রহস্যঘেরা শহর চট্টগ্রাম,পর্ব-1
লেখক : শাহ্রিয়ার আবিদ।
এই শীতের সকালে কম্বল মুড়িয়ে ঘুমানোর মজাই আলাদা৷ আর যদি ঘুম ভেঙে উঠতেই হয় তাহলে এক কাপ ধোঁয়া ওঠা চা পেলে মন্দ হয় না।
শীতকালকে আমার মনে হয় ঘুমের মাস৷ কিন্তু আমার বেলায় আসলে তার উল্টো শীতকালে আমার কাজের চাপ আরো বেড়ে যায়। একটা প্রাইভেট কোম্পানিতে জব করি। আসলে আমাদের প্রতিষ্ঠানের প্রধান কাজ হলো, রিসার্চ করা, তথ্য সংগ্রহ করা। তবে তথ্য সংগ্রহের ক্ষেত্রে বেশ ঝুঁকি থাকে। কারণ আমাদের প্রতিষ্ঠান এমন সব তথ্য জোগাড় করে যা খুব দূর্লব! সেটা যাই কিছু হোক, তারপর তথ্যগুলো জোগাড় করে, সেগুলো চড়াদামে কোনো ব্যাক্তি বা প্রতিষ্ঠানের কাছে বিক্রি করে। তথ্য গুলো এমন, কোনো দেশের সামরিক তথ্য, কিংবা কোনো দেশের সিক্রেট সোসাইটির, কিংবা কোনো গোপন স্বীদ্ধান্তের ইত্যাদি৷ এসব তথ্য সংগ্রহের জন্য সংগ্রাহকদেরও কিন্তু চড়ামূল্যও দেয় প্রতিষ্ঠানটি ! সবচেয়ে অবাক করা বিষয় হলো, আমাদের প্রতিষ্ঠান প্রধানকে স্বচক্ষে কেউ কখনো দেখে নি! আমাদের প্রতিষ্ঠানটি যেমন ঘোটা এক রহস্যপুরী আর সে রহস্যপুরের রাজাও তেমনি রহস্যময় মানব! আমিও এখানে কাজ করছি, আমার ব্যাক্তিগত কিছু তথ্যের জন্য। আর সেটা এমন এক রহস্যময় প্রতিষ্ঠান থেকে তথ্যের জন্য সাহায্য পাবো আশা করতেই পারি৷
.
আসুন আমার পরিচয়টা দিই। তাহলে আমার গল্পটা বুঝতে আপনার সুবিধা হবে। কেন?কোথায়? কিভাবে?
কেন? কোথায়? কিভাবে? এই তিনটা প্রশ্নবোধক জিনিসের মতো আমার জীবনটাও এক প্রশ্নবোধক গোলক ধাঁধাঁ। আমার নাম রায়হান৷ আমি একজন সফটওয়্যার ইন্জিনিয়ার। আর দেখুন না ভাগ্যের কি পরিণাম। ‘ চুয়েট ‘ থেকে ইন্জিনিয়ারিং পাশ করে, স্পাই এর কাজ করছি৷ হ্যাঁ একপ্রকার স্পাই বলা যায়। আমরা যে ধরনের যেভাবে তথ্য জোগাড় করি সেটা অনেকটা গুপ্তচরদের মতো। বুঝতে পারছি আমার কথাগুলো আপনার মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে ; কিন্তু কি করার বললাম না আমার জীবনটা অনেকটা গোলকধাঁধার মতো৷ আমার কথাগুলো বুঝতে পারবেন তার জন্য আপনাকে একটু ধৈর্য ধরতে হবে৷
ও হ্যাঁ যা বলছিলাম, আমার বয়স এখন আনুমানিক ৩৪ হবে। আমার জন্মতারিখটি সঠিকভাবে আমার মনে নেয়৷ আমি এখনো পর্যন্ত জানি না আমার আসল পরিচয়। তাই আমি সবসময় একটি পরিবারের অভাব বোধ করতাম৷ ছোট অবস্থায় এতিমখানায় বড় হয়েছি৷ আর তখন থেকেই আমি একটি নতুন পরিবারের খোঁজে রয়েছি। যখন অনেক কষ্টের পর একটি পরিবার বানালাম৷ তার অল্পদিনের মাথায় উপরওয়ালা সেটাও ছিনিয়ে নিলেন। এখানেই আমার প্রথম প্রশ্ন “কেন?”।
.
ক্রিং ক্রিং …
বেল বাজার শব্দ হলো৷ ওহ্, থিতলি এসেছে মনে হয়৷ দরজা খুলে দিয়ে আসি৷
-” বাবা দেখো আমি অংকে ৯৫ পেয়েছি! ” দরজা খুলতেই উল্লসিত কন্ঠে থিতলি বলল৷
– ” দেখতে হবে না কার মেয়ে।” কোলে তুলে নিলাম, আসলে সন্তানরা যখন ভালো কিছু করে কিংবা অর্জন করে সেই ভালোলাগার অনুভূতিটা অন্য সব অনুভূতিকে হার মানায়।
থিতলিকে কোল থেকে নামিয়ে দিলাম।
-“যাও হাত মুখ ধুয়ে নাও, আমি তোমার জন্য নাস্তা তৈরি করছি।” মাথা নেড়ে বুঝালো ঠিক আছে।
– “ভালোভাবে পরিষ্কার করে হাত মুখ দুবে কিন্তু। ” থিতলিকে আরো একবার বলে দিলাম৷
.
আমি আর আমার মেয়ে থাকি এ বাড়িতে৷ বাড়িটা একটু নির্জন বটে, আশেপাশে তেমন বাড়িঘর নেই৷ আমাদের ঘরটা দুতলা, চারপাশে নানান রকমের গাছপালা রয়েছে৷ তবে দুটো গাছ আছে, যেগুলো খুব দূর্লভ প্রজাতির৷ সাধারণত এ গাছগুলো বেশি কাজে লাগে তান্ত্রিকদের!
.
ফ্রিজের দরজা খুলে দুটো ডিম বের করে। হাফ বল বানাতে পারলেই হয়, সেগুলো পরটা দিয়ে কোনো রকম বাপ মেয়ে পেটে চালান করে দিতে পারবো এখনকার মতো৷
থিতলি হাত ধুয়ে আসার পর দুজনে মিলে খেতে বসলাম।
.
.
খাওয়া শেষে, থিতলি বাইরে চলে গেল ‘মিল্টন’ এর সাথে৷ মিল্টন হলো আমার পোষা কুকুর ‘জার্মানিজ’ প্রজাতির৷ আসলে জার্মানিজ প্রজাতি নেই, আমি জার্মান আর জাপানিজ এদুটো জাতকে একত্রিত করে জার্মানিজ বললাম৷ মিল্টনের বাবা ছিল জার্মানির আর মা ছিলো জাপানি। কুকুরটা আসলে ছিল আমার এক প্রতিবেশীর।
আমার স্ত্রী মিতুল এক তান্ত্রিকের ভুল এক্সপেরিমেন্টের স্বীকার হয়েছিল৷ আর সে ভুলটা আজ আমাদের পুরো শহরবাসীকে পীড়া দেয়৷ সেদিন আমার ভাগ্য ছিল তাই আমি আর আমার মেয়ে বেঁচে যায়৷ আর সাথে মিল্টন ও বেঁচে যাই, আর তখন থেকেই সে আমাদের সাথেই থাকে৷ এ-ই পুরো চট্টগ্রাম শহরে আমরা হাতেগোনা পাঁচশো এর মতো মানুষ রয়েছি৷ এখনো এখানের অর্ধেক রাস্তা ভাঙা, যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন অনেক এলাকায়৷ পুরোপুরি বরবাদ হয়ে গিয়েছে এ শহর। আর বরবাদ হবার পর যারা বেঁচে ছিল তাদের মধ্য থেকে অনেকে পাড়ি দিয়েছে ঢাকা শহরে৷
কেউ কখনো কল্পনাও করতে পারেনি, বন্দর নগরী চট্টগ্রাম ধ্বংসস্তূপে পরিণত হবে! আর এই ধ্বংস স্তূপের উপর রিসার্চ করতে সাথে এ শহরের এমন হওয়ার আসল কারণ জানতে আমার অফিস থেকেই আমাকে এখানে পাঠানো হয়েছে। তবে আমি তাদের কাছ থেকে একটা তথ্য গোপণ করেছি এসব ঘটনার সাথে আমার স্ত্রী জড়িত! আমি সব স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিলাম কি হচ্ছিল শহরটার সাথে সব পরিষ্কার দেখতে পারছিলাম৷ এখনো মনে পড়লে আমার পুরো শরীর শিউরে ওঠে৷
তখন থিতলি খুব ছোট, একবছরের মতো হবে বয়স তখন, দাঁড়াতে শিখেছিল আর অল্প অল্প হাঁটি হাঁটি পা পা করতো৷ সময়টা ছিল রাতের দিকে, আমি থিতলির সাথে খেলছিলাম। কিন্তু হঠাৎ খেয়াল করলাম আশপাশের চারদিকটা কেমন যেন নড়ে উঠছে। তারপর আমি দেখলাম আমাদের বিল্ডিং থেকে দুইটা বিল্ডিং আগের একটা বিল্ডিং পুরোপুরি চুপসে যাচ্ছিল, দেখে মনে হলো কেউ যেন বিল্ডিংটি থেকে কিছু একটা শুষে নিচ্ছিলো। তারপর হুর মুর করে পুরো সাত তলা বিল্ডিং মুহূর্তের মধ্যেই ভেঙ্গে গিয়ে মাটির সাথে মিশে গেল। দেখে আমার পিলে চমকে উঠল৷
এরপর তার পরের বিল্ডিংয়ের একই অবস্থা৷
আমি আর দেরি করলাম না, থিতলিকে নিয়ে রুম থেকে বের হয়ে “মিতুল,মিতুল” তার নাম ধরে ডাকতে ডাকতে তার রুমে গেলাম৷ সেখানে সে নেই, আমি পুরো বাড়ি খুঁজে দেখলাম কিন্তু কোথাও পেলাম তাকে, অবশেষে স্টোর রুম যেটা গতি দুবছর ধরে খোলাই হয়নি৷ সেখান থেকে গর্ গর্ করে একটা হিংস্র আওয়াজ ভেসে আসছে৷ আমি থিতলিকে শক্ত করে আঁকড়ে ধরলাম৷ থিতলি বের হওয়ার দরজার সামনে রেখে , ধীর পায়ে সাবধানে স্টোর রুমের সামনে গেলান৷ দরজার সাথে কান লাগিয়ে শুনবার চেষ্টা করলাম৷ শুধু থেমে থেমে গর্ গর্ কোনো বড় হিংস্র দানবের শব্দ শুনতে পেলাম৷ আমি বেশ খানিকটা ঘাবড়ে গেলাম৷ তারপরেও দরজা খুলেই ফেললাম। পুরো ঘরের একসেট চাবি সবসময় আমার কাছে থাকে আর একসেট থাকে মিতুলের কাছে।
দরজা খুলতেই যা দেখতে পেলাম সেটা আমার জীবনের ঐ মুহূর্ত গুলোর একটি মুহূর্ত যা আমি সশরীরে উপস্থিত থেকেও কোনো জ্ঞান ছিল না৷ আমি পুরোপুরি কাণ্ডজ্ঞানহীন হয়ে পড়েছিলাম৷ আর এমন কিছু দেখব আসা করিনি৷ পরে কোনো রকম আমাকে আর থিতলিকে হেলিকপ্টারের মাধ্যমে উদ্ধার করেছিল৷
এমন ভয়ানক কিছু দৃশ্য দেখেছিলাম, যা কোনো স্বামী তার স্ত্রীকে এমন অবস্থায় দেখতে চাইবে না৷
চলবে….