রহস্যেঘেরা শহর চট্টগ্রাম,পর্ব-২
লেখক শাহ্রিয়ার আবিদ
এক তান্ত্রিক তার হাতে জ্বলন্ত বই। তবে সম্পূর্ণ পুড়ে নি, আধপোড়া বলা চলে বইটির দিকে তাকিয়ে আছে আর মন্ত্র পড়ছে। আমার স্ত্রী মিতুল তার সাথে সাথে সে মন্ত্র উচ্চারিত করছে৷ মিতুলের হাতে ছিল আরেকটি বই৷ একটি মন্ত্র পড়ছে আর একটি পৃষ্ঠা ছিড়ে আগুনে ফেলে দিচ্ছে, আর সাথে সাথে হুর মুর করে ভেঙ্গে পড়ছে দালানগুলো৷ আমি মিতুলকে এমন অবস্থায় দেখে বাকশক্তি হারিয়ে ফেলেছি মনে হতে লাগল৷ কয়েকবার ডাক দিলাম, কিন্তু আমার গলা দিয়েও একটি শব্দও বের হলো না৷ অনেক কষ্টে সর্বশক্তি দিয়ে, “মিতুল ” বলে গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে ডাক দিলাম৷
সে কর্ণপাতও করলো না! আমি আবার ডাক দিলাম, অবশেষে সে আমার দিকে তাকাল।
আমি এখনো মনে মনে বলি, সেদিন সে আমার ডাক না শোনার অভিনয় করলে নিজেকে বুঝাতে পারতাম৷ কিন্তু, আমার দিকে তাকানোর পরে আমার পৃথিবীর অর্ধেক শূণ্য হয়ে গিয়েছিল।
তার ভাবখানা ছিল এমন, সে কখনোই আমাকে আগে দেখেনি, আমার দিকে তাকিয়ে অস্পষ্ট ভাঙ্গা ভাঙ্গা কন্ঠ বলেছিল,
– ” মিতুল কে? আর আপনি কাকে চান? ”
.
আমি তার টানা টানা চোখের দিকে তাকিয়ে শুধু আমার জন্মপরিচয় না জেনেও শুধু আমি মানুষটাকে ভালোবেসেছিল, আমি সেই মিতুলকে খুঁজে বেড়াচ্ছিলাম৷
অবশেষে আমাকে হতাশ করে দুঃখের সমুদ্রে ভাসিয়ে দিলো৷ নতুন পরিচয়ে বাঁচতে শিখছিলাম। সেটিও খুইয়ে বসলাম।
তার খোঁজ, আমাকে ব্যর্থ করেছে রোজ।
.
টলতে টলতে কোনো রকমে থিতলিকে নিয়ে বেঁচে ফিরেছি সেদিন। আর আমরা তখন বেঁচে যাওয়া দুশো পরিবারের এক পরিবার হয়ে নাম লেখালাম। শূণ্য থেকে পূর্ণে হওয়ার জন্য আরেকবার নতুন শুরু করার ৷
.
ধাক্কাটা সামলাতে বছর তিনেক সময় লেগেছিল৷ এটা এমন একটা ধাক্কা ছিল, যা প্রতিটি মানুষের জীবন তছনছ করে সবকিছু নিঃশেষ করে দেয়ার মতো ধাক্কা। এখান থেকে কিছু মানুষ ফিরে আসতে পারে তার মধ্যে কারো ভাগ্য ভালো হলে সে কোনো রকম বাঁচতে পারে, বাকিরাও বাঁচে ঠিক কিন্ত জীবন্ত লাশ হয়ে৷ আর জীবন্ত লাশ হয়ে বেঁচে থাকার মানে হলো, শুধুমাত্র মাটির দেহ ছাড়া বাকি সবকিছু মরে যাওয়া।
এখন আমি ঠিক ওরকম জীবন্ত লাশ হয়ে আছি৷ শুধু মাত্র থিতলিকে মাটির দেহ দিয়ে আগলে রাখার জন্য৷ কারণ আমি জানি পিতৃ মাতৃ হীন ছেলেমেয়েদের জীবনটা কতটা করুণ!
.
অফিসের জন্য কিছু তথ্য জোগাড় করতে হবে আমাকে। অফিস থেকে বলা হলো, ‘শহরের মানুষের আপাতত কি অবস্থা, আর শহরটি পুনর্গঠন করা হবে নাকি এটুকুতে আরো বেশ কিছুদিন এভাবেই থাকবে? ‘ এ সম্পর্কে পুরো তথ্য দিতে হবে অফিসে৷ অফিস থেকেও এটা জানিয়েছে, ” চট্টগ্রাম পরিদর্শনে প্রধানমন্ত্রী আসছেন। ”
গত সাত বছরের মধ্যে কোনো দেশ প্রধানের চট্টগ্রামে প্রথম সফর হতে যাচ্ছে এটিই৷ তাই এই সফর টিকে ঘিরে অনেক উত্তেজনা, উন্মাদনা কাজ করছে৷ সাথে অনেকে শংকাও প্রকাশ করছে এ সফরটি নিয়ে৷ এর আগেও প্রধান মন্ত্রীর বেশ কয়েকবার চট্টগ্রাম সফরে আসারর কথা থাকলেও আসা হয়নি। আর চট্টগ্রাম শহরের এমন ঘটনা দেখে পুরো বিশ্ববাসী উদ্বিগ্ন! প্রায় আধ ঘন্টার মধ্যেই পুরো শহর কাম তামাম! যা বিশ্বে তাক লাগিয়ে দেয়ার মতোই একটি ঘটনা৷ তার চেয়েও বড় আজব ঘটনা, এখনো পর্যন্ত জানা যায়নি এমন দূর্ঘটনা হওয়ার কারণ৷
পৃথিবীর বড় বাঘা বাঘা বিজ্ঞানীরা অনেক পরীক্ষা নিরীক্ষার পরে, এটি নিশ্চিত করেছিলেন। এখানে কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ হয়নি৷
তবে অনেকে অনেকে বলেছেন, এর পেছনে কোনো অজানা শক্তির হাত রয়েছে! আসলেই রয়েছে, যা আমি নিজের চোখে দেখেছিলাম৷
.
পৃথিবী বাসি শুধু প্রথম যুদ্ধের হিংস্রতা সহ্য করে ছিল। তারপর দ্বিতীয় যুদ্ধের জাপানের নাগাসাকির পারমাণবিক বোমার ভয়ঙ্করতা অনুভব করেছিল ৷ আর চট্টগ্রামে পৃথিবী বিনা যুদ্ধে ধ্বংসাত্নকতা দেখেছে!
যা মানব ইতিহাসে গঠিত সবচেয়ে বড় বিপর্যয় গুলোর একটি মানা হয়৷
.
আমার অফিসের কাজকর্ম সম্পর্কে আপানদেরতো ধারণা দিয়ে ছিলাম৷ কিভাবে কোন পর্যায়ে গিয়ে কাজ করতে হয় আমাদের। আমাদের কোম্পানির প্রত্যেকটি কর্মচারী ছদ্মবেশ ধরে চলে৷
‘ এস আই এল’ মানে ‘ সিকিউর ইনফরমেশন লিক্ড্’। যা আমাদের প্রতিষ্ঠানের নাম৷ তবে সরকারি ভাবে প্রতিষ্ঠানটি অনেক আগে সিল মেরে বন্ধ করে দেয়া হয় বাংলাদেশ থেকে৷ তারপরেও গোপনে এটি চালু রয়েছে। তবে যেদিন বন্ধ করে দেয়া হয় সেদিন প্রায় বারো জন এজেন্ট আটক হয়৷ আর পরে তাদের বিরুদ্ধে দেশদ্রোহীর মামলা করে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে দেয়া হয়। এরপর থেকে এই গুপ্ত প্রতিষ্ঠানের কোনো কর্মচারীকে পেলে সেখানেই ক্রসফায়ারে মেরে ফেলে হয়৷ আমাদের এ অফিসটি প্রায় পৃথিবীর প্রত্যেকটিই দেশেই এর শাখা রয়েছে৷
আর ঐ দিন হেলিকপ্টার করে আমি আর আমার মেয়েকে এই অফিসের কিছু কর্মচারীরা বাছাই৷ তারপর থেকে আমি তাদের হয়ে কাজ করছি৷ আর মাস শেষে মোটা অঙ্কের টাকা পাচ্ছি৷ প্রতিষ্ঠানের দেয়া বাংলো, ইন্টারনেট, যাবতীয় সবকিছুই করছি৷ যেমন সুবিধা আবার তেমনি অসুবিধাও রয়েছে।
এখনো পর্যন্ত কেউ বলতে পারে না, প্রতিষ্ঠানটির মালিক কে? তবে যেই হোক না কেনো সে একজন মাস্টার মাইন্ডের মাস্টারপিস মানুষ৷
সে একজনকে এজেন্টকে এতো সুবিধা দিচ্ছে। কিন্তু তার আগে সে তাকে হাতে পায়ে বেঁধে নেই কৌশলে৷ তার দেয়া কিছু শর্ত থাকে৷ যেমনঃ ” প্রতিষ্ঠানের দেয়া বাংলোতে থাকতে হবে, আর সেই বাংলোটাতে সব জায়গায় সিসিটিভি ক্যামেরা বসানো, বাথরুমে সাউন্ড শোনার যন্ত্র৷ তারপর তাদের দেয়া সিম কার্ড, মোবাইল, নেট ব্যবহার করতে হবে৷ যাতে এজেন্ট কি করছে, না করছে সব খবরের উপর প্রতিষ্ঠানের নজরদারিতে থাকে৷ কোনো সময় তাদের না জানিয়ে কোথাও যেতে পারবে না, তাদের নেটওয়ার্ক, প্রোটোকলের বাইরেও যেতে পারবে না৷ আর কোনো এজেন্ট যদি কাজ ছাড়তে চাই তাহলে তাকে দেশ ছাড়তে হবে। আর যদি এসবের ব্যাতিক্রম হয় তাহলে, তার জন্য মৃত্যু অপেক্ষা করছে৷ কারন প্রত্যেক এজেন্টের শরীরে কাজের আগে অপারেশন করে একটা ছোটো ছিপি ঢুকিয়ে দেয়া হয়। সেটা ইলেকট্রনিক্স ডিভাইস, যা লোকেশন ট্র্যাকিং করে তার সাথে সেখানে কিছু পরিমাণ ‘ইনল্যান্ড তাইপেন’ সাপের বিষ ঢুকিয়ে দেয়া হয়৷
ইনল্যান্ড তাইপেন পৃথিবীর সবচেয়ে বিষধর সাপ। এর বিষ এই গ্রহের সবচেয়ে মারাত্মক। এই সাপ সাধারণত অস্ট্রেলিয়ার প্রান্তদেশে দেখা যায়। লম্বায় এগুলো প্রায় আট ফুটের মতো হয়ে থাকে। এক ছোবলে তাইপেন এত বিষ ছোড়ে যা ৬০ থেকে ১০০ লোকের মৃত্যুর জন্য যথেষ্ট। অথবা এতে মারা যেতে পারে এক লাখ ইঁদুর। প্রাণীবিদরা জানান, তাইপেনের এক ছোবল অন্তত ৫০টি কোবরার ছোবলের সমান। এদের বিষে আছে মারাত্মক ধরনের নিউরোটক্সিন। যা মানুষের শরীরের সব অঙ্গ প্রত্যঙ্গ পুরোপুরি বিকল করে দিতে পারে। এর ছোবল পেশি অবশ করে হার্ট বন্ধ করে দেয়। আরেকটি টক্সিন রক্ত জমাট করে ঘন স্যুপের মতো করে দেয়। এদের বিষের আরেকটি ভয়ঙ্কর দিক হচ্ছে, এ বিষ মানুষের রক্তে মিশলে রক্ত শক্ত হয়ে যায়।
বুঝতেই পারছেন, আমরা ‘ এস আই এল’ এজেন্টরা জীবন বাজি রেখে কাজ করি৷
.
সরকারি বড় বড় পদেও আমাদের বেশ কিছু লোক রয়েছে৷ এখন প্রধান মন্ত্রী আসছেন কিনা? অথবা কি কারণে আসছেন? মূল লক্ষ্য কি জানার জন্য তার সাথে দেখা করতে যেতে হবে৷
.
খেলা শেষে সাড়ে বারোটার দিকে মিল্টন আরও থিতলি ফিরে এলো। দুজনকে বেশ ক্লান্ত দেখাচ্ছে তবে দুজনকে কেমন একটা যেন দেখাচ্ছে..
– কি হয়েছে থিতলি? তোমাকে এমন দেখাচ্ছে কেনো, কারো সাথে ঝগড়া করেছো?
মাথা নিচু করে রইল সে, বুঝতে পেরেছি আজকেও কেউ একজনের সাথে ঝগড়া বাধিয়ে এসেছে৷
– তোমাকে না কতবার বলেছি, কারো সাথে ঝগড়া করবে না৷ তারপরেও তুমি…
কথা শেষ করতে পারলাম না বেল বেজে উঠল৷
আমি ঘড়ির কাটার দিকে তাকালাম, সাধারণত এমন সময় কেউ আসার কথা নই৷ আমি পাশে ডেক্স থেকে রিভলবার হাতে তুলে নিলাম। থিতলিকে উপরে পাঠিয়ে দিয়েছি।
– মিল্টন তুইও থিতলির সাথে যা।
মিল্টনকে থিতলির সাথে পাঠিয়ে দিয়েছি,
ভালো করে আরেকবার চেক করে দেখলাম বুলেট ফুল আছে কি না আড়াইশো গ্রাম ভরের, একলাখ বাইশ হাজার টাকা দামের রিভলবারটি। তারপর রিভলবার পেছনে লুকিয়ে এগিয়ে গেলাম দরজার দিকে….
চলবে…