শূন্যতায় অস্তিত্ব (দ্বিতীয় পর্ব)
লেখাঃ তাজরীন খন্দকার
যার থেকে পালিয়ে বেড়াচ্ছিলাম ,তার কাছেই সপে দেওয়ার সিদ্ধান্ত? কিন্তু সে কেন এটা করতে চাচ্ছে?
আমার মাথা কোনো কাজ করছেনা।
তারপর এতকিছু আর না ভেবে আমি এক দৌঁড়ে দাদুর রুমে গেলাম, আমি যাওয়ার সাথে সাথে দেখি আমার বাবা দাদুর পাশ থেকে উঠে দাঁড়িয়েছে আর নিজের মুখ অন্যপাশে ঘুরিয়ে নিয়েছে। বাবার প্রতি যে রাগ নিয়ে এই মূহুর্তে এখানে এসেছি সেটা নিমিষেই নিঃশেষ হয়ে গেলো। দাদু সত্যি খুব অসুস্থ, হাতে এখনো একটা স্যালাইন চলছে।
বাবা চুপিচুপি রুম থেকে বের হয়ে গেলো।
আমি দাদুর পাশে বসতেই উনি চোখ খোলে আমাকে দেখে ডুকরে কেঁদে উঠলেন। আমাকে প্রতিবার দেখলেই দাদু খুশিতে কেঁদে ফেলে,কিন্তু আজকে দাদুর শরীরের অবস্থা দেখে আমারও ভীষণ খারাপ লাগলো।
মাথায় কিছুক্ষণ হাত বুলিয়ে বললাম,
___দাদু বাইরের লোকজন আমার বিয়ে নিয়ে কি বলছে?
দাদু আবার কেঁদে উঠলো। আমি বুঝলাম না, আজকে উনি এতো বেশি কাঁদতেছে কেন! আমি উনাকে চুপচাপ থাকতে বলে মা’কে গিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম,
__ বাবা কোথায় বলো?
মা কিছুটা শঙ্কিত হয়ে বাম দিকে দেখিয়ে দিলো।
দেখলাম বাবা বসে সিগারেট খাচ্ছে। আমাকে দেখেই বাবা সিগারেটটা নিচে ফেলে পা দিয়ে ঢেকে নিলেন।
কাছে গিয়েই রাগী স্বরে বললাম,
___তুমি না সিগারেট ছেড়ে দিয়েছো? এখন এসব কি?
বাবা মাথা নিচু করে চুপ করে রইলেন। আমি কয়েকটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বাবার পাশে গিয়ে বসলাম।
আস্তে আস্তে বললাম,
___ বাবা আমি আমার বান্ধবীদের সঙ্গে শেয়ার করিনা এমন কথাও কিন্তু তোমাকে বলি। আমার মা জানেনা অথচ তুমি জানো আমার জীবনের হাজারো ঘটনা। আমার কাছে আমার বাবা পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ বন্ধু।
তুমি তিয়াসকে খুব ভালো করেই চিনতে, বলো চিনতে না? আমি তোমাকে বলিনি? তাহলে কি করে আমাকে না জানিয়ে তার সাথে আমার বিয়ে ঠিক করে ফেললে? বাবা আমরা ওদের মতো উচ্চবিত্ত না হতে পারি কিন্তু আত্মসম্মানবোধ তো আছে নাকি?
বাবা এবার মুখ তুলে বললেন,
___ বিয়ে ঠিক করেছি এই কথা কে বললো তোকে?
আমি মাথা নেড়ে বললাম,
___ওই যে ওই বাসার ভাবী।
বাবা আমার মতো করে ওইদিকে তাকিয়ে বললো,
___মাসুদের বউ নীরার কথা বলছিস? আরে ওর মাধ্যমেই তো প্রস্তাব পাঠিয়েছে। ওর জেঠাতো ভাইয়ের, শ্বশুরবাড়ির আর কি কি ভাবে যেন তারা আত্মীয়। ওরা বলছে যে তুই রাজী থাকলে কালই গায়ে হলুদ এবং পরশু বিয়ের আয়োজন করে ফেলবে৷ কিন্তু আমি বলছি আমার মেয়ের সিদ্ধান্ত ছাড়া আমি কিছু বলতে পারছিনা। কিন্তু তারা বলে আপাতত ছোটখাট আয়োজনে, পরে নাকি..
এইটুকু বলার পরে বাবার কথার উপরে আমি জোর গলায় বললাম,
___ তোমার কি মনে হয় আমি রাজী হবো? তুমি ডিরেক্ট না বলে দিলে না কেন? এইবাড়ি সেইবাড়ি এটা রটানোর কি দরকার ছিল? এখন লোকজন ভীড় করে আমাকে দেখতে আসছে!
___ আমি সেদিনই তো জানাতাম। কিন্তু তোর ফোন বন্ধ। আজকে তোকে না পেলে আমি নিয়ে আসার জন্য যেতাম ওখানে। তোর কথা ছাড়া আমি “না” সম্মতিটাই কি করে দিবো বল তো?
___ বাবা আমি ওদের জন্য বাসা বদলে ফেলেছি। গেলেও আমাকে খুঁজে পেতেনা। যাই হোক দাদু হঠাৎ অসুস্থ হলো কীভাবে?
___তোর দাদু কিছুদিন ধরেই অসুস্থ। এই সমন্ধ আসার পরে উনি বারবার বলছেন, উনার আয়ু কম অন্তত নাতনির বিয়ে দেখা থেকে যেন বঞ্চিত না করি। আর তিয়াস আর ওদের পরিবার আসছিলো যে, তখন তোর দাদুর সাথে তিয়াস অনেক্ষণ বসে কথা বলছে, কেন জানি ওই ছেলেকে এতো পছন্দ হয়েছে, আমাকে সেদিন থেকে পাগল পাগল করে দিচ্ছে এখানেই বিয়ে ফিক্সড করতে। আমি বারবার বুঝাতে চেয়েছি তোর সামনে পরিক্ষা, তোর অনেক স্বপ্ন, কিন্তু কিছু বললেই কেঁদে বুক ভাসিয়ে ফেলতেছে।
আমি উঠে দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে দুই চোখ বন্ধ করে বললাম,
___ ঘরে চলো বাবা। দাদুকে আমি দেখছি!
ঘরে প্রবেশ করে দেখি নীরা ভাবী দাদুর পাশে বসে গুনগুন করে কি জানি বলছে। আমাকে দেখেই ভাবী কিছু না বুঝার ভান করে সরে বসলো। আমার বুঝতে বাকি রইলোনা দাদুকে ওরাও রাতদুপুরে কানপড়া দেয়। তাকিয়ে দেখলাম স্যালাইন প্রায় শেষ দিকে, আমি সেটাকে খুলতে খুলতে বললাম,
___ দাদু পাত্র পছন্দ হয়েছে?
দাদু আস্তে আস্তে উঠার চেষ্টা করে দাঁত ছাড়া গালে ফিক করে হেসে বললো,
___মাশাল্লাহ ছেলে পুরো নায়েক!
আমি ধপাস করে বসে, দাদুর খুব কাছে গিয়ে বললাম,
___ তাহলে তুমি বিয়ে করে ফেলো। তোমাদের দুজনকে মানাবে বেশ!
দাদুর হাসিমুখটা তখন পেঁচার মতো করে হয়ে গেলো। পেছনে বাবা দাঁড়িয়ে ছিল উনি হাসতে হাসতে চলে গেলেন কিন্তু এখানে ভাবীটা বসে বসে হাসতেছে।
দাদু পরক্ষণে চেহেরাটায় একটা ভাব এনে বললো,
___জোয়ান বয়সে আমিও কম ছিলাম না বুঝলি? তোর দাদা তার চাচাতো ভাইয়ের জন্য আমাকে দেখতে গেছিলো , কিন্তু আমাকে দেখার পরে এমন পাগল হয়েছে যে, আমাকে বিয়ে করে তারপর তবে থেমেছে। আমাকে মজা করে রূপবান বলেও ডাকতো।
দাদুর কথা শুনে আমি হুহু করে হেসে উঠলাম। কয়েক মিনিটের জন্য আমার ভেতরের যন্ত্রণাগুলো থেমে গিয়েছিল কিন্তু সেটাকে জাগ্রত করে দিলো নীরা ভাবী। তিনি বললেন,
___লিয়া কাল সকালে রোজিনা খালা আর তিয়াস আসবে তোমার সাথে কথা বলতে।
আমি ভেতরে প্রচন্ডরকম রাগ নিয়ে মুখে একটা হাসি ঝুলিয়ে উনাকে বললাম,
___খুব ভালো ঘটকালি করেন তো ভাবী। এতো কম বয়সে মানে বলতে চাচ্ছি এখনো তো বাচ্চাকাচ্চা বড় হলোনা, এখন থেকেই কি নিখুঁত ঘটকী করেন। আপনি আমাদের এলাকার রত্ন হবেন!
উনার চেহেরার দিকে তাকিয়ে বুঝিনি মনে মনে আমাকে বকছে কিনা। তবে মুখে হাসি একটা ছিল, যেটা এই মূহুর্তে আমার মুখে আছে। রাগ থেকেই বোধহয় উনি এইরকম চাপা হাসিতে বুঝাতে চাচ্ছেন আমার কথায় কিছু মনে করেননি।
রাতে নানা রকম চিন্তা, অল্প পড়ালেখা আর পরিবারের সঙ্গে এই বিয়ে কীভাবে ভাঙবে সেসব নিয়ে আলোচনা করে অনেক দেরিতে ঘুমালাম। পরিবারের সবাই জানে আমি আগে নিজের ক্যারিয়ার গড়তে চাই তাই বিয়ে করতে চাচ্ছিনা, শুধু বাবা জানে আসল রহস্যটা কি। বাবাকে পূর্বেই মানা করেছি যাতে মা’কেও এসব না জানায়। কারণ আমার মা আমার বাবার থেকে বেশি শাসন করে, এমনকি বাবাও মাকে কিছুটা ভয় পায়৷
‘
‘
পরেরদিন সকাল সকাল মা আমাকে ডেকে তুললো আর বললো,
___আমরা মানা করা সত্ত্বেও ওরা আসছে। আমরা কতভাবে বলেছি তুই রাজী না, তুই লেখাপড়া শেষ করে বিয়ে নিয়ে ভাব্বি কিন্তু ওরা বলে এসব দায়িত্ব নাকি ওরা নিবে৷ এখন আর কোন উপায় নেই, সরাসরি তুই তিয়াসকে বুঝিয়ে বলবি। আর কথা বলে দেখতে পারিস,ছেলেটা অনেক ভালো।
আমি ঘুম ঘুম চোখে উঠে বললাম,
___ছেলেটা ঘোড়ার ডিম। যাও আসলে আমি কথা বলবো। কিছু বললে তো তুমি আবার রেগে যাবা। আর শুনো কোনো খাবারের আয়োজন করবা না। ওরা দাওয়াতি মেহমান না। তবে আমার জন্য ভালোমন্দ রান্না করতে পারো,কতদিন পরে আসছি বাড়িতে!
বলেই আম্মুর দিকে তাকিয়ে হাই তুলতে তুলতে ওয়াশরুমে গেলাম। আম্মু রুম ঝাড়ু দিচ্ছিলো, হাতে ঝাড়ু নিয়ে আমার দিকে তাকানোর ধরন এতোটাই ভয়ানক ছিলো যে আমি ভাবছিলাম এই বুঝি দিবে একটা!
‘
‘
পাত্রপক্ষের সামনে যাওয়ার জন্য বেশ কিছুক্ষণ ধরে তাড়া দিচ্ছে। আমার মধ্যে অনন্য মেয়েদের মতো সাজসজ্জার কোনো কিঞ্চিৎ রেশ নেই। কিন্তু আমাকে সামনে যেতে হবে, যেভাবেই হোক! কোনো রকম ঘোমটা না টেনেই স্বাভাবিক ভঙ্গিতে গিয়ে আন্টিকে উদ্দেশ্য করে সালাম দিলাম।
তিয়াসের দিকে আমার কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই।
আন্টি আমার দিকে তাকিয়ে বললো,
___লিয়া তুমি এভাবে হারিয়ে গেলে কেন? তুমি জানো তোমাকে কতো খুঁজেছি? নাম্বার অফ পাওয়ার পরে তিয়াস তোমাকে খুঁজতে খুঁজতে তোমার পুরনো বাসায় পৌঁছেছে,সেখান থেকে প্রভা তোমাদের গ্রামের বাড়ির সব ঠিকানা দিলো। এখানে এসে নীরার মাধ্যমে প্রস্তাব দিলাম। কথা হলো, নীরা মিথ্যা বলেছে, আসলে আমাদেরকে নীরা চিনেনা, কিংবা কোনো আত্নীয়তা নেই। শুধু মাধ্যমের জন্য তার সাথে আমরা নতুন যোগাযোগ তৈরি করেছি।
আমি বাবার দিকে তাকিয়ে আন্টিকে কিছু বলতে যাবো তখন আবার আন্টি বললো,
___ এতোকিছু কেন করছি এটাই জানতে চাও তো? তুমি আমার বাসার একজন টিউটর ছিলে,সেখান থেকে পুত্রবধূ করার জন্য হঠাৎ পাগল হলাম কেন!?
এর পুরো ব্যাপারটাই আমার ছেলের জানা। আমি এইটুকুই জানি তোমাদের মধ্যে একটা সময় খুব ভালো সম্পর্ক ছিলো, আমার বোকা ছেলে সেদিন না বুঝে তোমাকে ছিন্ন করেছে, করেনি অবশ্য, তোমাকে দূরে যেতে বাধ্য করেছে। এখন তোমরা কথা বলতে পারো একান্তে,এতো বছর পর অন্তত ওর কথাগুলোও তোমার শোনার দরকার।
আমি আন্টির দিক থেকে চোখ সরিয়ে পাশে বসে থাকা দাদুর দিকে তাকালাম। দাদু আমাকে ফিসফিস করে বলছে,
___রাজী হয়ে যা না। তুই আমার বড় ছেলের বড় মেয়ে। বিয়েটা খেয়ে মরতে দিস!
আমি দাদুর কথাটার সম্মতি দেখতে বাবার দিকে তাকালাম। কিন্তু বাবার চোখেমুখ বলছে আমার সিদ্ধান্তই যেন উনার সিদ্ধান্ত।
আমি তিয়াসের দিকে তাকালাম। বহু বছর পর এই মানুষটার দিকে ভালো করে আজ তাকিয়েছি। আমি ক্ষানিক বিমূঢ় হয়ে চোখ ফিরিয়ে দাদুকে দেখিয়ে সবাই উদ্দেশ্য করে বললাম,
___ প্রথমত আমি এখন বিয়ে করতে চাইনা, আগে নিজেকে এতটা বড় করে তুলি, যতটা হলে কখনো কোথাও রিজেক্ট হতে হবে না। কারণ আমি চার বছর আগের কথা এখনো ভুলিনি। আশা করি এটা বিপরীত পক্ষেরও ভুলে যাওয়ার কথা না।
এরপর দাদু তুমি যদি এটাই চাও আমি শীগ্রই বিয়ে করি, আমার সারাজীবনের স্বপ্নের কাছে তোমার কাছে বিয়েটাই বড়, তাহলে আমি যে কাউকে বিয়ে করবো। শুধু তিয়াসকে নয়। কাউকে অপমান করার সাহস কিংবা যোগ্যতা আমার নেই,শুধু আত্মসম্মান থেকে আমার এই কথাগুলো!
বলেই আমি তিয়াসের দিকে একবার তাকিয়ে সেখান থেকে উঠে গেলাম। ওর চোখ দুটো লাল হয়ে ছলছল করছে। আমার এতটাও জেদ হয়তো সে কখনোই প্রত্যাশা করেনি।
আমার মাও আমার দিকে ক্ষিপ্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। শুধু বাবার দিকে তাকিয়ে কিছুই বুঝতে পারলাম না।
রুমের ভেতরে এসে দরজা বন্ধ করার জন্য ফিরলাম,সাথে সাথে দরজার একপাশে হাত দিয়ে ধাক্কা লাগলো। আমি সরে গিয়ে চমকে উঠলাম, ভেজা চোখ লুকানোর চেষ্টা করে কাঁপা গলায় বললাম,
___ এখানে কেন এসেছো আবার?
চলবে….