শুক্লাদ্বাদশী,পর্ব-১
Arishan Nur (ছদ্মনাম)
— আপনি ভারী অসভ্য তো! এভাবে কোন মেয়ের ঘরে বিনা অনুমতিতে ঢুকে পড়া কেমন ধরনের ভদ্রতা শুনি?
সামনে দাঁড়িয়ে থাকা কম বয়সী একটা মেয়ের মুখে এমন নেতিবাচক কথা শুনে আরোশের গা রিরি করতে লাগে। প্রচুন্ড রাগ হলো তার। এক প্রকার মানুষ আছে,যারা কোন কিছু যাচাই-বাছাই না করেই মন্তব্য পোষণ করে।এদেরকে আরোশের একদম পছন্দ না। মানুষ মাত্র চিন্তাশীল৷ অথচ এই শ্রেণির লোকেরা চিন্তা করতে নারাজ।
মেয়েটা পুনরায় ঝাঁঝ গলায় বলে উঠে, একটা মেয়েকে এভাবে আপত্তিকর অবস্থাতে দেখেও আপনি খাম্বার মতো দাঁড়িয়ে আছেন। এতো বিবেকহীন কেন আপনি বলুন তো? আপনার কি কোন লাজ-লজ্জা নাই? ঘরে মা-বোন নেই?
মেয়েটার কন্ঠ অতিরিক্ত ঝাঁঝালো। নিশ্চয়ই অন্য কারো রাগ তার উপর ঝাড়ছে।
আরোশ এবারে মেয়েটার দিকে তাকালো। সাধারণ বাঙালী চেহারা। নাকটা একটু বোঁচা। চোখের নিচটায় হালকা কালি জমা। ঠোঁটের হাফ ইঞ্জি নিচে বড় কুচকুচে একটা তিল। এবারে, গায়ের রং লক্ষ্য করলো সে। ধবধবে ফর্সা বা দুধে আলতা গায়ের রঙ নয় মেয়েটির, আবার শ্যামলাও না। এমন চামড়ার মেয়েদেরকে সম্ভবত বলা হয়, হলুদ ফর্সা। মেয়েটা হলুদ ফর্সার অধিকারী।
আপত্তিকর অবস্থা বলতে মেয়েটা কি বোঝাচ্ছে সেটা বোঝার জন্য আরোশ মেয়েটার দিকে আরো তীক্ষ্ম নজর দেয়।
মেয়েটা তা বুঝে ফেলে। এবং সঙ্গে সঙ্গে বাজখাঁই গলায় বলে, বেয়াদব ছেলে কোথাকার! বের হন বলছি আমার ঘর থেকে।মেয়ে মানুষ দেখলেই চোখ ছানাবড়া হয়ে যায় তাই না? গিলে খেতে মন চায়! লম্পট কোথাকার! এমনি এমনি তো আর অসভ্য বলিনি।
আরোশ এবারে বুঝলো মেয়েটা আসলে ভেজা কাপড়ে আছে। শরীরে লেপ্টে আছে পরনের শাড়িটা। ভিজে জুবুথুবু অবস্থা যাকে বলে। চুল বেয়ে টুপটুপ করে পানি পড়ছে। চুলের পানি মেঝেতে পড়ছে। আরোশ বুঝে পাচ্ছে না ভেজা অবস্থায় থাকা কিভাবে আপত্তিকর অবস্থা হয়?মেয়েটার কি মাথা ঠিক আছে? তাছাড়া এতো কম বয়সী মেয়ে তার উপর রাগ ঝাড়ছে এটাও আরোশের আত্নসম্মানে লাগছে খুব। কথায় কথায় মেয়েটা কোন কিছু বিবেচনা না করেই তাকে গালি-গালাজ করছে।
আচমকা আরোশের খেয়াল হলো মেয়েটার পরনে ব্লাউজ নেই। কিন্তু সুন্দর-পরিপাটি করে আটপৌরে শাড়ি পড়ে দাঁড়িয়ে আছে। এক প্যাচে গ্রাম্য ধাঁচে পেছন দিয়ে আঁচল গুজে শাড়ি পরিধান করা যাকে বলে। এমনকি কোমড়ের সঙ্গে শাড়ির আঁচল গুজে দেয়া। গ্রাম বাংলার আর দশটে মেয়েও ঠিক এভাবেই শাড়ি পড়ে স্নান করতে যায়৷ খুবই সাধারণ দৃশ্যপট তবুও আরোশ এই সাধারণ বিষয়টি কে স্বাভাবিক ভাবে নিতে পারলোনা।কি যেন হয়ে গেল তার ভেতর-ভেতর!
তার চোখ অস্বাভাবিকভাবে, মার্বেলের মতো বড় হয়ে যায়। বুকে ঢিপঢিপ আওয়াজ বাড়তে লাগে। এম্নিতেই সে হাপাচ্ছিলো। প্রচুন্ড বেগে দৌড়ে আসার ফলে জোড়ে জোড়ে শ্বাস নিচ্ছিল। অতঃপর এমন বিষ্ময়কর কিছু দেখার সঙ্গে সঙ্গে নিশ্বাস আটকে আসতে লাগে তার। সে খুকখুক করে কাশতে লাগলো। হুট করে মূহুর্তের মধ্যে গলা কাঠে পরিনত হয়ে গেল। ঢোক গিলতেও সে ভুলে গেল। গা বেয়ে শীতল শিহরণ বয়ে যাচ্ছে। কেমন অস্থির লাগা শুরু করলো। সে এখনো বেহায়ার মতো মেয়েটার মুখমণ্ডলের পানে চেয়ে আছে। সাধারণ চেহারা হলেও মেয়েটার মুখে কিছু একটা আছে যা তার চোখে ধরা পড়ছে কিন্তু ভাষায় প্রকাশ পাচ্ছে না! সে আবারো খুকখুক করে কাশলো৷
মেয়েটা বিরক্ত হয়ে গেল এবং ফটাফট বলে উঠে, যক্ষ্মা রোগী নাকি?
আরোশ জবাব দিলোনা। মেয়েটার আঁকাবাঁকা দাঁত তাকে আর্কষিত করলো। আঁকাবাঁকা দাঁত ও এতো চমৎকার হয়! আরোশের মনে হচ্ছে এই মেয়ের দাঁতগুলো আঁকাবাঁকা নাহলে দুনিয়া উলটে যেত! সে বহু কষ্টে ঢোক গিলল। অস্বস্তি বোধ দূর করার জন্য কি করবে তা বুঝে কুল পাচ্ছেনা। বেরিয়ে যাবে ঘর থেকে? যাওয়া তো উচিত!
মেয়েটা আবারো বলে উঠে, ভারী ইতর স্বভাবের তো আপনি! এতো অপমান করছি তাও আমার দিক থেকে চোখ সরান! দেখুন আমি বিবাহিত। খবরদার বাজে কিছু করার চিন্তা মাথায় আনবেন না,,,,,,,,,
আরোশের বুকে যেন আকাশের সমান ভারী কিছু আছড়ে পড়লো। হুট করে বুকে মৌমাছির হূল ফোড়ার মতো ব্যথা অনুভব হলো কেন?
সে এক পা দু পা পিছাতে পিছাতে বলে, দুঃখিত। আন্তরিক ভাবে দুঃখিত। আমি বুঝতে পারিনি। ক্ষমা করবেন৷
— থাক! এখন আর এতো সাধুবাবা সাজতে হবেনা। কৃপা করে আমার সামনে থেকে চলে যান৷
— আপনি ভুল ভাবছেন আমাকে। আমি মোটেও এমন ছেলে না।
— তাহলে কেমন ছেলে আপনি? ( কটাক্ষের সুরে বললো মেয়েটা)
— জানি না।
— জানবেন কিভাবে? নিজেকে আয়নায় দেখেছেন কখনো? এই মূহুর্তে আপনাকে দেখতে বানরের মতো লাগছে! বনে বসবাস করা বানর! বুঝেছেন কি বলছি?
— না৷
— মানকি মতো লাগছে আপনাকে!
বলেই মেয়েটা আঁকাবাকা দাতে হালকা হাসতেই থেমে যায় যেন তার হাসা বারং!
হাসির আওয়াজে চকিত দৃষ্টিতে আরোশ সব লজ্জার মাথা খেয়ে মেয়েটার পানে তাকিয়ে থাকে। কেমন হাসফাস লাগা শুরু হলো তার। সে আর এক দন্ড অপেক্ষা না করে ঘর ছেড়ে, উঠান পেড়িয়ে মেয়েটার দৃষ্টি সীমার বাইরে চলে গেল।
অপরিচিত লম্পট ধরনের ছেলেটা দৌড়ে পালাতেই আমি হাফ ছেড়ে বাঁচলাম। এরপর বেশ শব্দ করে ঘরের দরজা ভিজিয়ে দিলাম। নিষ্পলক চোখে কিছুটা সময় ওই জং ধরা দরজার পানে চেয়ে রয়ে থেকে, কিছু সময় পর, ঘরের মাঝ বরাবর এসে হাটু গেড়ে বসে কেঁদে ফেললাম। এতোক্ষন যাবত কান্না আটকানোর বহু চেষ্টা করছিলাম। কিন্তু চেষ্টা সফল হলোনা। শেষমেস কান্নারা দলা পাকিয়ে চোখ বেয়ে বেয়ে বর্ষন হতে লাগলো।গাল ভিজে যাচ্ছে চোখের অশ্রুতে আর মন পুড়ে যাচ্ছে হাহাকারে৷
ডুকরে ডুকরে কাদতে লাগলাম। আজকে আমার জন্য কাল-রাত। আজকের রাতের উপর আমার হাসি-কান্না, সুখ-দুঃখ স্বপ্ন পূরণ কিংবা স্বপ্ন ভঙ্গন নির্ভর করছে। বাবার সিদ্ধান্ত জানার জন্য আমি চাতক পাখির ন্যায় অপেক্ষা করছি।
সাত দিন আগেই আমার বয়স আঠারো হলো। হাজারো স্বপ্ন দেখা ও রঙের বয়স আমার। মাত্র আঠারোতে পা দিতেই যেন চারপাশের মানুষ-জনের কাছে আমি বুড়ি হয়ে যাচ্ছি। বিয়ে দেয়ার বয়স নাকি হয়ে গেছে? কে জানে? আঠারো বছর বয়সই বোধহয় বিবাহের জন্য উত্তম সময়? ছেলেটাকে মিথ্যা বলেছি আমি বিবাহিত নই কিন্তু বাবা আমার নামের আগে বিবাহিতা তকমা লাগানোর সর্বোচ্চ চেষ্টা করছেন। আচ্ছা আমি যদি মেয়ে না হয়ে ছেলে হতাম, তবুও কি আঠারোতে পা দিলে আমার বিয়ে দেওয়ার জন্য উঠেপড়ে লাগত সবাই? কে জানে? আমার মনে হচ্ছে, ইশ যদি ছেলে হয়ে জন্ম নিতাম! তাহলে আমিও মুক্ত স্বাধীনভাবে স্বপ্ন দেখতে পারতাম। ইচ্ছা হলেই ছুট লাগাতাম সদরে! কেউ বাঁধা দিয়ে বলত না, মেয়ে মানুষ কেন একলা ওতো দূর যাবে?
আশেপাশের অবস্থা ভালো না জন্য পাশের বাসার চাচি সহ আব্বা ব্যতিব্যস্ত হয়ে গেছে আমাকে শ্বশুড়বাড়ি পাঠানোর জন্য। বিয়ে দেয়ার পেছনে আরো একটা কারণ হলো রুপ। বাবা আর চাচি ভাবেন আমি বুঝি খুব রূপবতী। এটা যে তাদের ভুল ধারণা সে সম্পর্কে তারা বিন্দুমাত্র অবগত না। আমি মোটেও সুন্দরী না। খুব সাধারণ একজন মেয়ে। তারপর ও তারা যত দ্রুত সম্ভব আমার বিয়ে দিতে চাচ্ছে। কিন্তু আমি! আমি খুব করে চাই বিয়ে যেন নাহয়। আমার স্বপ্ন ডাক্তার হওয়ার। বড় একজন ডাক্তার হয়ে মানুষের সেবা করা আমার জীবনের একমাত্র লক্ষ। কিন্তু বাবা আমাকে একদম বুঝে না। তার মতে, আমার নিরাপত্তাই সবকিছু। বাবাকেও দোষ দেওয়া যায় না। আসলেই তো কম বয়সী মেয়েরা নিরাপত্তাহীনতায় আছে। কখন কি ঘটে যায় কে জানে? প্রতিটা দিন, প্রতিটা ঘন্টা, প্রতিটি মিনিট আতংকে কাটছে! ভয়ে।ভয়ে যাচ্ছে দিন গুলো।
হুট করে আমার মাথায় একটা ভয়ংকর চিন্তা খেলে গেল। ছেলেটা কে? আগে তো কোনদিন দেখিনি তাকে! এই ভর দুপুরে কি চাই? বাবা তো বাসায় নেই! আমি একা বাসায়। ভয়ে ঢোক গিললাম।খারাপ কিছু অপেক্ষা করছে না তো আর জন্য! কোন কিছু না ভেবেই দ্রুত শাড়ি বদলিয়ে ঘরের বাইরে বের হলাম। সঙ্গে সঙ্গে বাসার সামনের খালি জায়গায় ওই লম্বা বাঁশের মতো রোগা মেরুন শার্ট পড়া ছেলেটাকে আবারো দেখতে পেলাম।
এক পা এগিয়ে আসতেই সে বলে উঠে,এইদিকে আসবেন না। পানি পড়েছে। জায়গাটা পিছলা হয়ে আছে৷
আমি অতিরিক্ত সাহস দেখিয়ে বলে উঠি, জন্ম থেকে এই বাসায় বেড়ে উঠেছি। চোখ বন্ধ করেও হাটতে পারব।
কথাটা শেষ করে যেই না উঠানের সিঁড়ি হতে নিচে পা ফেলব, ওমনি পিচ্ছিল কাদায় পা লেগে চিটপাটাং হয়ে পড়তে ধরলে, খুব গরম দুটো হাত আমার কোমড় জড়িয়ে ধরে।
আমি চমকে উঠি তার উষ্ণ স্পর্শ তে। তিরতির করে কাপতে লাগলো আমার চোখের পাপড়ি। কেমন যেন চাপা বেদনা তৈরি হলো আমার মনের কোণে। চোখে পানি চলে আসলো।
সে আমাকে শক্ত করে চেপে ধরে রেখে, বিনীত গলায় বলে, এখুনি তো একটা দুর্ঘটনা ঘটে যেত!
অতি নিকটে দাঁড়িয়ে আছি আমরা দুজন।আমাদের মাঝে দূরত্ব কেবল চার ইঞ্জি।
তার গায়ের গন্ধ আমার নাকে এসে লাগছে।
আমি বিষ্ময় ভরা চোখে তার দিকে চেয়ে আছি। নাকের ডগায় শিশির বিন্দুর মতো ফোটা ফোটা ঘাম জমে গেল।
আচমকা কার যেন কন্ঠস্বর ভেসে ওঠে। কানে ধ্বনি এলো, ছিঃ! ছিঃ! এইসব কি নষ্টামি চলছে? তোদের উপর গজব পড়বে৷
চলবে।