গল্পের নাম:প্রেম পায়রা,পর্ব ২১
লেখনীতে:অজান্তা অহি (ছদ্মনাম)
ভেজা ভেজা কুয়াশাঘেরা রাত্রি।রাস্তাঘাট একদম নির্জন।কোনো জনমানুষের সাড়া নেই।দুরন্ত বাতাসের গতি থেমে গেছে।সন্ধ্যাবেলা থেকে তুষার পড়তে পড়তে এখন ক্লান্ত!রাস্তায় কয়েক ইঞ্চি পুরু হয়ে বরফ জমে আছে।দূরের গাছপালা গুলোতে বরফের আস্তরণ।মনে হচ্ছে বরফ মানব বুক ফুলিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।সকালের সূর্য রশ্নি না পড়া পর্যন্ত এই বরফ গলবে না।কনকনে হাড় কাঁপানো শীত!এই শীতে সম্পদ কেঁপে উঠলো।
সম্পদ তীক্ষ্ণ-সন্ধানী দৃষ্টিতে সামনের মেয়েটির দিকে তাকিয়ে আছে।মেয়েটির চেহারায় লুকিয়ে থাকা প্রত্যাশিত সেই মানুষটিকে খুঁজে চলেছে। ল্যাম্পপোস্টের আলো আঁধারির খেলা ফুটে উঠেছে মেয়েটির মুখ জুড়ে।সে মিনমিন করে বলল,
—‘তুমি কি তিথি?মানে আমার বউ তিথি?’
পরমুহুর্তে সে হাতে চিমটি কাটলো।কিঞ্চিত অবাক হয়ে সুর পাল্টে বলল,
—‘হাতে চিমটি কেটেও ব্যথা পাচ্ছি না।তারমানে আমি গভীর ঘুমে।অনেকটা বাস্তবের কাছাকাছি স্বপ্ন দেখছি।’
—‘মি. প্রোপার্টি!তুমি স্বপ্ন দেখছো না।বাইরে প্রচুর শীত।শীতে তোমার হাত পা ঠান্ডা হয়ে জমে গেছে।সেজন্য কিছু ফিল করছো না।আমি তোমার বউ তিথি!’
বলে তিথি অপেক্ষা করলো না।এক হাতে ট্রলি ধরে আরেক হাতে সম্পদের হাত চেপে ধরলো।সম্পদের চেপে ধরা হাতটা সে কোর্টের পকেটে চালান করে দিল।চোখের ইশারায় সম্পদকে এগোতে বলতে সম্পদ কাঠের পুতুলের মতো এগিয়ে গেল। অতি সন্তর্পনে বরফের খাঁজে খাঁজে পা আটকে তিথি এগিয়ে গেল।
একটুখানি হেঁটে তারা পুরনো কিন্তু অভিজাত এক সুন্দর বাড়ির সামনে দাঁড়ালো।বাইরে থেকেই বাড়িটির ঐশ্বর্য আর রুচিস্নিন্ধতার পরিচয় পেল তিথি।সারা বাড়ি জুড়ে কুয়াশাজড়ানো রাতের গাঢ় ছায়া।সে সম্পদের হাতে সামান্য ঝাঁকি দিতে সম্পদ সদর দরজা দিয়ে ভেতরে ঢুকলো।
সম্পদ এলোমেলো পা ফেলে ভেতরে ঢুকলো।স্বপ্ন আর বাস্তবতার দ্বিধাদ্বন্দে ভুগছে সে।ফ্যাকাসে চোখে মুখে ডোর লক করে পেছন ঘুরতেই মেয়েটা এসে তাকে ঝাপটে ধরলো।
বিস্ময়ে সম্পদের চোখ বড় বড় হয়ে গেল।নিজেকে ধাতস্থ করতে কিছুটা সময় লাগলো।কিন্তু এটা বুঝতে পারলো যে তিথি সত্যি সত্যি ফিনল্যান্ড চলে এসেছে। তার কাছে চলে এসেছে।তার একটিমাত্র বউ ছুটে এসেছে।
এই তো সেই চেনা স্পর্শ,চেনা অনুভূতি, সেই চিরচেনা ঘ্রাণ!তিথির বুকের সেই চিরপরিচিত হার্টবিট!মুহূর্তে সম্পদের সমস্ত শরীর উষ্ণতায় ভরে গেল।মুখে হাসি অযাচিত বন্যার মতো উপচে পড়লো।নিস্তেজ হয়ে পড়ে থাকা হাত দুটো মুহূর্তে তিথির পিঠ স্পর্শ করলো।তিথিকে ফ্লোর থেকে সামান্য উঁচু করে জড়িয়ে নিল।খুশিতে বার কয়েক চারপাশ ঘুরে বলল,
—‘তুমি এত পাজি তিথি?একটা থাপ্পড় পাওনা রইল তোমার!একবার বলে আসবে না? এভাবে কেউ কাউকে চমকে দেয়?জানো,আমি কতটা ভয় পেয়ে গেছিলাম।একটুর জন্য, জাস্ট একটুর জন্য হার্ট অ্যাটাক হয়নি।’
—‘ওই হার্টে আমার বসবাস।নিশ্চিন্তে থাকো।ওটার কখনো অ্যাটাক ঘটবে না।’
—‘তাই বুঝি?’
—‘হুঁ!এবার নিচে নামাও!’
সম্পদ নিচে নামাল না।আরো কয়েক পা ঘুরে ফিসফিস করে বলল,
—‘তুমি যে আমায় তুমি তুমি করে বলছে সে খেয়াল আছে?’
তিথি নিচে নামার জন্য হাত পা ছোঁড়াছুড়ি শুরু করলো।সম্পদ হাত ঢিলে করে তিথিকে নিচে নামাল।তবে ছাড়লো না।ফ্লোরে পা স্পর্শ করতে তিথি লম্বা শ্বাস নিল।মাথা নিচু করে লজ্জিত মুখে বলল,
—‘খেয়ালে আছে।এটাও আমার সারপ্রাইজের অংশ ছিল।এতদিন কল্পনায় তোমার সাথে তুমি তুমি করে কথা বলে অভ্যাস করেছি।তুমি খুশি হওনি?’
সম্পদ কিছুক্ষণ তিথির মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো।মনে হচ্ছে যুগ যুগ পর সে তিথির এই প্রিয় মুখটা দেখলো।ঝট করে সে তিথিকে কোলে তুলে নিল।তিথির নাকে নাক ঘষে বলল,
—‘অনেক!অনেক খুশি হয়েছি বউ!’
—‘ভালো এবার কোল থেকে নামান।ফ্রেশ হতে হবে।’
—‘নামাব না!এখন থেকে দিন-রাত কোলে তুলে রাখবো তোমায়।’
—‘আচ্ছা, আগে ফ্রেশ হয়ে আসি তো!কাপড় চোপড় কেমন নোংরা মনে হচ্ছে।ট্রলি থেকে শাড়ি বের করতে হবে।সব বেগুনি রঙের শাড়ি এনেছি।’
সম্পদ তিথিকে কোলে নিয়ে শোবার ঘরে এলো। বিছানায় বসিয়ে দিয়ে তিথির গায়ের কোর্ট খুলে সরিয়ে রাখলো।এলোমেলো চুল গুলো গুছিয়ে দিয়ে বিষণ্ণ সুন্দর কন্ঠে বলল,
—‘চুপচাপ এখানে বসে থাকো।আমি ড্রেস বের করছি।’
ড্রয়িং রুম থেকে ট্রলি এনে সে নিজে থেকে ট্রলি খুলল।সব ভাঁজে ভাঁজে রাখা।শাড়ির সাথে ম্যাচিং করে সব বের করতে তাকে বিন্দুমাত্র কষ্ট করতে হলো না।কাপড়ের সাথে শুকনো টাওয়াল যুক্ত করে সে ওয়াশরুমে রেখে এলো।তারপর রুমে এসে আবার তিথিকে কোলে তুলে নিল।
ওয়াশরুমের ভেতরে নামিয়ে দিয়ে বলল,
—‘সব এখানে আছে।হট শাওয়ার নাও।আমি খাবার রেডি করছি ততক্ষণে।ক্ষুধা লেগেছে নিশ্চয়ই?’
তিথি স্বাভাবিক কন্ঠে বলল,
—‘প্রচুর!’
—‘হুঁ!শাওয়ার শেষ করে আমায় ডাকবে আবার।এখন থেকে যা করবে সব আমার কোলে থেকে করবে।নো হাঁটাহাঁটি।এত কষ্ট করে, এতটা পথ পেরিয়ে আমার কাছে ছুটে এসেছ, আর আমি এইটুকু পারবো না!অবশ্যই পারবো।’
তিথি চোখ ছোট ছোট করে বলল,
—‘সব ছুঁয়ে দেওয়ার ধান্দা।বুঝি তো!’
সম্পদ ফট করে দু পা এগিয়ে এসে বলল,
—‘আর একটু ছুঁয়ে দিই?’
—‘এই,একদম না!’
সম্পদকে জোরপূর্বক বের করে দিয়ে তিথি ডোর লক করলো।সম্পদ মুচকি হেসে দরজার দিকে চেয়ে রইলো।তারপর একলাফে বিছানার উল্টোদিকে শুয়ে কিছুক্ষণ গড়াগড়ি করলো।কি যে খুশি লাগছে!তার এখনো বিশ্বাস হতে চায় না যে তিথি এসেছে!
ভেজা চুল মুড়িয়ে বেগুনি রঙের শাড়ির পড়ে তিথি বের হলো।সারা রুমে নজর বুলালো।দীর্ঘ ছাদ,চমৎকার দেয়ালে ঘেরা মোহময়ী রুম।রুমের এক কর্ণারে জানালার পাশে ফায়ারপ্লেস!ফায়ারপ্লেসে গনগনে আগুন জ্বলছে।পাশে বসার মতো দুটো জায়গা!আগুনের পাশে সুদর্শন একটা ছেলে বসে আছে যার চোখে মুখে উপচে পড়া খুশি।ছেলেটা তার ভালোবাসা,তার স্বামী!
তিথি এগিয়ে যেতে সম্পদ উঠে দাঁড়ালো।হাত ধরে তিথিকে আগুনের পাশে বসিয়ে দিল।ওয়ারড্রব থেকে নিজের গরম চাদর বের করে গায়ে জড়িয়ে দিয়ে বলল,
—‘বেশি শীত লাগছে তিথি?’
তিথি এদিক ওদিক মাথা নেড়ে না বোধক সম্বোধন করলো।কৌতূহল নিয়ে প্রশ্ন ছুঁড়লো,
—‘এই ফ্ল্যাটে তুমি একা থাকো?’
—‘হুঁ!কয়েক হাত ড্রয়িং রুম,রান্নাঘর আর একটা ঘুমানোর রুম।প্রতিটি ফ্ল্যাটে ভেতরে ঢোকার দরজা আলাদা।’
—‘আমি যে আসলাম কেউ কিছু বলবে না?’
—‘উঁহু।প্রতিটি ফ্ল্যাটের পুরুষ গুলো তাদের বান্ধবীদের প্রায়ই নিয়ে আসে।বুড়ো বাড়িওয়ালা কিছু বলে না।এসব দেশে এগুলো খুবই কমন ব্যাপার।’
তিথির মজার ছলে বলে ফেলল,
—‘তুমি কোনো বান্ধবীকে নিয়ে আসোনি?নাকি আমি প্রথম?’
সম্পদ অদ্ভুত দৃষ্টিতে তার দিকে তাকাল।তার মুখ কালো হয়ে গেছে।সে অভিমান করে চলে যেতে নিতে তিথি হাত টেনে ধরলো।অপরাধী সুরে বলল,
—‘স্যরি!আর রাগ করে না!’
তিথির মুখোভঙ্গিতে সম্পদ স্বশব্দে হেসে ফেলল।পরমুহূর্তে হাসি লুকিয়ে বলল,
—‘আমি খাবার নিয়ে আসছি।’
সম্পদ চলে যেতে তিথি আগুনের আঁচে হাত গরম করলো।তার আরাম লাগছে।কি চমৎকার, চোখ ধাঁধানো পরিবেশ চারিদিকে।সে কাচের জানালা দিয়ে চোখ দুটো বাইরে গলিয়ে দিল।শুভ্র রঙের কুয়াশা জমাট বেঁধে আছে বাইরে।যতদূর চোখ যায় মনে হচ্ছে বরফের রাজ্য!আকাশে জমাটবাঁধা মেঘ।একমাত্র এই মেঘটা তার চেনা!বাংলাদেশে শরৎকালে প্রায়ই এমন জমাটবাঁধা মেঘ আকাশে ঘুরে বেড়াতে দেখেছে সে!
সে চোখ সরিয়ে নিল।রুমের মধ্যে লালচে আভা।তার কিছুটা অংশ জানালার শার্শিতে গিয়ে পড়েছে।কি মনোমুগ্ধকর আরামদায়ক পরিবেশ!
সম্পদ খাবারের প্লেট হাতে তিথির দিকে এগিয়ে এলো।সকালে খাওয়ার জন্য সে ফ্রিজে ঢুকিয়ে রেখেছিল।এখন ওভেনে গরম করে এনেছে।চমৎকার কারুকার্য খচিত বেতের টুল টেনে সে তিথির সামনে বসে পড়লো।তিথিকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে খাওয়ানো শুরু করলো।
তিথির মনের আকাশে এলোমেলো বাতাস বইছে।এই বাতাসটা সম্পদ আশপাশে থাকলে ফিল করে।সে আড়চোখে সম্পদের দিকে তাকিয়ে আছে।গভীর মনোযোগ দিয়ে সম্পদের প্রতিটি কাজ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে।তাকে আয়াস সহকারে খাইয়ে সম্পদ প্লেটগুলো রান্নাঘরে রেখে এলো।ওয়াশরুমে ঢুকে হাতে মুখে পানির ঝাপটা দিল।তারপর বিছানার কুঁচকানো বেডশিট টান টান করলো।বালিশটা মাঝামাঝি রেখে হঠাৎ ঘুরে দাঁড়িয়ে বলল,
—‘তিথি বালিশ কিন্তু একটা!’
—‘ওতেই চলবে!’
মুখ ফসকে বলার পরেই তিথি জিভ কাটলো।লজ্জায় মাথা নিচু করে ফেলল।একটুপর মাথা তুলে দেখলো সম্পদ রুমে নেই!
—‘এই নাও কফি!’
তিথি দু হাতের তালু একত্রে ঘঁষে সামনে তাকাল।সম্পদ কফির কাপ বাড়িয়ে আছে।সে আগ্রহ ভরে ছোঁ মেরে কফির কাপটা হাতে নিল।কফির কাপে ছোট্ট একটা চুমুক দিয়ে তৃপ্তির নিঃশ্বাস ফেলল।
সম্পদ চুপচাপ তিথির পিছনে দাঁড়িয়ে মাথার টাওয়াল খুলে ফেলল।মাথার চুলগুলো নেড়েচেড়ে অবাক হয়ে বলল,
—‘তিথি!তোমার মাথার চুল তো আরো বড় হয়ে গেছে।এত চুল টানার এনার্জি কোথায় পাও?সেজন্যই এত চিকন হয়ে গেছো?’
তিথি প্রতিত্তরে মাথা ঘুরিয়ে সম্পদের দিকে তাকিয়ে হাসলো শুধু।সম্পদ সে হাসিতে নিজেকে হারিয়ে ফেলল না।সে আগের থেকে দ্বিগুণ চিন্তিত কন্ঠে বলল,
—‘এই চুল রাখা যাবে না।নো ওয়ে!কেচি দিয়ে নিচ থেকে কেটে ছোট ছোট করে দিই?তোমার টানতে এত কষ্ট হবে না।কি বলো?’
সম্পদ উত্তরের অপেক্ষা না করে কাচের টেবিলের দিকে এগিয়ে গেল।তিথি বিস্মিত নয়নে চেয়ে চেয়ে সম্পদকে দেখছে।সারাজীবন শুনে এসেছে ছেলেরা মেয়েদের লম্বা চুল দেখে নিজেকে হারিয়ে ফেলে সেখানে সম্পদ?অন্যান্য মেয়েদের বর যেখানে স্ত্রীদের মাথার ঘন, লম্বা চুলের প্রতি দূর্বল থাকে,সেখানে সম্পদ চুল কেটে দিতে চাইছে?
সম্পদ কেচি হাতে তার পেছনে দাঁড়াতে তিথি বাঁধা দিল।মন খারাপ করে বলল,
—‘তুমি আমার চুল পছন্দ করো না সম্পদ?’
সম্পদ স্বাভাবিক ভাবে বলল,
—‘করি তিথি!তোমার চোখ, নাক, কান, চুল, ইভেন পায়ের নখ!সব পছন্দ করি এবং ভালোবাসি।কিন্তু তোমার থেকে বেশি নয়।চুলের জন্য তোমার কষ্ট হচ্ছে, তুমি দিনদিন আরো পাতলা হয়ে যাচ্ছো,সে চুল আমার চাই না।প্রয়োজনে ন্যাড়া হবে।আমার শুধু এই তুমিটাকে চাই!সুস্থ হিসেবে,সবসময় হাসিখুশি হিসেবে,পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী ব্যক্তি হিসেবে।বুঝতে পেরেছ?’
তিথির মুখে ভালোবাসামিশ্রিত প্রশ্রয়ের হাসি ফুটে উঠলো।সে কফির কাপে মুখ ডুবিয়ে রইলো।একটুপর ক্ষীণ স্বরে বলল,
—‘তার মানে আমার গায়ের চামড়া যখন ঝুলে পড়বে,শরীর হাড় জিরজিরে হয়ে যাবে,মুখোশ্রী নষ্ট হয়ে যাবে তখনো তুমি আমায় এতটা ভালোবাসবে?’
তিথির চুলের ফাঁকে থাকা আঙুলটা থেমে গেল।সম্পদ সামনে এসে তিথির সামনে হাঁটু মুড়ে বসে পড়লো।তিথির বাম হাতটা দু হাতের মুঠোয় নিয়ে চেয়ে রইলো ক্ষণিক সময়।তারপর আবেগমাখা কিন্নর কন্ঠে বলল,
—‘শোনো তিথি!শুরুতে অর্থাৎ প্রথম যখন তোমায় দেখি তখন তোমার সুন্দর চেহারার প্রেমে পড়েছিলাম কি না জানা নেই!তবে বহু আগেই নিজেকে চেহারার প্রেম থেকে মুক্তি দিতে পেরেছি।তোমার সুন্দর মুখোশ্রীর আড়ালের মানুষটাকে আমি ভালোবাসি।তার সুন্দর মনটাকে, তার আত্নাকে, তার ভেতরের মানুষটাকে ভালোবাসি।এই তোমাকে ভালোবাসি।তোমার চেহারা দিন কে দিন বিকৃত হয়ে গেলেও আমার কাছে তুমি এভারগ্রিন থাকবে।তোমার প্রতি আমার অনুভূতির কোনোদিন পরিবর্তন ঘটবে না।এসব প্রশ্ন আর কোনোদিন করবে না।কেমন?’
তিথি চোখ দুটো ছলছল করে উঠলো।সম্পদ তাকে বুকে আগলে নিয়ে ধরা গলায় বলল,
—‘তিথি তুমি আমার সাথে ভালো আছো তো?সুখে আছো তো?জানো,আমার ভেতরটা সবসময় ছটফট করে।মনে হয় এই বুঝি তোমায় কষ্ট দিয়ে ফেললাম।এই বুঝি তুমি ব্যথা পেলে, দুঃখ পেলে!মাথার মধ্যে সারাক্ষণ ঘোরে, ঠিক কতটা আগলে রাখলে তুমি সবচেয়ে ভালো থাকবে,রাজরাণীর মতো থাকবে।সবসময় মনে হয় সবকিছু ফেলে রেখে শুধু তোমায় ভালো রাখার যুদ্ধে নামি!শুধু তোমায় ভালোবাসার যুদ্ধে নামি।তিথি,সত্যি করে বলো তো?তুমি ভালো আছ?’
চোখের নোনাজলে তিথির গাল ভিজে গেল।দু হাত আঁকড়ে সম্পদের বুকে মিশে গেল।তার মনে হলো কাকলি ভুল বলেছে।হাইজেনবার্গের অনিশ্চয়তা নীতি শুধুমাত্র জড়বস্তুর জন্য প্রযোজ্য।মানুষের জন্য নয়!মানব মন যে বড় বিচিত্র!এ বিচিত্র সভায় সব অনিশ্চয়তা কাটিয়ে ভালো থাকা যায়।সুখে থাকা যায়।দেহের ভালোবাসা আর মনের ভালোবাসা একজনের থেকে পাওয়া যায়।একমাত্র সত্যিকার ভালোবাসা পারে সব অনিশ্চয়তা কাটিয়ে প্রকৃতির সব সূত্র ভুল প্রমাণ করতে!
সে সম্পদের বুক থেকে মাথা তুলল। গভীর দৃষ্টিতে সম্পদের চোখে চোখ রাখলো।এই চোখ দিয়ে ভেতরটা পড়ে ফেলা যায়।কোনো জটিলতা ছাড়াই একে অপরকে আবিষ্কার করা যায়।খোলা বইয়ের মতো মুখস্থ করা যায় একে অপরের না বলা হাজারো অনুভূতি। না উচ্চারিত হাজারো মনের কথা!
তিথি ডান হাতটা সম্পদের টিশার্ট গলিয়ে বুকের উপর রাখলো।মুখে প্রশান্তি হাসির ফুটিয়ে ভেজা দৃষ্টিতে বলল,
—‘এ বুকে আশ্রয় পেয়েছি,আমি ভালো না থেকে পারি?এই বুকটা যে আমার পৃথিবীর সবচেয়ে কমফোর্ট জোন, আমার একমাত্র ভালো থাকার জায়গা!ভালোবাসার জায়গা!’
বলে সে সম্পদের বুকে স্বশব্দে চুমু খেল!
৩৩.
রাস্তায় বের হয়ে তিথি চমকে গেল।গতরাতের বরফ গলে ভেজা রাস্তা।কি সুন্দর আবহাওয়া!মাথার উপরে ঝকঝকে মেঘমুক্ত আকাশ।আকাশের বুক চিঁড়ে সূর্যের মুখ দেখা যাচ্ছে।মিষ্টি রোদ উঠেছে।ঝকঝকে, তকতকে পরিষ্কার রাস্তাঘাট।রাস্তার দুপাশে সারি সারি রেড বেরিস গাছ!গাছ থেকে লতার মতো ছড়িয়ে পড়েছে লাল লাল ফুলগুলো।ফুলের উপর তুষার পড়ে আছে।সবেমাত্র রোদ উঠেছে বলে বরফ গলা শুরু হয়নি!
মাথার উলের টুপিটা একটু নেড়েচেড়ে সম্পদের দিকে তাকালো তিথি।সম্পদ তার দিকেই চেয়ে ছিল।চোখে চোখ পড়তে সম্পদ রাস্তার চারপাশ দেখতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো।তিথি মুগ্ধ নয়নে বলল,
—‘এত সুন্দর জায়গা আপনি থাকেন?’
সম্পদ আস্তে করে তিথির হাতটা নিজের হাতে পুড়ে নিল।গুটিগুটি পা ফেলে সামনে এগোতে এগোতে বলল,
—‘পর্যটকদের জন্য ফিনল্যান্ড দারুণ একটা জায়গা।মারাত্মক সুন্দর সুন্দর জিনিস আছে দেখার মতো।বিশেষ করে এই হেলসিঙ্কিতে বেশি।আমার তেমন ঘোরা হয়নি।শুধু টুরিস্ট গাইড আর গুগল ম্যাপ ঘেটে সব জেনেশুনে রেখেছি।এবার তোমায় সাথে নিয়ে ঘুরবো।’
—‘এখন আমরা কোথায় যাচ্ছি?’
—‘এদিকে একটা মুসলিম রেস্টুরেন্ট আছে।সকালের খাবারটা ওখান থেকে খাব।তারপর কিছুক্ষণ ঘুরবো।আসার পথে মুসলিম গ্রোসারি থেকে কিছু বাজার করে নিয়ে আসবো।দুপুরে দুজন একত্রে রান্না করে খাব।’
তিথি হাসিমুখে বলল,
—‘হুঁ!’
রেস্টুরেন্টে ঢুকে তিথি মুগ্ধ।কি সুন্দর চোখ ধাঁধানো ডেকোরেশন।চোখ জুড়িয়ে যায় একদম।সাথে ওয়েটারদের মধুর ব্যবহার!আহা!
সম্পদ তিথিকে জিগ্যেস করে সালাদ,নুডলস,চারটে রোল,চিকেন ফ্রাই,দুটো চকলেট শেক,আর সবশেষে দুটো কফি আইসক্রিমের সাথে অর্ধেক ব্লবেরি পাই!কিছুক্ষণের মধ্যে টেবিল ভরে গেল খাবারে।সম্পদ খুব যত্ন সহকারে একটার পর একটা তিথির দিকে এগিয়ে দিল।
(চলবে)