অসুখের নাম তুমি,পর্ব নং-১৭,১৮

অসুখের নাম তুমি,পর্ব নং-১৭,১৮
লেখিকা–সোনালী আহমেদ
পর্ব-১৭

পালাবদলে ঋতু পরিবর্তন হয়েছে।বদলে গিয়েছে আবহাওয়া। শুরু হয়েছে নতুন ব্যবস্থা। ঘটেছে প্রযুক্তির আবির্ভাব। সাথে বদলেছে রেশমি, পরিবর্তন ঘটেছে তার চেহারায়। গোলগাল লাভন্য যুক্ত চেহারা হারিয়ে ফেলেছে সে।শুকিয়ে কাঠ হয়েছে, চোখের নিচে কালো কালো দাগ পড়ে কৌটরে ডুকে গিয়েছে। আগের সেই ছোট্ট গড়নের শরীর বদলে গিয়েছে। মুখে দেখা দিয়েছে প্রাপ্ত বয়স্ক কুমারী মেয়েদের ছাপ।সাংসারিক চাপে শরীরের ধবধবে সাদা রং চাপা পড়ে গেছে। পড়বেই না কেনো? সংসারের দায়িত্ব যে এসেছে তার কাঁধে। এক হাতে এত বড় ঘর বাড়ী সামলানো কোনো সহজ কাজ নয়। বেসামাল মানুষগুলোকে যে তাকে সামলাতে হয়। এ যে তার কর্তব্য। স্বামীর সংসার মানেই তার সংসার।

নিভৃতে নিঃসঙ্গে দিন কাটায় কাঙ্ক্ষিত মানুষটির আশায়। সব কষ্ট মুখ বুজে সহ্য করে নেয় সেই ব্যক্তিটির জন্য। আর আজ দীর্ঘ সময় অতিবাহিত হওয়ার পর শেষ হলো সেই মানুষটির অপেক্ষা। চার বছর শেষ হয়ে গিয়েছে। আজ সৌহার্দের ফিরে আসার কথা। চিঠিপত্র থেকেই দিন টি জেনেছে সে। খুশিতে তর সইছে না তার। তবে মুখে তা ফুটিয়ে তুলছে না। আবার দুঃখ ও হচ্ছে, সে কি জবাব দিবে সুমির ব্যাপারে? তার মন টা বড্ড অস্থির। পাখির মতো ডানা মেলে উড়তে চাইছে। সে এত খুশি কই রাখবে।

স্বামী নারীদের মনের রাজা। এ স্থানে যোগ্য মানুষ খুব কম বসতে পারে। খুব কম মানুষ ই ভাগ্যবতী হতে পারে। রেশমি সেই ভাগ্যবতীদের একজন। স্বামী হলো সুখ,দুঃখ,যন্ত্রণা আর ভালোবাসা। রেশমির নিকট সৌহার্দ ঠিক এমন। তার চিন্তা হচ্ছে, বহু দিন পর সৌহার্দকে কাছে পাওয়ার সুখ সইতে পারবে তো সে?চোখের আড়াল হলেই নাকি মনের আড়াল। অথচ তাদের এত বছর দূরত্ব ভালোবাসা আড়াল করে নি বরং আরো বাড়িয়ে দিয়েছে।

মাঝে মাঝে সম্পর্কে দূরত্ব খুব বেশি দরকার।কারন তখন মানুষটির শূন্যতা তাকে বুঝিয়ে দেয় সে কতখানি ভালোবাসে। তাই আপাতদৃষ্টিতে “দূরত্ব” ভালোবাসার এক বহিঃপ্রকাশের মাধ্যম।

—————————–
চাপা উত্তেজনা আর কৌতুহল নিয়ে বাড়ীর সামনে পা রাখলো সৌহার্দ। দুই হাতের ব্যাগপত্র খুব শক্ত করে ধরে রেখেছে সে। চোখে মুখে উচ্ছাসিত হাসি। রোদের আলোয় জ্বলমল করছে সে মুখখানি। নিলাট লম্বাটে চেহারা আর
প্রশস্ত ললাটের আশেপাশে ছড়িয়ে আছে হাসির কিরণ। আগের থেকে বেশ বদলেছে গড়ন। দেখতে সুঠাম আর শক্তিশালী লাগছে। পরনে জিন্স প্যান্ট, সাথে সাদা শার্টের উপর ঝুলানো নেভি ব্লু কালারের কোট। গলায় কালো টাই ও লাগিয়েছে। হাতে সিলভার রঙের ঘড়িও পরেছে। সব মিলিয়ে দেখতে বেশ লাগছে তাকে। এত সাজসজ্জা শুধুই প্রিয়তমার জন্য। তাকে আকৃষ্ঠ করতেই এত এত ফর্মালিটি করে এসেছে। সি এন জি ড্রাইভারকে টাকা টা দিয়ে ঘরে আসতে বললো। চারদিকে এত গরম পড়ছে, লোকটা বোধ হয় ভীষণ ক্লান্ত হয়েছেন। এক গ্লাস ঠান্ডা জল খেতেই এই নিমন্ত্রণ।

ঘরের সামনে আসতেই তার ভ্রুজোড়া কুচকে এলো। এ পাশে নতুন আরেকটা ঘর দেখা যাচ্ছে। দু দুটো ঘর! মাথায় বিভিন্ন চিন্তা ঘুরপাক খেলো। পরক্ষণেই ভেবে নিলো হয়তো কোনো দরকারে বানানো হয়েছে।

ঠোঁটে প্রশস্ত হাসি ঝুলিয়ে সৌহার্দ ডাক দিলো,

‘সুমি, ও সুমি। ‘

কথাটা বলেই একটু ভাব নিয়ে দাড়ালো সে। বোন টা এসে নিশ্চই তাকে লজ্জা দেওয়ার সকল বন্দবস্ত করবে। সাথে তার বাচ্চা বউকেও শরম দিবে। সে মুচকি হাসতে লাগলো।

সুমিকে আসতে না দেখে সে আবারো ডাক দিলো,

‘কিরে? কই গেলি তুই? দেখে যা আমি এসে গিয়েছি।’

ললাটের হাসি সরছেই না। এতদিন পর আপনজনকে কাছে পাওয়ার সুখ তাকে পাগল করে দিচ্ছে। দমফাটা খুশি লাগছে তার। সকলকে দেখবে, কথা বলবে,হাসবে থাকবে। মনে কি যে খুশি! কিন্তু যখন বোনের বিভীষিকাময় কাহিনী শুনবে তখন কি হাল হবে তার? কেমন প্রতিক্রিয়া দেখাবে সে। তখনও কি থাকবে এই হাসি?

সৌহার্দের দ্বিতীয় ডাক গিয়ে পৌঁছিয়েছে রেশমির কানে। যার তরঙ্গে মনে উথাল-পাতাল শুরু করে দিয়েছে। হাতের গামছা বিছানায় ফেলে প্রায় দৌড়ে ঘর থেকে বেরিয়ে আসলো সে। একদম সৌহার্দের কাছাকাছি পৌঁছাতেই থেমে গেলো সে। ঠোঁট আর চোখজোড়া কাঁপছে। পলকহীন তাকিয়ে রইলো সৌহার্দের নীলাভ চোখের দিকে। ধীরে ধীরে সে সম্মোহিত হতে লাগলো। চোখে আনন্দ অশ্রু খেলা করতে শুরু করলো। কত মুহূর্ত তৃষ্ণার্থের মতো চেয়ে রইলো দুজন,যা দুজনের জানা নেই। চোখের তৃপ্তি মিটছেই না। যেনো শত শত বছরের তৃষ্ণার্থ। সাথে ঘটতে লাগলো সুপ্ত ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ।

কাঁপা কাঁপা কন্ঠে প্রশ্ন করলো,

‘ক্ কেমন আছো?’

রেশমি ঠোঁট দুটো নাড়িয়ে জবাব দিলো সে ভালো আছে। উত্তর দিয়েই চুপ করে রইলো। ততক্ষণে ঘরের মানুষজন এসে পড়েছে। জমিলার বয়স আগের থেকে বেড়েছে। সে এখন কুঁজো হয়ে হাঁটে। লাঠি ছাড়া এক মুহূর্ত চলতে পারে না। ঠক ঠক আওয়াজ করে জীর্ণ শরীর নিয়ে সৌহার্দের সামনে এসে দাড়ালো।

হুট করে সৌহার্দ তার দাদীকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগলো। সেদিন চলে যাওয়ার সময়ের মতো কান্না করছে। পার্থক্য হলো সেদিন ছিলো দুঃখের কান্না আর আজ সুখের।

“সুখ সবসময় হাসির মাধ্যমে নয় মাঝে মাঝে কান্নার মাধ্যমেও প্রকাশ ঘটে।”

সবার সাথে কুশল বিনিময় করার পর সৌহার্দের চোখদুটো বোনকে খুঁজে ওঠলো। সে চারপাশে তাকিয়ে খোঁজ চালাচ্ছে। বোন কি তার নিজেকে লুকিয়ে রেখেছে নাকি? তার সামনে ভাগ্নে-ভাগ্নি কে দেখিয়ে চমকে দেওয়ার প্ল্যান করছে না তো। সৌহার্দ কথাগুলো মনে মনে ভেবে হেসে উঠলো। এতদিনেও বোনের পাগলামো স্বভাব গেলো না। সৌহার্দ ও ভেবে নিয়েছে, সে একদম চমকে যাওয়ার ভান ধরবে,যাতে বোনের চেষ্টা সফল হয়। আর সে প্রাণখুলে হাসে।

মিটমিটে হেসে সজীবকে প্রশ্ন করলো,

‘ছুটকি কই? আর তোমার চ্যাম্পকেও যে দেখছি না। কই লুকিয়েছো তাদের?’

সৌহার্দের প্রশ্নে গা কাঁটা দিয়ে ওঠলো সজীবের। নিরুত্তর রইলো সে। কি জবাব দিবে ? কোন মুখে বলবে তার বউ আর বেঁচে নেই। সুমির কথা মনে পড়তেই চোখের কৌঠরে জ্বল এসে জমা হলো তার।

সৌহার্দ তাকে জবাব দিতে না দেখে সিয়ামকে জিজ্ঞাস করলো। কিন্তু সে ও একই ভঙ্গিতে দাড়িয়ে রইলো। একে একে সবাইকে প্রশ্ন করলো সে।জবাব না পেয়ে ভ্র দুটো কুঁচকে এলো তার। কেউ জবাব দিচ্ছে না কেনো? সবাই কি পণ করে রেখেছে নাকি তাকে জবাব দিবে না। সে ও কম কিসের? মনে মনে তাকে ধরার ফন্দি আঁটলো।

হাতব্যাগের চেইন খুলে স্বর্ণের চেইন বের করে, উঠোনে উঠিয়ে ধরে বলে ওঠলো,

‘সুমি, তোর জন্য একটা স্বর্ণের চেইন এনেছি। ভাবলাম তোকে দিবো,কিন্তু এখন তো তুই নেই তাই এটা আমি রেশমিকে দিয়ে দিচ্ছি। তোর তো লাগবে না তাই না।’

‘নাআআ,আমার লাগবে।’ এ বাক্যটুকু চেঁচিয়ে বলে বের হবে সুমি। এমন ভাবছে সৌহার্দ।কিন্তু অবাক করার কান্ড হলো তার এমন বাক্য শুনে সুমি তো বের হলো না উল্টো দাদী আর রেশমি কেঁদে ওঠলো। সৌহার্দের বুক টা মোচড় দিয়ে উঠলো। সুমির কিছু হয় নি তো।

‘দাদী,দাদী তুমি কাঁদছো কেনো?কি হয়েছে? সুমি কই? ওর কিছু হয় নি তো?’

সৌহার্দের মন কু ডাকছে। সবার হাবভাব দেখে মনে হচ্ছে তাকে এখন খারাপ কোনো দুঃসংবাদ শুনতে হবে।

বেশকিছুক্ষণ পর সৌহার্দ শুনতে পেলো রেশমি মুখে আঁচল দিয়ে কেঁদে কেঁদে বলছে,

‘আ্ আপু,,, ‘

‘হ্যা,কি হয়েছে আপুর?’

‘ম্ মারা গেছেন।’

কথাটি শুনতেই শরীর কাঁটা দিয়ে উঠলো সৌহার্দের। থরথর করে কাঁপতে লাগলো সে। চোখদুটো বড় বড় হয়ে আসলো। গলা শুকাতে লাগলো।

কাঁপা কাঁপা গলায় বললো,

‘ক্ কি কি বলছো এ্ এসব? ‘

বিপরীতে রেশমির কান্নার আওয়াজ শুনা গেলো। সৌহার্দ আবার প্রশ্ন করলো,

‘মি্ মিথ্যা বলছো ত্ তাই না? আমি জানি ওকে এখানে কোথাও লুকিয়ে রেখেছো।এই সুমি বেরিয়ে আয়। নাহলে তোকে পেলে ঠাডিয়ে দুইটা চড় দিবো।’

সৌহার্দের শরীর টলছে। চোখ দুটো ঝাপসা হয়ে গিয়েছে। বারবার ঢোক গিলছে। মনে মনে প্রার্থনা করছে,’সে যা শুনেছে তা যেনো মিথ্যা হয়।’

সৌহার্দ মানছে না দেখে, সিয়াম চট করে তার হাত ধরলো। বাড়ীর পাশে সুমির কবর। তাকে সেখানে টানতে টানতে দাড় করিয়ে বললো,

‘এটা ভাবীর কবর।’

সিয়ামের কথার প্রতিধ্বনি বারবার সৌহার্দের কানে বাজতে লাগলো। কবরের উপর নেইমপ্লেট টা দেখতেই থমকে গেলো সে। হাতের চেইন টা সেখানেই পড়ে গেলো। ঘোরের মধ্যেই হাটুগেড়ে মাটিতে বসে পড়লো। নিঃশব্দে চোখের জল গড়িয়ে পড়তে লাগলো। নিজেকে তার পাগল লাগছে। চোখের সামনে বোনের সাথে কাটানো শৈশব ভেস উঠলো। সাথে সাথে গগন ভুলানো চিৎকার দিয়ে উঠলো। উন্মাদের মতো কবরের কাছে যেতে লাগলো। পেছন থেকে সজীব আর সিয়াম তাকে ধরে টেনে নিয়ে আসতে চাইলো। কিন্তু তারা সৌহার্দের শক্তির কাছে ব্যর্থ হতে লাগলো। সৌহার্দ উন্মাদের মতো ব্যবহার করছে। কান্নার আওয়াজে আশেপাশের লোকজন এসে জড়ো হতে লাগলো। এক সময় প্রবল জোর খাটিয়ে তাদের কাছ থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে কবরের পাশে গিয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়লো সে। হাুটগেড়ে বসে কবরকে জড়িয়ে ধরলো। কবরের শুকনো মাটি ভিজে উঠতে লাগলো তার চোখের জলে। ‘সুমি,এই সুমি’ বলেই বারবার কবরকে সম্বোধন করছে সে।

‘এই উঠনা,দেখ কে এসেছে? ওহ,আচ্ছা তুই রাগ করেছিস বুঝি? এই নে,কান ধরেছি এবার উঠে যা না বোন। “তুই যে আমার চোখের মনি, তুই আমার নয়নের ক্ষণি। তুই ছাড়া আর কে আছে আমার?” সোনা বোন বলছি,উঠে আয়। কথা দিলাম তুই যা বলবি তার সব শুনবো। এবার উঠ না।’

ডুকরে কেঁদে উঠলো সৌহার্দ। বোন যে তার কথা বলছে না, বোনকে যে সে দেখছে না। কবরের উপরে মাথা টা এলিয়ে স্বশব্দে কাঁদতে লাগলো সৌহার্দ।

চলবে….

অসুখের নাম তুমি
পর্ব নং–১৮
লেখিকা–সোনালী আহমেদ

সৌহার্দের মাত্রাতিরিক্ত জ্বরের মধ্য দিয়ে কেটে গেছে দুইদিন। কাঁদতে কাঁদতে কবরের উপর জ্ঞান হারানোর পর, তাকে ঘরে নিয়ে আসা হয়, এরপরেই শুরু হয় জ্বর। জ্বরের সাথে বেশ কয়েকবার বমি ও হয়েছে। কিছুই মুখে দিতে পারছে না, যা ই খাচ্ছে তা ই বমি করে ফেলে দিচ্ছে। জ্বর হয়েছে তার জ্বালিয়েছে রেশমিকে। আবোলতাবোল বকাবকি ছাড়া কিছুই করে নি। সুমির মৃত্যু তার পক্ষে মেনে নেওয়া সহজ হচ্ছে না। জমিলা এক দন্ড সময় ও তার পাশ থেকে নড়ছেন না। এক নাতিন চলে গেছে,আরেক নাতিকে হারাতে চান না। নাতির পাশে বসে জমিলা স্নেহ ভরা হাতে সৌহার্দের মাথায় বুলিয়ে দিচ্ছে। সৌহার্দ চোখ বন্ধ করে তা অনুভব করছে। কিছুক্ষণ পর সৌহার্দ জ্বরের ঘোরে বলে,

‘দাদী,ও কীভাবে মারা গেছে?’

জমিলা কাপড়ের আঁচল দিয়ে চোখের জল মুছতে মুছতে বললো,

‘পেটের বাচ্চা টা নষ্ট হয়ে গেছিলো। শোক সামলাতে না পেরে নাতিন টা চইলা গেছে।’

কথাটা অস্পষ্টভাবে বলেই ডুকরে কেঁদে দিলেন।সৌহার্দের বুক চিরে দীর্ঘশ্বাস বের হয়ে এলো। দাদীর দিকে দ্বিতীয়বার প্রশ্নবান ছুড়লো,

‘ বাচ্চা নষ্ট হওয়ার পর চাচী ঝামেলা করছে না?’

‘হু। করছিলো, হাত কাইটা ফালাইছিলো। না,না এইটা এর আগে হইছিলো। ‘

‘চাচী হাত কেনো কাটছে?’

‘তোর বউ লিনার লগে বেয়াদবি করছিলো। তখন বিচার হইছে আর বিচারে সুমি তোর বউয়ের পক্ষে সাক্ষী দিছিলো। তাই লিনা হাত কেটে ফেলছিলো। ‘

সৌহার্দ অকপটে বলে ওঠলো,

‘ আর সাক্ষী দেওয়ার পর থেকেই বোনটারে শেষ কইরা দিছিলো, না?’

জমিলা নিরুত্তর রইলো। সৌহার্দ ও আর প্রশ্ন করলো না,যা বুঝার বুঝে গিয়েছে সে। মনের খোরাক মেটাতে কিছুক্ষণবাদে প্রশ্ন করলো,

‘তুমি তো আমার বউরে দেখতে পারো না, তাহলে ওরে নিয়া আলাদা ঘরে থাকতাছো কেন? বের কইরা দিছে?’

‘বের করবো ক্যান? আমি বাহির হইয়া আইছি।’

‘কেনো?’

জমিলা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলতে লাগলেন,

‘সজীবরে আবার বিয়া করানোর সময় ঝগড়া করছিলাম।’

‘সজীব বিয়ে করেছে?’

‘হ। মাইয়ারা বিশাল বড়লোক। অনেক টাকা দিছে। জিনিসপত্র ও দিছে।’

দাদীর কথায় সৌহার্দের মনে কৌতুহল দেখা দিলো। চোখ মেলে ধীরে ধীরে উঠে বসলো। দাদীর দিকে তাকিয়ে বলে,

‘এত বড়লোক,হইলে সজীবের কাছে বিয়ে দিছে কেনো?’

‘ মেয়ের আগে একবার বিয়া হইছে। বিয়ের কয়েকমাস পর মেয়েটারে কেনো জানি দিয়া গেছে। আর এজন্যই সজীবের কাছে বিয়া দিছে। ‘

সৌহার্দ জ্বরের ঘোরেই মৃদু হাসলো। তাচ্ছিল্যের সুরে বলে,

‘ভালো তো।’

জমিলা বেগম খানিক গর্ভের সুরে বলতে লাগলেন,

‘আমিও ঝগড়া করছি, আমার নাতনিটার মরার এক বছর না হইতেই বিয়া করাইতেছে। এসব কোনো কথা? তখন বিশাল ঝগড়া কইরা তোর বউরে নিয়া আলাদা ঘরে আইসা পড়ছি।’

‘আলাদা ঘর কীভাবে করেছো?’

‘তোর বিদেশের পাঠানো টাকা দিয়ে। সজীবরে বিয়া করানোর পর ওগুলার একটা টাকাও আমি তাদের দেই নাই। মারামারি কইরা সব নিয়া গেছি। এসব কিন্তু তোর বউয়ের বদৌলতে সম্ভব হইছিলো। জানিস, মেয়েটা বেশ ভালো রে। আমি তার সাথে কত কি করছি তারপরেও লিনার সাথে আমার জন্য ঝগড়া করছে। আমার এক কথায় ওই ঘর থেকে বের হয়ে আমার সাথে চলে আসছে। তুই খুব ভাগ্যবান রে, এত লক্ষী বউ পাইছোস। রেশমি লাখে একটা। তোর উপরে আমার কোনো রাগ,দুঃখ নাই। একদম ভালো করেছিস সেদিন বিয়ে করে।’

সৌহার্দ কিছু বললো না। গা টা আবার গুলাচ্ছে, মনে হচ্ছে বমি আসবে। চোখ বন্ধ করতেই শরীর কাঁটা দিয়ে উঠলো। কল্পনায় চোখের সামনে সুমির বিভীষিকাময় জীবন ভেসে উঠেছিলো। অনুমান করছে,কে কি করেছে সুমির সাথে। বুকটা তীব্র হাহাকার করছে। মৃত্যুর আগের সকল ঘটনা সে অনুমান করতে পারছে। মনে মনে প্রতিজ্ঞা করে নিলো, বোনের মৃত্যুর প্রতিশোধ সে নিয়েই ছাড়বে। তীব্র ক্রোধের সহিত অসুস্থ শরীর নিয়ে বেড়িয়ে পড়লো। ঘন্টাখানেকের মধ্যেই সে বোনের মৃত্যুর জন্য বিচার বসালো। রেশমি এসব দেখেই সৌহার্দকে বারণ করছে। সে বলছে ‘শুধু শুধু ঝামেলা হবে। প্রকৃতপক্ষে কিছুই হবে না।’ কিন্তু সৌহার্দ শুনলো না।

বিচারে বেশ নামিদামী লোকজন বসেছেন। তারা আসতে চায় নি,তখন সৌহার্দ কিছু টাকা গুজো দিয়েছিলো। মোটকথা সৌহার্দ উন্মাদ হয়ে আছে। চাচীদের একটা শেষ দেখে ছাড়বে সে। বিচারসভায় বেশ হট্টগোল চলছে। লিনার ঘর থেকে কেউ আসতে চাইছে না। কিসের বিচার?তারা কি করেছে? সজীবের শশুড়বাড়ীর লোক বড়লোক হওয়ায় লিনার ঘর আজকাল বেশ চলছে। তাদের টাকা দিয়েই এত দাপট দেখাচ্ছে। তাই বিচারকদের তারাও টাকা খাওয়াতে পেরেছে। দুই পক্ষের টাকা খেয়ে বিচারকরা নিরপেক্ষ রইলো। আলোচনায় লিনা বলে ওঠে,

‘কিসের জন্য বিচার বসেছে জানতে চাই।’

এক বিচারক বললো,

‘সৌহার্দের বোনের জন্য। তাকে আপনারা অত্যাচার করে মেরে ফেলেছেন।’

লিনা ফুসে ওঠে বলে,

‘সুমি আমার ছেলের বউ। ওকে কেনো আমি অত্যাচার করবো? মেরে ফেলার হলে ছোট থেকে এত বড় করতাম না। হায়,হায়! এত বড় অপবাদ দেওয়ার আগে আমার কিছু হয়ে গেলো না কেনো? যে মেয়েকে আমি নিজ হাতে বড় করেছি তাকেই নাকি আমি মেরে ফেলেছি। ওহ,আল্লাহ গো,কই তুমি!’

লিনার কুমিরের কান্নায় গলে গেলো সকলে। বিচারকরা তার কথায় যুক্তি পেয়ে সৌহার্দকে বলে,

‘উনি ঠিক বলেছেন। তোমার বোনকে মারার হলে তো আগেই মেরে ফেলতেন। আসলে তোমার বোন বাচ্চা নষ্ট হওয়ার শোকেই মরে গিয়েছে। তুমি তো বিদেশে ছিলে, তাই আসল ঘটনা জানোই না। উনার কথাই ঠিক।’

কারো আর সৌহার্দের আর কথা শুনা হলো না। বিচার সেখানেই শেষ হয়েছে। রাগ আর ক্ষোভ সৌহার্দের মনে দ্বিগুন বেড়ে গেলো। বোনের মৃত্যুর প্রতিশোধ নিতে না পেরে রেগে চেয়ার-টেয়ারে লাথি দিয়ে ঘরে চলে আসলো। তার এত কষ্ট লাগছে যে, সে কি করবে বুঝতে পারছে না। মাথায় আগুন জ্বলছে। বোনের মৃত্যু কি এভাবেই বিফলে যাবে? সে কি কিছুই করতে পারবে না।

রেশমি গুটিগুটি পায়ে ভেতরে আসলো। এসেই সৌহার্দের পাশে দাড়ালো। সে বুঝতে পারছে সৌহার্দের মনে কি ঝড় চলছে। সে তার কাঁধে হাত রাখলো। সৌহার্দ টকটক লাল চোখে পেছনে ঘুরলো। রেশমি দেখতেই শান্ত হয়ে গেলো। কান্না পাচ্ছে তার,ভাষণ অসহায় লাগছে। সে টলমল চোখে রেশমিকে বলে,

‘আমি কিছুই করতে পারলাম না। আমার বোনের মৃত্যুর কোনো বিচার হলো না।’

বলতে বলতে সৌহার্দ বসে পড়লো। রেশমি তার মাথায় হাত বুলাতে লাগলো। তার কোলের উপর মুখ গুজে কাঁদতে লাগলো সৌহার্দ। রেশমি ভীষণভাবে অনুভব করছে সৌহার্দের কষ্ট। তার ও তো কষ্ট হচ্ছে সুমির জন্য। কিন্তু সৌহার্দ এভাবে ভেঙ্গে পড়লে তো হবে না,তাই রেশমি সান্তনা দিয়ে বললো,

‘ এই পৃথিবীতে কোনো মানুষ চিরস্থায়ী নয়। সময় ফুরিয়ে গেলে সবাইকে একদিন পৃথিবী ছেড়ে চলে যেতে হবে। এমনকি আমি, আপনি আমরা কেউই নয়। আপুর সময় শেষ হয়ে গিয়েছে তাই উনাকে চলে যেতে হয়েছে। আপুর সাথে যা হয়েছে তার জন্য উপরওয়ালা আছেন। তিনি সব দেখেছেন। উনারা একদিন তাদের প্রাপ্যটুকু ঠিকই পাবেন। এর জন্য আপনি নিজেকে দোষ দিতে পারেন না। আপনার তো কোনো দোষ নেই।’

এবারে সৌহার্দ খানিকটা সামলে নিলো নিজেকে। রেশমির কথায় মনোবল খুঁজে পেলো সে। সেদিন আবার জ্বর দেখা দেয় তার। সারাদিন বিছানায় শুয়ে রইলো। রাতের দিকে শুরু হলো ঝড়। টিনের ঘরের উপর বৃষ্টির ফোঁটা পড়ার সাথে ছমছম আওয়াজ হচ্ছে। বৃষ্টির সঙ্গে ঘরেও শীতল হাওয়া প্রবেশ করেছে। সৌহার্দ জ্বর নিয়ে শুয়ে আছে। বেশ দূরত্ব রেখেই বসে আছে রেশমি। কিছুক্ষণবাদে সৌহার্দ চোখ মেলে রেশমির দিকে তাকালো। তার চোখে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে তীব্র আকুতি। সৌহার্দ হাত বাড়িয়ে রেশমির আঙ্গুলগুলো ছুঁয়ে দিলো। রেশমি খানিকটা কেঁপে উঠলো। সৌহার্দ বললো,

‘তুমি আমার কাছে আসো। এত দূরে কেনো?বাহিরে ঝুমঝুম বৃষ্টি হচ্ছে,ঠান্ডা বাতাস বইছে।তোমার কি অন্যায় কিছু করতে ইচ্ছে করছে না?’

চলবে…..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here