অসুখের নাম তুমি,পর্ব নং-১৯ (শেষ)
সোনালী আহমেদ
‘তুমি আমার কাছে আসো। এত দূরে কেনো?
বাহিরে ঝুমঝুম বৃষ্টি হচ্ছে,ঠান্ডা বাতাস বইছে।তোমার কি অন্যায় কিছু করতে ইচ্ছে করছে না?’
লজ্জায় রেশমির মুখ লাল হয়ে উঠলো। মাথা নুইয়ে চুপ করে রইলো। সৌহার্দ মৃদু হেসে বললো,
‘তোমাকে এত সুন্দর লাগছে কেনো?চোখ বন্ধ করতেই ইচ্ছে হচ্ছে না।’
রেশমির লজ্জার পরিমাণ আরো বেড়ে গেলো।
দাঁত মুখ খিঁছে বিছানার চাদর খামছে ধরলো। আড়ষ্ট হয়ে বললো,
‘আগে বুঝি সুন্দর ছিলাম না।’
‘উমম..তখন তো পিচ্ছি ছিলে। এখন তো বড় হয়ে গেছো। আগে একদম লজ্জা পেতে না,যেচে যেচে আমার কাছে আসতে। এখন তো লজ্জায় আমার দিকে তাকাও পর্যন্ত না।’
রেশমি চুপ করে শুনে রইলো। কয়েক মুহূর্ত বাদে সৌহার্দ ফিসফিস করে বলে উঠে,
‘তুমি কি জানো? তোমার সব কিছু আমাকে চম্বুকের মতো আকর্ষণ করছে। তোমার নাক,ঠোঁট, চোখ,লজ্জা রাঙ্গা হাসি গোলাপি গোলাপি গাল, সব সব সবকিছু। ‘
কথাগুলো রেশমির কানে পৌঁছাতেই শরীর কাটা দিয়ে উঠলো। এত লজ্জা এর আগে পায় নি সে। লোকটা এসব কি বলছে?কিচ্ছু কি মুখে আটকায় না? তিনি কি বুঝে না এসব তার লজ্জা লাগে। উথালপাতাল মনকে শান্ত করার চেষ্টা করলো। নিজেকে ধাতস্থ করে সৌহার্দের দিকে হালকা ঝু্ঁকে কাঁথাটা টেনে দিয়ে বললো,
‘ঘুমান। জ্বরে পাগল হয়ে গিয়েছেন। কিসব আবোলতাবোল বকছেন! ঘুমিয়ে পড়লে সুস্থ হয়ে উঠবেন।’
রেশমি কাঁথা তার বুকের উপর নিয়ে আসার আগেই সৌহার্দ কাঁথা সহ রেশমির হাত ধরে ফেললো। পলকহীনভাবে রেশমির চোখের দিকে তাকিয়ে বলে,
‘আমি তো সুস্থ হতে চাই। তুমিই তো আমাকে অসুস্থ করে রেখেছো। মনে অশান্ত চেনাজানা ঝড় তুলে দিয়েছো। আমার পুরুষালী চোখে রাতের পর রাত পানি নামিয়েছো। আরামের ঘুম কেড়ে নিয়ে রাত জাগা পাখি বানিয়েছো। বুকে তীব্র লাল-নীল ব্যাথা সৃষ্টি করেছো। ‘
রেশমি চোখ বন্ধ করে আছে। সৌহার্দের কথা তার বুকে তীব্র স্পন্দন সৃষ্টি করছে। সে কাঁপছে। এত ভয়ানক কথা এ লোক কীভাবে বলছে! শরীর নিস্তেজ লাগছে। এ বোধ হয় ঢলে পড়বে।
রেশমির অবস্থা দেখে মৃদু হাসলো। কানের কাছে মুখ টা এগিয়ে ফিসফিস করে বললো,
‘ আমার সব অসুখের কারণ তুমি,
আমার সব অসুখের উপশম তুমি।
আমার সব অসুখের নাম তুমি।’
ব্যাস!রেশমি আর নিজেকে ধরে রাখতে পারলো না। চোখ বন্ধ রেখেই গা এলিয়ে দিলো পেছনের দিকে। সে কাঁপছে, গলা শুকিয়ে আসছে। এ মুহূর্তে পানি না পেলে হয়তো মারা যাবে। তার শরীর বিছনায় স্পর্শ হওয়ার আগেই সৌহার্দ ধরে ফেললো। ডান হাতের বাহুতে জড়িয়ে নিজের সাথে মিশিয়ে নিলো। রেশমির কম্পন স্পষ্ট টের পাচ্ছে সে। ধীরে ধীরে রেশমির কানের কাছে তার মুখ নিয়ে এলো। তপ্ত নিঃশ্বাস উপছে পড়ছে রেশমির কানের লতিতে। সাথে সাথে শরীরের কম্পন দ্বিগুন গতিতে বেড়ে গেলো। দুই হাতে খামছে ধরলো পরনের পোশাক।
সৌহার্দ ধীর গলায় বললো,
‘ আমার এই ভীষণ কঠিন অসুখ নিবারণ করতে তার উপশম পান করতে চাই। অনুমতি পাবো কি?’
রেশমির মুখে দিয়ে আওয়াজ ই আসছে না সে কি জবাব দিবে? আগের ন্যায় দাঁত মুখ খিঁচে চোখ বন্ধ করে আছে। কথা বলছে না সে,আর না নড়ছে। শুধু চোখের পাপড়িগুলো ক্ষণিকে ক্ষণিকে কাঁপছে। তার এই মৌনতা সম্মতির লক্ষণ ধরে নিলো সৌহার্দ। বাহিরে বৃষ্টির বেগ বেড়ে গেলো, সাথে শীতের প্রকোপও। তুমুল ঝড়ে পৃথিবীর গরম উত্তাপ শান্ত হয়ে উঠছে।
–
‘পাপা বাপকে ছাড়ে না।’ এমন একটি প্রচলিত কথা আছে। যার প্রকৃত প্রতিফলন লিনা। রুবির এর টাকা-পয়সা আর ঐশর্য দেখে আর কোনো কিছু বিবেচনায় না এনে, তাকে ছেলেকে বিয়ে করিয়ে নিয়ে আসে। অঢেল টাকা দেখে স্বামীর একমাত্র পুজির উপায় দোকান টাকেও বিক্রি দেয়। অহংকার আর দাপটে কাউকে ধারে কাছে ঘেষতে দিতো না। যে মেয়েকে সোনার ডিমপাড়া হাস ভেবে নিয়ে এসেছেন সে আজ কুমির বের হলো। ঘরের যাবতীয় সকল কাজ তাকে দিয়েই করানো শুরু করে দিয়েছে রুবি। বড়লোকের আলালের দুলাল, সে এসব কাজকর্ম করতে পারবে না। লিনা এসব জেনেও বিয়ে করিয়েছে,ভেবেছে কয়দিন পর হয়তো ঠিকই তার ছেলের বউ সব করবে। তাছাড়া টাকা তো পাচ্ছে সে। তাই বিয়ের পর থেকেই ঘরের সকল কাজ করে সে। ফলস্বরুপ মোটা অংকের টাকা। এত কিছুতেও তার কোনো আফসোস ছিলো না। কিন্তু বিপত্তি বাধে তখন যখন কয়েকদিন আগে শুনলো রুবি বাচ্চা দানে অক্ষম। আর তার প্রথম বিবাহ বিচ্ছেদের কারণ টাও এই। এ কথা শুনেই সে হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেললো। রুবির সাথে তার পুরানো রুপের আচরণ শুরু করলো। যার ফল তার উপর দ্বিগুণ ভারী পড়লো। রুবি তাকে ঘর থেকে বের করে দিতে দ্বিতীয়বার ভাবলো না। বর্তমানে ঘরের মালকিন রুবি, তার উপর এখন আর কারো চলে না। রুবিকে তার বিবেকের প্রশ্ন করা হলে সে জবাব দেয়,
‘ যেখানে আপনি আপনার বৃদ্ধ শাশুড়ি কে বের করে দিয়েছেন, সেখানে আপনি তো আমার জোয়ান শাশুড়ি। এখানে দ্বিতীয়বার কথা বলছেন কীভাবে?’
লিনা ভীষণ ক্ষেপে, রুবির সাথে অসদাচরণ করে ঘর থেকে বের হয়ে গেলো। বের হতেই টের পেলো সে কতটা অসহায়। না আত্মীয় আর না অনাত্মীয়, কারো ঘরেই তার ঠাঁই হয় নি। এই অসহায় মুহূর্তে তার সুমির কথা মনে পড়লো। চোখের সামনে ভেসে উঠলো,ভোর বেলায় চা করে নিয়ে দাড়িয়ে থাকতো,কোনো কিছু চাওয়ার আগেই উপস্থিত করতো। এরপরেও কত কথা সে শুনাতো। কি অবলীলায় সব শুনে যেতো সুমি। আজ তার মেয়েটাকে ভীষণ মনে পড়ছে, বারবার প্রার্থনা করছে সুমি যেনো ফিরে আসে। কিন্তু আফসোস মরা মানুষ আর কখনো ফিরে আসে না। লিনা কাঁদছে, শেষ বয়সে এসে তার এ অবস্থা হবে সারাজীবনেও কল্পনা করে নি। স্বামী আর সন্তানের হাত ধরে পথচারীর মতো দাড়িয়ে আছে সে। জীবনের পুরানো অধ্যায়ে যদি ফিরে যাওয়া যেতো, তাহলে সে সুমির দুই পা জড়িয়ে ক্ষমা চাইতো। ক্ষমা চাইতো তার করা কৃতকার্যের জন্য।
পরিশিষ্ট– সেসব দিনের পর বহু বছর কেটে যায়। অনেক কিছুর পরিবর্তন ঘটেছে। সৌহার্দের টিনের ঘরের পরিবর্তে তৈরী হয়েছে ইট পাথরের দালান। গ্রামের কাঁচা রাস্তার বদলে পাকা রাস্তা করা হয়েছে। স্থাপিত হয়েছে নতুন নতুন ব্যবস্থা। রেশমি এখন ব্যস্ত জননী। এক হাতে সবকিছু সামলায়। জমিলা বেগম গত হয়েছেন বহু আগেই। মা, আর মামা-মামীকে এ বাড়ীতে নিয়ে এসেছে। রুহানীর বিয়ে হয়ে গেছে। রেশমিরও ফুটফুটে নাদুসনুদুস দুইটি জমজ ছেলেবাচ্চা হয়েছিলো। ছেলেদুটো এখন বড় হয়ে গিয়েছে। স্কুলের গন্ডি পেরিয়ে কলেজের গন্ডিতে গিয়েছে। আজ তাদের ঘরে বিশেষ আয়োজন চলছে, যার প্রধান অতিথি অসহায়,গরীব,এতিম মানুষজন। বিশেষ কারণ হলো এই দিনে সুমি মারা গিয়েছিলো। তাই প্রতিবারের ন্যায় আজও তার জন্য খাওয়ানোর আয়োজন করা হচ্ছে। আঁচলে ভেজা হাত মুছতে মুছতে জানালার পাশে এসে দাড়ালো রেশমি। বাহিরে উঁকি দিতেই দেখলো, তার স্বামী সন্তান পরম যত্নের সহিত সকলকে খাবার বেড়ে দিচ্ছে। এ দৃশ্য দেখে চোখ জুড়িয়ে গেলো। সারাদিনের ক্লান্তি নিমিষেই গায়েব হয়ে গেলো। একজীবনের দুঃখ করে আজ সুখের ছোঁয়া পেয়েছে সে। পেয়েছে স্বামীর প্রগাঢ় ভালোবাসা। সে এত সুখী হবে জানলে কখনও আগের দুঃখগুলোর জন্য কাঁদতো না। জানালার পাশ থেকে সরে পেছনে ঘুরতেই সৌহার্দকে দেখলো। তার ভাবনা-চিন্তার মাঝে কখন সৌহার্দ এসে দাড়িয়েছে সে টের ই পায় নি।
সৌহার্দ ভ্রু বাকিয়ে বললো,
‘ বুড়ো হয়েছি বলে কি আমার দিকে তাকানো যায় না? কখন থেকে দাড়িয়ে আছি একবারও ফিরে দেখলে না। আমাকে কি এখন আর পছন্দ হয় না!’
সৌহার্দের ভাবসাব দেখে রেশমি মৃদু হেসে বললো,
‘ আপনি একটা পাগল।’
সৌহার্দ মৃদু হেসে জবাব দিলো,
‘তোমার জন্য পাগল, তোমার নেশায় পাগল।’
‘ তাহলে ডাক্তার দেখান।’
সৌহার্দ রেশমিকে টান মেরে কাছে নিয়ে আসলো। তাল সামলাতে না পেরে সৌহার্দের বুকের উপর পড়লো সে। মাথার ঘোমটা পড়ে গিয়ে চুলের খোঁপা ও খুলে গেলো। সৌহার্দ তার দিকে ঝুঁকতেই রেশমি আতঙ্কিত গলায় বলে,
‘কি করছেন? বাড়ীভর্তী মানুষ। কেউ এসে পড়বে তো।’
‘ তুমি বললে না ডাক্তার দেখাতে তাই ডাক্তার দেখাচ্ছি। কারণ- আমার ডাক্তার তুমি মেডিসিনও তুমি। আমার অসুখের নাম তুমি।’
“-সমাপ্ত”