ধূসর পাহাড়,পর্ব_২৩

ধূসর পাহাড়,পর্ব_২৩
লেখিকা আমিশা নূর

কুয়াশা সামায়রার রুম থেকে বেরিয়ে এলো।মাহির সামায়রাকে একটুও চোখের আড়াল করে না।কিন্তু অরণ্য?সে তো কুয়াশাকে এভয়েড করছে।সকাল থেকে এতো মেসেজ দিলো কিন্তু রিপ্লে এলো না।
কুয়াশা মনে মনে ঠিক করে নিলো অরণ্যকে আর কল,মেসেজ কিছু করবে না।

২৭.
“কুয়াশা তুই তো নিজেই বলতি যে রিলেশনের ফিউচার নেই সেই রিলেশনটা যাস্ট টাইম পাস হয়।”
“হুম।কিন্তু দেখ আমি কাকে ভালোবেসে বসে আছি।জানিস অনেক চেষ্টা করি ওর সাথে কথা না বলার,দূরে থাকার।কিন্তু বার বার ফেইল হয়।তোর বিয়ের দিন ঠিক করে নিলাম ওর সাথে কোনো কথা বলবো না কিন্তু আবারো মেসেজ দিলাম।”
“অরণ্য সত্যি লাকি রে তোর মতো কাউকে নিজের লাইফে পেয়েছে।কিন্তু আফসোস ও সেটা না বুঝে তোকে অবহেলা করছে।”
“বাদ দে তো।নিজের খেয়াল রাখিস।”
“আবার কখন আসবি?”
“তোর বাবু হলে।”
“সিরিয়াসলি?এক বছর পর?”
“আচ্ছা তুই প্রেগন্যান্ট হলে আসবো।”
“তুই…”
“হাহাহাহা”

সামায়রার সাথে হাগ করে কুয়াশা,তিহান আর শব্দ এয়ারপোর্টে প্রবেশ করলো।কুয়াশার মধ্যে অন্যরকম ফিলিংস হচ্ছে।যেন প্রথম বার অরণ্যের সাথে দেখা হবে।তবে এইটা ভেবে প্রশান্তি আসছে যে আজ সবার সাথে দেখা হবে।সব প্রশ্নের উত্তর পাবে।তবে কুয়াশা এইটা ভেবে অবাক হচ্ছে যে অধ্রী,রৌদ্রময় বা কানন একবারের জন্যও খবর নেয়নি।তাই কুয়াশা অরণ্যকেও জানায়নি আজকে বাংলাদেশ ফিরে যাচ্ছে।
.
.
“এতোদিন কেউ ভারতে থাকে আমি প্রথম শুনলাম।কে জানে ভারতের নাম করে অন্য কোথা থেকে ঘুরে এসেছে কীনা?যে চালাক এই ছেমরি।”

ওয়াশরুম থেকে বের হতেই কথাগুলো কুয়াশার কানে ভেসে আসলো।শেষের কথাটা শুনতেই কুয়াশার মাথায় রক্ত উঠে গেলো।হাতের তোয়ালে নিচে ফেলে দিয়ে তার খালার সামনে গেলো।প্রচন্ড ঝাঁঝালো কন্ঠে বললো,”নিজের বলা কথাগুলোর প্রতি একটু খেয়াল রাখুন।”
“তোর সাহস তো কম না,কথাটা শুনে ঝগড়া করার জন্য চলে এলি?”
“খালা যা জানেন না তা নিয়ে কথা বলবে না।আমি ইন্ডিয়া গেছিলাম নিজে খুব ভালো করে জানেন তাহলে শুধু শুধু ওমন কথা কেনো বলছেন?”
“হু হু। খুব ভালো করেই জানি কই কই যাস তুই।সারাদিন ছেলেদের সাথে ঘুরাফেরা করিস।”
“ফালতু কথা একদম বলবেন না।”
“টাসসসস।”

কথাটি শুনতেই কুয়াশার খালা কুয়াশাকে থাপ্পড় দিলো।কুয়াশা গালে হাত দিয়ে রইলো।রাগে গা থর থর করে কাপছে।কুয়াশা দৌড়ে রুমে চলে গেলো।দরজা বন্ধ করেও স্পষ্ট শুনা যাচ্ছে,”হুহ..স্পর্ধা বেরে গেছে।সত্য কথা বললে গা ঝালা করে!ছেলেপেলে গুলার সাথে কক্সবাজার গিয়ে ঘুরে আসলো।কতো সাহস বাড়ছে….”কুয়াশা কান চেপে ধরে ওয়াশরুমে গিয়ে চোখে মুখে পানি দিলো।তারপরও বারবার কথাগুলো কানে গুনগুন করছে।ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে ঘুমের ঔষুধ খেয়ে বিছানায় শুয়ে পড়লো।এখন ঘুম থেকে উঠলেই স্বাভাবিক হতে পারবে।
.
.
আছরের সময় কুয়াশা’র ঘুম ভাঙ্গলো।প্রথমে মোবাইল চেক করলো।কিন্তু অরণ্যের কোনো খবর পাওয়া গেলো না।কুয়াশা কৃষ্ণার নাম্বারে ডায়াল করলো।দু’বার রিং হওয়ার পর রিসিভ করলো,

“হ্যালো!কৃষ্ণা আপু?”
“হ্যা,কুয়াশা কেমন আছো?”
“জ্বি, আলহামদুলিল্লাহ ভালো।তুমি?”
“আমিও।ইন্ডিয়া থেকে কখন ফিরলে?”
“আজই।আয়ন কেমন আছে?”
“ও তো।ভালোই…আমরা গ্রামের বাড়ি এসেছি।কালকে ফিরবো।”
“ওহ,আচ্ছা।তাহলে আমি কালকে যাবো।”
“আচ্ছা।”
“সীয়ামা কোথায়?”
“সীয়ামা তো প্রকৃতিকে নিয়ে বাইরে গেলো।”
“প্রকৃতি?”
“আচ্ছা কুয়াশা তোমাকে আমি একটু পর কল করছি।”
“ওকে।”

কল কেটে দিয়ে কুয়াশা ভাবতে লাগলো,”কোন প্রকৃতি’র কথা বললো আপু?আর যদি নিপুর আপু হয় তাহলে ও সীয়ামার সাথে কী করছে?অরণ্যই বা কোথায়?অধ্রীদের কোনো খোঁজ নেই কেনো?সব প্রশ্নের উত্তরের জন্য সীয়ামাকে কল দিতে হবে।”
দ্বিতীয় বার না ভেবে কুয়াশা সীয়ামাকে কল দিলো।কিন্তু কেউ রিসিভ করলো না।বিরক্ত হয়ে কুয়াশা অরণ্যকে কল করলো।

“হ্যালো,কে বলছেন?”

অজান্তেই কুয়াশার চোখ থেকে জল গড়িয়ে পড়লো।আজ প্রায় তিনদিন পর অরণ্যের কন্ঠ শুনছে।শ্বাস-প্রশ্বাস এর শব্দ শুনছে।কুয়াশা পুরোনো ভাবনায় ডুব দিলো।

“হ্যালো?”
“অরণ্য?”

অরণ্যের বুকটা ধক করে উঠলো।এইটা তো কুয়াশা,কতোটা অসহায় লাগছে ওর কন্ঠস্বর!কতো ইগনোর করেছে মেয়েটাকে!নিশ্চয় অনেক কেঁদেছে কুয়াশা।পরিবারের জন্য নিজের ভালোবাসা,ফ্রেন্ডস, ত্যাগ করেছে অরণ্য।জানে না আরো কতো কী করতে হবে।

“অরণ্য শুনছো?”
“হ..হুম।তুমি ফিরলে কবে?”
“আজ।কেমন আছো?”
“হুম ভালো।”
“গ্রামের বাড়ি গেছো বলোনি তো?”
“সময় হয়নি।”
“ওহ।প্রকৃতি তোমাদের সাথে?”

অরণ্যের গাবড়ে গেলো।কুয়াশা কীভাবে জানলো প্রকৃতির কথা?কী রিয়েক্ট করেছে ওর কথা শুনে?

“তুমি প্রকৃতিকে জানো?”
কুয়াশার প্রশ্ন শুনে অরণ্য নিশ্চিত হলো যে কুয়াশা কিছুই জানে না।

“হ্যা ঐ প্রকৃতি..”
“প্রকৃতি?”
“আচ্ছা বাদ দাও না।”
“কেনো?আর অধ্রীরা কোথায়?”
“অধ্রী মুম্বাই চলে গেছে।আর রৌদ্রময় লন্ডন।”
“হুয়াট?কবে?কেনো?”
“শুনো তোমাকে আমি সব বলবো।শুধু একটু ধৈর্য ধরো।”
“কিন্তু কেনো?কী হয়েছে?”

অরণ্যের হঠাৎ ভিষন রাগ উঠলো।রাগের মাথায় বললো,”সব সময় এতো জানার আগ্রহ কেনো রাখো?বললাম না পরে বলবো সব?তোমার জন্য আমাদেী ফ্রেন্ডশিপ নষ্ট হয়েগেছে।যাস্ট বিকজ অফ ইউ।তুমি বিরুক্তিকর পার্সন একটা।আর কোনোদিন আমাকে কল করবে না।”

অরণ্যের কথা শুনে কুয়াশা থমকে গেলো।কী বলছে অরণ্য এসব?ওর জন্য?কিন্তু কুয়াশা কী করেছে?
.
.
“এতো রুড ব্যবহার না করলেও পারতেন অরণ্য।”

প্রকৃতির কথা শুনে অরণ্যের রাগ বেড়ে গেলো।প্রকৃতির দু বাহু দেওয়ালের সাথে ঠেকিয়ে রাগি গলায় বললো,”তুমি কেনো এসেছো আমার লাইফে?তোমার জন্য কুয়াশার সাথে এতো বাজে ব্যাবহার করতে হয়েছে।আমাকে একদম বুঝানো ট্রাই করবে না।ডোন্ট ইউ ডেয়ার।”

প্রকৃতিকে ছেড়ে দিয়ে অরণ্য রুম থেকে বেরিয়ে গেলো।প্রকৃতি এসব কথায় মোটেও কষ্ট পেলো না।তার তো কষ্ট হচ্ছে কুয়াশার জন্য। কী করবে ঐ জেদি মেয়েটা?যখন জানতে পারবে আসল সত্যিটা?”

এভাবে অনেকটা দিন কেটে যায়।কুয়াশা আয়ন’কে টিউশনি করাবেনা বলে দিয়েছে।অরণ্য’কে কুয়াশা অনেক বারই মেসেজ,কল দিয়েছে কিন্তু ওপাশ থেকে কোনো প্রতিক্রিয়া আসে নি।অরণ্যের এতোটা ইগনোর কুয়াশা কিছুতেই মানতে পারছে না।এর মাঝে নিজেকে অনেকবার আঘাতপ করেছে।গত দিন গুলোই কুয়াশা লক্ষ্য করলো সে আবার আগের মতো হয়ে যাচ্ছে।অল্পতেই রেগে যাওয়া,জেদী,সব কিছু মিলিয়ে যেনো অন্য এক কুয়াশা।একদিন কুয়াশা কলেজ থেকে ফিরার পথে কাননের সাথে দেখা হয়।কিন্তু কানন কুয়াশাকে দেখেও না দেখার ভান করে থাকে।রেগে গিয়ে কুয়াশা কাননকে ধমকায়।কিন্তু কোনো লাভ হয়নি।সেদিন ও কুয়াশা খুব কেঁদেছিলো।আজ সকাল বেলা কুয়াশার ফোনে কল আসে।ধড়ফড়িয়ে কুয়াশা কল রিসিভ করে কারণ কলটা অরণ্য করেছিলো।

“হ্যালো অরণ্য?”
“হুম।দেখা করতে পারবে?”
“দে..দেখা? হুম করতে পারবো।”
“আচ্ছা তাহলে #ধূসর_পাহাড়ে আসিও।”
“কখন?”
“তিনটায়।”
“ওহ আচ্ছা।”

দুজনেই কিছুক্ষণ চুপ করে রইলো।এতোদিন কুয়াশা অরণ্যের কলের জন্য অপেক্ষা করলেও আজ অরণ্যের খুব অভিমান হচ্ছে।কুয়াশা ঠিক করে রেখেছিলো অরণ্য যদি কোনোদিন ও কল করে তাহলে অনেকগুলো কথা শুনাবে।কিন্তু এখন মুখ থেকে একটা অক্ষরও বের হচ্ছে না।কী অদ্ভুত!

“আচ্ছা রাখি তাহলে?”
“আর একটু কথা বললে খুব বেশি কী খারাপ হবে অরণ্য?”

ওপাশ থেকে কোনো প্রতিক্রিয়া এলো না।শুধু ব্যাক্তির নিঃশ্বাস ছাড়া।কুয়াশা আবারো বললো,”একবার ধূসরী বলে ডাকবে অরণ্য?”

অনেকক্ষণ অপেক্ষা করলো কুয়াশা।কিন্তু ওপাশ থেকে কিচ্ছুটি শুনা গেলো না।রাগ-দুঃখে কুয়াশা ফোন আছাড় দিলো।হাঁটু মাথা রেখে কাঁদতে লাগলো।এই কদিনে কাঁন্নায় যে তার এক মাত্র সঙ্গী।
.
.
নীল শাড়ি,চোখ ভর্তি গাড় কাজল,হাতে কাঁচের চুরি,চুল ছেড়ে দেওয়া এক ধূসরী কন্যা’কে দেখে অরণ্য মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে রইলো।মেয়েটি চোখ ভর্তি জল নিয়ে পাহাড়ের নিচে বিশাল সমুদ্রে তলিয়ে গেলো।তখনি অরণ্যের ঘুমটা ভেঙে গেলো।বালিশের নিচ থেকে মোবাইল নিয়ে দেখলো দুটো বাজছে।তিনটায় কুয়াশার সাথে দেখা করার কথা মাথায় আসতেই তাড়াতাড়ি উঠে বসলো।ওয়াশরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে রুমে আসতেই দেখলো বিছানায় কালো শার্ট আর পেন্ট রাখা।ভ্রু কুচকে অরণ্য শার্টটা হাতে নিলো।এর সাথে ছোট একটি চিরকুট লাগানো আছে।যাতে লিখা “বাইরে যাওয়ার সময় এই শার্ট পড়বেন।” অরণ্যের বুঝতে বাকি রইলো না এই কাজ কার।রেগে গিয়ে অরণ্য আলমারি’র কাছে গেলো।সেখানে আরো একটি চিরকুট লাগানো আছে।যাতে লিখা,”কুয়াশার পছন্দের কালার কালো!”অরণ্যের মনে পড়ে গেলো সত্যিই তো কুয়াশার পছন্দের রং কালো।অনেক দিন দেখা হয়নি আর কালো ড্রেসে দেখলে নিশ্চয়ই খুশি হবে।বাকি আর না ভেবে অরণ্য রেডি হয়ে গেলো।

(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here