অসুখের নাম তুমি (পর্ব-০৯,১০)
সোনালী আহমেদ
পর্ব-৯
যথাসময়ে হাসপাতালে নিয়ে আসা হয় সুমিকে। সবার অবস্থা বেশ ভয়াবহ। সুমির জন্য সবাই অধিক মাত্রায় চিন্তা করছে। এক একেক জনের চেহারার কি বিচ্ছিরি হাল হয়েছে! কারো মুখের অবস্থা তাকানোর মতো নয়। রেশমির মনের অবস্থাও সবার মতো বেগতিক। তবুও সে নিপুণ দক্ষতার সাথে সবাইকে সান্ত্বনা দিয়ে সামলে যাচ্ছে। সৌহার্দকে এত টা ভেঙ্গে যেতে দেখে তার ভেতর টা দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছে। তার খুব খারাপ লাগছে।
বেশ খানেক সময় ডাক্তারবাবু বেরিয়ে এসে প্রথম যে কথা টা বলে তা হলো,
—‘রোগীর স্বামী কে?’
প্রশ্ন টা সবাইকে নিরব করে দিলো,কেননা সজীব তো এখানে নেই। আশ্চর্য বিষয় হলো,কেউ সে কথা টাও বলছে না। বোধ হয়, মুখে তালা আটকিয়ে দেওয়া হয়েছে।
একই প্রশ্ন আবারো বলেন ডাক্তার। তার ২য় উচ্চারণে যেনো সবার সম্মতি ফিরে আসে। সৌহার্দ প্রশ্ন করে ওঠে,
—‘কেনো ডাক্তার?কি হয়েছে? আমার বোন ঠিক আছে তো? তার কিছু হয় নি তো?
রেশমি বাদে বাকিরাও একই প্রশ্ন করে। ডাক্তার হয়তো তাদের অস্থিরতা টের পেয়েছেন, তাই তো তিনি হেসে বলে ওঠেন,
—‘ তিনি বাবা হবেন সেজন্যই প্রথমে উনার খোঁজ করলাম।’
ডাক্তারের সহজ-সরল জবাব সকলকে চূড়ান্ত বিষ্মিত করে দিলো মুহূর্তেই। ফ্যালফ্যাল করে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকার পর কথাটির অর্থ বুঝতে সক্ষম হলো সবাই।
বেশ সময় পর ডাক্তারকে দাদী প্রশ্ন করে,
—‘ সুমির কি অবস্থা?’
—‘ রোগী আপাতত ঠিক আছেন। অতিরিক্ত চিন্তার ফলে জ্ঞান হারিয়েছিলেন তিনি। কিছুদিন বিশ্রাম নিলেই দ্রুতই উনার দূর্বলতা কেটে যাবে। কিছুদিন পর যখন তিন মাস হবে তখন কিন্তু প্রায়ই এই ধরনের সমস্যা দেখা দিবে। তাই বিশ্রামের পাশাপাশি, উনার দূর্বলতা কাটানোর জন্য বেশি বেশি ভিটামিন জাতীয় খাবার খাওয়াতে হবে। আর বিশেষ করে চেষ্টা করবেন উনি যেনো সবসময় চিন্তামুক্ত থাকে। ‘
—‘ তিনমাস হবে মানে?’
—‘জ্বি,উনি এখন আড়াই মাসের প্রেগন্যান্ট। ‘
—‘ কিহ! কি বলেন ডাক্তার?’
—‘ জ্বি, রোগী হয়তো তার উপসর্গ গুলো আপনাদের জানায় নি। কিংবা তিনিই বুঝে উঠতে পারেন নি।’
বিছানায় বসে আছে সুমি। আজ তার কাছে অন্যরকম লাগছে।
মেয়েরা যখন প্রথমবারের জন্য মা হওয়ার সু-সংবাদ শুনে তখন তার অনুভূতি টা হয় আকাশচুম্বী! হবে না ই বা কেনো? মা হওয়ার অনুভূতি টা ই যে এমন স্নিগ্ধ। সেই সময় খুশির অঢেল বন্যা বইতে থাকে মনে। পবিত্র সেই অনুভূতি টা খুব সহজেই ছড়িয়ে পড়ে শরীর জুড়ে। এ এক এমন অমূল্য সুখ যা পৃথিবীর অন্য কোথাও টর্চ দিয়ে খুঁজলেও পাওয়া যাবে না।
বিশ্বাস হচ্ছে না? তাহলে এক বন্ধ্যা নারীর কাহিনী না হয় শুনে নিয়েন। তার মা না হওয়ার আক্ষেপ, বাচ্চা না দিতে পারার অক্ষমতা কতটা কষ্ট আর যন্ত্রণা দেয় তাকে।
বাড়ীর লোকের দিকে লজ্জায় সে তাকাতেও পারছে না। দাদীর দেখা পেলে সাথে সাথে মাথা লুকানোর জায়গা খুঁজে বেড়ায়। এই দাদীমার লাজ-লজ্জা কিছুই নেই। তিনি দিব্যি সুমিকে এই সেই বলে লজ্জা দিয়ে যাচ্ছেন।
সজীবকে জানানোর কথা হতেই,দাদী সাফ না করে জানিয়ে দেন যে,” কেউ জেনো কিছু না বলে,সুমি যেনো নিজে জানায়।”
ঘরের প্রত্যেক টা ব্যক্তির মুখে বাচ্চার সংবাদ শুনার পর হাসি ফুটলেও ফুটে নি লিনার মুখে। তার মুখের বিচ্ছিরি অবস্থা হয়ে আছে, সে কারো সাথে কথা বলছে না। পাশের বাড়ীর ইনি, উনি এসে দেখা সাক্ষাত করে যাচ্ছে, লিনা সেসব মুখ তুলেও দেখছে না।
বেশ রাত করেই রুমে আসে সজীব। বাড়ীতে আজ ও যথাসময়ে এসেছিলো,কিন্তু রুমে যাওয়া হয় নি। কারন আজ তাকে মায়ের রুমে যেতে হয়েছিলো। সেই থেকে মুখের অবস্থা বেশ বেগতিক। তাকে দেখলে মনে হবে,বোধ হয় কেউ জোর করে তাকে তিতা রস খাইয়ে দিয়েছে।
আট- দশ টা স্বাভাবিকভাবেই বাচ্চার সংবাদ দিতে পারে নি সুমি। তার আগেই সজীব কীভাবে যেনো জেনে গিয়েছে,যা তার অজানা।
—” আমি বাবা হবো, নাকি তুমি মা হবে?”
সজীবের এমন প্রশ্নে বিচলিত হয়ে যায় সুমি। সে ধরতে পারছে না কথা দুটোর ভিন্নতা। তার মাথা কেমন ভোঁ ভোঁ করছে।
শূন্য দৃষ্টিতে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইলো।
—‘কি হলো বলছো না কেনো?”
—” জ্বি,আমরা বাবা-মা হবো।”
—” কার বাচ্চা গর্ভে নিয়ে আমার নামে চাপিয়ে দিতে চাও? কার পাপের ফসল বুনতে চাও?”
—‘ এসব কি বলছেন আপনি?”
সজীব জবাব দেয় না। তার মেজাজ বিচ্ছিরি ভাবে বিগড়ে আছে। লাথি দিয়ে টুল টা ফেলে দিলো। দুই হাত মাথার ঝাঁকড়া ভর্তি চুলে দিয়ে খামছে ধরলো। অনেক্ষণ এদিক-ওদিক হেটে বাতি নিভিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়লো।
সুমি চুপ করে আছে, কিছু বললে হয়তো লোকটা ক্ষেপে তার উপর ঝাঁপিয়ে পড়বে। তাই তর্ক করলো না। নিঃশব্দে চোখের জল ফেলে বিছানায় সে ও এসে জায়গা করে নিলো।
—” সরে ঘুমা, গায়ে লাগবি না। নাহলে খবর করে দিবো।”
সুমি বেশ দূরত্ব রেখেই শুয়েছিলো। এ কথা শুনে সে আরো ছিটকে সরে পড়লো। লোকটা এমন কেনো? তার ভেতর ছোট্ট একটা প্রাণ বেড়ে ওঠেছে। ভেবেছিলো মানুষ টা বুকে শুয়ে সারা রাত তার গল্প করবে। মানুষ টাও বুঝি পরম আদরে তার মাথার চুলে হাত বুলিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিবে।
সে প্রায়শই নিজেকে বলে,’জেগে জেগে স্বপ্ন দেখবি না সুমি,এসব তোর জন্য হারাম।’ তবুও দেখো একটু সুখের আভাস পেলেই সে একই ভুল করে বসে। সে বড্ড বোকা, বড্ড! তাই তো বারংবার একই ভুল করে বসে। স্বপ্ন ভাঙ্গা সংসার তার। এ তো জোড়া লাগবার নয়। কেনো স্বপ্ন দেখে সে? কাঁদতে কাঁদতে মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলো সে আর স্বপ্ন দেখবে না, কোনোদিন না।
৪.
বিছানায় গালে হাত দিয়ে বসে আছ রেশমি। দৃষ্টি তার হাস্যজ্জ্বোল সৌহার্দের দিকে। লোক টা বোনের বাচ্চার সংবাদ শুনার পর থেকেই বাচ্চার মতো ব্যবহার করছে। খুঁজে খুঁজে তাদের ছোট বেলার এবং বাবা-মায়ের দেওয়া জিনিসপত্র বের করছে। আর একটার পর একটা দেখিয়ে রেশমিকে নানান কথা বলে যাচ্ছে। বোনের প্রতি কতটা টান আর মমতা রেশমি বুঝতে বেগ পেতে হলো না। তার ও যদি একটা ভাই থাকতো সে বোধ হয় এমন করতো।
বাচ্চা বউ বাচ্চামি করলে মানা যায়,কিন্তু বুড়ো দামড়া ব্যাটা বাচ্চামি করলে মানা যায় কি! রেশমি এসব মানতে পারছে না।
তার মন হঠাৎ করে ভেবে উঠে, যখন এই বুড়ো দামড়া বাবা হবে তখন জানি কী করবে?
কথাটা ভাবতেই লজ্জায় লাল হয়ে আসলো তার মুখ। ছিঃ, সে এসব কি ভাবছে!
আবার ভাবলো আচ্ছা লোকটাকে একবার বলেই দেখি কী করে সে!মনের কৌতূহল মেটাতে সৌহার্দে একদম গা ঘেষে দাড়ায় রেশমি। খুব অস্বাভাবিক ভঙ্গিমায় ভাব ধরলো। সৌহার্দ অবাক হয়ে তার দিকে তাকায়। এ মেয়ে হঠাৎ এমন করছে কেনো?
সৌহার্দের কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বলে,
—” আপনাকে কিছু বলার ছিলো,,,,,!!”
—“কী?”
—” আ আ আপনি,,!!”
—“আমি কী?”
—“আপনি বাবা হবেন।”
কথাটা বলেই সৌহার্দের কানের থেকে মুখ সরিয়ে চোখ বন্ধ করে ফেললো। সৌহার্দের প্রতিক্রিয়া দেখার জন্য একটা চোখ অল্প খুলে তার দিকে তাকায়।
সৌহার্দের মুখের অবস্থা দেখে রেশমি না হেসে পারলো না। ইয়া বিশাল বড় হা করে তাকিয়ে আছেন তিনি। মনে হচ্ছে বিশ্বের সবচেয়ে আশ্চর্য বিষয় শুনেছে।
তব্দা লেগে যায় সৌহার্দ। বিয়ের এক টা সপ্তাহ না হতেই সে বাবা হবে? এসব কোনো কথা?
নিজেকে সামলে রেশমির দিকো তাকাতেই দেখলো সে নাই। ফুড়ুৎ করে বিছানায় কম্বলের ভেতর ডুকে পড়েছে। সৌহার্দ নিঃশব্দে হেসে ওঠে।
দরজায় ঠক ঠক আওয়াজ হতেই রেশমি ফট করে ওঠে আসলো। সৌহার্দের আগে ঝড়ের গতিতে এসে দরজা খুললো। এবার ও যদি দরজার ওপাশে বুড়ি হয় তাহলে কয়েক টা কথা শুনিয়ে দিবে সে।
পর পর দুবার এসে সৌহার্দকে এটা সেটা বলে নিয়ে গেছে তিনি। এ নিয়ে তিনবার হবে।
দরজা খুলতেই জমিলা কে দেখে রেশমি একদম বলে,
—-” এতবার দরজায় কড়া নাড়েন কেনো? নতুন নতুন বিয়ে হয়েছে আমাদের, বুঝেন না এখন ব্যস্ত থাকবো। এভাবে বারবার এসে ব্যাঘাত ঘটান কেনো?”
রেশমির নির্লজ্জের মতো জবাবে রোবটের মতো হয়ে যায় সৌহার্দ। লজ্জায় মাটিতে মিশে যেতে পারলে সে শান্তি পেতো। ছিঃ, দাদীকে এই মেয়ে মুখের উপর কীভাবে এসব বলছে?
রেশমি যে এমন কথা বলতে পারবে জমিলার ধারনার বাহিরে ছিলো। নাতির সামনে এভাবে লজ্জা দিলো। তিনি নিজের শরমকে প্রকাশ না করে, উল্টো রেশমিকে লজ্জা দিতে বলে,
—” স্বামীকে ছাড়া বুঝি থাকতে পারছো না? বাহ,বেশ তো।”
—” হ, থাকতে পারছি না। আপনি বলেন এবার আপনার কোন স্বর্ণের ধন নামিয়ে দিতে হবে উনাকে?”
—” না,কিছু নামিয়ে দিতে নয়। সূচনার মাথা ব্যাথা করছে। বেচারি বিছানা থেকে নড়তে পারছে না। তাই,,”
—” এখন উনি গিয়ে কি সূচনার মাথা খাবে?”
জমিলা থতমত খেয়ে যায়, এ মেয়ে খুব কথা বলছে। সময় আসুক,হাড়ে হাড়ে সব বুঝিয়ে দিবে। আর মাত্র কয় টা দিন বাচাধন, তোমার কপালের ভাত যদি না উঠাতে পেরেছি আমিও জমিলা বেগম নয়।
—” না,সৌহার্দ নয় তোমার কথা বলছি। একটু ওর মাথাটা টিপে দিলে বেশ উপকার হতো। সুমি তো অসুস্থ না হয় তাকেই বলতাম।”
—” আপনি কী করবেন? আপনি টিপে দেন।”
রেশমির কথা শুনে সৌহার্দ ভেতর থেকে ধমক দিয়ে বলে,
—” রেশমি!!! বড়দের সাথে এসব কি ধরনের কথা? যাও দাদী যা বলে করে দিয়ে আসো।”
—” আরে,আপনি বুঝতেছেন না…!”
—“আমার বুঝার দরকার নেই। তোমাকে আমি বলেছি যেতে তারপরেও মুখের উপর কথা বলছো কেনো?”
রেশমি রাগে গজগজ করতে বেরিয়ে গেলো। দাত চেপে বুড়িকে বিরবির করে বলে,
—‘ আসেন,আপনার কোন সূচনা,ফূচনার গলা টিপে দিতে হবে?”
জমিলা বেগম ক্ষেপে যান। আজ এই মেয়ের এক ব্যবস্থা না করে দম নিবেন না তিনি। মুখে খই ফুটেছে। বেশ কথা বলা,তাই না? আজ বের করছি কথা বলা। জমিলা বেগম ফুসে ওঠে হাত মুষ্টিবদ্ধ করলেন।
চলবে!
অসুখের নাম তুমি (পর্ব-১০)
সোনালী আহমেদ
জমিলা বেগম ক্ষেপে যান। আজ এই মেয়ের এক ব্যবস্থা না করে দম নিবেন না তিনি। মুখে খই ফুটেছে। বেশ কথা বলা,তাই না? আজ বের করছি কথা বলা। জমিলা বেগম ফুসে ওঠে হাত মুষ্টিবদ্ধ করলেন।
রেশমি হাটতে হাটতে পেছনে জমিলার সাড়াশব্দ না পেয়ে ঘুরে তাকায়। সে বেশ কৌতুহল নিয়ে জমিলার আগা গোড়া স্ক্যান করতে লাগলো। এ মহিলা এত শান্ত-শিষ্ট কীভাবে হলো? নিশ্চয়ই মনে মনে বুদ্ধি আঁটছে। দেখেছো, বয়স হয়েছে তবুও কাটনীতি যায় নি।
রেশমি রুমে ডুকতে দেখলো সত্যি সত্যি সূচনা বিছানায় শুয়ে আছে। চোখ মুখ দেখেই বুঝা যাচ্ছে শরীর টা ভালো নেই।
সূচনার মাথায় হাত দিতেই, সূচনা উপরে মুখ তুলে তাকালো। সাথে সাথে ছিটকে সরিয়ে দিলো রেশমির হাত। সে ভেবেছিলো তার অসুখের কথা শুনে নিশ্চই সৌহার্দ আসবে। কিন্তু এখানে তো রেশমি। এই মেয়ে কেনো এসেছে? কি চায় সে?
রেশমি হতভম্ভ হয়ে সূচনার দিকে তাকালো। মেয়েটা এমন করলো কেনো? গায়ে তো বেশ জ্বর মনে হচ্ছে। হাসিমুখেই তো তাকিয়েছিলো আবার মুহূর্তেই মুখের রং বদলে ফেললো কেনো? মেয়ে টার কি তার উপস্থিতি পছন্দ হয় নি? তাকে কি সহ্য করতে পারে না?
তাছাড়া তার বিশেষ নজরে এসেছে, যতবার ই এ মেয়ের সাথে দেখা হয় তখন কেমন ক্ষোভের নজরে তাকায়। সে কথা বলতে চাইলেই সঙ্গে সঙ্গে স্থান ত্যাগ করে ফেলে। মেয়েটা কি কোনো কারণ বশত তাকে পছন্দ করে না?
—-” আপনি! আপনি এখানে কেনো এসেছেন?”
—” দাদী বললো,আপনার নাকি মাথা ব্যাথা করছে,তাই মাথা টিপে দিতে আসলাম।”
—” নানী বলেছেন এই কথা?”
—” জ্বি।”
রেশমির জবাব তার কানে পৌঁছাতেই, চেঁচিয়ে জমিলাকে ডাকতে লাগলো সে।
—” নানী, নানী, নানী????”
জমিলা হন্তদন্ত হয়ে এগিয়ে আসলেন। অস্থির হয়ে প্রশ্ন করলো,
—-” হ্যা,হ্যা। কি রে এতবার ডাকছিস কেনো? এ মেয়ে কিছু করেছে নাকি? কি করেছে আমাকে বল।”
—” তুমি নাকি উনাকে আমার মাথা টিপে দেওয়ার জন্য নিয়ে এসেছো?”
—“হু।”
—-“কিন্তু কেনো? তোমাকে আমি কি বলেছি এই মেয়েকে নিয়ে আসার জন্য?
—” আরে ওকে না বললে তো,,,”
—“কি হবে? মরে যাবো?”
রাগে ফুলে ওঠছে সূচনা। এই মেয়েকে দেখলেই তার রাগ লাগে। তারপরেও দাদী কী বুঝে তাকে নিয়ে এসেছে? সে বুঝতে পারছে না।
তিনি কি বুঝেন না রেশমিকে দেখলে তার খারাপ লাগে। সাথে কষ্ট ও লাগে। বারবার মন বলে ওঠে, এ জায়গা তো তার প্রাপ্য,রেশমির নয়। মনের অজান্তেই হিংসা করে বসে।
জমিলা বেগমের চোখেমুখে বিরক্তির রেশ। এ বোকা মেয়েটা কিচ্ছু বুঝে না। সে তো ওদের আলাদা রাখতেই রেশমিকে নিয়ে এসেছে। অথচ তাকে দেখে কি সুন্দর ওকে তাড়িয়ে দিতে চাইছে।
তিনি ইশারায় তাকে বারবার বুঝাতে লাগলো। সূচনা অনেক্ষণ তাকিয়ে থাকার পরে বুঝতে সক্ষম হয়েছে। সাথে সাথে চেহারার রং বদলিয়ে সে রেশমিকে বলে,
—” আহ্, যন্ত্রণা বেড়ে গিয়েছে। আমার খুব কষ্ট হচ্ছে। আ্ আপু একটু মাথা টিপে দেন না।”
রেশমি অবাক হয়ে যায় সূচনার হঠাৎ করে ফেলা আচরণে। এদিকে সূচনা আরো চিৎকার দিয়ে যাচ্ছে ব্যাথায়। তাই সে আর কোনোকিছু না ভেবে মলম নিয়ে কপালে খানিকক্ষণ ঘষিয়ে হাত দিয়ে টিপতে লাগলো।
রেশমির স্পর্শ সূচনার গায়ে কাটা দিলেও মষ্তিষ্কে এক চরম সুখ দিচ্ছে। রেশমির সাথে যদি দ্বন্দ্ব না থাকতো নিশ্চিত এতক্ষণে তার হাতের জাদুর গুনগান করে ফেলতো। এত আরাম লাগছে যে মুহূর্তেই ব্যাথ্যা ভ্যানিস হয়ে গিয়েছে মনে হচ্ছে। জমিলা বেগম আয়েশ করে বসে পান খাচ্ছেন। আজ কোনো মতেই এ মেয়ে কে যেতে দেওয়া যাবে না।
ঘন্টা খানেকের মতো সূচনার মাথা টিপে দেওয়ার পরেও সূচনা বলছে না যে আর লাগবে না। এদিকে রেশমির হাত ব্যাথায় কাত হয়ে যাচ্ছিলো। সে কয়েকবার জিজ্ঞেস ও করে নিয়েছিলো যে ‘হয়েছে,হয়েছে?’ সে একটা মানুষ, কোনো যন্ত্র নয় যে ঘন্টার পর ঘন্টা টিপে যাবে।
জবাবে, সূচনা এদিকে ওদিক দেখিয়ে বলেছে,’এখানে দাও- ওখানে দাও।’
হাত আর চলছিলো না বলে রেশমি ওঠে বলে,
—” আপু,আমার হাত ব্যাথ্যা করছে,ঘুম ও আসছে তাই আমি চলে যাচ্ছি। ”
ঠিক তখন ই জমিলা বেগমের পায়ের ব্যাথা দেখা দেয়। তিনি সোজা হয়ে হাত পা পালঙ্গে ছুঁড়তে ছুঁড়তে ‘ব্যাথ্যা ব্যাথ্যা’ বলে আওয়াজ করতে লাগলেন। রেশমি চলেই যাচ্ছিলো কিন্তু বুড়ি তখন ক্রমাগত চেঁচাতে চেঁচাতে বলতে লাগলো,
—‘ ও সজীব,ও সৌহার্দ তোরা কই রে? দাদী পায়ের ব্যাথ্যায় মরে যাচ্ছি রে।’
রেশমির আর যাওয়া হলো না। তৎক্ষণাৎ ফিরে এসে জমিলার পায়ের পাশে বসলো। পায়ের দিকে তাকিয়ে মনে মনে বলে ওঠে, ‘ ঝামেলা বুড়ি,বুড়ো বয়সে ভিমরতি! দাড়াও ছুটাচ্ছি তোমার ব্যাথা।’
রেশমি, জমিলার পায়ে হাত দিতেই একসাথে উপস্থিত হয়, ‘ সজীব আর সৌহার্দ।’
দাদীর চিল্লানোর আওয়াজ কানে যেতেই ঘুম ভেঙ্গে গিয়েছিলো। পিছন পিছন সুমিও এসে উপস্থিত হয়। সুমি আর সৌহার্দের চোখে ঘুম আর ঘুম। দুজনে চোখে কানে কিছুই দেখছে না। তবুও প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে দাদীর রুমের দিকে উঁকি দিলো সবাই।
জমিলা বেগম তখন পায়ের ব্যাথায় কাতরাচ্ছেন। কেঁদে কেঁদে পা ব্যাথা বলে চিল্লাচ্ছেন।
—” কি হয়েছে দাদী? চিল্লাইতেছো কি জন্যে?”
—” ওরে,তোরা এসেছিস! আমি মনে হয় আর বাঁচুম না রে। তোরা আমারে মাফ করে দিস, আমি মরলে আমার জন্য মিলাদ পড়াইস।”
সজীব বিরক্তি নিয়ে বলে,
—“আহা,দাদী এসব কি বলছো?”
—-” আমি কি আর এমনি এমনি বলছি? দেখে যা আমার পায়ের অবস্থা। ব্যাথায় টনটন করতেছে, মনে হচ্ছে সাপের কামড়ের দিছে। ও আল্লাহ,তুমি কই! আমারে বাঁচাও। কেউ একটু পা টাও টিপে দেয় না গো। এরা আমাকে মেরে ফেলবে গো!”
রেশমি মুখের করুণ অবস্থা করে ফেললো। হাত নাড়াতে না পারার মতো করে বলে ওঠে,
—” দাদী, আর কোথায় ব্যাথা করছে?এখানে তো দু ঘন্টার মতো দিলাম। অন্য কোথাও কি ব্যাথা করছে?”
জমিলা বেগম টাসকি খেয়ে রেশমির দিকে তাকায়। এ মেয়ে তো একবারো এখন ঠিকমতো হাত দেয় নি আর বলছে দুঘন্টার মতো টিপেছে।
ওদিকে সৌহার্দ বকার সুরে বলে,
—-” উফফ দাদী, রেশমি তো পা টিপেই দিচ্ছে।”
—“মিথ্যা, মিথ্যা! এ মেয়ে একবারও দেয় নাই। ও ভং ধরছে। বিশ্বাস কর,আমি সত্য কইতাছি।”
সুমি তখন এগুতে এগুতে বলে,
—” দাও,দাদী আমি টিপে দেয়।”
সজীবের মাথা বিগড়ে গেলো। সে তখন ধমক দিয়ে বলে ওঠে,
—” এক চড় দিবো যে চোখে কানে কিছু দেখবি না। তোকে কেউ বলেছে টিপে দিতে? আমাদেরকে কি কাজ দেখাতে চাস? আবার বলে ‘দাও,আমি টিপে দেই।’ যাও রুমে যাও। আমি এসে যেনো ঘুমে দেখি নাহলে অবস্থা খারাপ করে ফেলবো। বেয়াদপ,কোথাকার। ”
সুমি দাত চেপে কান্না আটকায়। ভাইয়ের দিকে এক পলক তাকিয়ে মাথা নিচু করে রুমের দিকে চলে যায়।
—“আর দাদী, উনি মিথ্যা বলছে না সত্য সেটা উনার দিকে তাকালেই বুঝা যায়।”
—” আরে,তুই বিশ্বাস কর, আমি….!!”
–“আমার বিশ্বাস করা লাগবো না, ভাবী আপনি সরুন তো। আমি টিপে দিবো। যান,আপনি যেয়ে ঘুমান।”
রেশমিও পেয়েছে সুযোগ, সে ‘আচ্ছা ভাই’ বলে ওঠে যায়। ওর দিকে তাকালে যে কেউ বলবে,ওর হয়তো বল-শক্তি সব শেষ।
সৌহার্দ হাত মুষ্টিবদ্ধ করে দরজায় দাড়িয়ে আছে। বোনের ছলছল দৃষ্টি দেখে সে নিজেকে সামলাতে পারছে না। তার ইচ্ছা করছে সজীবকে এখন ই মাটিতে পুঁতে ফেলতে।
সে গর্জে ওঠে বলে,
—” আমার বোনকে এভাবে বলার দুঃসাহস আপনার কোথা থেকে এলো?”
সজীব নির্বিকারে বলে,
—” সে আমার বউ। আর আমার বউকে মারার-কাটার সব কিছুর দুঃসাহস আমার আছে।”
সৌহার্দ ফুসে ওঠে। রেশমি অবস্থা বেগতিক দেখে সৌহার্দকে টেনে নিয়ে আসলো।
সৌহার্দ ভীষণ রেগে আছে। ঘরের নির্জীব বস্তুদ্বয়ের উপর নিজের রাগ মেটানোর পূর্ণ চেষ্টায় আছে। রেশমি ভয় পেয়ে যায়। সে এর আগে সৌহার্দকে এমন রাগতে দেখে নি। সৌহার্দের মেজাজ ঠিক ই হচ্ছে না। সব কিছু ধ্বংস করতে পারলেই বোধ হয় তার কলিজায় শান্তি মিলতো।
নিজেকে তার নিকৃষ্ট মনে হচ্ছে, চোখের সামনে বোনকে কষ্ট পেতে দেখেও কিচ্ছু করতে পারলো না সে। তার মতো হতভাগী কেউ আছে?
সে রেগে গিয়ে মাথার চুল খামছে ধরলো। বসে বসেই সে ফোঁপাচ্ছে।
—“আপনি এমন করছেন কেনো,উনি ভুল কিছু করেন নাই। আপনি বুঝার চেষ্টা করুন।”
সৌহার্দের চোখদুটো লাল হয়ে ওঠে, আচমকা ওঠে রেশমির বাহুদ্বয় ধরে বলে,
—” আমার চোখের সামনে সব ঘটেছে আর তুমি বলছো, আমার বুঝার ভুল? ”
—“হু,ভুল। কারণ যদি এমন হতো,তাহলে উনি নিজে দাদীর পা টিপতে যেতেন না। আপুর সাথে উনিও চলে যেতেন। আপুকে পাঠিয়ে দিয়ে,আপুর বদলে উনি টিপতে বসেছেন। কারন উনি চাইছিলেন না যে আপু কাজ টা করুক।”
—“তাই নাকি?তাহলে সেটা ভালোভাবেও বলা যেতো। ”
—“ভালোভাবে বললে আপু কি শুনতো বা আপনার দাদী কি মানতেন? দেখা যেতো, দাদী এটা নিয়ে খিল্লি উড়াতেন। আপুকে ডাক্তার বিশ্রাম নিতে বলেছিলো, উনি যদি এখন রাত জেগে দাদীর পা টিপতেন তাহলে নিশ্চই আপুর শরীর খারাপ করতো। আপনিই বলুন,উনার কি দোষ ছিলো? ”
সৌহার্দের মুখে কথা নেই। রেশমি যা বলছে তা কি ঠিক? নাকি এসব রেশমির মনগড়া কাহিনী?
—” জানেন, উনি এতক্ষণ জেগে ছিলেন, হয়তো আপুর মাথায় হাত ও বুলাচ্ছিলেন।”
সৌহার্দ ভ্রু কুচকে বলে,
—” তুমি কীভাবে জানো?”
—“উনার মুখ থেকে বিড়ির গন্ধ করছিলো আর যখন দাদীর পায়ে হাত দিচ্ছিলেন তখন হাতে লম্বা চুল দেখেছিলাম।”
সৌহার্দ রেশমিকে ছেড়ে দিলো। প্রাণহীনের মতো হেটে বিছানায় বসলো। তার মাথা কাজ করছে না। রেশমি যা বলছে তা সত্য নাকি সে যা দেখেছে সেটাই সত্য! দ্বিধায় ভুগতে লাগলো সৌহার্দ। তার ভেতর কেমন অস্থিরতা কাজ করতে লাগলো। এ কেমন ধাঁধায় আটকে গেলো সে! দক্ষিণের জানালা দিয়ে মৃদু বাতাস এসে সৌহার্দের গা ছুঁতেই তার শরীর ঠান্ডা হয়ে আসলো। রেশমি এসে তার পাশে বসে কাঁধে হাত রাখলো। এতক্ষণের তেজ আর রাগ দুটোই বরফের মতো গলে পানি হয়ে গেলো। বাহিরে প্রবল বেগে বাতাস বইছে। টিপ টিপ ফোঁটা পড়ে বৃষ্টি নামার আভাস দিতে লাগলো আকাশ।
চলবে!