হৃদপিন্ড,পর্ব-১৮,১৯
জান্নাতুল নাঈমা
পর্ব-১৮
দিহান চমকে পিছন ঘুরতেই মেঝেতে ইয়া বড় এক লাঠি দেখতে পেলো, মুসকানের কন্ঠও তাঁর কানে পৌঁছেছে ভ্রুযুগল কুঁচকে সায়রীর দিকে তাকালো।
সায়রী চোখের পানি মুছে নিজেকে স্বাভাবিক করে বললো মুসকান।
দিহান ভ্রু কুঁচকেই বললো ডাকাত মানে আর লাঠি।
সায়রী বাম হাতে ডান হাতের কনুই চেপে এক দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো তুই।
দিহান হকচকিয়ে গেলো ভ্রু উঁচিয়ে বললো আমি ডাকাত।
সায়রী কিছু বললো না, অন্যদিক চেয়ে রইলো।
দিহান অন্যদিকে মন না দিয়ে আবারও সায়রীর অনেকটা কাছে গিয়ে দাঁড়ালো।
–কেমন আছিস।
–সেটা তোর না জানলেও চলবে কেনো এসেছিস এখানে চলে যা।
–স্যাট আপ,,, আমি এখানে তোর জন্য আসিনি। আমি এসেছি আমার মেয়ের জন্য। আমি এসেছি আমার মেয়ের মা কে আপন করে নেওয়ার জন্য রেডি থাকিস নেক্সট ফ্রাইডে বিয়ে।
–হোয়াট! পাগল হয়ে গেছিস তুই। এতোগুলো বছর পরও তোর মাথা থেকে ভূত নামলো না। আমার পক্ষে তোকে বিয়ে করা সম্ভব নয়। এখন তো কোনভাবেই নয়। সময় গড়িয়েছে অনেক,জীবনটাও এগিয়ে গেছে অনেকটা। যা তখন সম্ভব হয়নি তা এখনো সম্ভব হবেনা। আমার মেয়েটাও এখন বড় হচ্ছে এখন তো কোনভাবেই পসিবল না।
–ভূত তো চাপেনি চেপেছে তো পেত্নী। পুরুষ মানুষের ঘাড়ে পেত্নী চাপলে সে কি আর যায় বল।
সায়রী তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকালো।
দিহান সায়রীকে এক টানে নিজের সামনে নিয়ে মুখোমুখি মুখ করে অগ্নি দৃষ্টিতে চেয়ে বললো এখনো তোর একা থাকার শখ মেটে নি,,,
একহাতে কাঁধে ধরে আরেক হাতের আঙুল ওঠিয়ে বললো আমি দেশে এসেছি শুধু তোর জন্য,,,
অনেক ছাড় দিয়েছি তোকে আর না।
সোজা আঙুলে ঘি না ওঠলে এবার দিহান আঙুল বাঁকা করে নেবে মনে রাখিস।
পাঁচ বছর আগের দিহান আর পাঁচ বছর পরের দিহান কে তুই গুলিয়ে ফেলিস না। সেদিন হয়তো আমার তোর প্রতি বেশীই দূর্বলতা ছিলো, সেদিন হয়তো আমি বেশীই আবেগপ্রবন ছিলাম।
কিন্তু এখন না আছে দূর্বলতা আর না আছে আবেগ।
–তাই দূর্বলতা, আবেগ যখন নেই তাহলে কেনো এসেছিস। চলে যা, এতোগুলো বছর যখন থাকতে পেরেছিস সারাজীবন ও পারবি।
দিহান সায়রীর দুগালে দুহাতে আলতো করে চেপে চোখ দুটো বন্ধ করে ফেললো।
কিভাবে ছিলাম তা এক উপরওয়ালা আর ইমন ই ভালো জানে, তুই তো একটা খোঁজ নেওয়ার প্রয়োজন মনে করিসনি।তোরা মেয়েরা বড্ড পাষান।
কি করে তোরা পারিস কে জানে।
বন্ধুত্বের টানেও কি পারতিনা একটা খোঁজ নিতে?
আট বছরের বন্ধুত্বকে কিভাবে ভুলতে পারিস তুই।
এতোটা নিষ্ঠুর তুই কিভাবে হতে পারিস।
চোখ বেয়ে অনবরত পানি ঝড়ছে,,,বুকের ভিতর চাপা কষ্ট গুলো যেনো হঠাৎ ই সমুদ্রের ঢেউয়ের মতো উতলিয়ে ওঠেছে।
দুহাতে দিহানের হাত ধরে ছাড়িয়ে নিলো নিজের গাল দুটো। খানিকটা পিছিয়ে গিয়ে বললো অহেতুক কথা-বার্তা বলিস না।আমাকে বিয়ে করার ভুল সিদ্ধান্ত থেকে পিছিয়ে আয়।
তুই অবিবাহিতা, চাইলেই আমার থেকে অনেক ভালো মেয়েকে জীবনসঙ্গী হিসেবে পাবি। আমাকে বিয়ে করে তুই কি পাবি বল??
কি আছে আমার মধ্যে এখন,, এই শরীরটা পবিএতার নাম করে অপবিএ হয়েছে।
এই গর্ভে আমার ভুল ভালোবাসা আর কারো বিশ্বাসঘাতকার ফল ধারন করেছি।
কিচ্ছু নেই কি পাবি বল। বরং সারাজীবন অন্যের সন্তানের বোঝা মাথায় নিতে হবে।
শেষ কথাটা বলে শেষ করতে না করতেই ঠাশিয়ে এক থাপ্পড় দিলো দিহান।
সায়রী গিয়ে দেয়ালে পড়লো দুহাতে দেয়াল ধরায় মাথাটা লাগেনি। বেশ ভয় পেয়ে গেলো, এক ঢোক গিলে ঘুরতে নিতেই দিহান ওর দুগালে শক্ত করে চেপে ধরে বললো — তোর সাহস কি করে হয় আমার মেয়েকে অন্যকারো সন্তান বলার। সেদিন কিছু বলিনি বলে যে আজ বলবো না সেটা ভাবিস না।
অনেক সহ্য করেছি আর না,,
ডেলিভারির সময় কোথায় ছিলো তোর ভুল ভালোবাসা, কোথায় ছিলো তোর বিশ্বাস ঘাতক।
হসপিটালের সমস্ত ফরমালিটি আমি পূরন করেছি বাবার জায়গায় আমার নাম ছিলো,আছে আর ভবিষ্যতেও থাকবে। সুপ্তি আমার মেয়ে বুঝেছিস তুই যদি বেশী বাড়াবাড়ি করিস তুই তোর মেয়ে কে হারাবি মনে রাখিস বলেই দুগাল ছেড়ে পিছন ঘুরে দাঁড়ালো। রাগে হাত-পা কাঁপছে তাঁর নিঃশ্বাস চলছে সমান গতিতে।
সায়রী দুহাতে মুখ ঢেকে ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠলো
দিহান কান্নার শব্দ পেতেই চমকে গেলো।
পিছন ঘুরতেই সায়রীর কান্না দেখে বুকের ভিতর টা মোচড় দিয়ে ওঠলো তাঁর চোখ দুটো বন্ধ করে এক দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে সায়রীকে জরিয়ে নিলো বুকের মাঝে।
,
মুসকান চুপচাপ মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে।
ইমন কঠোর চাহনীতে চেয়ে আছে তাঁর দিকে।
বিছানায় বসে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি ছুড়ছে সে।
মুসকান ভয়ে এবার কাঁপতে শুরু করেছে। চোখ তুলে তাকানোর সাহসটুকুও সে পাচ্ছে না।
মনে মনে শুধু আল্লাহকে ডাকতে লাগলো।
তবুও ইমন তাঁর দৃষ্টি সরালো না।
চোখ বেয়ে পানি বেরিয়ে এলো, গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে, এভাবে বাঘের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মশকিল হয়ে পড়ছে। উপায় না পেয়ে মিনমিন করে বললো সরি,,,
ইমন একবার নিজের হাতের দিকে আরেকবার মুসকানের দিকে চাইলো।
মুসকান আরো দ্বিগুন ভয় পেয়ে গেলো।
অপরাধীর মতো মুখ করে বললো সরি, আমি বুঝতে পারিনি আপনি বলেই কেঁদে ফেললো।
ইমন আবারো নিজের হাতের দিকে তাকালো দাঁতের দাগ স্পষ্ট হয়ে আছে, রাগে সে দাঁতে দাঁত চেপে বললো এ বাড়িতে ডাকাত পড়বে কেনো?? দাড়োয়ানকে কি ঘাস কাটার জন্য রাখা হয়??
না জেনে না বুঝে লাঠি নিয়ে মারতে গেছো আমি ঠিক সময় না আসলে কি হতো ভাবতে পারছো??
মূহুর্তেই মুসকান চমকে ওঠলো।
মাথায় হাত দিয়ে হায় আল্লাহ আপা তো একা, তারাতারি চলুন ওখানে ডাকাত এসেছে বলেই রুমের বাইরে পা বাড়াতে নিতেই ইমন চট করে ওঠে দাঁড়িয়ে দ্রুত মুসকান কে টেনে রুমের ভিতর এনে দরজা লক করে দিলো। দেয়ালে ঠেকিয়ে দু কাঁধে চেপে ধরে ধমক দিয়ে বললো বলছিতো কোন ডাকাত আসেনি।
মুসকান জোর গলায় প্রায় চিল্লিয়েই বললো ডাকাত এসেছে,আমি দেখেছি আপার সাথে ধস্তাধস্তি করছে।
ইমন মুসকানের কাঁধ থেকে হাত সরিয়ে হাতটা কোমড়ের কাছে নিয়ে একদম পেচিয়ে নিজের খুব কাছে নিয়ে এলো। আঙুল দিয়ে ঠোঁট চেপে কঠোর গলায় বললো আমার বন্ধু দিহান এসেছে। আর দিহান সায়রীরও বন্ধু। ডাকাত এলে অবশ্যই আমি এতোক্ষন এখানে চুপচাপ হাত গুটিয়ে বসে থাকতাম না।
এবার মুসকানের যেনো হুঁশ ফিরলো।
সত্যি তো ওনি তো কিছুই বলছে না। তাহলে কে লোকটা মনে প্রশ্ন ওঁকি দিতেই তা মুখে আসতে নিয়েও পারলো না।
ইমনের গভীর দৃষ্টি তে আটকে গেলো সে।
ঠোঁট জোরা ইমনের আঙুলে বন্দী।
নিঃশ্বাসের বেগ যেনো দমকা হাওয়ার মতো বেড়ে গেলো। কানের কাছে ইমনের গভীর কন্ঠস্বর ভেসে এলো।
–আমার বাড়ি ডাকাত পড়েনি। তবে বেশ আগেই পাক্কা বাঘিনীর অবস্থান ঘটেছে। সেটা আমার প্রথম দিনই বোঝা উচিত ছিলো। বিষহীন দাঁতে কামড় বসিয়ে তো কোন লাভ নেই,,,
মুসকান ভ্রু উঁচু করে বড় বড় চোখ করে চেয়ে এক ঢোক গিললো।
ইমন সেই চাহনী দেখে বাঁকা হেসে বললো
“চোখের ইশারায় যদি হৃদস্পন্দন থেমে যায়
মন তো সকল বাঁধ্যতা ভুলে গিয়ে এই ঠোঁটে প্রেম ছোঁয়াতে চায়”
কথাটা শোনা মাএই মুসকানেরও যেনো হৃদস্পন্দন থেমে গেলো।
–ওনাকে কামড় দিয়েছি বলে কি ওনিও আমায় কামড় দিবে নাকি এমন বলছে কেনো মুখে কামড়াবে ওরে আল্লাহ যে করেই হোক ওনার থেকে মাফ চাইতে হবে আমাকে।
ধীরে ধীরে ইমন তাঁর ঠোঁট জোরা এগুতে নিতেই
মুসকান চোখ দুটো বন্ধ করে ভয়ে ভয়ে বললো বিশ্বাস করুন আমি জানতাম না আপনি, আমি ডাকাত ভেবেই কাজটা করেছি।
কথাটা শোনা মাএই ইমন হকচকিয়ে গেলো।
মুসকানকে ছেড়ে কাশতে শুরু করলো।
মুসকান ঘাবড়ে গেলো ভীষন দৌড়ে গিয়ে গ্লাসে পানি ভরে ইমনের সামনে দিলো।
ইমন পানিটা খেয়ে গ্লাসটা মুসকানের হাতে দিয়ে বিছানায় গিয়ে বসলো।
ওহ গড,, আমি কি বললাম এই মেয়ে কি বুঝলো।
ইশ মিসটেক হয়ে গেলো ভীষন, আমার বোঝা উচিত ছিলো এই মেয়ের মাথায় এসব ঢুকবে না।
হাভভাব এমন যেনো পাকা বুড়ি, সর্ব গুনে গুণান্বিত।
শুধু পড়াশোনা,কাজ, আর সব কাজ জানলেই কি সে সব জানতা হয়ে যায়। একে মানুষ করতে টাইম লাগবে। কিশোরী নাম যে কবে ঘুচবে ভেবেই গভীর শ্বাস ছেড়ে মাথা ধরে শুয়ে পড়লো।
মুসকান অপরাধীর মতো মুখ করে বিছানার পাশে দাঁড়িয়ে বললো আমি মাথা টিপে দিবো।
ইমন কিছু বললো না।
মুসকান আবারো বললো আমি মাথা টিপে দেই ভালো লাগবে।
ইমন বেশ রেগেই বললো তুমি আমার সামনে থেকে যাও নিজের রুমে গিয়ে চুপচাপ ঘুমাও।
–ইশ ওনি অনেক রেগে গেছে,রাগারই তো কথা কি ভয়ংকর কাজটাই না করেছি ছিঃ। দাদী জানলেও আমার ওপর রেগে যাবে। কি করলে এখন ওনার মন ঠিক হবে। আমি ওনাকে আঘাত করেছি ওনি আমাকে করুক তাহলেই সমানে সমান।
আচ্ছা এই ভালো একটু ব্যাথাই তো আমি ঠিক সহ্য করতে পারবো।
–শুনুন,,
–হুম বলো।
–আমি আপনার হাতে কামড় দিয়েছি আপনি আমার হাতে দিয়ে দিন শোধবোধ।
ইমন চোখ খুললো, মুসকানের বোকামি মাখা কথা শুনে প্রচন্ড হাসি পেলো তাঁর। মুসকানের মুখের দিকে চাইতেই অদ্ভুত এক ভালো লাগায় ছেয়ে গেলো।
মুখটা বেশ মলিন ইমন তাঁর ওপর রেগে আছে তাই ভেবে তাঁর মনের আকাশে মেঘ জমেছে। বেশ বুঝতে পারলো ইমন। এই মেয়েটার সবটা সে বুঝতে পারে এখন। এই মেয়েটা যে তাঁর সবটা জুরেই রয়েছে।
এই মেয়েটা এখন তাঁর অভ্যেস, এই মেয়েটা এখন তাঁর ভালোলাগা মন্দ লাগার সাথে ওতোপ্রোতো ভাবে জরিয়ে আছে।
–কি হলো দিন না, তারপরই আমি চলে যাবো।
ইমনের ঘোর কাটলো মুসকান হাত পেতে আছে,
তাঁর ভাষায় শোধবোধ করার জন্য।
কি যেনো হয়ে গেলো তাঁর নেশাভরা গলায় বললো আমি শোধবোধ সহজভাবে করিনা, যতোটা আমি পেয়েছি তাঁর দ্বিগুণ ফেরত দিবো বলেই একটানে মুসকান কে নিজের ওপর ফেললো।
একহাতে কোমড় জরিয়ে আরেকহাতে ঘাড়ে চেপে গলায় গভীরভাবে ঠোঁট ছোঁয়ালো। মুসকানের অদ্ভুত কাঁপুনি, শ্বাস অনুভব করতেই শোধবোধ করার জন্য কামড় বসালো।
ব্যাথা পেলেও টু শব্দ টি করলো না সে,শুধু দুহাতে শক্ত করে চেপে ধরলো ইমনের শার্ট। চোখ বেয়ে কয়েকফোঁটা নোনা জল বেরুলে যার একফোঁটায় ইমনের শার্ট ভেদ করে কাঁধে শীতলতা অনুভূত হলো।
হাত আলগা হয়ে এলো তাঁর।
মুসকান লজ্জায়, ভয়ে মিইয়ে গেলো।
ইমন এক নজর মুসকান কে দেখে চোখ দুটো বন্ধ করে বললো বেরিয়ে যাও জাষ্ট ফাইভ সেকেন্ড।
হুমকির স্বরে কথা বুঝেই মুসকান দ্রুত রুম ছেড়ে বেরিয়ে গেলো।
সায়ু,,,
এই সায়ু,,,যতো পারিস কেঁদে নে আজ। আজকের পর আর তোকে কাঁদতে দিবো না সায়ু। একটা বার শুধু তুই আমাকে গ্রহন করে নে সায়ু। তোর জীবনের সব না পাওয়া, সব ভালো লাগা সব ভালোবাসা উজার করে দেবো আমি।
সায়রী কেঁদেই যাচ্ছে এতো স্ট্রং মেয়েটা যেনো কয়েক মিনিটের বেবধানেই ভেঙে চুরমার হয়ে গেছে।
সকল দূর্বলতারা ঘিরে ধরেছে তাকে।
দিহান আরো গভীরভাবে জরিয়ে নিয়ে মাথায় কিস করলো।
–আমি তোর শরীর চাইনা সায়ু, আমি শুধু তোকে চাই, আমি তোর সন্তান এর বাবা হতে চাই। আমার সবটা জুরে আগেও তুই ছিলি,এখনো আছিস ভবিষ্যতেও শুধু তুই ই থাকবি সায়ু তুই ই থাকবি।
বলেই সায়রীর গাল দুটো ধরে মুখ ওঠালো।
সায়রী চোখ বুঁজে কেঁদেই চলেছে দিহান বুড়ো আঙুলে গাল মুছে বললো সায়ু ঐ দিন রাত তিনটার দিকে আমার স্বপ্নে কিউট একটা বাচ্চা মেয়ে এসে আমার হাত ধরে খুব ডাকাডাকি করছিলো তখনি ফোনের শব্দে ঘুম ভেঙে যায়।ফোন টা ছিলো ইমনের ছুটে হসপিটালে যাই আমি, ইমন পারতো নিজে সবটা করতে কিন্তু করেনি কারন ও জানতো পৃথিবীতে সায়রীর জন্য আর কেউ থাকুক বা না থাকুক এই দিহান আছে। আর ওর জন্য এই এক দিহানই যথেষ্ট। সব ঠিক ছিলো সায়ু তুই সেদিন শুধু তুই ঠিক ছিলি না।
সায়রী চোখ খুলে তাকালো দিহানের দিকে।
দুটো চোখ এক হলো,দুটো মুখ মুখোমুখি।
–সত্যি সব ঠিক ছিলো দিহান??
দিহান আবারো হাইপার হয়ে গেলো।
–হ্যাঁ সব ঠিক ছিলো। তুই যদি শিশিরের মতো বিশ্বাস ঘাতকের হাত ধরে তোর পুরো পরিবারের বিরুদ্ধে যেতে পারিস মাএ একবছরের পরিচয়ে তাহলে আটবছরের বন্ধুত্বকে কেনো ভরসা করতে পারলি না। তুই ঠিক থাকতি সায়ু শুধু তুই ঠিক থাকতি।
সায়রী আবারো চোখ বুজে ফেললো। কান্নামিশ্রিত গলায় বললো –একবার এক পরিবারকে অসন্তুষ্ট করে যে ভুল করেছি সেই ভুল আবার কি করে করতে পারি বল তুই।
দিহান ছেড়ে দিলো সায়রীকে আর এক মূহুর্তও দেরী করলো না সে সোজা সায়রীর রুমে গিয়ে সুপ্তি কে ঘুমন্ত অবস্থায়ই কোলে নিয়ে বের হতে লাগলো।
সায়রী ছুটে এসে বললো- দিহান পাগলামো করিস না, ছাড় ওকে।
দিহান এক ঝটকায় সায়রীর হাত ছাড়িয়ে দিয়ে বললো পাগল করে দিয়ে এখন বলছিস পাগলামো করিস না। মনে রাখিস পাঁচ টা বছর পর আমি ফিরে এসেছি এমনি এমনি না। আমাকে আর আমার মেয়েকে একা সময় কাটাতে দে নয়তো চিরদিনের মতো মেয়ে কে হারাবি। বলেই বেরিয়ে পড়লো।
সায়রী চুপচাপ সেখানেই ঠায় দাঁড়িয়ে রইলো।
সে খুব ভালো করেই জানে দিহান যেমন ভালোর ভালো খারাপের খারাপ। যেহেতু জেদ ওঠেছে সুপ্তিকে নিজের কাছে রাখার সেহেতু আর কারো কিছু করার নেই।
কিন্তু ভয় একটাই সুপ্তি দিহানকে দেখলেই চিনে ফেলবে। আর একবার যদি দিহান বুঝে যায় তাহলে দিহানের হাত থেকে রক্ষা নেই।
কিন্তু দিহান যা চায় তা তো সম্ভব নয় ওর পরিবার কোনদিন এই সম্পর্ক টা মেনে নেবে না।
কোন পরিবার চাইবে এমন একটা সম্পর্ক মানতে,,,
এক দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে সায়রী নিজের রুমে চলে গেলো।
সারা রাত নির্ঘুম কাটলো তাঁর ।
,
সারারাত ইমনের ঘুম হলোনা। প্রচন্ড রাগ হচ্ছে নিজের ওপর আঠারো,ঊনিশ বয়সী যুবকদের মতো এতো অবুঝ পানা করে ফেলবে ভাবতেও পারেনি।
“রাগ হচ্ছে নিজের নিয়ন্ত্রণহীনতার ওপর।
রাগ হচ্ছে মুসকানের অবুঝ মনের ওপর”
রাগ হচ্ছে এটা ভেবেই যে তাঁর অনুভূতি টা মুসকান না বুঝেই শোধবোধ করার বায়না করলো।
চলবে..
হৃদপিন্ড
জান্নাতুল নাঈমা
পর্ব-১৯
ঘুম ভাঙতেই এতো বড় সারপ্রাইজ পাবে ভাবতেও পারেনি সুপ্তি, বাবাই বলেই চিল্লিয়ে ওঠলো।
দিহানের ঘুম ভেঙে গেলো। সুপ্তির উৎসুক চাহনী,হাসি মাখা গুলুমুলু গাল দুটো দেখে তাঁর বুকটা যেনো শীতলতায় ভরে ওঠলো।
“ভালোবাসা জিনিসটাই যে এমন।
যাকে ভালোলাগে যাকে আমরা ভালোবাসি তাঁর সব কিছুই আমাদের ভালোলাগে।
তাঁর ভালো লাগাতে আমাদের বুকের ভিতর ভালোলাগায় ছেঁয়ে যায়।
তাঁর খুশিতে আমাদের মন-প্রান জুরে খুশিরা ওকি দেয়।
তাঁর সুখে আমরা সুখী,তাঁর দুঃখে আমরা দুঃখী।
এটাই যে ভালোবাসার নিয়ম।
প্রিয়জনের প্রিয় জিনিসগুলোও আমাদের বড্ড প্রিয় হয়। প্রিয়জনের প্রিয় জিনিসের প্রতি যদি আমাদের ভালোলাগা না থাকে, আমাদের প্রিয় না হয় তাহলে বুঝতে হবে মানুষ টাই আমাদের প্রিয় নয়।
যদি সে আমাদের প্রিয় হয় তো তাঁর সাথে জরিত,তাঁর সাথে সম্পর্কিত সবটাই আমাদের প্রিয় হবে।
তাঁর অপ্রিয় জিনিসগুলোও আমাদের অপ্রিয় হবে।
যেমনটা ছয়,সাত বছর আগে নিজের প্রিয়তমার প্রেমিক কেও ভালো লাগতো দিহানের।
আর এখন তাঁর প্রিয়জনের সর্বোচ্চ প্রিয় জিনিসটাই তাঁর কাছে রয়েছে। সামনের এই বাচ্চা টা শুধু তাঁর প্রিয় নয়, এই বাচ্চা সেই বাচ্চা যে কিনা পৃথিবীতে আসার আগমনী বার্তা তাঁর মায়ের পরে তাঁকে দিয়েছে। হ্যাঁ যেদিন থেকে দিহান জানতে পেরেছিলো সায়রী প্র্যাগনেন্ট সেদিন থেকে এমন কোন রাত নেই যে তাঁর স্বপ্নে ছোট্ট কিউট বাচ্চা না আসতো।
কখনো হাতে ধরে টানতো, কখনো ছোট ছোট গোলাপী রাঙায় হাতগুলো দিয়ে তাঁর দিকে যাওয়ার আহ্বান করতো। আর যেদিন সে পৃথিবীতে আসে সেদিন তো স্বপ্নে বাবা বাবা করে পাগল করে দিচ্ছিলো। এই বাবা ওঠো ওঠোনা বাবা,,,
সাথে সাথে ফোনের রিংটন বেজে ওঠেছিলো ঘুম ভাঙতেই বুকের ভিতরটায় ঝড় ওঠে যায়। ইমনের কথা শুনে যে অবস্থায় ছিলো সে অবস্থায়ই বেরিয়ে যায় হসপিটালে।
জন্মের পর দিহানের কোলেই প্রথম জায়গা পায় সুপ্তি।
সুপ্তি কে কোলে তুলে নেওয়ার পর অপলক চাহনীতে চেয়ে ছিলো দিহান।বিরবির করে বলতে শুরু করেছিলো – কে বলেছে আমি হেরে গেছি,কে বলেছে আমি সব হারিয়েছি, এইতো আমি আমার শ্রেষ্ঠ উপহার পেয়ে গেছি। ইয়েস আমি আমার মেয়েকে পেয়ে গেছি।
ইমন দেখ আমার বুকের সব যন্ত্রণা এক নিমিষেই শেষ হয়ে গেছে। আমার বুকটা একদম হালকা হয়ে গেছে। দেখ আমার মেয়ে একদম আমার মতো হয়েছে দেখ। ওর শরীরে আমার রক্ত বইছে না কিন্তু ওর মন প্রান জুরে শুধু আমিই থাকবো। আমি ওর একমাএ বাবা হ্যাঁ আমি ওর বাবা।
দিহানের কান্ড দেখে ইমন কাঁধে হাত রেখে বললো হ্যাঁ সব ঠিক আছে তোর মেয়ে তোরই থাকবে এখন চুপচাপ থাক লোকজন নয়তো পাগল ভাববে।
–ভাবুক পাগল, এতে আমার কোন যায় আসেনা।
ওরা দেখুক আমি কতো ভাগ্যবান দেখুক ওরা।
সত্যি কারের ভালোবাসা কে কখনো কেউ আলাদা করতে পারেনা। আমার পবিএ ভালোবাসা, পবিএ চাওয়া কে ঐ উপরওয়ালাও অস্বীকার করতে পারেনি দেখ কতো বড় উপহার দিয়ে দিলো ওনি আমাকে। আমার ভেঙে গুড়িয়ে যাওয়া টা তিনি সহ্য করতে পারেনি তাই তো নতুন করে বাঁচতে নতুন করে ভালো থাকতে এই অসীম নিয়ামত দান করলো ওনি। ভাগ্যের লিখন খন্ডানো যায় না ইমন।
“যা আমার তা কোন না কোনভাবে আমার হবেই।
“যা তোর তা কোন না কোন ভাবে তোর হবেই।
সায়রীর জীবনে যেই আসুক যেই যাক এই দিহান ওর জীবনে চিরস্থায়ী। এই সন্তান যার মাধ্যমেই আসুক না কেনো এই সন্তান আমার জন্য এসেছে।
হ্যাঁ ও আমার ও শুধুই আমার বলেই আলতো করে বুকে চেপে নিলো।
–বাবাই ও বাবাই তুমি সত্যি এসেছো নাকি আমি আবারো সুইট ড্রিম দেখছি,,, মাম্মা সব সময় ঘুমের আগে বলে দেয় ঘুমালে আমি সুইট সুইট ড্রিম দেখবো। আর আমি সব সময় আমার বাবাইকে দেখি।
বলেই দিহানের গলা জরিয়ে ধরলো।
সুপ্তির কথাটা বার বার দিহানের কানে বাজতে লাগলো। এটা কি করে সম্ভব সুপ্তি আমার সাথে এতোটা স্বাভাবিক, আমিতো ভেবেছিলাম কাঁদতে শুরু করবে ঘুম ভাঙলেই।
দিহান সুপ্তি কে জরিয়ে নিয়ে আদুরে গলায় বললো আমার মেয়েটা তো খুব পাঁকা সে কি করে বুঝলো তাঁর বাবাই আমি,,,
সুপ্তি সাথে সাথে ছাড়িয়ে চোখ ঘুড়িয়ে ঢোক চিপে চিপে, মাথা নাড়িয়ে বলতে লাগলো -তোমার এতো এতো ভিডিও মাম্মা আমাকে দেখিয়েছে। তোমার এতো এতো ছবি আছে আমার কাছে।
দিহান যেনো বিস্ময় চোখে চাইলো। সায়রী যে সুপ্তিকে দিহানের ছবি দেখাবে বাবা হিসেবে তাঁকে চেনাবে এটা তাঁর কল্পনার বাইরে ছিলো।
চাওয়ার তুলনায় বেশী কিছু পেলে মানুষের ভিতর কতোটা আনন্দ কতোটা সুখের সৃষ্টি হয় যারা পায় তাঁরাই বুঝে।
সুপ্তি আরো কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেলো। মুখে বিষাদের ছায়া এঁকে মুখ ঘুরিয়ে বুকের ওপর দুহাত ভাঁজ করে রইলো।
দিহান ভ্রু কুঁচকে বললো কি হলো মামনি বলো।
–না তোমার সাথে কথা নেই, কাট্টি, কাট্টি কাট্টি।
দিহান মুখ ফুলিয়ে সুপ্তিকে টেনে কোলে নিয়ে বসে গালে কয়েকটা চুমু খেলো।
–কেনো আমার মামনি আমাকে কাট্টি করছে কেনো।
সুপ্তি অসহায় ভনিতায় অদ্ভুত ভাবে মুখ ফুলিয়ে কেঁদে ফেললো।
তুমি খুব পচা,তুমি মাম্মাকে কাঁদাও।আমাকে কাঁদাও। সবাই তাঁর বাবার হাত ধরে স্কুলে যায়। ছুটির দিনে ওদের বাবার সাথে কতো ঘুরে,আইসক্রিম খায়,চকলেট খায়। ওদের বাবা কতো ভালোবাসে ওদের আর তুমি একটুও ভালোবাসোনা আমাদের। আমি কখনো বাবার কোলে ওঠতে পারিনি,বাবার হাত ধরে স্কুল যেতে পারিনি। মামাই,মাম্মা, অভ্র মামাই ছাড়া কেউ আমাকে আইসক্রিম খেতে নিয়ে যায় না।
তুমি খুব পঁচা, খুব পঁচা বলেই ঘুরে গলা জারিয়ে কাঁদতে লাগলো।
দিহানের বুকটা কেমন কেঁপে ওঠলো।
সুপ্তি তাঁর বাবাকে মিস করে প্রচন্ড মিস করে।
এই বয়সে প্রত্যেকটা বাচ্চাই চায় মা,বাবার ছায়ায় বেড়ে ওঠতে। সুপ্তিও চায় এটা অস্বাভাবিক কিছু না।
দিহান এক দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো সুপ্তি নাকি খুব স্মার্ট,খুব ইনটেলিজেন্ট। ইমন তো তাই বলেছে আমায় তাহলে এমন বোকার মতো কাঁদছে কেনো?
সুপ্তি কি জানে তাঁর বাবাই একেবারে তাঁর কাছে চলে এসেছে তাঁর সব আবদার পূরন করতে।
তাঁকে অনেক অনেক আদর,ভালোবাসা দিতে।
সুপ্তি চট করে মাথা তুললো।
–সত্যি,,,
–ইয়েস মাই প্রিন্সেস।
,
খাবাড় গুছাচ্ছে আর মনে মনে ভাবছে ওনার খুব কষ্ট, বাইরে থেকে যতো শক্ত থাকুক, যতোই চড়া মেজাজ থাকুক ভিতর থেকে মানুষ টা খুবই ভালো।
আগে ভাবতাম হয়তো দুনিয়াতে আমিই সব থেকে দুঃখী কিন্তু এখন ধীরে ধীরে বুঝতে পারছি আমার থেকেও দুঃখী মানুষ এই পৃথিবীতে রয়েছে।
“পৃথিবীতে সব মানুষের ভিতরেই গভীর কষ্ট লুকিয়ে থাকে।
দুঃখ,কষ্ট বিহীন মানুষ এই পৃথিবীতে বোধ হয় একটাও খুঁজে পাওয়া সম্ভব নয়”
ইমন চেয়ার টেনে বসতেই খানিকটা শব্দে চমকে ওঠলো মুসকান।
ইমন একবার চেয়ে আবার চোখ সরিয়ে নিলো।
মুসকান খাবাড় সামনে এগিয়ে দিতে দিতে বললো সায়রী আপা তো আজ এখনো রুমের দরজা খুললো না। অনেক ডেকেছি, বুয়াও ডেকেছে তবুও খুলেনি।
–তো কি হয়েছে ওর যখন মন চাইবে খুলবে, একবার ডেকে পাওনি যেহেতু সেহেতু এতো ডাকাডাকির কিছু নেই।
–সুপ্তির খাবাড়টাও তো ঠান্ডা হয়ে গেলো তাই বলছিলাম আর কি।
ইমন খেতে খেতে উত্তর দিলো সুপ্তি দিহানের কাছে আছে এতো টেনশনের কিছু নেই।
মুসকান বড় বড় চোখ করে বললো সুপ্তি ঘরে নেই।
ইমন কিছু বললো না।
,
ইমন সব কিছু গুছিয়ে বের হচ্ছিল মুসকান বললো শুনছেন আপনার ওয়ালেট টা,,,
ইমন হকচকিয়ে গেলো বাইরের পা টা ভিতরে নিয়ে এলো। কথাটা প্রয়োজনীয় হলেও ভীষন ভালো লাগলো তাঁর । ঘাড় বাঁকিয়ে তাকালো মুসকানের দিকে মুসকান খানিকটা দৌড়েই ওয়ালেট টা এগিয়ে দিলো। নাকে বিন্দু ঘাম জমেছে তাঁর ইমন ওয়ালেট নিতে নিতে তাঁর মুখের দিকে চেয়ে ছিলো কিছুটা সময়।
,
আমি চাই কাকি এসে সায়রীর সাথে কথা বলবে।
আমি জানি সায়রী এই একটা কারনেই আপত্তি করছে শুরু থেকে। আমি সিওর কাকি, কাকা রাজি হয়েছে জানলে কাকি পুএবধূ হিসেবে ওকে স্বিকার করে নিলে সুপ্তি কে নাতনী হিসেবে মেনে নিলে সায়রী পিছুপা হতে পারবে না। ইমনের কথা শুনে দিহান বললো –
–হুম আর তুই তোর কিশোরী বধূকে কবে বধূ করে নিজের ঘরে স্থান দিবি। বাড়িতে তো আগেই ঢুকে পড়েছে মনেও জায়গা করে নিয়েছে এবার পার্মানেন্ট কিছু একটা কর ভাই। সেদিনের জন্য আমি কিন্তু পুরোভাবেই দায়ী তাই চাইছিলাম দায়মুক্ত হতে।
ইমন বাঁকা হাসলো,,,
ঘরে যে স্থান দেইনি তাঁর কি গ্যারান্টি,,,
— হুম তা তো ঠিকি বলছো দোস্ত। তোমার মুগ্ধময়ী তো অনেক আগেই তোমায় মোহিত করে ফেলেছে।
–হুম শোন তুই কাকিকে নিয়ে বাড়ি আয় আজ।
আর আমি শুধু দাদী কে নিয়ে আসবো আর কাউকে নিয়ে আসতে চাইছিনা এই মূহুর্তে। বুঝিসই তো একটু সমস্যা আছে। এতো বড় ইন্ডাস্ট্রির মালিক বাল্যবিবাহ করছে তা নিয়ে সমালোচনার শেষ থাকবে না।
–এই ওয়েট ওয়েট তুই কবে থেকে সমালোচনার ধার ধারিস,,,
–ধার ধারছিনা। সমস্যা টা আমার হবে না। মি.একরামুল চৌধুরীর যাতে কোন প্রশ্নের সম্মুখীন হতে না হয় এই আর কি। এছাড়া লোকজন যে কিছু জানেনা এমনটা নয় একটা ঘটনা ঘটে গেলে তা সবার কানে পৌঁছাবেই। আপাতত নিজে থেকে লোক জানাজানি করতে চাইছিনা। তোদের সব ঠিক ভাবে হবে এটা সিওর থাক তোদের কাজের ফাঁকে আমাদেরটা কমপ্লিট করে ফেলবো।
,
কাজের বুয়াটা বেশ খোঁচাচ্ছে মুসকান বেশ বিব্রত বোধ করছে, থেকে থেকে গলার দিকে কেমন ভাবে চেয়ে আছে। লজ্জায় মাটির সাথে মিশে যেতে ইচ্ছে করছে তাঁর। এর আগেও কয়েকটা বুয়াকে ইমন বিদায় করে দিয়েছে তাঁদের এমন খোঁচানো স্বভাব দেখে।
কাজ করছে দুজনে মুসকান রুম গোছাচ্ছে বুয়া ফ্রিজ পরিষ্কার করছে। খানিক সময় পর মুসকানের কাছে এসে চট করে বলেই ফেললো।
–একটা সত্যি কথা বলবা বড় আপা মনে কইরা বলো তো দেহি।
মুসকান ঘাবড়ে গেলো ভীষণ ভয়ে এক ঢোক চিপল।
–বড় সাহেব এর সাথে কি তুমি রাত কাটাও,,,
কথাটা যেনো বিষের মতো আঘাত করলো মুসকানকে। সে কিসের ইঙ্গিত দিয়েছে তা বুঝতে খুব একটা অসুবিধা হলো না।
তবুও মুসকান নিজেকে একটু স্বাভাবিক রেখে বললো হ্যাঁ রাত কাটাই।
ওনার যে পর্যন্ত ঘুম না আসে আমি ওনার পাশে বসে ওনার মাথা টিপে দেই৷ ওনি যদি সারারাত জেগে কাজ করে তো আমি ওনার পাশে বসে থাকি যখন যেটা প্রয়োজন পড়ে তখন সেটাই ওনার সামনে নিয়ে আসি। ওনার ঘুম না হলে সারারাত জেগে ওনার সাথে গল্প করি। এটাকে তো রাত কাটানোই বলে।
বুয়া যেনো বিশ্বাস করলো না।
মুসকানের হাত টা চেপে সোফায় গিয়ে বসল মুসকানকেও বসালো। ফিসফিস করে বলতে লাগলো আমি এখানে রোজ আসার সময়ই আশে পাশের মানুষ আমারে জিগায় শেফালী ওবাড়ি যে মাইয়াটা আছে তাঁর বিষয়ে কিছু জানোস।
আমি বলি হ জানি আপা তো খুব ভালো এই সেই।
তখন আমারে বলে সব তো বুঝলাম ইমন চৌধুরীর সাথে ঐ মেয়ের কি সম্পর্ক সেইটা কি জানোস।
আমি কই না জানি না তো।
তখন তাঁরা আমারে কয় তোমারে নাকি খারাপ পাড়া থিকা নিয়া আইছে। আমি প্রথম বিশ্বাস করিনাই কিন্তু আইজকা কেমন জানি খটকা লাগতাছে।
মুসকানের শরীরটা শিউরে গেলো। মাথাটা কেমন যেনো করে ওঠলো বুকের ভিতর সহ পুরো শরীরে কাঁপুনি ধরে গেলো । দুকান চেপে চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে করলো আমি খারাপ পাড়া থেকে আসিনি। আমি খারাপ মেয়ে না।
নিজের মন শরীর দুটোই শক্ত রাখলো সে।
মুখটা তাঁর মলিনতায় ছেয়ে গেলো।
বুয়া বললো আহারে বুঝি গো সবই বুঝি। তোমার পরিস্থিতি আমি বুঝতাছি এখন।
তোমার অনেক কষ্ট তাইনা,,,
মুসকান অবাক চোখে বুয়ার দিকে চাইলো।
বুয়া অদ্ভুত মুখ করে ভয়ে ভয়ে বললো বড় লোকের মতি,গতির ঠিক নাই। এখন তোমারে নিয়া আইছে ভালো খাওন, ভালো কাপড় দিতাছে ঐ রাতে একটু সুখ পাবার জন্যই। নিজেগোর চাহিদা মিটা গেলে ঠিকি ছুঁইড়া ফালাই দিবো। মাইয়ারা হইলো পুরুষগো ভোগের সামগ্রী। আর ইমন চৌধুরী হইলো শহরের বড় ব্যবসায়ীর ছেলে।কতো বড় বাড়ির মানুষ সে তাঁর দ্বারা তো এসব হবোই। বুঝনা টাকা আছে ক্ষমতা আছে। মেয়ে দেখলে তাগোর শরীরের রক্ত টগবগ করে। আমি শুনছি তাঁর ছোট ভাইও নাকি এমন চরিএের ঠিক নাই। বড়টা এমন কেউ বিশ্বাস করেনাই এখন সবাই বুইঝা গেছে বড়টা আরো বড় মাপের চরিত্রহীন। তোমারে যে এইসব বলতাছি আবার কাউরে বইলো না। আমি বুঝি তুমি পরিস্থিতির স্বীকার হইছো। কি আর করবা সবই কপাল।বলে এক দীর্ঘশ্বাস ছাড়ার সময় টুকু শেফালী পেলো না। মুসকানের শরীরে যেনো আগুন ধরে গেছে। শেফালী অবাক হয়ে এক চিৎকার দিলো।
সে যেনো এতোদিনের চেনা মুসকান আর এই মুসকানকে মেলাতেই পারছেনা। চুলের মুঠী ধরে ইচ্ছারকম টানছে আর বলছে তোর সাহস কি করে হয় ওনাকে তুই চরিত্রহীন বলিস সাহস কি করে হয়।
চোখ দিয়ে অঝড়ে পানি পড়ছে আর মুখ দিয়ে সমানে কথা গুলো বলছে। পাগলের মতো চুলে টানাটানি করছে। শেফালী সমানে চিৎকার করছে।
আমিতো তোমার ভালার জন্যই কইলাম। ছাড়ো আমারে ছাড়ো।
তুই ভালোর জন্য বলছস,তুই আমাকে যা খুশি বলতি তুই ওনাকে নিয়ে বললি কেনো? তুই না জেনে ওনাকে চরিএহীন বললি কেনো। ফেরেশতার মতো মানুষ টারে তুই এতো খারাপ কথা বললি। ওনার মতো মানুষ তুই আর একটা দেখাতে পারবি শয়তানী মহিলা তোকে আজ মেরেই ফেলবো। ছেঁচরাতে ছেঁচরাতে রান্নাঘরের দিকে নিয়ে যাচ্ছে উদ্দেশ্য বটি দিয়ে ঘার বরাবর কোঁপ দিবে।
ইমনের সম্পর্কে এমন অপ্রিয় কথাবার্তা ইমনের চরিএে দাগ লাগানোটা যেনো তাঁর সহ্য হলোনা। বুকের ভিতর যেনো দাউদাউ করে আগুন জ্বলছে তাঁর। মাথায় আর মস্তিষ্কে একটা কথাই খেলছে তাঁর ঐ মানুষ টা কখনো খারাপ হতে পারেনা। তাঁর ঐ মানুষ টাকে নিয়ে কেউ কোন বাজে মন্তব্য করার স্পর্ধা দেখালে সে তাঁকে খুনই করে ফেলবে।
নিচের এমন চেচামেচি শুনে সায়রী ছুটে নিচে চলে আসে। আর যা দেখে তাঁতে যেনো তাঁর মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে। এটা যে মুসকান তাঁ বিশ্বাস করতে প্রচন্ড কষ্ট হলো। কিন্তু ঘটেছে টা কি, এমন কি ঘটলো যার কারনো পানির মতো ঠান্ডা স্বভাবের মেয়েটা এভাবে তীব্র আগুনের মতো জ্বলে ওঠলো। এভাবে গর্জন ছাড়ছে কেনো।
মুসকানের হাত থেকে শেফালীর চুলগুলো ছাড়ালো।
ব্যাস্ত গলায় বললো এসব কি ছাড়ো পাগল হয়ে গেছো মুসকান, ছিঃ এসব কি করছো তুমি বলেই এক ঝটকায় ছাড়ালো।
মুসকান খানিকটা ছিটকে পড়লো।
সায়রীকে দেখে ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠলো। শেফালী ভয়ে অনেকটা দূরে সরে গেলো।
মুসকান নিচ থেকে ওঠে সায়রীকে জরিয়ে হাউমাউ করে কাঁদতে লাগলো।
শেফালী ভয়ে এক ঢোক গিললো।
–আপা ওনি তো অনেক ভালো আপা তাও কেনো সবাই ওনাকে খারাপ ভাবে। আপা আমি কোন অপরাধ না করেও সকলের অনেক খারাপ মন্তব্য সহ্য করি। ছোটবেলা থেকে সহ্য করতে করতে আমার সয়ে গেছে। কিন্তু ওনাকে নিয়ে কেউ চুলপরিমান অপ্রিয় কথা বললেও আমি সহ্য করতে পারিনা। কান্নার মাঝেই কড়া গলায় বললো ওনাকে নিয়ে কেউ বাজে কথা বললে তাঁকে আমি খুন করে ফেলবো বলেই শেফালীর দিকে চাইতেই শেফালী ভয়ে ও বাবাগো বলেই এক দৌড়ে বাড়ির বাইরে চলে গেলো।
সায়রী ভ্রু কুঁচকে বললো মানে ইমনকে নিয়ে শেফালী কি বলেছে,,,
মুসকান সবটা খুলে বলে হাউমাউ করে কাঁদতে লাগলো। সায়রী এক দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো মুসকান কে সান্ত্বনা দিয়ে ইমনকে ফোন করে সবটা জানালো।
ফোন রেখে দিহানের নাম্বারে ডায়াল করলো সুপ্তিকে খাওয়িয়েছে কিনা জানার জন্য।
,
রুমে বসে নিঃশব্দে কেঁদে যাচ্ছে মুসকান।
সায়রী সবটা জানানোতে ইমন দ্রুতই বাড়ি ফিরলো।
পোশাক না পাল্টেই মুসকানের রুমে চলে গেলো।
ইমন রুমে ঢোকার সাথে সাথে মুসকান ছুটে গিয়ে তাঁকে জাবটে ধরলো। যেনো তাঁর অপেক্ষাতেই ছিলো সে। যেনো সে জানতো তাঁর মানুষ টা ঠিক তাঁর কাছে আসবে।
দুহাতে জরিয়ে বুকে মাথা রেখে নিঃশব্দে চোখের পানি ফেলছে মুসকান।
ইমন তাঁকে না ধরেই ভারী আওয়াজে বললো তুমি নাকি মারপিট করেছো। চুলে ধরে টানাটানি এসব কি শুনছি আমি মুসকান।
মুসকান ভয় পেয়ে গেলো। ইমন তাঁর হাসিটা খুব কষ্টে চেপে বললো কাজটা মোটেই ঠিক হয়নি।
মুসকান ইমনকে ছেড়ে ভয়ে গুটিশুটি হয়ে দাঁড়িয়ে মাথা নিচু করে চোখ বন্ধ করে বললো আমি আপনাকে “ভালোবাসি”
আপনার ভালো-মন্দ খেয়াল রাখাটা যেমন আমার ভালোবাসা আপনার সম্পর্কে কেউ বাজে কথা বললে তাঁর প্রতিবাদ করাটাও আমার ভালোবাসা।
শেফালী আপার জায়গায় যে কেউ থাকলেই আমি তাঁর ঐ অবস্থাই করতাম। সাহস হয় কি করে আপনাকে নিয়ে বাজে কথা বলার বলেই রাগে ফুঁসতে লাগলো। শরীর কাঁপছে, গলায়ও কাঁপুনি স্পষ্ট।
ষোল বছরের কিশোরীর মুখে ভালোবাসি কথাটা শুনে তাঁর যতোটা না অবাক,এবং ভালো লেগেছে তাঁর থেকেও বেশী অবাক এবং ভালোলেগেছে তাঁর ভালোবাসার ধরন দেখে।এই মেয়েটার মাঝে হঠাৎ এতোটা সাহস কি করে চলে এলো তা যেনো মাথায়ই ঢুকছেনা তাঁর।
“ভালোবাসার মানুষের অপমানে যদি তোমার মন না কাঁদে তবে কেমন ভালোবাসো তুমি তারে”
মুসকানের মনটা প্রচন্ড ভাবে কাঁদছে ইমনের অপমান, ইমনের সম্পর্কে বলা বাজে কথা গুলো তাঁর বুকে আঘাত করেছে। তাঁর নিষ্পাপ মনের নিষ্পাপ ভালোবাসার ধরনটাই যে এমন।
ইমন খানিকটা এগিয়ে গেলো একহাতে মুসকানের কোমড় পেচিয়ে নিজের খুব কাছে নিয়ে এলো। আঙুল ওঠিয়ে ঠোঁট টা চেপে মুখোমুখি হয়ে বললো চুপপ,,
অনেক হয়েছে এই রাগ,এই অস্থিরতায় যেনো আর কোন দিন ভুগতে না হয়। অমন অপ্রিয় কথাগুলো যেনো আর কখনো না শুনতে হয় সেই ব্যবস্থাই করবো এবার।
মুসকানের চোখ বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়লো।
ইমন বাঁকা হেসে বললো যতোটা সরল দেখা যায় ততোটাও তুমি নও,,বেশ ঝাঁঝ।
মুসকান লজ্জায় মিইয়ে গেলো চোখ দুটো সরিয়ে নিলো।
ইমন তাঁর গভীর দৃষ্টি ছুঁড়ে দিলো মুসকানের দিকে।
কামড়ের দাগটায় হাত বুলাতেই মুসকান হালকা কেঁপে ওঠলো। চোখ দুটো বন্ধ করে ফেললো সে।
ইমন মুসকানের আবদ্ধ চোখের পাতায় চুমু খেলো।
কপালে, গালে, থুতনিতে অবশেষে ঠোঁট জোরাতে হালকা করে ঠোঁট ছোঁয়াতেই মুসকান তাঁকে শক্তভাবে আঁকড়ে ধরলো।
ইমন কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বললো “আমাকে অবাক করে দিয়েছে আজ তোমার এই চঞ্চলতা,,
আমাকে অবাক করে দিয়েছে তোমার এই পাগলাটে ভালোবাসা,,
আমাকে অবাক করে দিয়েছে তোমার পাগলামোমাখা প্রতিবাদ,,
আমি সত্যি বিস্মিত হয়েছি আজ।
আমি সত্যি অনুভব করেছি আজ আমারো কেউ আছে, খুব আপন কেউ যে কিনা আমার সামান্যতম বদনাম টুকুও সহ্য করতে পারেনা।
তাঁর অবুঝ মনে এইটুকু জায়গা করে নেওয়াটায় আজ যেনো নিজেকে সার্থক মনে হচ্ছে”
“তাঁর মুখে ভালোবাসার স্বীকারোক্তি আমাকে ঘায়েল করতে পারেনি।
ঘায়েল হয়েছি তাঁর অবুঝ মনের পাগলামোতে ঘেরা বাঘিনী রূপে ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশে”
চলবে..