অসুখের নাম তুমি,১৩তম পর্ব
সোনালী আহমেদ
সৌহার্দের অবাক অবস্থা দেখে কোনো ভাবাবেগ দেখা দিলো না রেশমির মধ্যে। চোখ বন্ধ করতেই সৌহার্দ তাকে টেনে বসিয়ে দিলো।বিরক্তিকর দৃষ্টিতে চোখ মেলতেই, সৌহার্দ মুখ অন্ধকার করে ফেললো।
মেঝেতে দৃষ্টি ফেলে হতাশার সুরে রেশমিকে বলে,
‘কাল আমি চলে যাবো। আর তুমি এখন ঘুমাচ্ছো?’
রেশমি অকপটে জবাব দেয়,
‘ তো কি করবো? আপনাকে নিয়ে নাচবো?’
সৌহার্দ রেশমির গা ঘেষে বলে,
‘না, জড়িয়ে ধরলেই হবে।’
রেশমি সরে বসলো।তার ফর্সা গালে লাল আভা দেখা দিলো। কাচুমাচু করে এদিক-ওদিক তাকাচ্ছে।
‘ বিশ্বাস করো, তোমার লজ্জা পাওয়া দেখে আমার শরম লাগছে।’
‘আপনি খুব খারাপ। সরে বসুন না।’
‘উহু,নো সরাসরি।’
সৌহার্দ এক টানে রেশমিকে কাছে নিয়ে আসলো। রেশমির গাল আগের থেকে আরো বেশি লাল হতে লাগলো। হুটহাট সৌহার্দের স্পর্শ সে মেনে নিতে পারছে না। এত লজ্জা লাগছে যে মন চাইছে মাটি ফাঁক করে নিচে ডুকে যাই। চুপ করে বেশ কিছুক্ষণ এভাবেই সময় কাটালো দুজন। নিরবতা ভেঙ্গে রেশমি বলে ওঠে,
‘আপনি সত্যি কাল চলে যাবেন।’
‘হু’
‘আমার কি হবে,কীভাবে থাকবোই বা আমি?’
সৌহার্দ দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। তার কাছে এর জবাব নেই। বুক টা খাঁ খাঁ করছে। তার নিজের কাছেও খারাপ লাগছে। সে নিজেও যেতে চাইছে না। কিন্তু না চাইলে কি আর সব হবে? তাকে যেতেই হবে। বহু ধার-দেনা জমেছে। বিদেশ গিয়ে এসব চুকাতে হবে। তাছাড়া বোনের পাশাপাশি বউয়ের দায়িত্ব এসে জমেছে তার কাঁধে। সংসারের জন্য হলেও তাকে যেতে হবে।
ভাবনা চিন্তার সুতো ছেড়ে যায় বুক ভেজা অনুভব করতেই। রেশমি কাঁদছে। চোখের পানি, নাকের পানি সব এক করে ফেলছে। ইতোমধ্যে সৌহার্দের শার্টখানার বিচ্ছিরি হাল হয়ে গেছে।
‘এই বোকা মেয়ে,কাঁদছো কেনো?’
রেশমি নাক টেনে টেনে বললো,
‘আমার ইচ্ছা হয়েছে।’
‘তো দূরে যেয়ে কাঁদো না। আমার জামা ভরিয়ে দিচ্ছো কেনো?’
‘আপনার কি সমস্যা,এটা আমার স্বামীর শার্ট। আমি শতবার নষ্ট করবো আপনার কি?’
সৌহার্দ হাসে। কদিন আগেও যে মেয়েকে চিনতো না আজ সে মেয়ে তার জন্য কাঁদছে। না কখনো দেখেছিলো না কখনো কথা হয়েছিলো তবুও এ কয়দিনে কি টান তৈরী হয়ে গিয়েছে। দুনিয়ার সব ভালোবাসা যেনো একত্র করে তার জন্য ঢেলে দিচ্ছে।
রেশমির মাথাটা বুক থেকে তুলে দুটো গালে পরপর বারকয়েকবার ঠোঁট ছুঁয়ে দিলো সৌহার্দ। তাকে আশ্বাস দিয়ে বলে,
‘মাত্র চার বছর। এরপর তো আমি আবার চলে আসবো। তখন তুমিও বড় হয়ে যাবে। আমরা একসাথে আবারো সংসার করবো। একদম কেঁদো না।’
রেশমি থামলো না। কাঁদতে না বললেই কি কাঁন্না থেমে যায়! সে নাক টেনে টেনে তার কথার ফুলঝুরি মেলে ধরলো। সৌহার্দ কীভাবে থাকবে,কীভাবে চলবে,কার দিকে তাকাবে,কার দিকে তাকাতে পারবে না, কবে ফিরে আসবে,ফিরে আসলে কি করবে,কয়টা বাচ্চা নিবে, কীভাবে ঘর সাজাবে এসব নিয়ে সারারাত্রি গল্প করেছে। তাকে এক ফোঁটাও ঘুমাতে দেয় নি,নিজেও ঘুমায় নি।
দুপুর পেরিয়ে বিকাল ঘনিয়ে আসলো। সৌহার্দকে কিছুক্ষণবাদেই রওনা দিতে হবে। সকাল থেকে সবার সাথে কথা হলেও জমিলা বেগমের সাথে তার দেখাও হয় নি। দরজায় খিল মেরে নিজেকে আটকে রেখেছে জমিলা। সারাদিনেও কোনো খাবার মুখে তুলে নি সে। রেশমি আর সুমি তাকে বার কয়েকবার ডেকেছে কিন্তু সে সাড়া দেয় নি। যেনো পণ করে রেখেছে কারো সাথে কথা বলবে না।
বাড়ীর প্রত্যেকটা সদস্যের মুখ ঈষৎ কালো দেখাচ্ছে। দায়সারাভাবে যে যার কার্য পালন করছে। সৌহার্দ চলে যাবে সেজন্য আজ কোনো কর্তা বাহিরে যায় নি। ঘরে বেশ ভালো ভালো খাবার রান্না হচ্ছে। সুমি নানান জিনিস ভাইয়ের জন্য প্যাকেট করেছে তা অবশ্য লিনার আড়ালে।
জমিলার ঘরের দরজায় বেশ কয়েকবার কড়া নেড়ে কোনো সাড়া পেলো না সৌহার্দ। শেষ সময়ে জমিলা বেগম বের হলেন, তবে কোনো কথা বললেন না। সৌহার্দ তাকে জড়িয়ে ধরে অনেক্ষণ কেঁদেছিলো। তিনি কোনোরকম পরিবর্তন দেখালেন না। শেষে সৌহার্দ রেশমি আর সুমি দুজনকেই তার হাতে দিয়ে তাদের দেখে রাখতে বলেছে এবং ছোট ভেবে ক্ষমা করতে বলেছে। নাতির উপর যতই রেগে থাকুক, শেষে নিজেকে সামলাতে পারে নি। হু হু করে কেঁদে দিলেন।
জমিলা বেগম আঁচল দিয়ে চোখের জল মুছতে মুছতে বললেন,
‘সাবধানে যাবি। খবরদার আজেবাজে কিছু মুখে দিবি না। বিদেশিরা বড্ড খারাপ,তাদের দূরে থাকিস।’
সৌহার্দ মাথা নাড়িয়ে সায় দিলো। সৌহার্দ রেশমিকে ডেকে জমিলার সামনে আনলো। তার হাত ধরিয়ে বললো,
‘দাদী, ও অনেক ছোট। বুঝ-জ্ঞান কম। ওর মাকে আমি আশ্বাস দিয়েছি যে ওকে আমি দেখে রাখবো। কিন্তু এখন তো আমি তো চলে যাচ্ছি,তাই আমার দায়িত্ব তোমাকে দিয়ে দিলাম। তুমি রাখবে না ওর খেয়াল?’
জমিলা বেগম কোনো জবাব দিলেন না। সৌহার্দ উঠে সুমির কাছে যেতেই হু হু করে কেঁদে ওঠলো সুমি। ভাইকে কত দিনের জন্য চোখের আড়াল করতে চলেছে তার জানা নেই। তার মনে পড়ে প্রথম যেদিন ভাই চলে যাচ্ছিলো সেদিন কতই না কেঁদেছিলো। কতগুলো দিন মুখে ভাত তুলতে পারে নি। যত বারই মুখে ভাত দিতে যাচ্ছিলো ততবারই ভাইয়ের চেহারা মনে পড়ে গিয়েছিলো। ভাই কীভাবে খাচ্ছে?কিছু খেয়েছে কি না? এসব ভাবলেই আর খাওয়া হতো না।
‘ছুটকি, শুন। আমি যখন আবার আসবো তখন যেনো চ্যাম্পের সাথে খেলতে পারি। তার জন্য তুই প্রতিদিন ওকে আমার কথা বলবি। যেনো সে আমাকে চিনতে পারে। কিরে বলবি তো?’
সুমি ভাইয়ের বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ে কাঁদছে। সে মুখ ফুটে বলতে চাইছে,’ভাই যে বাচ্চার কথা তুমি বলছো তাকে তো তার বাবা-দাদী চায় না। তাকে মেরে ফেলার জন্য তারা উঠে পড়ে লেগেছে।’ কিন্তু বলতে পারলো না। ভাই তাকে নিয়ে চিন্তিত থাকুক এটা সে চায় না।
খুব কষ্টে নিজেকে সামলিয়ে ভাইকে বলে,
‘ ভাই,আবার যখন আসবে তখন যেনো তোমার নিজেরও একটা চ্যাম্প হয়,আর খুব খুশিতে সংসার করিও। কেউ থাকুক আর না থাকুক তোমরা দুজন একসাথে সুখে সংসার করবে। কথা দাও।’
সৌহার্দ বোনের কথার আগামাথা কিছুই বুঝলো না। সে প্রশ্ন করতে নিচ্ছিলো এসব কি বলছিস তুই’ কিন্তু সেটা আর করা হলো না। সুমি তাকে প্রশ্ন করতেই দিলো না। শুধু ওয়াদা নিয়ে নিলো।
পালাক্রমে রেশমির কাছে আসতেই সৌহার্দের দম আটকে গেলো। মুখ দিয়ে দুজনের কোনো কথা হলো না। চোখে চোখ রেখেই তাকিয়ে ছিলো। শত শত না বলা কথা ব্যক্ত হচ্ছিলো। রেশমির চোখে জল ছলছল করলেও তা গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে না। সে যথাসম্ভব নিজেকে সামলিয়ে রাখছে।
গাড়ির হর্ণ বাজতেই সে মুখ খুললো,বলে,
‘ভালো থেকো,সবার খেয়াল রেখো।’
রেশমি ঠোঁট কামড়ে মাথা নাড়ালো। বিয়ের সপ্তাহ না ফুরাতেই স্বামী চলে যাচ্ছে। ঠিকঠাক এক রাতের জন্য কাছে পেয়েছিলো। আর সকাল না হডেই বিদায় দিতে হচ্ছে। এ কোন দোষের শাস্তি পাচ্ছে সে। বুক দক করে ওঠছে,গলায় কান্না দলা পেকে গিয়েছে। ইচ্ছে করছে গলা ফাটিয়ে কাঁদতে। সে বুঝতে পারছে না এত কষ্ট কেনো হচ্ছে তার? সৌহার্দ তো চলে যাচ্ছে। তার কি হবে?কীভাবে থাকবে সে? সবাইকে কীভাবে সামলাবে? তার ইচ্ছা করলো, শাড়ির আঁচলে বেঁধে সৌহার্দকে আটকে রাখতে।
সবার চোখে জল। এ যেনো কান্নার অনুষ্ঠান চলছে। বহু কষ্টে সৌহার্দ নিজেকে সামালিয়ে সবাইকে বিদায় দিয়ে বের হয়ে যায়। সময় হয়ে গিয়েছে,তাকে যে যেতেই হবে।
চলবে