অসুখের নাম তুমি,প্রথম পর্ব

অসুখের নাম তুমি,প্রথম পর্ব
সোনালী আহমেদ

বিবাহের প্রথম রজনীতে প্রথমবারের মতো মেয়েলী সমস্যা দেখা দেয় রেশমি’র! সবে মাত্র চৌদ্দ বছর শেষ হয়েছে তার। সে জানে এর নাম ‘পিরিয়ড’। মা তাকে বলেছিলো এ ব্যাপারে। ক্ষণে ক্ষণে তাকে প্রশ্ন করতো এ নিয়ে। আশুরা বেগমের কত চিন্তা ছিলো এ নিয়ে। কে জানতো বিয়ের রাতেই তার মেয়ে সাবালিকা হয়ে ওঠবে!

নব বধূর বেশে বিছানায় চেপে বসে আছে রেশমি।বুকের ভেতর ডিপডিপ আওয়াজ হচ্ছে। ভয়ে দেহখানা প্রচন্ড কাঁপছে। কি হবে? কি করবে? এমন ভাবনাই তার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে।এমন সময় দরজায় হাসি-রসিকতার আওয়াজ ভেসে আসলো।

দরজার সামনেই গেইট পেতে সৌহার্দকে আটকে রেখেছে তার বোন-ভাবীগণ। তাদের দাবী হাজার খানেক টাকা দিলেই তাকে ভেতরে ডুকতে দেওয়া হবে। প্রস্তাব শুনতেই তৎক্ষণাত না করে দেয় সে। ‘নিজের রুমে যেতে আবার কিসের টাকা?’ এমন যুক্তি সে তাদের বুঝাচ্ছে।
এ নিয়েই মিনিট খানেক থেকে তর্ক-বিতর্ক চলছে তাদের মধ্যে।

সৌহার্দর একমাত্র বোন সুমি ন্যাকা কান্নার সুরে বলে ওঠে,—” দাভাই! তুমি এমন ক্যা বলো তো? বিলেত থেকে এত এত টাকা নিয়ে আসলা। আমাগো রে মাত্র কয়ডা টাকা দিতে তোমার হাত কাঁপতাছে?”

—” বিলেতে তো আমার চাঁদপানা মুখ দেখেই টাকা দেয়,না রে?”

সুমি মুখ ফুলিয়ে বলে,–“আচ্ছা বেশ। শ’পাঁশেক টাকা দিলেই হবে।”

সৌহার্দ বোনের ওমন মুখ দেখে আর কথা বাড়ালো না। পকেট থেকে চকচকে একশ টাকার নোট পাঁচখানা বের কর দিলো সুমির হাতে। টাকা পেতেই দরজা থেকে সরে সুমির দিকে অগ্রসর হলো সবাই। সুযোগ বুঝে সৌহার্দ রুমে ডুকে তড়িঘড়ি চিটকানি টা লাগিয়ে দিলো।

হবু বরের উপস্থিতি রুমে বুঝতেই হিমশীতল হাওয়া বয়ে গেলো রেশমি’র শরীরে। তার দেহখানা আগের চেয়ে দ্বিগুণ গতিতে কাঁপছে। ভয় আর অস্বস্তিতে নয়নমণিতে পানির ঢেউ খেলে গেলো। বেনারসির ভারে সে নুয়ে পড়েছে।মাথার উপরের ঘোমটাখানা ঠৌঁট বরাবর দিয়ে বিছানায় বসিয়ে রাখা হয়েছে।

সৌহার্দ ছোট ছোট কদম ফেলে বিছানায় বসলো। চাপা উত্তেজনা নিয়ে সে তার নব বিবাহিত বউয়ের মুখের ঘোমটা টা তুলে ধরলো।
এ কি! বউয়ের চোখে এত পানি! সে তো ভেবেছিলো লজ্জারাঙ্গা একখানা পূর্নিমার আলোর মতো মুখ দেখতে পাবে। এ তো হলো উল্টো কান্ড!

নববধূর উজ্জ্বল জলমলে মুখ না দেখতে পেয়ে মলিনতা দেখা দিলো সৌহার্দের মুখে।

রেশমি দ্বিগুন ভয় পেয়ে গেলো। সে তাকায় নি,চোখ বন্ধ করে আছে। মামি তাকে বুড়ো টাকলা ব্যাটার সাথে বিয়ে দিয়েছে এ কথা সে বিয়ের আগে একমাত্র মামাতো বোনের কল্যাণে জেনে গিয়েছে। যা রেশমির মনে এক ঘৃণার জন্ম দিয়েছে। তাই সে তাকাতে চায় না ওই মুখের দিকে।

বাবা মারা যাওয়ার পর মাকে নিয়ে একমাত্র মামার বাসাতেই মাথা গুজানোর ঠাঁই হয় তার। মামা-মামী প্রথম প্রথম সহানুভূতি দেখালেও ধীরে ধীরে আসল রুপ বের হয়ে আসে তাদের। রেশমির মামী নানারকম নির্যাতন করতেন তার স্বামীর আড়ালে। একমাত্র মেয়ে রুহানীকে দিয়ে রেশমিকে কম মার খাওয়ায় নি তিনি। বলতে গেলে রেশমিকে ঝিঁ এর মতো খাটাতেন।
মায়ের কাছে বলেও কোনো লাভ হতো না রেশমির। বিপরীতে আশুরা বেগম রেশমিকে বকাঝকা করতেন। বেশির ভাগ সময় গালাগালি করতেন। যেদিন তিনি বলেছিলেন,–‘ বাবাকে খেয়েও তোর হয় নি? এখন আবার আমার ভাইয়ের সংসারে আগুন লাগাতে চাস মুখপুড়ী?” সেদিনের পর আর কোনোদিন রেশমি তার মায়ের কাছে কোনোকিছুর বিচার দেয় নি। কথাটা তাকে পাথরের মতো করে দিয়েছিলো। সে জানে না এ কথার অর্থ কত?কিন্তু খুব কষ্ট পেয়েছিলো। কথাটি যখনই মনে আসে তখন ই তার চোখে অটোমেটিক জল চলে আসে।

আজ তার মামাতো বোনকে নতুন ক্লাস ভর্তি করিয়েছেন তার মামা আর এদিকে আজই তাকে বিয়ে দিয়ে দিয়েছে। পড়ালেখার জন্য তার অনেক স্বপ্ন ছিলো, যা পলকেই ধূলিসাৎ হয়ে গেলো।

—” পেটে হাত দিয়ে চোখ দিয়ে জল বিসর্জন দিচ্ছো। অর্থাৎ পেট ব্যাথ্যা করছে,তাই না? ”

বাঁশির মধুমাখা সুরের আওয়াজ পেয়ে বিষ্মিত হয়ে যায় রেশমি। সে মনে মনে বলে,’টাকলা ব্যাটার আওয়াজ তো চিকন শুনাচ্ছে,কীভাবে? ব্যাটার কন্ঠ তো- ভাঙ্গা ভাঙ্গা মোটা মোটা শুনানোর কথা? কাহিনী কি?’

কথাটা ভেবে না শেষ করতেই চোখ খুলে ফেলে সে। কিন্তু আফসোস, মুখের উপর বেনারসির লম্বা ঘোমটার কারণে সামনের ব্যক্তিটিকে দেখা নসিবে জুটলো না। ঘোমটার আড়ালেই মাথা নাড়ায় সে। সৌহার্দ ফুশ করে নিঃশ্বাস ছাড়লো। তার মনে অন্য ধারনা ছিলো।

যাক তাহলে পেট ব্যাথা বলে কাঁদছে। নিশ্চই আজেবাজে কিছু খেয়েছে।

সৌহার্দ প্রশ্ন করে,–” তোমাকে কি ওরা উল্টাপাল্টা কিছু খাইয়েছিলো?”

প্রশ্নের বিপরীতে বোকা বোকা চাহনীতে তাকায় রেশমি। কি বলছে এ বুড়ো ব্যাটা? কে তাকে কি খাইয়েছে? সে ঘোমটার ভেতর থেকেই মিনমিন গললায় প্রশ্ন করে,—” কারা?”

—‘তোমার মামা-মামী? ”

রেশমি জবাব দিলো না। মামা-মামী তো খাবার ই দেয় নি। আবার উল্টাপাল্টা খাবার। তার ভেতর প্রচন্ড লজ্জা আর সংকোচ কাজ করছে।
হঠাৎ পেটের ব্যাথা তীব্র আকার ধারণ করতে লাগলো। রেশমি দাত চেপে কান্টা আটকানোর বৃথা চেষ্টা করলো। সফল হতে না পেরে হালকা শব্দ করে কেঁদে দিলো। সৌহার্দ ভড়কে যায় তার এমন কান্ডে।

কোনে উপায় না পেয়ে সে তার বোন সুমিকে ডেকে নিয়ে আসে।
‘কি হয়েছে দাভাই?’

‘ তোর ভাবীর কি হয়েছে একটু দ্যাখ তো। সে আমাকে কিছু বলছে না।’

এ বলে সৌহার্দ দরজা টেনে দিয়ে বাহিরে অপেক্ষা করতে লাগলো। কিছুক্ষণ পর সুমি ভরাক্রান্ত মুখ নিয়ে ফিরে এলো।

‘দাভাই…’

‘হ্যা, কিরে কি হয়েছে?কিছু বলেছে?’

সুমি আমতা আমতা করতে লাগলো। কথাটা সে কীভাবে বলবে ভেবে পাচ্ছে না। সৌহার্দ বোনকে চুপ করে থাকতে দেখে বলে,’ সুমি কি হয়েছে বল? বড় কোনো অসুখ নাকি?ডাক্তার নিয়ে আসা লাগবে নি?’

‘ না,না। ডাক্তার লাগবে না। আসলে,’

‘আসলে কি?’

‘ ভাবীর ওইসব দিন চলছে। বুঝেছো তো?’

সৌহার্দের অশান্ত মন হঠাৎ থমকে যায়। কয়েক সেকেন্ডের জন্য চুপ করে যায়।

‘ওহ।’

বলেই সৌহার্দ চলে যেতে চাইলো। সুমি বলে উঠে,’ভাই,’

‘হ্যা,হ্যা। কিছু বলবি?’

সুমি মাথা নিচু করে বলে,’ এটাই ভাবীর প্রথম।’

সৌহার্দ হঠৎ করে চেচিয়ে বলে ওঠে,’কিহ।’

সুমি মাথা নাড়িয়ে চলে যায়। আর সোহার্দ নির্বাক হয়ে ওখানে দাড়িয়ে রইলো। বিরবির করে বলে,’ ও আল্লাহ। এত ছোট ও! মামার সাথে বিয়ে হলো কি যে হতো? শুকরিয়া খোদা।’

কয়েক সেকেন্ড দরজার বাহিরে থম মেরে দাড়িয়ে রুমে প্রবেশ করে দরজা টা লাগিয়ে দিলো সোহার্দ। রেশমির বুক দুকদুক করছে। সৌহার্দ ধীর পায়ে এগুতে লাগলো।

চলবে,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here