গল্পের নাম:হ-য-ব-র-ল,পর্ব_০৬
লেখনীতে: অজান্তা অহি (ছদ্মনাম)
অহি এগিয়ে এসে আলতো করে ডান হাতটা রোদ্দুরের গালে রাখলো।হালকা করে স্পর্শ করে বলল,
‘কোন গালে থাপ্পড় মেরেছে?’
রোদ্দুর বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে আছে।এ কোন অহিকে দেখছে সে?নিজে থেকে ছুঁয়ে দিচ্ছে!এত মায়া জড়ানো কন্ঠে কথা বলছে।সে নিজের বাম হাতটা উঁচু করে তার গাল স্পর্শ করা অহির হাতের উপর হাত রাখলো।অহির যেন ঘোর কাটলো।দ্রুত নিজের হাত সরিয়ে নিল।এক পলক এদিক ওদিক তাকিয়ে বলল,
‘থাপ্পড়ই তো মেরেছে।চাকু টাকু মেরে তো দেয়নি।এত উতলা হচ্ছেন কেন?
‘অজান্তা,তুমি একবার আমার মুখের দিকে তো তাকাও!গাল লাল হয়ে গেছে।’
অহির ভেতরটা অস্থিরতায় টইটম্বুর হয়ে যাচ্ছে।সে অগোছালো দৃষ্টি মেলে একবার রোদ্দুরের দিকে তাকালো। রোদ্দুরের কাকুচক্ষু জলের মতো স্বচ্ছ গভীর দৃষ্টি বুকের কোথাও তোলপাড় সৃষ্টি করলো।সে দ্রুত অন্য দিকে ঘুরে দাঁড়াল।পাশের সিটের ব্যাগ গুলো সরিয়ে নিজের কালো চামড়ার ব্যাগটা বের করলো।তরল জাতীয় একটা ওষুধ বের করে লম্বা করে শ্বাস নিল।
রোদ্দুর হঠাৎ পেট চেপে বলল,
‘অজান্তা,পেট শূন্য কুয়ো হয়ে গেছে।ক্ষুধায় মরে গেলাম।’
‘আমাকে কেন বলছেন?আমি কি করতে পারি?’
‘অনেক কিছুই করতে পারো।একটু ক্ষুধা নিবারণের মেডিসিন দাও!’
অহি ফোঁস করে একটা নিঃশ্বাস ছাড়লো।উত্তর দিল না।একটুপর ঘুরে রোদ্দুরের দিকে এগিয়ে গেল।নিজেকে সামলে বেশ স্বাভাবিক ভাবে রোদ্দুরের পাশে বসে পড়লো।হাতের ডগায় একটু মেডিসিন লাগিয়ে বলল,
‘মুখটা এদিকে ঘুরান তো!’
রোদ্দুর মুখ ঘুরাতে অহি আঙুলের ডগা দিয়ে রোদ্দুরের মুখের দুই গালে তরল মেডিসিন লাগিয়ে দিল।গম্ভীর কন্ঠে বলল,
‘জ্বালাপোড়া কমেছে?একটু ঠান্ডা ঠান্ডা অনুভূত হচ্ছে?’
রোদ্দুর হাঁ করে তাকিয়ে আছে।তার চোখ দুটো কোটর থেকে বের হবে যেন!অহির এত কেয়ারিং বিহেভ তার হজম করতে কষ্ট হচ্ছে।মনে হচ্ছে জেগে জেগে স্বপ্ন দেখছে সে।কাত ঘুরলেই স্বপ্ন ভেঙে যাবে।এই কেবিন,এত নিশুতি রাত,এই যে পাশের এই লক্ষীমন্ত্র মেয়ে সব মিলিয়ে যাবে।সে চোখ খুলে দেখবে নিজের রুমে শুয়ে আছে এবং এতক্ষণ গভীর কোনো স্বপ্ন দেখছিল।
এসবের কিছুই হলো না।স্বপ্ন ভাঙলো না।অহির বিরক্তিকর কন্ঠ কানে বাজলো।কাঠ কাঠ গলায় বলছে,
‘এভাবে সাপের মতো তাকিয়ে থাকেন কেন?ছোবল মারবেন?’
রোদ্দুর ডানে বায়ে মাথা নেড়ে না জানাল।মিনমিন গলায় বলল,
‘ছোবল তো আপনি মেরেছেন ডক্টর!ছোবল মেরে ভেতরে প্রেমের বিষ ঢুকিয়ে দিয়েছেন।এখন আপনার থেকে দৃষ্টি সরালে চোখ জ্বালা করে!’
‘কি?’
অহির দৃষ্টি সরু হতে রোদ্দুর উঠে দাঁড়ালো।খুকখুক করে কেশে বলল,
‘অজান্তা,কথা বলতে পারছি না।গালে টান লাগে!’
‘কথা বলতে বলেছে কে?’
‘কিছু খেতেও তো পারবো না।ডান হাত আঘাতপ্রাপ্ত।আবার মুখও!অন্য কোনো ভাবে খাবার শরীরে প্রবেশ করানো যায় না অজান্তা?’
‘আমার জানা নেই!’
‘চলো, আমাদেন কেবিনে।মা ডাকছে তোমায়।’
অহি কপাল কুঁচকে বলল,
‘আমি কিছুক্ষণ আগে দেখা করেছি।কথা হয়েছে।আবার কেন ডাকবে?’
‘আরে তুমি চলো তো!এবার আমার সাথে চলো।ভাবীর মেয়েকে দেখবে না?’
‘দেখেছি।ওর নাম কি ঠিক করেছেন?’
‘করিনি।বাসায় গিয়ে গ্রান্ড সেলিব্রেশন করে নাম ঠিক করা হবে।সবাই সবার পছন্দের নাম একটা করে ছোট্ট কাগজে লিখবে।এটা ভাঁজ করে একটা বোয়ামে রাখা হবে।সেখান থেকে একটা বের করে তাতে যে নাম লেখা থাকবে সেটা ফাইনাল নাম হবে।আপাতত সবাই যার যা খুশি তাই বলে ডাকছে।যেমন ধরুন,আমি মনে মনে তাকে রূপচাঁদা বলে ডাকছি!’
‘কিহ!রূপচাঁদা?’
‘হুঁ।তোমার বাবা নামফি বলে ডাকছে।আমার মা ভানু বলে ডাকছে।আরো অনেকে অনেককিছু বলে ডাকছে।’
অহির নিজেকে বড্ড ক্লান্ত লাগছে।স্লিপিং বার্থ কেবিনের টিকেট কেটেছিল ঘুমানোর জন্য।অথচ আজকের এই ট্রেন জার্নিতে ঘুম বাদে বাকি সব হয়েছে।সে সূক্ষ্ম একটা হাই তুলে দরজার দিকে এগিয়ে গেল।খোলা দরজা আরো একটু খুলে বলল,
‘আপনি এবার আসতে পারুন,রোদ্দুর হিম!’
রোদ্দুর আশাহত হয়ে বের হলো।কেবিনের বাইরে পা রেখেই সে অহির নীল রঙের ঝুলন্ত ওড়নার নিচের অংশ হাতের মুঠোয় পুড়ে নিল।
ওড়নায় টান পড়তে অহি চমকে রোদ্দুরের হাতের দিকে তাকালো।ওড়না ছাড়ানোর চেষ্টা করে বলল,
‘আপনি একটা কিন্তু-পার!ওড়না ছাড়ুন!’
রোদ্দুর নিচের দিকে তাকিয়ে অনুরোধের স্বরে বলল,
‘প্লিজ আসো না অজান্তা!’
রোদ্দুরের কন্ঠস্বর অহির বুকের গহীনে গিয়ে বিঁধলো যেন।হার্টবিট বেড়ে গেল।সে ঠোঁট কামড়ে বলল,
‘ওড়না ছাড়ুন!আমি আসছি!’
রোদ্দুরের মনের আকাশটা যেন মেঘমুক্ত হয়ে গেল।সে ঝলমলে হাসি হেসে ওড়না ছেড়ে দিল।অহি কেবিন থেকে বের হয়ে দরজা টেনে দিল।
৭.
রোদ্দুর এই মুহূর্তে বসে আছে পলি মজুমদারের সামনে।তার পাশের সিটে হাত পা এলিয়ে বসে আছে ডিরেক্টর আলতাব মৃধা!
পলি মজুমদার ঘন ঘন মাথার চুল নাড়াচাড়া করছে।টিস্যু দিয়ে নাক আর কপালের ঘাম মুছছে।দেখেই বোঝা যাচ্ছে নিজেকে যথাসম্ভব স্মার্ট আর গর্জিয়াস রূপে প্রেজেন্ট করতে চাচ্ছে সে।
রোদ্দুর মিনিট দশ পনেরো হলো এভাবে বসে আছে।তাকে জরুরি তলব করে ডিরেক্টর আলতাব মৃধা ডেকে পাঠিয়েছিল।এখানে আসার পর আলকাব মৃধা তাকে বলেছে যে, সে নয়!তার সাথে কথা বলবে পলি মজুমদার।সে অনেক ক্ষন হলো পলি মজুমদারের সামনে বসে আছে।কিন্তু নায়িকা মাথার চুল নাড়াচাড়া বাদে আর কিছুই বলছে না।
নিজের ভেতরের চাপা রাগটা নিয়ন্ত্রণ হারাতে বসেছে যেন।রোদ্দুর এই মেয়েটাকে কেন জানি সহ্য করতে পারছে না।মেয়েটটির গলা চেপে উপরে তুলে ট্রেনের জানালা দিয়ে ছুঁড়ে ফেলার গোপন ইচ্ছেটা সে দীর্ঘ শ্বাস রূপে বের করে দিল!
আলতাব মৃধা নিরবতা সহ্য করতে না পেরে মুখ খুললেন।পেছন ঘুরে এক স্টাফকে রাগান্বিত স্বরে বললেন,
‘চোখে দেখিস না?সব বলে দিতে হবে?তিন কাপ চা দিয়ে যা!’
স্টাফদের মধ্যে নড়ন চড়নের হিড়িক পড়ে গেল।পলি মজুমদারও মুখ খুলল।রোদ্দুরের দিকে চেয়ে বলল,
‘আপনার বায়োডাটা ইতোমধ্যে আমি মুখস্থ করে ফেলেছি।আপনি কি সত্যি আর্টিস্ট হিসাবে নিজের ক্যারিয়ার গড়তে চান?গ্ল্যামার দুনিয়ায় আসতে চান?’
রোদ্দুর সিরিয়াস মুখে বলল,
‘হ্যা,চাই!’
‘বেশ!ভেবে বলছেন তো?ফিল্ম ইন্ড্রাস্ট্রি তে একবার ঢুকলে আর কিন্তু বের হওয়ার অপশন নেই।সেকেন্ড থট?’
রোদ্দুর বেশ কনফিডেন্স নিয়ে বলল,
‘আমি আর্টিস্ট হতে চাই!’
‘ঠিক আছে।এবার আপনাকে আমরা অনেক বড় একটা অপরচুনিটি দিবো।আলতাব ভাইয়ের সাথে আমি কথা বলেছি।এর পরবর্তী মুভিতে হিরোর রোলে আপনি অভিনয় করবেন।হিরোইন আমি!সাথে কো-এক্টর হিসেবে থাকবে শাওন!রাজি?’
রোদ্দুর যেন আসমান থেকে পড়লো।এ কি শুনলো সে?চোর থেকে সরাসরি নায়ক?এটা তো মুভিতে দেখেছে শুধু!সে সিউর হওয়ার জন্য বলল,
‘আর একটু বুঝিয়ে বলুন।’
পলি মিষ্টি করে হাসলো।সে আর কিছু বললো না।এবার কথা বলল আলতাব মৃধা।রোদ্দুরের দিকে চেয়ার টেনে এগিয়ে এসে বলল,
‘তোমার এক্টিং আমরা দেখেছি।অত্যন্ত নিঁখুত অভিনয় তোমার।তোমার শরীরে যেন আর্টিস্টের রক্ত মিশে আছে।আনবিলিএভল!আমার নেক্সট মুভিতে একটা নতুন মুখের প্রয়োজন ছিল।তোমার মতো এত সুদর্শন ছেলে মেইন লিডে অভিনয় করলে মুভি হিট!তাছাড়া তোমার মধ্যে সততার একটা ব্যাপার স্যাপার আছে।তুমি কোনো কাজকে ছোট মনে করো না।তোমার চিন্তা ধারণা এমন থাকলে তোমান ক্যারিয়ার উজ্জ্বল নক্ষত্রের মতো।তাই আমি অনেক ভেবে চিন্তে তোমার চোরের রোলটা বাদ দিয়েছি।অন্য কেউ করবে সেটা।তুমি হিরো হিসেবে কিছুদিনের মধ্যে নতুন ছবির শ্যুটিং শুরু করবে।’
রোদ্দুরের সামনে চা রাখা হয়েছে।সে যেন নিজের মধ্যে নেই।চারপাশ কেমন অচেনা মনে হচ্ছে।পানি পিপাসা পাচ্ছে।কোনো রকমে চায়ের কাপ হাতে তুলে তাতে চুমুক দিল।অন্য মনস্ক ভাবে চুমুক দিয়েই চায়ের তাপমাত্রা টের পেল।পিচ করে সব চা মুখ থেকে ফেলে দিল।হাত দিয়ে মুখে হাওয়া করতে করতে বলল,
‘শিট!!ঠোঁট পুড়ে গেল!’
পলি মজুমদার চিন্তিত মুখে একটা টিস্যু এগিয়ে দিল।রোদ্দুর কৃতজ্ঞতার দৃষ্টিতে তার দিকে তাকাল।টিস্যু দিয়ে মুখ মুছে দুজনকে উদ্দেশ্য করে বলল,
‘আমি রাজি আপনাদের প্রস্তাবে।আমি ভীষণ খুশি হয়েছি।আমাকে এই সুযোগ করে দেয়ার জন্য ধন্যবাদ।আমি খবরটা সবাইকে জানিয়ে আসি।’
সবাইকে বিদায় জানিয়ে রোদ্দুর বের হলো।তার মাথা ঝিম ঝিম করছে।এত বড় একটা সংসাদ যেন সব অগোছালো করে দিচ্ছে।তার এখনো বিশ্বাস হচ্ছে না সে মুভিতে অভিনয় করবে!
বুফে কারের বেঞ্চে অহির বাবাকে দেখা যাচ্ছে।রোদ্দুর মুখ আড়াল করে তাকে সাবধানে পাশ কাটিয়ে করিডোরে আসলো।অহির কেবিনের দরজায় টোকা দিল।ভেতর থেকে অহির মিহি সুর ভেসে এলো।ঘুমজড়ানো কন্ঠে বলল,
‘বাবা,ভেতরো এসে ঘুমিয়ে পড়ো!’
রোদ্দুর দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকল।কেবিনে লাইট জ্বলছে।সাদা আলোর ঝলকানি!সেই আলোর প্রায় সবটা অহির মুখের উপর গিয়ে কেন্দ্রীভূত হয়েছে।তাকে এই রোদ্দুরের কাছে আলোর বহর মনে হচ্ছে।যে তার অন্ধকার জীবনে আলোর মশাল হাতে পথ দেখাচ্ছে।এই মেয়েটার সব শুভ তার জন্য।এই মেয়েটা আস্তো একটা মায়ায় মোড়ানো ভালোবাসা!
রোদ্দুরের বুকের ভেতর ভালোবাসার ঢেউ খেলে গেল যেন!তার দৃষ্টি মিশে আছে অহির মুখপানে। অহির মাথার চুলগুলো সিটের উপর ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। বন্ধ চোখের পাপড়ি গুলো যেন স্বগর্বে দাঁড়িয়ে আছে।পাতলা ঠোঁট তাকে টানছে!কাছে টানছে চুম্বকের মতো!
রোদ্দুর ক্ষীণ সুরে পা ফেলে এলোমেলো গতিতে অহির কাছে গেল।অহি পাতলা কম্বল গায়ে জড়িয়ে পা ভাঁজ করে শুয়ে আছে।সে এগিয়ে গিয়ে অহির মাথার কাছে নিচে বসে পড়লো।
খুব কাছে কারো অস্তিত্ব অনুভব করতে অহির শরীরের ভেতরের দিয়ে শীতল রক্তস্রোত বয়ে গেল।ধপ করে চোখ খুলে রোদ্দুরকে খুব কাছাকাছি দেখতে পেল।কয়েক সেকেন্ড সে মুখের দিকে চেয়ে এক লাফে উঠতে নিল।কিন্তু পারলো না।
জোর পূর্বক উঠার চেষ্টা করতে রোদ্দুর দু কাঁধ চেপে অহিকে শুইয়ে দিল।অগোছালো কন্ঠে বলল,
‘অজান্তা,আমার ঠোঁট পুড়ে গেছে।চিকিৎসা দাও!’
(চলবে)