিস্তব্ধ অন্ধকার করিডর থেকে মেয়েলী গোঙ্গানি আর ধস্তাধস্তির আওয়াজ কানে আসতেই পিলে চমকে উঠে জয়নবের। শ্বাসরূদ্ধ কর অবস্থা যেন তার। জয়নব ভয় টুকু টুপ করে গিলে নিলো। মর্গের ভিতর থেকেই আসচ্ছে এই শব্দ। জয়নব দ্রুত পা চালিয়ে দরজা ধাক্কা দিয়ে খুলে থম মেরে গেলো। একটু মেয়েকে হাত পা বেঁধে মাটিতে ফেলে রেখেছে। মেয়েটির উপর আরেকটি লোক ঝুঁকে আছে। কি যেন করছে। ধর্ষন নয় তো? ভেবেই গা কেঁপে উঠলো জয়নবের। এদিক ওদিক তাকিয়ে সামনেই পড়ে থাকা বালতি দিয়ে বাড়ি দিতে লাগলো জয়নব । লোকটি কুকিয়ে উঠলো৷ এক ধাক্কা দূরে সরিয়ে দিলো জয়নব। মেয়েটির কাছে আসতেই চক্ষু চড়কগাছ। সিনিয়র যুথী আপু । যে কি না খাবার টেবিলে তার সাথে রুড ব্যবহার করে ছিলো। জয়নব এক পলক তাকিয়ে হাত পা খুলে দিতে লাগলো। খুলা শেষে কোনো কথা না শুনেই আবার মারতে লাগলো নিচে পড়ে থাকা লোকটিকে। এদিকে যুথীও চেঁচিয়ে বলে যাচ্ছে,
” আরে আরে করছে কি তাকে মারছো কেন? ছাড়ো ছাড়ো?”
জয়নবের কানে কোনো কথাই ঢুকলো। চোখের সামনে বোনের মুখটি ভেসে উঠতেই মাথায় চরচর করে রাগ বেরে গেলো। থাম থুম মারা শুরু। লোকটি যেন পেরে উঠছেই না তার সাথে। ধাক্কা দিতে চেষ্টা করেই যাচ্ছে। পিছন থেকে যুথিও টেনে উঠাতে পারছে না। বার বার বলছে,
” জয়নব কি করছো? ছাড়ো উনাকে, ছাড়ো। এই মেয়ে কি করছো।”
মর্গে তখন-ও আধো আলো। লোকটি মাস্ক পড়া। চেহারা এখনো আবছায়া। জয়নব লোকটির উপর চড়ে বসেছে। এলোপাতাড়ি থাপড় মেরেই যাচ্ছে।লোকটি এবার জয়নবকে উল্টে ফেললো। তার উপর চড়ে নিজেকে রক্ষা করতে চাইলো। তখন পাশের বালতি দিয়ে দাপাস করে মাথায় এক বাড়ি বসিয়ে দিতে লোকটি “আহ্” বলে কুকিয়ে উঠলো। আর্তনাদ শোনা গেলো যুথির মুখে থেকে-ও,
“আদর স্যার!”
আদর নামটা কানে যেতেই হীম হয়ে গেল শরীর। ভয়ে ভয়ে তার উপর ঝুকেঁ থাকা লোকটি দিকে চাইলো মুখে এখনো মাস্ক। রক্তিম ফ্যাকাসে চোখ দুটি ভাঙ্গা চশমার আড়ালে তীর্যক দৃষ্টি নিক্ষেপ করছে। চোখ দিয়ে গিলে ফেলবো টাইপ। মাথা এক হাত দিয়ে চেঁপে ধরে উঠে বসলো আদর। রক্ত বের হচ্ছে কঁপাল ফেঁটে। যুথী কাঁদো কাঁদো মুখ নিয়ে তাকিয়ে আছে। জয়নব অসহায় চোখে তাকিয়ে আছে তাদের দিকে। যুথি ব্যস্ত হয়ে পড়লো,
“স্যার আপনি ঠিক আছেন? আম সরি, আমাকে বাঁচতে এসেই আপনি ইনজুরি হয়ে গেলেন।”
জয়নবের মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়লো। ডাঃ আদরকে এখনো সে চোখে দেখেনি। আর এই অবস্থা যে কেউ ভাববে যুথীকে কেউ রেপ করার চেষ্টা করেছে। জয়নব উঠে বসলো। জড়সড় ভাবে বলল,
“আমি ভেবেছিলাম আপু কেউ তোমাকে রেপ করতে চাইছে! তাই…!”
যুথী কিড়মিড় করে উঠলো,
“তাই না বুঝে এসেই স্যারের উপর হামলে পড়েছো। দেখো রক্ত পড়ছে মাথা ফেটে। সরি স্যার প্লিজ কিচু মনে করবেন না। আসুন আমি ড্রেসিং করিয়ে দিচ্ছি!”
আদর রক্তিমা ফ্যাকাসে চোখ দুটি এক পলক দেখে বেড়িয়ে গেলো। টু শব্দটি করলো। এ দিকে জয়নব অবাক। যার জন্য করলো চুরি সেই বলে চোর? বাহ্।
—————
সকালের মিষ্টি রোদ খেলা করছে হাসপাতালের রুম গুলোর দিকে। চারিদিকে ছুটছে মানুষের দল বল। কেউ দৌড়চ্ছে ঔষধের জন্য? কেউ ডাক্তার দেখাবার জন্য, কেউ বা ভর্তি হতে, আবার কেউ বা স্বজন প্রীতির হারাবার টানে। জয়নব ছোট শ্বাস ছাড়লো হাসপাতালের রুটিন মাফিক কাজের সাথে এসব ও যেন জড়িয়ে গেছে নিত্যাদিনের জীবনে। জীবনটা বড্ড বিচিত্র। ছোট বেলায় বাবা-মার সাথে হাসপাতালে এলে মনে হতো এদের কত মজা। দিন রাত ডাক্তারের পোষাক করে এদিক ওদিক ছোটা, মানুষকে নিয়ে এদের খেলা খুব ইন্টারেস্টিং লাগতো। বস থেকে বেশি রুফাইদার। তাই তো সেদিন চট করে বলে ফেলেছিল,
“বাবা, আমি বড় হয় ডাক্তার হবো! ”
সাইফ তখন খুশিতে আত্মহারা। সে চাইতো তার মেয়ে ডাক্তার হোক। স্বপ্ন পূরণের কয়কে কদম আগেই মেয়েটি হারিয়ে গেলো। ভেঙ্গে চুরমার হলো তার স্বপ্ন, তার পরিবার। ছোট শ্বাস সুপ্তপূর্নে টুপ করে গিলে নিয়ে পা বাড়ালো ডাঃ আদরের কেবিনে। বুকের মাঝে চিন চিন ব্যথা করছে জয়নবের। লোকটি কেন তাকে ডাকে পাঠালো? মাথায় খেলছে না। কি চায় সে? কাল রাতের জন্য তাকে কলেজ থেকে বের করে দিবে না তো? তেমন হলে তার সব প্ল্যান ভেস্তে যাবে। তাহলে? সত্যি এমন হলে কি করবে জয়নব? ডাঃ আদরের হাত জোর করবে? দরকার পড়লে পা পড়ে যাবে। বন্ধ ঘরেই বা কে দেখতে আসচ্ছে তাকে? জয়নব সাহস সঞ্চয় করছে ভুড়ি ভুড়ি। কিন্তু আর বেশিক্ষণ রইলো না। কেবিনে ডুকতেই বেলুনের মতো চুপসে গেলো যেন।
নাতিশীতোষ্ণ ঘরটির কোনে ভনভন করে এসির শব্দ হচ্ছে। এত ঠান্ডার মাঝেও মাথার পাশটায় ঘামের বিন্দু। জয়নব দাঁড়িয়েই রইলো মাথা বুকের সাথে লাগিয়ে।
হালকা লেমন কালারের একটি ফুল হাতা শার্ট। মুখে সবুজ মাস্কের উপর ওয়ানটাইম মাস্ক। মাথা ঝাকড়া চুল।মাথার এক পাশে ব্যান্ডেজ করা। সুদর্শন, দীর্ঘাকায় এক যুবক জয়নবের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। যুবকটির চোখ রীতিমতো খেলা করছে কিশরীর উপর। কিশোরী গায়ের রং চাপা। জিড়ো ফিগার, ঘন ভ্রু যুগেলের চোখ গুলো পিট পিক করে। করমচার মতো ঠোঁট গুলো কাঁপছে। যুবকটি যেন নিজের আনমনেই বলে ফেললো,
“মা শা আল্লাহ! ”
কথাটি কান পর্যন্ত পৌঁছাতেই চোখ দুটি তুলে তাকায় জয়নব,
“এক্সকিউজ মি! স্যার কিছু বললেন? ”
ডাঃ আদর কেশে উঠলেন। চেয়ারটা পিছনের দিক ঠেলে আরম করে হেলে বসলেন। হাতের কলম ঘুরাতে ঘুরাকে কথা ঘুরিয়ে বললেন,
“তো আপনি মিস, রুবাইদা জয়নব?”
জয়নব এবার লোকটিকে দেখলো। ফ্যাকাসে চোখের শ্বেতাঙ্গ যুবকটি তার দিকেই শান্ত অথচ যেন ধারালো দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন। জয়নব তাকিয়ে রইলো তার চোখের দিকে। মাথা নাড়িয়ে বলল,
“জি স্যার! ”
“তো রাতে আধারে মর্গের সামনে কি করতে গেছিলেন??যতটুকু জানি আপনার হোস্টেল তো তার উল্টো দিকে?”
চমকে তাকালো জয়নব। যেন চোর ধরা পড়ে গেছে টাইপ। শুকনো ঢুক গিলে তোতলাতে তোতলাতে বলল,
” আ..মি, আ..মি ফোনে কথা বলতে বলতে ওখান কিভাবে যেন চলে গেছিলাম!”
“এত রাতে ফোন কথা বলছিলেন? কার সাথে?”
প্রশ্নটি এমন ভাবে ছুঁড়ে দিলো ডাঃ আদর যেন স্পষ্ট অধিকারবোধ। জয়নব এবার সরাসরি তাকালো ডাঃ আদরের ফ্যাকাসে চোখ দুটোর দিক।শান্ত, স্থীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ডাঃ আদর।
“ইটস পার্সোনাল স্যার!”
চোয়াল কিছুটা শক্ত হয়ে এলো। গভীর শ্বাস টেনে উঠে এসে দাঁড়ালো জয়নবের মুখোমুখি। জয়নব কিছুটা ঘাবড়ে দু পা পিছিয়ে গেলো। ডাঃ আদর মিষ্টি করে হাসলো। জয়নবের কানের কাছে এগিয়ে ফিসফিস করে বলল,
“বয়ফ্রেন্ড জনিত রোগে ভুগছেন বুঝতে পারছি!”
স্তম্বিত হলো জয়নব। রাতের মতোই হীম হয়ে গেলো শরীর। শির শির করতে লাগলো পায়ের পাতা। এ কেমন অনুভূতি? ডাঃ আদর মিটিমিটি হেসে দরজা খুলে বের হতে নিলো। ঠিক তখনি ভেসে আসা জয়নবের রিনঝিনে কন্ঠে থেমে গেলো। ভ্রু কুচকে সন্দেহ দৃষ্টিতে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলো জয়নব,
“এতে রাতে আপনি কি করছিলেন মর্গের এখানে..স্যার??”
চলবে,