আরেকটি_বার #পর্বসংখ্যা_৩১ #Esrat_Ety

#আরেকটি_বার
#পর্বসংখ্যা_৩১
#Esrat_Ety

রাওনাফের বুক থেকে মাথা তুলে উর্বী বিরক্ত ভঙ্গিতে তাকায় তার মুখের দিকে। রাওনাফ ফোন নিয়ে ব্যস্ত ছিলো। উর্বী তার হাত থেকে ফোন টা কেড়ে নিয়ে দূরে রেখে আবারও রাওনাফের দিকে তাকায় । রাওনাফ হেসে ফেলে। উর্বী বিরক্তিতে কপাল কুঁচকে আবারও শুয়ে পরে। রাওনাফ উর্বীর চুলে হাত বুলিয়ে দিয়ে নরম গলায় জানতে চায়,”শরীরটা এখন ঠিক লাগছে?”

উর্বী অস্ফুট স্বরে বলে,”হু।”

রাওনাফ বলতে থাকে,”তোমার বয়স মনে হচ্ছে আরো কমে গিয়েছে। অনেক রোগা লাগছে। খাচ্ছো ঠিক ভাবে?”

_হ্যা খাচ্ছি, সব খাচ্ছি,পানি খাচ্ছি, আনারের জুস খাচ্ছি……

রাওনাফ মৃদু হাসে। তারপর বলে,”আগামীকাল আমাকে রাজশাহী যেতে হবে। ওখানকার ম্যানেজমেন্টে একটু ঝামেলা হয়েছে। সামিউল একা সামলাতে পারছে না।”

_ঠিক আছে যাবেন!

দু’জনেই চুপ। রাওনাফ হঠাৎ বলে ওঠে,”কিছু বলতে চাও হাঁসের ছানা?”

উর্বী রাওনাফের দিকে তাকায়। সে কিছু বলতে চায় তা রাওনাফ কিভাবে বুঝলো!
নিচু স্বরে বলে,”চাই।”

রাওনাফ বলে,”বলে ফেলো। তবে ও বাড়ি যাওয়ার কথা বলো না। কারন মা মানবে না। মা রোজার মাসে বাড়ির বৌকে কখনো বাড়ি থেকে যেতে দেননা কোথাও, মায়ের সব অদ্ভুত নিয়মের মধ্যে এটাও অন্যতম। আজ পর্যন্ত মায়ের সাথে এই বিষয়ে তর্ক করে পারিনি। আজও হয়তো পারবো না। এক কাজ করবো,আমি রাজশাহী থেকে ফিরে এলে ঈদের শপিং করে ও বাড়ির জন্য পাঠাবো তখন না হয় যেও।”

উর্বী বলে,”ওবাড়ি যাওয়ার কথা বলতে চাচ্ছি না। আমার কোথাও যাওয়ার আগ্রহ নেই।”

_তাহলে কি? বলো?

উর্বী চুপ হয়ে যায়, কিছু সময় চুপ থেকে বলে,”আপনি রাজশাহী থেকে আসুন। তারপর বলবো।”

_চাকরী করতে চাও?

উর্বী বিরক্ত হয়। ইচ্ছে করছে বলে দিতে “তার মধ্যে ছোটো রাওনাফ এসেছে” । কিন্তু এখনি সে বলবে না। সে অপেক্ষা করছে দশ তারিখের। সেদিন রাওনাফের জন্মদিন। সে ঠিক করেছে সেদিনই বলবে। দুদিন অনুভূতি গুলো সে একাই সামলাক।

রাওনাফ বলতে থাকে,”কি হলো! চাকরী করতে চাও?”

_না।

_তাহলে কি চাও! আজ বিকেলে শর্মী শায়মী দুজন অনলাইনে দু’টো ড্রেস দেখিয়ে বললো তারা ঈদে নিতে চায়। তুমিও কি সেরকম কিছু চাও? কোনো এক্সপেনসিভ শাড়ি বা….

উর্বী মহাবিরক্ত হয়ে উঠে বসে, মুখে চ কারন্ত শব্দ করে বলে,”থামবেন আপনি? আমি বলতে চেয়েছি আমি ঘুমাতে চাই ব্যস! ”

উর্বী ওপাশ ফিরে শুয়ে পরে। রাওনাফ বোকার মতো তাকিয়ে আছে। খানিক বাদে উর্বী উঠে বসে। একপলক রাওনাফের দিকে তাকিয়ে তড়িঘড়ি করে ছুটে ওয়াশরুমে ঢুকে হরহর করে বমি করে দেয়।
রাওনাফ উর্বীর পিছু পিছু গিয়ে উর্বীকে আগলে ধরে। এক হাতে উর্বীকে জরিয়ে রেখে অন্যহাতে উর্বীর কপাল চেপে ধরে,যাতে উর্বী মাথা ঘুরে পরে না যায়। উর্বী চোখে মুখে পানি দিয়ে হাপাচ্ছে। পুরোপুরি নেতিয়ে পরেছে সে। রাওনাফ শক্ত করে ধরে রাখে উর্বীকে, বিরক্ত ভঙ্গিতে বলে,”গ্যাস প্রবলেম! এখন এসবের সাথেও বন্ধুত্ব করে ফেলেছো দেখছি।”

উর্বী অবাক হয়ে রাওনাফের মুখের দিকে তাকায়। আচ্ছা এতো লক্ষন দেখেও রাওনাফের মনে কোনো প্রশ্ন জাগছে না? কেমন সব বুঝেও না বোঝার ভান ধরে আছে। বিষয়টা পুরোপুরি এড়িয়ে যেতে চাইছে যেন! যেহেতু ডাক্তার,একটু হলেও তো বোঝার কথা উর্বীকে দেখেই। তাতে তো টেস্ট রিপোর্টের প্রয়োজন পরেনা। এ কি আদৌও ডাক্তার? এ পাশ করলো কিভাবে এমবিবিএস? নকল করে?

উর্বী পিটপিট করে তাকাচ্ছে। রাওনাফ দু্র্বল উর্বীকে কোলে তুলে নেয়, উর্বীর মুখের দিকে তাকিয়ে বলে,”তুমি হাঁসের ছানা হলেও তোমার ওজন হাঁসের একটা পালকের মতো।”

উর্বী কথা বলে না। সে গাঁয়ে কোনো জোর খুঁজে পাচ্ছে না। বমি করে শরীরের সব শক্তি হারিয়ে ফেলেছে। উর্বীকে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে রাওনাফ ঘড়ির দিকে তাকায়। রাত দেড়টা বেজে গিয়েছে প্রায়।

বিছানায় শুয়ে উর্বী রাওনাফের দিকে তাকিয়ে থাকে। মনে মনে বলে,”আমি আর অপেক্ষা করতে পারছি না ডাক্তার। এখনই বলে দিতে ইচ্ছে করছে আমি আপনার সন্তানের মা হতে যাচ্ছি! দেখতে ইচ্ছে করছে আপনি কতটা খুশি হন,নাকি আদৌও হন না।”

রাওনাফ ওযু করে তাহাজ্জুদ নামাজ আদায় করতে দাঁড়িয়ে যায়।

উর্বী সেদিকে তাকিয়ে দেখছে। তার চোখ জুড়িয়ে যাচ্ছে। পেটে একটা হাত রেখে একটা গভীর নিঃশ্বাস ছেড়ে দেয় সে। মনে মনে প্রার্থনা করে,যেই আসুক,এই লোকটার মতো কেউ আসুক।

কিছু সময় পরেই উর্বী ঘুমিয়ে যায়। রাওনাফ নামাজ আদায় করে টুপিটা কাবার্ডে রেখে বিছানায় একপাশে এসে বসে। তার দৃষ্টি ঘুমন্ত উর্বীর মুখের দিকে। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে রাওনাফ আনমনে হেসে ফেলে। ধীরে ধীরে হাতটা উর্বীর পেটে রেখে তার মুখের দিকে তাকায়,মনে মনে বলে ওঠে,”লুকোচুরি খেলছো আমার সাথে মৃদুলা উর্বী। তুমি বোকা উর্বী হতে পারো আমিতো বোকা ডাক্তার নই!”

হাত টা সরিয়ে পুনরায় উর্বীর মুখের দিকে তাকায়। কপালের কাছে এলোমেলো হয়ে থাকা চুলগুলো সরিয়ে আলতো করে ঠোঁট ছুঁইয়ে দীর্ঘসময় ধরে একটা চুমু খায় সে।
তারপর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলে,”পিতৃত্ব সবসময় একই রকমের আনন্দ দেয় মৃদুলা উর্বী, নির্ভেজাল,স্বর্গীয় সুখানুভূতি। হয়তো বয়স ভেদে অনূভুতি প্রকাশের ধরণ আলাদা হয়। এই ব্যাপার গুলো তোমার কাছে বোধগম্য হবে না বোকা উর্বী। টিপিক্যাল ইমোশনাল ফুল!”

উর্বীর গায়ে চাদর টেনে রাওনাফ পাশে শুয়ে পরে। তাকিয়ে থাকে উর্বীর ঘুমন্ত মুখের দিকে ।
উর্বীকে দেখেই সে কিছুটা আন্দাজ করেছিলো সকালে। তারপর সন্ধ্যায় যখন সেমিনার থেকে ফিরলো তখন হসপিটালের রেডিওলজি বিভাগের প্রধান রাওনাফকে কংগ্রাচুলেট করে। রাওনাফের আর জানতে বাকি নেই তার জীবনে নতুন কারো আগমনের খবর,
এ তার বাচ্চা,তার অংশ !

সে বুঝতে পারছে না এতো কেন লুকোচুরি করছে উর্বী বিষয়টা নিয়ে! নাকি উর্বী ভাবছে রাওনাফ খুশি হবে না। উর্বী কি করে জানবে পিতৃত্বের অনূভুতি কিরকম হয়, এই পৃথিবীতে যে প্রানীগুলো বাবা হয়েছে শুধু তারাই জানবে।
রাওনাফ দেখতে চায় উর্বী কবে জানায়,কিভাবে জানায় খবরটা। তার মন যা চাইছে করুক, স্বভাবে এতোটা বাচ্চামো মিশে আছে, অদ্ভুত মহিলা।

শিমালার কথা মনে পরে যায় রাওনাফের, প্রেগ’ন্যা’ন্সির কথা রাওনাফকে জানাতে গিয়ে কেঁদে ফেলেছিলো। উর্বী কি করবে! রাওনাফও দেখতে চায়, অপেক্ষা করছে সে। দুদিন লুকোচুরি চলুক! তার ধেরে খুকি বৌ নিজের ইমোশনকে নিজে টর্চার করুক দুদিন।

****
ঘন্টা খানেকের জন্য চোখের পাতা লেগেছিল রাওনাফের। তারপর শুনতে পায় পাশের মসজিদে বলছে,”সেহরি খাওয়ার সময় হয়ে গিয়েছে।”

উঠে বসে উর্বীর দিকে তাকায়। ক্লান্ত শরীরটা গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। ডাকতে ইচ্ছে করছে না তবু মৃদু আওয়াজে ডাকে,”উর্বী ওঠো।”

তিনবারের বার ডাকতেই উর্বী ধরফরিয়ে উঠে বসে, উৎকণ্ঠা নিয়ে বলে, “দেরী হয়ে গিয়েছে! আজান দিয়ে দিয়েছে!”

_না,অনেক সময় হাতে।

উর্বী চোখ ডলতে ডলতে বিছানা থেকে নামে। ওয়াশরুম থেকে ওযু করে বেরিয়ে তাড়াহুড়ো করে চলে যায়। সিঁড়ি দিয়ে একপ্রকার ছুটতে ছুটতে নামছিলো। রাওনাফ পেছন থেকে গম্ভীর কন্ঠে বলে ওঠে,”ধীরে। এখানে কোনো দৌড় প্রতিযোগিতা হচ্ছে না।”

উর্বী পায়ের গতি কমিয়ে দেয়। পরমুহূর্তেই মনে পরে তাকে তো এখন থেকে এভাবে হাঁটলে চলবে না। সে এবার বেশ পা টিপে টিপে নামতে থাকে। যেনো কোনো শব্দও না হয় মেঝেতে। রাওনাফ উর্বীর এহেন কান্ড দেখে পেছনে নিশ্চুপ হাসতে থাকে।

রাওনাফ করীমের তিনছানা ইতিমধ্যেই সেহরি খেতে টেবিলে বসে গিয়েছে। শর্মীর চোখ থেকে ঘুম এখনও কাটেনি। সে টেবিলে মাথা ঠেকিয়ে ঘুমাচ্ছে। শায়মী বারবার হাই তুলছে। রাওনাফ এগিয়ে যায়। শায়মীর দিকে তাকিয়ে বলে,”এখন একটু ওড়নাটা মাথায় তুলে দাও মামনী।”

শায়মী পাপার কথায় লাজুক হেসে মাথা ঢাকে। শর্মীও মাথা তুলে ওড়না পেঁচিয়ে দেয় মাথায়।
রওশান আরাও অসুস্থ শরীর নিয়ে এসেছেন নিচে সেহরি খেতে। উর্বী তাকে দেখে বলে,”মা আপনি কেন নামতে গেলেন। আমি খাবারটা ঘরে দিয়ে আসতাম।”

রওশান আরা হেসে বলে,”এই একটা বেলা ছেলে,বৌ,নাতী নাতনি নিয়ে খেতে বসা হয়। ইফতার তো রাওনাফ বাইরেই করে।”

উর্বী এগিয়ে যায় রান্নাঘরে। রওশান আরা বলতে থাকে,”কি একটা ঝামেলায় পরতে হলো। আমীরুনের বাবা অসুস্থ খুব। দু-চারদিনে মনে হয়না ফিরবে। একটা বিশ্বস্ত লোকও পাচ্ছি না বাড়িতে রাখবো। সময়-অসময়ের কাজ সব বৌমাকে একাই করতে হয়।”

রাওনাফ চেয়ারে না বসে কিচেনের দিকে এগিয়ে যায়। উর্বী তাকে দেখে অবাক হয়ে বলে,”এখানে কেন এলেন! যান গিয়ে বসুন। আমি সব গরম করে নিয়ে আসছি।”

রাওনাফ উর্বীর দিকে তাকিয়ে উর্বীর হাত থেকে বাটি টেনে নিয়ে বলে,”তুমি গিয়ে বসো। আমি নিয়ে আসছি!”

উর্বী অস্ফুট স্বরে বলে,”আপনি….”

_যাও।
রাওনাফ উর্বীকে থামিয়ে দিয়ে বলে। উর্বী চুপ চাপ এসে চেয়ার টেনে বসে। তারপর রাওনাফকে দেখতে থাকে। রওশান আরা একবার উর্বীকে দেখে, একবার রাওনাফকে। তার তিন ছেলেই বৌয়ের প্রতি যত্নশীল। এসব কখনও তার জীবনে ছিলো না ‌। নিজের না পাওয়া সব কিছু তার ছেলের বৌয়েরা পাচ্ছে এটা তাকে আনন্দ দেয়।

****
সকালেই রাওনাফ বেরিয়েছে রাজশাহী যাবে বলে, যাওয়ার আগে উর্বীর গালে হাত রেখে বলেছে,”নিজের খেয়াল রেখো।”
রাওনাফের বলার ধরণটা আজ অন্যরকম লেগেছে, প্রতিদিনের মতো নয়।

উর্বীর মনটা খুব অস্থির লাগছে সকাল থেকে। শারীরিক কোনো যন্ত্রনা নেই কিন্তু মনে হচ্ছে কিছু একটা ঠিক নেই। ও বাড়িতে ফোন দিয়ে মায়ের খবর জেনেছে। লুৎফুন্নাহার ভালোই আছেন। তবুও অস্থিরতা কাটছে না।

রোজার দিনে দুপুর বেলা সচারচর হাতে কোনো কাজ থাকেনা। কিছুক্ষণ কোরআন তিলাওয়াত করে উর্বী উঠে দাঁড়ায়,ওরা তিন ভাইবোন বাড়িতেই আছে,প্রত্যেকের স্কুল কলেজ বন্ধ অথচ কারো টু শব্দটিও নেই। সবাইকে খুঁজতে খুঁজতে উর্বী তাদের শর্মী শায়মীর ঘরে পেয়ে যায়। তিনমাথা এক হয়ে বসে ফোনে কিছু একটা দেখছিলো। উর্বীর পায়ের শব্দ পেয়ে প্রত্যেকে মাথা তুলে তাকায়। উর্বী বলে,”কি হচ্ছে এখানে?”

শায়মী বলে,”আমরা প্ল্যান করছি!”

_কিসের প্ল্যান?
উর্বী অবাক হয়ে জানতে চায়। তারপর গিয়ে ওদের মুখোমুখি বসে। শায়মী বলতে থাকে,”দশ তারিখ পাপার বার্থডে তাই তার জন্য লুকিয়ে লুকিয়ে গিফট কিনবো। সারপ্রাইজ দেবো পাপাকে।”

শর্মী ফোনটা উর্বীর কাছে নিয়ে এসে বলে,”আন্টি দেখো। এটা ভালো হবে না?”

উর্বী ফোনের স্ক্রিন তাকায়। একটা রিস্ট ওয়াচের ছবি।
শর্মী বলতে থাকে,”এটা আমি দেবো। পাপার অনেক ঘড়ির কালেকশন আছে। এটা হবে সবচেয়ে ইউনিক।”

উর্বী মাথা নাড়িয়ে বলে,”হ্যা। এটা সুন্দর।”

তারপর শায়মী নাবিলের দিকে তাকিয়ে বলে,”তোমরা কি দেবে সারপ্রাইজ?”

শায়মী হেসে বলে,”আমাদেরটা এখন বলবো না। ওটা শুধু পাপার জন্য না,সবার জন্য সারপ্রাইজ!”

তারপর উর্বীকে প্রশ্ন করে,”তুমি কি দেবে আন্টি?”

উর্বী শায়মীর দিকে তাকায়। বলে,”কি দেবো?”

_সারপ্রাইজ দেবে না?

উর্বী ম্লান হাসে। সারপ্রাইজ তো সেও দেবে। অনেক বড় একটা সারপ্রাইজ।

শায়মী বলে,”কি হলো আন্টি! কিছু দেবে না?”

উর্বী হাসে, অস্ফুট স্বরে বলে,”দেবো।”

_কি দেবে?

উর্বী মাথা নেড়ে বলে,”এখন বলা যাবে না,তোমরাও পরে জানবে। দশ তারিখ”

শর্মী বলে,”অনেক বড় একটা সারপ্রাইজ!”

উর্বী লজ্জামাখা মুখে মাথা নাড়ায়। প্রসঙ্গ পালটে বলে,”আজ না তোমাদের সুমনা আপার বাড়িতে ইফতার পার্টিতে যাওয়ার কথা? যাবে না?”

শায়মী বলে,”যাবো। খালামনি গাড়ি পাঠিয়ে দেবে বলেছে। দুপুরের পর যাবো।”

_আজ রাতে ফিরবে না?

_না। আগামী পরশু ফিরবো। পাপার কাছ থেকে পারমিশন নিয়েছে খালামনি।

দুপুরের পরে শায়মী আর নাবিল চলে যায় সুমনাদের বাড়িতে। থেকে যায় শর্মী। হঠাৎ করে সে তার সিদ্ধান্ত পালটে ফেলেছে। তার নাকি যেতে ইচ্ছে করছে না।

****
রওশান আরা তার পুত্রবধুকে দেখছেন। দেখছেন বলতে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পর্যবেক্ষণ করছেন। উর্বী মাথায় ঘোমটা দিয়ে ইফতারি তৈরি করছে।
রওশান আরা তাকে দেখতে থাকে। লক্ষন দেখে তো তার সন্দেহই সত্যি বলে মনে হচ্ছে। বুড়ো তো এমনিই হয়নি সে। মেয়েদের এসব সে বুঝতে পারে। উর্বীকে কি জিজ্ঞেস করবে? না যদি লজ্জা পেয়ে যায়? সেরকম কিছু হলে তো সে জানবেই।
রওশান আরা দোয়া করতে থাকে। তার সন্দেহ যেনো সত্যি হয় ‌। তাহলে তার চেয়ে বেশি খুশি আর কেউ হবেনা।
উর্বী কাজ করতে করতে তার শাশুড়ির দিকে তাকায়। রওশান আরা চোখ নামিয়ে নেয়।
বলে,”হয়েছে? এতো বেশি আইটেম করতে হবে না। আমরা তো মোট তিনজন মানুষ। আর কিছু তৈরি করো না।”

উর্বী মাথা নাড়ায়। পরক্ষনেই দৌড়ে বেসিনের কাছে গিয়ে বমি করতে থাকে।
রওশান আরা ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে। তার চোখ খুশিতে চকচক করছে। তার সন্দেহ সত্যিই মনে হচ্ছে!

****
সারাদিনে আজ ঝিরি ঝিরি বৃষ্টি পরলেও সন্ধ্যার পর থেকে মুশলধারে পরছে।
ইফতারের পরে রওশান আরা উর্বীর ঘরে ঢুকে দেখে সে কোরআন পাঠ করছে। সে খাটে মুগ্ধ হয়ে বসে তিলাওয়াত শোনে। যদিও কিছু কিছু জায়গায় উচ্চারণ কিছুটা ভুল হচ্ছে।

রওশান আরা উর্বীর দিকে তাকিয়ে আছে। এই মেয়েটার প্রতি তার এতো মায়া কাজ করে কেনো! অবশ্য সে তা সবসময় বুঝতে না দেওয়ার চেষ্টা করে। বেশি লাই পেলে বৌ মানুষ নষ্ট হয়ে যায়। কিন্তু সে জানে উর্বী নষ্ট হয়ে যাওয়ার মেয়ে নয়।

উর্বী কোরআন পাঠ শেষ করে রওশান আরার দিকে তাকায়।
“মা কিছু লাগবে?”

_না,তোমাকে দেখতে এলাম। তোমার শরীর এখন কেমন?

_ভালো মা। শর্মী কোথায় মা?

_শর্মী ঘরে। পড়ছে।

উর্বী উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলে,”ওকে কিছু একটা বানিয়ে দেই মিষ্টি টাইপের। ইফতারের সময় বললো খেতে ইচ্ছে করছে নাকি।”
রওশান আরা উর্বীকে থামিয়ে দেয়। বলে,

“ও ফ্রিজ থেকে আইসক্রিম বের করে খেয়ে নিয়েছে। তুমি বসো।”

উর্বী বসে।
রওশান আরা বলে,”কোনো অসুবিধা হলে আমায় জানাবে। তোমার স্বামী ডাক্তার হোক শত,মেয়েদের সমস্যা মেয়েরাই ভালো বুঝবে। আমি তোমার মায়ের মতোই।”
রওশান আরা ঘর থেকে বের হতে যায়। উর্বী নিচু স্বরে ডাকে,”মা।”

রওশান আরা উর্বীর মুখের দিকে তাকায়। উর্বী কিছুটা সময় নিয়ে মাথা নিচু করে অত্যন্ত মৃদু স্বরে বলে,”আপনি আবারও দাদু হতে যাচ্ছেন মা।”

রওশান আরার ইচ্ছা করছে সে খুশিতে একটা চিৎকার দেবে। কিন্তু সে নিজেকে সামলে নেয়।
উর্বী মাথা উঠায় না। তার ভীষণ লজ্জা লাগছে।

রওশান আরা গলার স্বর অত্যন্ত স্বাভাবিক রেখে বলে,”আলহামদুলিল্লাহ। রাওনাফ জানে? ওকে জানিয়েছো? ”

উর্বী মাথা নাড়ায়। সে জানায়নি। মুখে বলে,”রাজশাহী থেকে ফিরলে জানাবো।”
রওশান আরা বলে,”ঠিক আছে। বিশ্রাম নাও।”

রওশান আরা উর্বীর ঘর থেকে বের হয়। তার ইচ্ছে করছে কিছুক্ষণ নাচতে। এতো সুখ। এতো আনন্দ সে কই রাখবে? বাড়িতে আবারো ছোট্টোসোনা আসবে। এই বাড়িটা তো আলোয় আলোয় ভরে যাচ্ছে!

***

উচ্ছাস গাড়িতে বসে আছে। সজীব ছাতা হাতে গাড়ির দরজায় টোকা দেয়। উচ্ছাস গাড়ির জানালার কাচ নামিয়ে দেয়।

সে বলে,”সব ঠিক আছে? দেখেছিস ভালো করে?”

“হু সব ক্লিয়ার। দাড়োয়ান টা তার কোয়ার্টারে শুয়ে ঝিমুচ্ছে। ড্রাইভার বাড়িতে। উর্বীর স্বামীকে রাজশাহী পৌঁছে দিয়ে দুদিনের ছুটি নিয়েছে।

উচ্ছাস বাঁকা হাসি হাসে। এতো সুযোগ একেবারে পেয়ে গেলো সে।

সজীব বলে,”ভাই।”

“হু।”
_ভাই আরেকবার ভেবে দেখেন। যে কাজটা করবেন তাতে কিন্তু…….। আগের বার একটুর জন্য বেঁচে গেছিলেন।”

উচ্ছাস সিগারেটের ধোঁয়া ছেড়ে বলে,”আগের বার বেয়াদবটার প্রতি মায়া দেখিয়ে সফল হতে পারিনি, এইবার তা হবে না। উর্বী না আসলে ওর লা’শ নিয়ে ফিরবো আমি। তুই এখানে বসে থাক, বিপদ দেখলেই সংকেত দিবি। কোনো ভুল হলে তোকে আগে মা’রবো।”

সজীব মাথা নাড়ায়,”আচ্ছা ভাই। ভাই একটা কথা বলবো?”

“হু।”
_ভাই দাড়োয়ান বুড়ো মানুষ। তারে তেমন কিছু করবেন না। তার কাছ থেকেই তো সব খবরাখবর নিতাম ‌। বড্ড সরল,আলাভোলা। সে ছাড়া তার দুই মেয়েকে দেখার কেউ নাই।

উচ্ছাস সিগারেট ফেলে দিয়ে গাড়ি থেকে নেমে পরে। সজীব গাড়িতে উঠে বসে। তার হাত পা কাঁপছে।

উচ্ছাস ধীরে ধীরে রওশান মঞ্জিলের দিকে এগিয়ে যায়। সে নিজেও জানে না সে আগুন নিয়ে খেলছে যার পরিনতি ভয়াবহ।

****

রাওনাফের ফোন এসেছে। উর্বী ফোনটা রিসিভ করে। ওপাশ থেকে

রাওনাফের গলা,”কি করছো?”

_কিছু না। আপনি কি করছেন।

_এইতো ইফতার করে বিশ্রাম নিচ্ছি।

_কি কি দিয়ে ইফতার করা হলো?

_অনেক কিছু। অন্তরা এতো এতো আইটেম বানিয়ে দেয় সামনে। লোভে পড়ে খেয়ে ফেলেছি।

_ওরা ভালো আছে?
_হ্যা। তুমি বলো, তোমার শরীরের কি অবস্থা?

_ভালো।
উর্বী অস্ফুট স্বরে জবাব দিয়ে চুপ করে থাকে। রাওনাফ ডাকে,”উর্বী!”

“হু।”

_আসার সময় কিছু একটা বলতে চেয়েছিলে,বলোনি। এখন বলো।

কথাটা বলে রাওনাফ মিটিমিটি হাসছে। সে জানে উর্বী কখনোই ফোনে বলবে না কথাটা।

উর্বী বলে,”পরে বলবো। এখন থাক।”

_না বলো।

_বললাম না পরে বলবো।

_ও বাড়ি যেতে মন চাইছে? বলেছিলাম সেদিন কদিনের জন্য গিয়ে ঘুরে এসো। সেদিন শোনোনি, এখন মা যেতে দেবেন? আচ্ছা মন খারাপ করো না,আমি মাকে বুঝিয়ে বলবো।

উর্বী মনে মনে হাঁসে। বলে,
“আচ্ছা পরে দেখা যাবে।”

_শর্মী কি করছে? ও কেন যায়নি? সুমনা আমাকে ফোন দিয়ে নালিশ জানালো ওর নামে।

উর্বী হেসে বলে,”মিড টার্মের রেজাল্ট নিয়ে চিন্তিত বেশ। এবারও যদি আপনাকে হতাশ করে তাই ফাইনালের জন্য তৈরি করছে নিজেকে। ইফতার করেই পড়তে বসেছে।”

হঠাৎ বাড়িতে লোডশেডিং হয়। উর্বী চ’ম’কে ওঠে।

পাশের ঘর থেকে শর্মী চেঁচিয়ে ওঠে।
রাওনাফ ফোনের ওপাশ থেকে বলে,”শর্মীর কি হলো! ও কেন চেঁচালো?”

_লোডশেডিং হয়েছে। তাই বোধ হয় ভয় পেয়েছে। আমি রাখছি। ফিরে এসে ফোন করছি।

উর্বী কল কেটে ফোনের ফ্ল্যাশলাইট অন করে।

****
শর্মী “আন্টি” বলে চেঁচাতে থাকে।
সে অন্ধকার ভয় পায়।

পুরো বাড়ি অন্ধকার হয়ে গিয়েছে। জেনারেটর চালু থাকা সত্ত্বেও কিভাবে পুরো বাড়ি বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলো উর্বী সেটাই বুঝতে পারছে না! জেনারেটর রুমে কাকে পাঠাবে এখন!

উর্বী তাড়াতাড়ি শর্মীর রুমে যায়।

“আন্টি ঘর অন্ধকার হয়ে গেলো কেনো?”
উর্বীকে দেখে চেঁচাতে থাকে শর্মী।

_তা তো জানি না। হয়তো কোনো সমস্যা হয়েছে। জেনারেটর রুমে কাকে পাঠাবো এখন!

উর্বী দাড়োয়ান চাচাকে ফোন দিতে থাকে। কেউ ফোন ধরছে না।

উর্বী আর শর্মী ঘর থেকে বেরিয়ে রওশান আরার ঘরে যায়। রওশান আরা তারাবির নামাজ আদায় করছে। তারা সেখান থেকে বেরিয়ে নিচে নামে। এই বৃষ্টিতে দাড়োয়ান চাচার কোয়ার্টারে যাওয়া সম্ভব না।

ছাতা নিলেও ভিজে যেতে হবে। উর্বী আবারো দাড়োয়ানকে ফোন দিতে থাকে। কেউ ফোন ধরে না।

উর্বী তখন একটা ছাতা নিয়ে বের হবার সিদ্ধান্ত নেয়। এই আধো অন্ধকারে বসে থাকার চেয়ে একটু কষ্ট করা ভালো।

উর্বী হাতে ছাতা আর ফোনটা নিয়ে সদর দরজার দিকে যায়। শর্মী বলে,”কোথায় যাচ্ছো আন্টি?”

_আমি আসছি। তুমি বসো। তোমার আসতে হবে না। ভিজে যাবে।

কথাটি বলেই উর্বী সদর দরজা খুলে দেয়। দরজা খুলতেই সে শিউরে ওঠে। দরজার ওপাশে উচ্ছাস দাঁড়িয়ে। তার মুখ হাসি হাসি।

চলমান……

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here