গল্পের নাম:প্রেম পায়রা,পর্ব ০৬
লেখনীতে:অজান্তা অহি (ছদ্মনাম)
অন্ধকার রুমে ঢুকে সম্পদ ক্ষীণ স্বরে ডাকলো,
—‘তিথি!এই তিথি?’
কোনো প্রতিত্তর আসলো না।দেয়াল হাতড়ে সুইচে চাপ দিতে স্নিগ্ধ আলোয় ভরে গেল সম্পূর্ণ রুম।পেছন ঘুরে তাকাতে সম্পদের চোখ আটকে গেল বিছানায়।তিথি বাঁকা ত্যাড়া হয়ে শুয়ে আছে।মাথার নিচে বালিশ নেই।শাড়ির লম্বা আঁচল এলোমেলো হয়ে বিছানায় ছড়িয়ে আছে।
সম্পদ মন্ত্রমুগ্ধের মতো এগিয়ে গেল।কাছে যেতেই তিথির ফর্সা পেটের কিঞ্চিৎ অংশ নজরে এলো।বাম পায়ের অনাবৃত অংশে চোখ পড়তে আরো একটা তিল আবিষ্কার করলো।কিছুক্ষণ একদৃষ্টিতে চেয়ে থেকে শুকনো ঢোক গিলল।তারপর ঝড়ের গতিতে বালিশের পাশ থেকে কম্বল নিয়ে তিথির পা থেকে মাথা পর্যন্ত ঢেকে দিল।
সম্পদের ঠোঁটের কোণে হাসি উপচে পড়ছে।সে যে দিন দিন পাগল হয়ে যাচ্ছে তা বেশ বুঝতে পারছে।এই মেয়েটা তার প্রতি এত কোল্ড,এতেই তার এই অবস্থা।এই মেয়েটার একটু উষ্ণতা পেলে তাকে নিশ্চিত আইসোলোমে ভর্তি হতে হবে!
সম্পদ বড় করে একটা হাই তুলল।বিছানা দেখে তার প্রচন্ড রকমের ঘুম ঘুম পাচ্ছে।কিন্তু সারাদিনের ঘর্মাক্ত শরীর নিয়ে ঘুমানো কি উচিত হবে?আবার তিথির পাশে ঘুমিয়ে পড়ার লোভটাও সামলাতে পারছে না!নিতান্ত অনিচ্ছায় সে কাপড়-চোপড় নিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকলো।
টাওয়ালটা কাঁধে ঝুলিয়ে ভেজা চুল ঝারতে ঝারতে ওয়াশরুম থেকে বের হলো সম্পদ।বিছানার দিকে তাকিয়ে দেখলো তিথি উঠে গেছে।খাটে হেলান দিয়ে মূর্তির মতো বসে আছে।মাথার চুলগুলো ইতোমধ্যে হাত খোঁপা করে নিয়েছে।সে এগিয়ে যেতে চোখ তুলে তাকাল তিথি।সে চোখের দিকে চোখ পড়তে সম্পদের ভ্রু কুঁচকে গেল।তিথির চোখ দুটো লাল হয়ে আছে।কেমন ঘোলাটে মনে হচ্ছে।চোখ মুখ ফোলা ফোলা।সে কি তার অনুপস্থিতিতে কান্না করেছে?কেন করেছে?
সম্পদ বিছানায় বসবে কি বসবে না তা মনস্থির করতে পারছে না।সকালের ঘটনাটি নিয়ে সে কিঞ্চিৎ লজ্জিত।সে তিথির পাশে বসলো না।তবে কাছাকাছি দাঁড়িয়ে বললো,
—‘তিথি!আর ইউ অকে?’
তিথি মাথা নেড়ে সায় জানাল।সম্পদ হুট করে তার মাথাটা তিথির দিকে এগিয়ে দিয়ে বললো,
—‘শাওয়ারের সময় পড়ে গিয়ে বেসিনের উপর মাথা ঠুকে গেছে হালকা।দেখো তো জখম হয়েছে কি না?’
তিথি চিন্তিত মুখে সম্পদের দিকে তাকালো।সম্পদের শরীর থেকে মাতাল করা একটা গন্ধ বের হচ্ছে।চুল থেকে গন্ধটা সরাসরি নাক দিয়ে ঢুকে ভেতরটাকে উলোটপালোট করে দিচ্ছে।সে কিছুক্ষণ হা করে চেয়ে রইলো।
—‘কি হলো?মাথার পেছন দিকে দেখো তো।’
সম্পদের তোড়জোড়ে তিথি মোলায়েম কন্ঠে বললো,
—‘হুঁ দেখছি।আপনি হাত সরান।’
সম্পদ হাতটা সরিয়ে নিতে তিথি খুব মনোযোগ দিয়ে চুলের ফাঁকে ফাঁকে আঙুল চালিয়ে ব্যথার জায়গা খুঁজলো।কানের কাছাকাছি হাত নিয়ে সম্পদ মৃদু স্বরে অস্ফুট শব্দ করলো।তিথির চোখ মুখ চিন্তায় শক্ত হয়ে গেল।সাবধানে আস্তে করে চুল সরিয়ে দেখলো জায়গা বেশ ফুলে উঠেছে।সে উৎকন্ঠিত হয়ে বললো,
—‘আপনার তো অনেকখানি লেগেছে।ফুলে উঠেছে জায়গাটা!’
সম্পদ আচমকা মাথা সরিয়ে নিল।মৃদু হেসে বললো,
—‘সামান্য!ঠিক হয়ে যাবে!তুমি রাতের খাবার খেয়েছ?’
তিথি সে প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে অনেকটা ধমকের সুরে বললো,
—‘আপনি তো দেখি মস্ত বড় গাধা।এতোবড় মানুষ গোসল করার সময় কিভাবে পড়ে?’
—‘একটু অমনোযোগী ছিলাম আর কি!’
—‘একটু অমনোযোগী ছিলাম আর কি!তা মন কোথায় থাকে?’
সম্পদের ঠোঁটের কোণের হাসি মুখের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়লো।ফস করে একটা কথা বলতে নিতেও বললো না।হাসতে হাসতে বেলকনির দিকে পা বাড়াল।তিথি তৎক্ষনাৎ চেঁচিয়ে বললো,
—‘দাঁড়ান!আবার ওদিকে কোথায় যান?এখানে বসুন।মাথায় কিছু একটা লাগাতে হবে!’
তিথি বিছানা ছেড়ে উঠে পড়লো।ড্রেসিং টেবিলের প্রতিটি ড্রয়ার খুলতে শুরু করলো।গতকাল ড্রয়ারে একগাদা মেডিসিন দেখেছিল।তৃতীয় ড্রয়ার থেকে সে মলম বের করলো।সোজা হয়ে তাকিয়ে দেখে সম্পদ এখনো ঠায় দাঁড়িয়ে আছে।সে হুকুমের সুরে বলল,
—‘আপনার কি শিকড় গজিয়ে গেছে?দেবদারুর মতো ওখানে দাঁড়িয়ে না থেকে বিছানায় বসুন।বৃক্ষের মতো দাঁড়িয়ে থাকলে তো আর আমি আপনার মাথা হাতের নাগালে পাব না।বসুন!’
সম্পদ আরাম করে বসে পড়লো।তিথি এগিয়ে এসে তার দিকে ঝুঁকে দাঁড়াল।সম্পদের মাথাটা ঘুরিয়ে হাতের আঙুলে করে মলম লাগিয়ে দিল।তিথি সরে যাওয়ার আগে সম্পদ তার হাত চেপে বললো,
—‘দেখো তো মাথায় উকুন হয়েছে কি না?অনেক চুলকায়।আমার মনে হয় তোমার মাথা থেকে আমার৷ মাথায় ট্রান্সফার হয়েছে।’
—‘আমার৷ মাথায় উকুন নেই।’
—‘অফকোর্স উকুন আছে।তুমিও রাতে ঘুমের ঘোরে মাথা চুলকাও!’
—‘বললাম তো আমার মাথায় উকুন নেই!’
—‘দু চারটে থাকলে মন্দ হতো না!’
তিথি কপাল কুঁচকে তাকাল। সম্পদ হাত উঁচু করে দু আঙুলের সাহায্যে তিথির কুঁচকানো কপাল প্রসারিত করে দিয়ে বলল,
—‘মেয়েদের কুঁচকানো কপালে একদমই মানায় না!এখন দেখো,কি সুন্দর লাগছে!’
তিথি অপ্রস্তুত হয়ে সরে দাঁড়াল।কিছুক্ষণ ইতি উতি করে হাতের মলমটা ড্রেসিং টেবিলের উপর রেখে বাইরে যেতে যেতে বলল,
—‘ডিনারের সময় হয়ে গেছে।মানুষের ক্ষুধা লাগলে যেন নিচে আসে।’
১২.
স্লথ গতিতে গাড়ি চলছে।এই ভোরবেলাই রাস্তায় প্রচুর গাড়ি।মোটামুটি জ্যামের মতো অবস্থা।সস্পদ হাতঘড়ির দিকে তাকালো।আটটা বাজতে মিনিট বিশেক বাকি।ভার্সিটি শুরু হতে বেশি সময় নেই।স্নেহা আর তিথিকে ভার্সিটি নামিয়ে দিয়ে তাকে আবার অফিস ধরতে হবে।
এ রাস্তায় প্রচুর গাড়ি।সে লেন পরিবর্তন করলো।এগারো নাম্বার সেক্টর দিয়ে গাড়ি ঢুকিয়ে দিল।ভিউ মিররে একবার তাকাল।তিথি থমথমে মুখে স্নেহার পাশে পেছনের সিটে বসে আছে।সে জানালার কাচ নামিয়ে দিল।
ভোরবেলার ঝিরিঝিরি বাতাস এসে চোখে মুখে ঝাপটা দিয়ে গেল।তিথি কোলের ব্যাগটা নামিয়ে রেখে জানালা ঘেঁষে বসলো।মুখটা বাইরের দিকে দিল।কি শীতল বাতাস!সরাসরি ফুসফুসে গিয়ে নাড়া দেয় যেন!স্নেহা মনোযোগ দিয়ে লেকচার খাতার পাতা উল্টাচ্ছে।তার আজ সিটি আছে!
সম্পদ গাড়ি চালাতে চালাতে বললো,
—‘তোদের কার কখন ক্লাস শেষ হবে?’
স্নেহা খাতা থেকে মুখ না তুলে বলল,
—‘আমার এখন পরপর দুটো ক্লাস আছে।একটা বিকেল তিনটায়।ওটা করবো না।’
—‘কেন করবি না?’
স্নেহা সুন্দর করে হেসে বলল,
—‘ভুল বলেছি ভাইয়া।তিনটায় কোনো ক্লাস নেই আমার।সাড়ে এগারটার দিকে ক্লাস শেষ হয়ে যাবে আমার।আমি একাই বাসায় চলে যেতে পারবো।’
খাতা বন্ধ করে স্নেহা তিথির কাছ ঘেঁষে বসে বলল,
—‘ভাবী তোমার ক্লাস শেষ হবে কখন?’
তিথি তার দিকে চেয়ে হালকা হেসে বলল,
—‘আমার আজ সারাদিন ল্যাব।কোনো ক্লাস নেই।’
সম্পদ বিষণ্ণ কন্ঠে বলল,
—‘কয়টায় শেষ হবে?’
তিথি জানালা দিয়ে আবার বাইরে তাকাল।উঁচু উঁচু বিল্ডিং গুলোর দিকে তাকিয়ে থাকতে ভালো লাগছে।সে চিকন সুরে বলল,
—‘বিকেল তিনটায়।আমিও একা যেতে পারবো।বেশিদূর তো নয়!রিকশা করে চলে যাব!’
সম্পদ আর কোনো কথা বলল না।কিছুক্ষণের মধ্যে গাড়ি এসে ভার্সিটির গেটে থামলো।স্নেহা একপলক দুজনের দিকে চেয়ে ব্যাগ নিয়ে বলল,
—‘ভাবী,তুমি ধীরে সুস্থে আসো।আমি যাই।ফ্রেন্ডরা অপেক্ষা করছে।আর আমার ক্লাস শেষ হলে তোমার সাথে দেখা করবো।তোমার সাইকোলজি ডিপার্টমেন্ট আমি চিনি!’
তিথি কিছু বলার আগেই স্নেহা চলে গেল।তিথি একপলক সম্পদের দিকে চেয়ে দ্রুত উঠতে নিতে হিজাবের খোলা অংশ জানালার সাথে আটকে গেল।সে শাড়ি পরে ভার্সিটি আসেনি।কুর্তি আর হিজাব পড়েছে।চরম বিরক্তি নিয়ে সে ওড়না টেনে বের করলো।
মাথার পিনগুলো ঢিলে ঢিলে মনে হচ্ছে।কোনোরকমে পিন খুলে গাঁথতে গাঁথতে বলল,
—‘নামছি একটুপর!’
সম্পদ ভিউ মিররে তাকিয়ে বলল,
—‘সাইকোলজি নিয়ে পড়ে কি লাভ যদি মানুষের মনই না পড়তে পারো?’
তিথির হাত থেমে গেল।সে বড় বড় চোখে একবার সম্পদের দিকে তাকালো।এপাশ থেকে সম্পদের মুখের একটা অংশ দেখা যাচ্ছে।তাকে ছবির মতো সুন্দর লাগছে।সে দ্রুত চোখ সরিয়ে হিজাব ঠিক করলো।ব্যাগটা হাতে নিয়ে গাড়ি থেকে নেমে পড়লো।সম্পদকে কিছু বলে যাওয়া উচিত।উচিত কাজগুলোই তার কাছে পাহাড়সম কেন মনে হচ্ছে?
সম্পদ গাড়ি থেকে নামেনি।নামবে না বোধ হয়।তিথি এগিয়ে এসে তোতলানো স্বরে বলল,
—‘আমি তাহলে আসছি!’
সম্পদ জানালার কাচ খুললো না।কোনো প্রতিত্তর ও করলো না।চুপচাপ গাড়ি স্টার্ট দিয়ে চলে গেল।সে চলে যেতে তিথির বুকের পুরনো ক্ষতে ব্যথা শুরু হলো যেন!মানুষটা কি কোনো কারণে তার উপর রাগ করেছে?
তিথির প্রচন্ড রকম মন খারাপ হয়ে গেল।মানুষটা তার উপর কোনোভাবে রেগে থাকুক তা সে মোটেই মেনে নিতে পারছে না।সম্পদের চলে যা-ওয়া রাস্তার দিকে সে বহুক্ষণ চেয়ে রইলো।কেন জানি মন বলছে সম্পদ আবার আসবে।সম্পদ আসলো না।তবে তিথির ঘোর কাটলো একটা মেয়ের ডাকে।তার বান্ধবী কাকলি!কাকলি তার মাথায় টোকা মেরে বলল,
—‘টানা এক সপ্তাহ কোথায় ডুব মেরেছিলি?অনলাইন আসিস না,সব ডিএক্টিভেট!নাম্বারে ফোন করলে বন্ধ বলে।কোথায় ছিলি রে তিথি?তুই ঠিক আছিস তো?’
তিথি হেসে মেয়েটাকে আশ্যস্ত করলো।বান্ধবীদের মধ্যে এই মেয়েটা তার সবচেয়ে বেশি কাছের।কাকলির হাত ধরে ক্লাসের দিকে হাঁটা ধরলো।টানা টানা কন্ঠে বলল,
—‘আরে ভাই আমি ঠিক আছি।আগে ক্লাসে যাই।সব বলবো!’
ক্লাসে বসে বড় করে শ্বাস নিল তিথি।ল্যাব ক্লাসে জুনিয়ররা এখনো প্র্যাক্টিক্যাল করছে।স্যার নাকি বলেছে আজ একটু লেইটে তাদের ক্লাস শুরু হবে।কাকলির হড়বড় প্রশ্নে অন্য কথা বলে তাকে থামিয়ে দিল।
বিয়ের কথাটা চেপে গেল তিথি।কাউকে জানাতে ইচ্ছে করছে না।তার বিয়েটা তো আনন্দের বিয়ে নয়।তার প্রিয় ব্যক্তির সাথেও বিয়ে হয়নি।তবে তিথি খুব করে চায় সম্পদ মানুষটা তার প্রিয় ব্যক্তি হয়ে উঠুক।সেটা কি আদৌ সম্ভব?
—‘দেখ তিথি।কি হ্যান্ডসাম একটা ছেলে!নিশ্চয়ই অন্য ডিপার্ট্মেন্টের সিনিয়র ভাই।দেখ দেখ!দরজা দিয়ে উঁকিঝুঁকি মারছে।আরে আরে!ছেলেটা তো আমাদের দিকেই তাকিয়ে আছে।’
কাকলির একগাদা কথায় তিথি কৌতূহল নিয়ে মাথা ঘুরিয়ে দক্ষিণের করিডোর সোজা দরজার দিকে তাকালো।সঙ্গে সঙ্গে তার পিলে চমকে উঠল।সম্পদ দাঁড়িয়ে আছে।চোখে মুখে গম্ভীর ভাব।
তিথি সটান দাঁড়িয়ে পড়লো।কাকলির চোখে হাত রেখে বলল,
—‘দেখিস না!’
কাকলি বিরক্তি ঝরা কন্ঠে বলল,
—‘হাত সরা তিথি।দেখবো না কেন?’
—‘কার না কার বর!’
—‘ধুর!বর হতে যাবে কেন?এই ছেলে এখনো বিয়ে করেনি।হয়তো প্রেজেন্টেশন ছিল সেজন্য ফরমাল লুকে এসেছে।হাত সরা তো!’
তিথি আরো শক্ত করে কাকলির চোখ বন্ধ করলো।দরজার দিকে চেয়ে অনুনয়ের সুরে মনে মনে বলল,
—‘প্লিজ!চলে যান!’
তার মনের কথা সম্পদ শুনতে পেল কি না সে জানে না!তবে কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে সম্পদ চুলে একবার আঙুল চালিয়ে করিডোর ধরে উল্টো ঘুরে গেল।তিথি হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো যেন।মনের গহীনে তলিয়ে দেখলো তার ভালো লাগছে।প্রচুর ভালো লাগছে।
হাতটা কাকলির চোখ থেকে সরিয়ে ধপ করে বসে পড়লো।সঙ্গে সঙ্গে কাকলি আগুন ঝরা কন্ঠে বলল,
—‘এটা কি হলো?’
তিথি কিছুটা বিব্রত বোধ করলো।কাকলি মেয়েটা উড়নচণ্ডী।সময় কাটানোর জন্য, নিজের পুরনো ক্ষত ভুলে থাকার জন্য প্রচুর ছেলের সাথে মেলামেশা করে।সেও একবার কাউকে চূড়ান্ত রকমের ভালোবেসে হারিয়ে ফেলেছে।তারপর থেকেই তার এই দশা।সুদর্শন কোনো ছেলে দেখলে একপ্রকার হামলে পড়ে।
তিথি কাকলির হাতে হাত রেখে বলল,
—‘এভাবে ছেলেদের দেখে কি লাভ বলতো?’
কাকলি কেমন নরম হয়ে আসলো।চোখ দুটো ছলছল করতে অন্য দিকে ঘুরে তাকাল।এপাশ ওপাশ তাকাতে তাকাতে তাচ্ছিল্যের সুরে বলল,
—‘কোনো লাভ নেই রে।জাস্ট চোখের আরাম!’
তিথির দৃষ্টি তীক্ষ্ণ হতে কাকলি হেসে বলল,
—‘তোকে কিছু কথা বলি তিথি।পৃথিবীতে দুই রকমের ভালোবাসা আছে।দেহের ভালোবাসা আর মনের ভালোবাসা।কিন্তু এই দুটো একই ব্যক্তির থেকে পাওয়া যায় না।প্রকৃতি পেতে দেয় না।অনেকটা ফিজিক্সের সূত্রের মতো।হাইজেনবার্গের অনিশ্চয়তা মূলনীতির মতো।একই সময়ে কোনো বস্তুর ভর এবং অবস্থান যেমন জানা যায় না,তেমনি একই সময়ে একই ব্যক্তির থেকে দেহের ভালোবাসা আর মনের ভালোবাসা পাওয়া না।একটা পেলে আরেকটা অনিশ্চয়তার মধ্যে থেকে যায়।দুটোই কিন্তু ভালোবাসা!এই আমাকে দেখ,আমি মনের ভালোবাসা পেয়েছি একজনের থেকে আর বিয়ে করতে হবে আরেকজনকে!’
তিথি মাথা নিচু করে আছে।তার হাত পা অস্বাভাবিক কাঁপছে।কাকলি হঠাৎ বুঝতে পেরে তার হাত চেপে বলল,
—‘আরে তিথি!মন খারাপ করিস না।এসব তোর সাথে হবে না।আমি বলে দিলাম তোর ক্ষেত্রে হাইজেনবার্গের নীতি ভুল এবং ভুল প্রমাণিত হবে।’
কাকলি বোতল খুলে নিজে খানিকটা পানি খেল।তিথির দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল,
—‘মানুষের বেঁচে থাকার মূল রহস্য জানিস তিথি?আমার মনে হয় মানুষের বেঁচে থাকার মূল রহস্য হলো এদের অবিশ্বাস্য রকমের শূন্যস্থান পূরণ করতে পারার ক্ষমতা। এরা আশপাশে যা পায় তাই দিয়ে নিজের শূন্য স্থান পূরণ করে ফেলে।যেই মানুষটাকে রাত জেগে কথা দেয়া হয় যে, তোমাকে রোজ সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখতে না পেলে আমি মরে যাব,একটা সময় বুঝতে পারা যায় কাউকে দেখতে না পেয়ে কেউ কখনো মারা যায় না।তাকে ছাড়া দিব্যি বেঁচে থাকা যায়।হয়তো ক্ষণিক সময়ের জন্য কষ্ট হয়, কিন্তু তা চিরস্থায়ী না।বস্তুত পৃথিবীর কিছুই চিরস্থায়ী না।সব আপেক্ষিক!সব কষ্ট,সব স্মৃতি আপেক্ষিক।একজনকে ভেঙে চূড়ে ভালোবাসার পরো অন্য একজনকে নিয়ে সুখে থাকা যায়।’
সিআর এসে সবাইকে ক্লাসের জন্য ডাকছে।কাকলি উঠে দাঁড়ালো।তিথি এলোমেলো ভাবে পা ফেলে তাকে অনুসরণ করলো।
১৩.
করিডোর ধরে হেঁটে নিচে নামল তিথি।মাঠে পা রাখতে বুঝতে পারলো আজ প্রচুর রোদ উঠেছে।এই বিকেল বেলাতেও রোদের তেজ বিন্দুমাত্র কমেনি!সে একাই হাঁটতে শুরু করলো।কাকলি আজ একটু তাড়াতাড়ি ভার্সিটি ত্যাগ করেছে।গেটের কাছে পৌঁছে আকাশের দিকে তাকালো সে।আকাশ রোদ ঝলমলে, পরিষ্কার!মেঘের ছিটেফোঁটা কোথাও নেই।তবুও আচমকা তার মনে হলো আজ আকাশ ভেঙে বৃষ্টি হবে।ঝুম বৃষ্টিতে পথঘাট ডুবে যাবে।
হঠাৎ এমন মনে হওয়ার কারণ খুঁজে পেল না সে।এটা প্রিকগনিশন নাকি?ভবিষ্যতের কথা আগে বলে ফেলল!অন্যমনস্ক ভাবে এগিয়ে রিকশার খোঁজে যেতে কেউ একজন বলল,
—‘গাড়িতে উঠো!’
চলবে