গল্পের নাম:প্রেম পায়রা,পর্ব ১৭

গল্পের নাম:প্রেম পায়রা,পর্ব ১৭
লেখনীতে:অজান্তা অহি (ছদ্মনাম)

তিথি পেছন থেকে আরো আষ্টেপৃষ্ঠে সম্পদকে জড়িয়ে ধরলো।বন্ধ চোখে টেনে টেনে বলল ,

—‘আপনার মতো আমারো রোগ হয়েছে মি. প্রোপার্টি!আপনাকে ছাড়া আমিও এখন খেতে পারি না,শুতে পারি না,ঘুমাতে পারি না।কিচ্ছু করতে পারি না।সারাক্ষণ শুধু আপনার কথা মনে পড়ে,আপনার চেহারা চোখের সামনে ভাসে।সারাক্ষণ আপনার সেই বিষণ্ণ সুন্দর কন্ঠটা শোনার জন্য মন আকুপাকু করে।মন খারাপের প্রতিটি সন্ধ্যায় শুধু আপনার বুকে মুখ লুকাতে ইচ্ছে করে।আপনার সঙ্গ আমার ভালো লাগে,আপনি আশপাশে থাকলে কেমন ঘোরের মধ্যে থাকি আমি।আপনার উপস্থিতিতে সবকিছু কেমন অন্য রকম সুবাসে ভরে যায়।আমার মনের আকাশটা এলোমেলো হয়ে যায়।আমি জানি না কবে আপনাতে ফেঁসে গেছি।তবে খুব বাজেভাবে ফেঁসে গেছি।আপনাকে ছাড়া আমি একটা সেকেন্ডও কাটাতে পারবো না।

আপনি জানেন, এই তিনটে মাস আমি কতটা কষ্টে কাটিয়েছি?কতটা অভাববোধ করেছি আপনার?আপনি জানেন,আমার জীবনের সবচেয়ে কষ্টকর সময় ছিল এই তিনটে মাস।আপনি খুব খারাপ!’

তিথির গলা ধরে এলো।কন্ঠ অস্পষ্ট!সে কাঁদছে।কান্নার ফলে শরীর কেঁপে কেঁপে উঠছে।সম্পদের আর বুঝতে বাকি রইল না।তার বুক কেঁপে উঠলো।পৃথিবীর সব
দুঃখ সহ্য করতে পারবে সে,এমনকি তিথির অবহেলাও!শুধু তিথির চোখের জল সহ্য করার ক্ষমতা তার নেই।এই মেয়েটার একটুখানি কষ্ট তাকে ছিন্নভিন্ন করে দিতে যথেষ্ট।

সে মুখটা নিচু করে তিথির জড়িয়ে রাখা হাতদুটোতে চুমু দিল।পেছন ঘুরার চেষ্টা করলো।কিন্তু পারলো না।তিথি তাকে ছাড়লো না।সে ধরা গলায় বলে উঠলো,

—‘এই তিথি!একদম কাঁদে না।’

তিথি ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে।কান্নারত গলায় বলল,

—‘এত অভিমান কেন আপনার?ঘুমের ঘোরে প্রথম দিকে হয়তো এক আধদিন নিশান ভাইয়ের নাম নিয়েছি আর তাতেই এত অভিমান?আমার বিয়ের পরবর্তী সব স্বপ্নে তো আপনি থাকতেন।স্বপ্নে আপনার কথা ভেবে,আপনার হাত ধরে, আপনার বুকে মাথা রাখলে আমার মুখে হাসি ফুটে উঠতো।আর আপনি কি সব ভেবে বসে থাকতেন!আপনি আমার জীবনে সবার আগে কেন এলেন না?এত অভিমান কেন আপনার?’

সম্পদ রুদ্ধ কন্ঠে বলল,

—‘আর অভিমান করে থাকবো না।’

—‘আজকের পর থেকে আপনি আমার থেকে আর দূরে যেতে পারবেন না।আমাকে রেখে অন্য কারো কথা ভাবতে পারবেন না।অন্য কারো মাথা বুকে রাখতে পারবেন না।আমাকে রেখে কিচ্ছু করতে পারবেন না আপনি।আপনি আর আপনি নেই!আপনি এখন কারো একান্ত ব্যক্তিগত সম্পদ।মনে থাকবে?’

সম্পদের মুখে তৃপ্তির হাসি ফুটে উঠলো।মাথাটা সামান্য ঘুরিয়ে বলল,

—‘মনে থাকবে।এবার মুখটা দেখতে পারি?’

মুহূর্তে তিথির কান্না থেমে গেল।সেখানে এসে ভর করলো লজ্জা!সম্পদকে জড়িয়ে রাখা হাত দুটো ঢিলে হয়ে এলো।তাকে ছেড়ে এক পা পিছিয়ে দাঁড়াল।সম্পদ দূর্বল ভাবে হেসে ঘুরে দাঁড়াতে নিল।তার আগেই তিথি উল্টো ঘুরে সম্পদের পিঠে নিজের পিঠ ঠেকাল।ফ্যাকাসে ভাবে হেসে বলল,

—‘প্লিজ!আমার দিকে তাকাবেন না।এভাবেই থাকুন।’

সম্পদ আর ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করলো না।ওভাবে ঠায় দাঁড়িয়ে পড়ে।হাত দুটো নিচু করে তিথির হাত চেপে ধরে।আঙুলের ভাঁজে আঙুল লুকিয়ে শক্ত হাতে চেপে ধরে।এই হাতের আঙুল গুলো

খুব সাবধানে তিথির একটা হাত ছেড়ে সম্পদ ঘুরে দাঁড়ায়।নিচু হয়ে ফ্লোরে পড়ে থাকা কোর্টের পকেট থেকে বক্সটা তুলে।মুখ দিয়ে খুলে ভেতরের চেইনটা হাতে নেয়।তিথির হাতের ভাঁজে থাকা ডান হাতটি ছাড়িয়ে নেয়।

তিথির দিকে কিছুক্ষণ অপলক চেয়ে থাকে।একটুপর মাথার খোলা চুলগুলো একপাশে সরিয়ে থিক চেইনের লকেটসহ মালাটা পরিয়ে দেয়।তিথি বন্ধ চোখ জোড়া খুলে অবাক হয়ে কিছুক্ষণ লকেটের দিকে চেয়ে থাকে।লকেটটা হাতের তালুতে নিয়ে তাতে ঠোঁট ছোঁয়ায়।

ততক্ষণে সম্পদ তার উন্মুক্ত ঘাড়ে চুমু খেয়েছে।তিথি নিরবিচ্ছিন্ন উত্তেজনায় কেঁপে উঠে।খুব দ্রুত ঘুরে দাঁড়িয়ে সম্পদের বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ে সে।সম্পদ তাকে বুকে আগলে নেয়!তিথির ঘন কেশরাশিতে মুখ ডুবিয়ে বলে,

—‘আমি তোমাকে ভালোবাসি!ভালোবাসি!ভালোবাসি!ভালোবাসি।’

ক্রমেই সম্পদের স্পর্শ গুলো গভীর থেকে গভীরতর হচ্ছে।তিথি সহ্য করতে না পেরে এক ঝটকায় নিজেকে ছাড়িয়ে নেয়।ঘুরে কিছুটা দূরে গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে। অস্ফুট স্বরে বলে,

—‘আপনার গা দিয়ে ঘামের গন্ধ বের হয়েছে মি. প্রোপার্টি!’

বলেই এক হাতে মুখ ঢেকে তিথি ফিক করে হেসে দেয়।সম্পদ অদ্ভুত দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ তিথির দিকে চেয়ে থাকে।একটুপর সন্দেহ নিয়ে নিজের আর্মপিট শুঁকে দেখে।কই!গন্ধ তো নেই!অবশ্য নিজের গায়ের গন্ধ নিজের নাকে নাকি ঢুকে না।সে দ্রুততার সহিত শার্টের বোতাম খুলে ফেলে।এক টানে শার্টটা খুলে কিছুটা দূরে ছুঁড়ে মারে।গায়ের স্যান্ডো গেঞ্জিটাও খুলে ফেলে দেয়।নিজের গা শুঁকে তিথির দিকে এগিয়ে যায়।আমতা আমতা করে বলে,

—‘ইয়ে মানে আমার মনে হয় জামা কাপড় দিয়ে গন্ধ বের হয়েছিল শুধু।খুলে ফেলেছি।এখন শুঁকে দেখো তো,গন্ধ আছে কি না!’

তিথির চোখে মুখে খুশির ঢেউ খেলে যাচ্ছে।ঘুরে দাঁড়িয়ে সম্পদের মুখোমুখি হয়।তিথির চোখে চোখ রাখতে সম্পদের বুকের ভেতর দমবন্ধ করা অনুভূতি হয়।মেয়েটার এই মুখের দিকে নিষ্পলক তাকিয়ে সে সহস্র বছর কাটিয়ে দিতে পারবে।বিনিময়ে তার তিথির ঠোঁটের কোণের এই মাতাল করা হাসিটুকুই যথেষ্ট।ঘোর লাগা দৃষ্টিতে সে তিথির তিলময় ডান হাতটা উঁচু করে তাতে চুমু খায়!

তিথি মুখটা নিচু করে বাম হাতটা সম্পদের লোমশ বুকে ছুঁয়ে দেয়।খুব যত্ন করে সম্পদের বুকে একটা চুমু খায়।ঠোঁটের কোণের হাসি লুকিয়ে তৎক্ষনাৎ চোখ মুখ কুঁচকে বলে উঠে,

—‘ছি!কি গন্ধ বের হচ্ছে মি. প্রোপার্টি!বিচ্ছিরি ঘামের গন্ধ।’

সম্পদ আর দেরি করে না।এক ঝটকায় তিথিকে কোলে তুলে নেয়।তিথির কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বলে,

—‘গন্ধ থাকে থাকুক।আমার ভালোবাসা হলো গন্ধযুক্ত ভালোবাসা।ঘামময় ভালোবাসা।’

২৯.

ঘড়িতে দশটার উপরে বাজে।তিথি তৃতীয় বারের মতো নিচ থেকে রুমে এলো।উদ্দেশ্য সম্পদকে ডেকে দেয়া।সম্পদের গাঢ় ঘুম।সে বহুবার ডেকেও তাকে উঠাতে পারেনি।

ঘড়ির দিকে এক পলক চেয়ে তিথির কপাল কুঁচকে গেল।বিছানায় সম্পদ উল্টে পাল্টে শুয়ে আছে।সম্পদের এত ঘুম তার সহ্য হলো না।সে এগিয়ে গিয়ে সম্পদকে বড়সড় ধাক্কা দিয়ে বলল,

—‘উঠে পড়ুন বলছি!এমন ভাব ধরছেন যেন রাত শুধু আপনি জেগে ছিলেন।আর আমি ঘুমে তলিয়ে ছিলাম!আশ্চর্য।উঠে পড়ুন বলছি।’

সম্পদ নড়েচড়ে আরো আরাম করে শুয়ে পড়লো।তার ঘুমন্ত মুখের দিকে তাকিয়ে তিথি আর রেগে থাকতে পারলো না।মুখের পেশি শিথিল হয়ে এলো।হাত বাড়িয়ে সম্পদের অল্প ভেজা চুলগুলো আঙুল দিয়ে ছুঁয়ে দিল।

সম্পদের ফোন বাজছে।তিথি উঠে টেবিলের দিকে এগিয়ে গেল।সবুজ ফোন করেছে।এই দিয়ে সপ্তম বারের মতো সে ফোন করেছে।তিথি ফোন রিসিভ লাউডস্পিকার অন করলো। সম্পদের কানের কাছে নিতে সবুজের চিন্তিত কন্ঠ শোনা গেল,

—‘স্যার, আসসালামু আলাইকুম।আপনি অফিসে আসছেন না কেন স্যার?আজ না আপনার মালীবাগ যাওয়ার কথা ছিল স্যার?এত দেরি করছেন কেন স্যার?’

সম্পদ কোনো রেসপন্স করলো না।অগত্যা তিথি ফোনটা কানে নিয়ে বলল,

—‘আমি তিথি বলছিলাম।আপনার স্যার ভয়ানক অসুস্থ।ওনার ডিসেন্ট্রি হয়েছে।আজ কোথাও যেতে পারবে না।সব ক্যান্সেল করে দিন।’

—‘কি কান্ড!স্যার কি অনেক অসুস্থ?স্কয়ার হসপিটালে নিতে হবে ম্যাডাম।’

—‘কোথাও নিতে হবে না।আপনি বরং ওদিকটা ম্যানেজ করুন।কেমন?রাখছি!’

—‘ঠিক আছে।আসসালামু আলাইকুম ম্যাডাম।’

তিথি ফোন কেটে দিল।ফোনটা রেখে টেবিলের উপর থেকে চায়ের কাপ হাতে নিল।সম্পদের জন্য চা নিয়ে এসেছিল সকাল বেলা।এতক্ষণে ঠান্ডা হয়ে গেছে।সে বিছানায় বসে বরফ শীতল চায়ে চুমুক দিল।

এক চুমুক খেয়েই চোখ মুখ বিকৃত হয়ে গেল।এই চা পানযোগ্যতা হারিয়েছে।চায়ের কাপ নামিয়ে রেখে সে ধুম করে সম্পদের বুকে কিল বসিয়ে দিল।অনেক হয়েছে আদরের ডাকাডাকি।

সম্পদ মৃদু আর্তনাদ করে চোখ খুলল।ঘুমজড়ানো গলায় বলল,

—‘স্ট্রেন্জ!কিল দিয়ে কেউ ঘুম ভাঙায়?’

তিথি তার উত্তর না দিয়ে উৎকন্ঠিত কন্ঠে বলল,

—‘আপনার ম্যানেজার হাজার খানেক বার ফোন দিয়েছে।অফিসে যাবেন না?’

—‘আজ আমি কোথাও যাব না বউ।’

সম্পদের মুখে বউ ডাক শুনে তিথি ঘাবড়াল না।শক্ত কন্ঠে বলল,

—‘ভেরি গুড।শুধু গুড নয়।গুড,বেস্ট,বেটার!মন প্রাণ ঢেলে ঘুমান।আমি আসছি।’

তিথি উঠতে নিতে সম্পদ তার হাত টেনে ধরলো।সম্পদের এই স্পর্শ তিথির উৎকন্ঠার সমুদ্র শৈবালের ভিতর প্রশান্তির ঝাপটা দিয়ে গেল।মায়াভরা দুটি চোখে সে সম্পদের দিকে তাকালো।সম্পদের চোখে কৃতজ্ঞতা ফুটে উঠেছে।সে তিথির হাতটা টেনে মুখের কাছে নিল।তাতে ঠোঁট ছুঁইয়ে বলল,

—‘ধন্যবাদ তিথি।আমার জীবনে এসে পূর্ণতা দানের জন্য।’

তিথির মুখে হাসির রেশ দেখা দিল।সম্পদের বুকে মাথা রেখে চোখ বন্ধ করলো।

তিথির ফোন বাজছে।কিছুক্ষণ খোঁজাখুঁজির পর সম্পদের মাথার বালিশের নিচ থেকে বের করলো।বড় মায়ের নাম্বার।ফোনটা রিসিভ করে কানে ধরলো,

—‘বড় মা,কেমন আছ?’

কয়েক সেকেন্ড কোনো উত্তর এলো না।একটু পরে তুলির ভয়ার্ত গলা শোনা গেল।উত্তেজিত কন্ঠে বলল,

—‘তিথি আপু,বাবা অসুস্থ হয়ে পড়েছে।হসপিটালে নেয়া হয়েছে।তুমি চলে এসো।’

তিথির বুকের ভেতর অজানা আতংকে কেঁপে উঠলো।হাত থেকে ফোনটা পরে গেল।থরথর করে কাঁপতে কাঁপতে বলল,

—‘সম্পদ,আমার বড় বাবা!বড় বাবা অসুস্থ।’

৩০.

হসপিটালের করিডোরে নিশান বসে আছে।তাকে অপ্রকৃতস্থদের মতো লাগছে।মাথার চুল অবিন্যস্ত।চোখ দুটো রাত জাগার ফলে ভয়ানক লাল হয়ে আছে।ছুটোছুটি করতে করতে পরণের শার্টে ময়লার আস্তরণ।মুখটা শুকিয়ে আছে।বুকের ভেতর কেঁপে উঠতে সে দু হাতে মুখ ঢেকে ফেলল।

কিয়ৎক্ষণ পরে কাঁধে কারো স্পর্শে চোখ তুলে তাকালো।

(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here