আরেকটি_বার #পর্বসংখ্যা_১৩ #Esrat_Ety

#আরেকটি_বার
#পর্বসংখ্যা_১৩
#Esrat_Ety

অন্তরা শুয়ে ছিলো। ইদানীং তার শরীর টা ভালো নেই। অনেক দুর্বল লাগে এবং মাথা ঘুরতে থাকে।
রওশান আরা তার ঘরে ঢুকে সামিউলকে ডাকতে থাকে।
অন্তরা উঠে বসে। শাশুড়ির দিকে তাকিয়ে বলে,
_সামিউল তো নেই মা। অফিসে গিয়েছে।

_ওও।
রওশান আরা অন্তরার ঘর দেখতে থাকে। ঘরটা অন্তরা বেশ চমৎকার করেই সাজিয়েছে।
অন্তরা তার শাশুড়ির দিকে তাকিয়ে আছে।

রওশান আরা অন্তরার মুখের দিকে তাকিয়ে গম্ভীর কন্ঠে বলে,”শুনলাম শরীর নাকি ভালো নেই তোমার। আমীরুন আছে,কোনো দরকার লাগলে ওকে ডেকে নিও। কিছু হলে তো আবার আমার দুর্নাম হবে।”

রওশান আরা চলে যায়। অন্তরা সেদিকে তাকিয়ে থাকে।

সামিউল বিকেলে বাড়ি এসে দেখে অন্তরা কাঁদছে। সামিউল অন্তরাকে ধরে জিজ্ঞেস করে,”কি হয়েছে? মা কিছু বলেছে?”
অন্তরা বলে,”মা এসে আমার খোজ নিয়েছে। দেখতে এসেছিলো আমি কেমন আছি।”

সামিউল হাসে। এতে কান্না করার কি হলো সে বুঝতে পারে না।মেয়েদের এই একটা ব্যাপার তার মাথায় ঢোকে না। যেখানে খুশি হওয়ার কথা সেখানে কাদে।

***
“ভাবি, রাওনাফের একটা কাহিনী বলি আপনাকে, রাওনাফ বোধ হয় আপনাকে বলে নি। আমরা বন্ধুরা সবাই নেপাল গিয়েছিলাম। কারো ফ্যামিলি সাথে নেইনি, প্লেনে…..”

-আহ,কি হচ্ছে জাহাঙ্গীর। খেতে বসে এতো কথা বলছিস কেনো।

জাহাঙ্গীর কে থামিয়ে দেয় রাওনাফ। পাশ থেকেই আশিক বলে,”এই তোর ডাক্তার না হয়ে প্রফেসর হওয়া উচিৎ ছিলো। সব ব্যাপারে সবাইকে কথা শুনাতে থাকিস। ভাবি পুরো গল্প আমি বলছি। প্লেনে সবাই এক মন্ত্রীর আশেপাশেই বসেছিলাম,মন্ত্রীর নাম বলবো না। সে রাওনাফকে দেখে,ওর সাথে কথা বলে এতোটাই মুগ্ধ হয়ে যায় যে সে সরাসরি প্লেনেই রাওনাফকে তার মেয়ের জন্য বিয়ের প্রস্তাব দিয়ে দেয়। রাওনাফ তখন তাকে বললো সে বিবাহিত। সে মানলোই না। দেশে ফিরেই সে রাওনাফের বাড়িতে আসে দেখার জন্য রাওনাফ সত্যিই বিবাহিত কি না। এসে দেখে রাওনাফ শুধু বিবাহিতই না,তার দুই জমজ ছেলে মেয়েও আছে। শায়মী নাবিলের তখন তিন বছর বয়স।”

খাবার টেবিলে বসা অন্যরা হো হো করে হাসতে থাকে।

রাওনাফ মাথা নিচু করে খাচ্ছে। উর্বী রাওনাফের আরেক বন্ধু জুনায়েদের পাতে মাংস তুলে দিতে যাবে তখন জুনায়েদ উর্বীকে বলে,”আপনারা কোথাও ঘুরতে যাননি ভাবি? এই শীতে তো সবাই ইচ্ছে মতো ট্যুর দিচ্ছে।”
জুনায়েদের স্ত্রী রাবেয়া বলে,”তোমার মনে হয় তোমার বন্ধু কোথাও নিয়ে যাবে ঘুরতে? সে তো তোমাদেরই বন্ধু।”

-কেনো ভাবি? এরকম বলছেন কেনো? আমরা কি করলাম। আমরা আমাদের স্ত্রীদের নিয়ে ঘুরি না?
জাহাঙ্গীর উত্তর দেয়।

জাহাঙ্গীরের স্ত্রী মিতা ব্যঙ্গ করে বলে,”তুমি শেষ কবে আমাদের নিয়ে ঘুরেছো সে তো আমার মনেই নেই। কখনো নিয়ে গিয়েছিলে কোথাও?

-আচ্ছা তাহলে এই কথা। বেশ এবার তাহলে আমরা সবাই মিলে একটা ট্যুর দেই চলো। শুধু স্বামী স্ত্রী যাবো। কোনো বাচ্চা কাচ্চা নেবো না।
আশিক সম্মতি দিয়ে বলে,”হ্যা হ্যা। তুনার মাও কয়েকদিন ধরে খুব বলছিলো। চল তাহলে এবার একটা ট্যুর দেওয়া যাক।”
সবাই তার কথায় সম্মতি জানায়।
রাওনাফ ঠান্ডা গলায় বলে,”আমি ব্যস্ত। এমনিতেই বেশ কয়েকবার ছুটি নিয়েছি। একজন ডাক্তার হয়ে এরকম আমি করতে পারি না।”

“একজন ডাক্তার হয়ে আমি এমন করতে পারি না! কোথাকার কোন মহাপুরুষ এসেছেন।”
ব্যঙ্গ কেটে জবাব দেয় জাহাঙ্গীর। রাওনাফ রেগে বলে,”তোদের দেখে মনে হয় না তোদের বয়স হচ্ছে। ছেলেমেয়েরা সব স্কুলে পড়ছে। খুবই হাস্যকর।”

-এই বয়সে তুই বিয়ে করতে পারলে আমরা একটু ঘুরতে পারবো না?

মৌমিতা রাওনাফের দিকে তাকিয়ে থাকে কথাটি বলে। রাওনাফ চুপ হয়ে যায়।

সবাই উচ্চশব্দে হাসতে থাকে।
উর্বীর ইচ্ছে করছে সেখান থেকে চলে যেতে।

-আমরা অত কথা শুনতে চাই না রাওনাফ ভাই। আমরা যাচ্ছিই।আর আপনিও যাচ্ছেন নতুন ভাবীকে নিয়ে আমাদের সাথে। সেটা যদি না হয় এটাই আমাদের শেষ আসা আপনাদের বাড়িতে।
বলে রাবেয়া।
-হ্যা হ্যা ঠিক তাই।

লামিয়া বলে ওঠে। জাহাঙ্গীর রাওনাফের দিকে তাকিয়ে বলে ওঠে,”শোন রাওনাফ। এখন নয়। শায়মী নাবিলের এক্সামের শেষে। তখন তোর কোনো কথা আমরা শুনছি না!”

তার সাথে তাল মিলিয়ে বলে অন্যরাও।

***
বাড়ির ল্যান্ডলাইনে কেউ বারবার ফোন দিচ্ছে। উর্বী নিচে যায়। গিয়ে কলটা রিসিভ করে। ওপাশ থেকে একজন ভদ্রমহিলা সালাম দেয়। উর্বী সালামের উত্তর দেয়।

ভদ্রমহিলা বলে,”আমি শায়মীর স্কুল থেকে বাংলা শিক্ষিকা বলছি আমি কি শায়মীর বাড়ির কারো সাথে কথা বলছি?”
-জ্বী বলছেন। বলুন কি দরকার!
-আপনি শায়মীর কি হন?

উর্বী ইতস্তত করে বলে,”আপনি বলুন না কি দরকার!”

-আপনাদের বাড়ি থেকে এখনি কাউকে স্কুলে এসে আমার সাথে দেখা করতে হবে।

-কেনো কি হয়েছে জানতে পারি?

-সেটা আসলেই বুঝতে পারবেন।
ভদ্রমহিলা ফোন রেখে দেয়। উর্বী তার ফোন দিয়ে রাওনাফের নাম্বারে বারবার ফোন দিচ্ছে। ফোনটা বন্ধ। উর্বী চিন্তায় পরে যায়। এখন কি করবে সে!

উর্বীর আজ অফ ডে ছিলো। উর্বীকে তৈরি হতে দেখে রওশান আরা জিজ্ঞেস করে,”কোথাও যাচ্ছো মা?”
-হ্যা মা একটু বের হচ্ছি। আমি তাড়াতাড়ি ফিরে আসবো। আপনি মনে করে দুপুরের ওষুধ টা খেয়ে নিবেন।

শায়মীদের স্কুলের বাংলা শিক্ষিকা আদুরী ইয়াসমিনকে টিচার্স রুমে পাওয়া গেলো। শায়মী একটা চেয়ারে বসে আছে, সে কাঁদছে।
উর্বী কক্ষে ঢুকে দেখে শায়মী কাঁদছে। আদুরী ইয়াসমিন উর্বীকে জিজ্ঞেস করে,”আপনি কে?”

-আমি শায়মীর বাড়ি থেকে এসেছি।

-ওহ,আপনার সাথেই কথা হয়েছিলো আমার? আপনি শায়মীর কি হন?
উর্বী বলে,”এটা জানা টা কি খুবই জরুরি?

-অবশ্যই।

-আমি সম্পর্কে ওর মা হই।
শব্দগুলো খুবই স্পষ্ট ভাবে উচ্চারণ করে উর্বী।

আদুরী ইয়াসমিন অবাক হয়ে তাকায়।
-আপনি শায়মীর মা?
-জি।
-বয়স কতো আপনার?
-ত্রিশ বছর।
-একজন ত্রিশ বছরের মায়ের ষোলো বছরের মেয়ে? এর ব্যাখ্যা কি? ওয়েট! রাওনাফ করিম খানের ব্যাপারে যা শুনেছি তা সত্যি তাহলে!

-আপনি দয়া করে বলবেন কি হয়েছে? আমার মেয়ে কাঁদছে কেনো?
উর্বী কাট কাট বলে ওঠে।

-শায়মী ক্লাসের টাইমে তার ছেলেবন্ধুর সাথে এদিক সেদিক ঘুরে বেড়ায়। আপনারা জানেন সেটা?

উর্বী হতবাক হয়ে যায়। সে শায়মীর মুখের দিকে তাকায়। শায়মী কাঁদছে, সে উর্বীকে বলে,”আমি কিছু করিনি বিশ্বাস করুন।”

উর্বী শায়মীকে বলে,”তুমি শান্ত হও। আমি দেখছি।”

আদুরী ইয়াসমিনের দিকে তাকিয়ে উর্বী বলে,”আপনার কোথাও ভুল হচ্ছে। শায়মী এমনটা করবে না।”

-দেখুন। আমাদের কোথাও ভুল হয়নি। আমাদের জীববিজ্ঞানের শিক্ষক হাসান সাহেব নিজে তাদের একটি রেস্তোরায় হাতে নাতে ধরেছে। ছেলেটি ঢাকা সিটি কলেজের ছাত্র। সামনে ওর এক্সাম! কত ব্রাইট স্টুডেন্ট ও। ডক্টর রাওনাফের মেয়ে ও।
ব্যাপারটা আমি এবং হাসান সাহেবের মধ্যেই আছে। শায়মী খুবই ভালো ছাত্রী। আমরা ওর ভালো চাই। তাই বিষয়টা আপনাদের জানানো হয়েছে। ওকে নিয়ে বাড়ি যান,ওকে বোঝাবেন।

উর্বী শায়মীর সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। শায়মী কাঁদতে কাঁদতে বলে,”আপনি প্লিজ পাপাকে কিছু বলবেন না,আমি আর এরকম কিছু করবো না কখনো। আপনি প্লিজ পাপাকে বলবেন না। পাপা আমাকে মেরেই ফেলবে!”
উর্বী শায়মীর গালে হাত রেখে বলে,”আমি কাউকেই কিছু বলছি না।তুমি চোখ মোছো। বাড়ি যেতে হবে আমাদের।”

***
রাওনাফ শুকনো মুখ নিয়ে ঘরে ঢোকে। উর্বী বইয়ে মুখ গুজেছিলো রাওনাফের আওয়াজ পেয়ে সে সেদিকে তাকায়, তাকিয়ে বলে,”আপনি অসুস্থ?”
-কই। নাতো।
-সেরকমই দেখাচ্ছে।
-ওহ তেমন কিছু না। আই এ্যাম অলরাইট।

তারপর তোয়ালে নিয়ে ওয়াশরুমে ঢোকে।
উর্বী বই রেখে উঠে পরে। রাওনাফ ওয়াশরুম থেকে বের হলে তাকে বলে,”আপনার খাবার টেবিলে দিয়ে দেবো?”
– নাহ। পরে খাবো। আজ শায়মীর স্কুলে গিয়েছিলে? মা বললো।

উর্বী থতমত খেয়ে বলে,”হ্যা। ওর বাংলা টিচার ফোন করে বললো ওর শরীরটা নাকি ভালো লাগছে না। তাই গিয়ে নিয়ে এসেছি। আপনি অপারেশন থিয়েটারে ছিলেন তখন, আপনার নাম্বার বন্ধ ছিলো। জানাতে পারিনি।”

-সে কি! তারপরে তো কেউ জানাতে পারতে। আশ্চর্য!

-শায়মী এখন ঠিক আছে। মনে হচ্ছে লো ব্লাড প্রেশার ওর।

-তা তো হবেই। কিচ্ছু মুখে দেয় সারাদিন!

রাওনাফ একটু থেমে বলে,”তুমি না চাইতেও আমার পরিবারের সমস্যাগুলি সামলাতে হচ্ছে তোমাকে!”
উর্বী কিছু একটা বলতে যাবে তখনই দরজার ওপাশে দাঁড়িয়ে আমিরুন ডাকে,”ভাবি খাইতে আসেন। খাবার দিয়া দিছি।”

রাওনাফ উর্বীর দিকে তাকায়।
-তুমি এখনো খাওনি?

-মা বললেন আপনি একা একা খান,তাই আমি যেনো আপনার সাথে খাই।

-মা বললেই সেটা করতে হবে? আশ্চর্য!
কন্ঠে বিরক্তিভাব রাওনাফের।

উর্বী অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখে তাকে। এতো রেগে যাওয়ার কি হলো! তার তো কোনো অসুবিধা হচ্ছিলো না। বিয়েটা মায়ের কথায় করতে পেরেছে! এখন নাটক করছে! ভারি অদ্ভুত লোক!

শায়মী ঘর অন্ধকার করে শুয়ে আছে। রাওনাফ বাইরে থেকে ডাক দেয়,”মামনী! ”
শায়মী উঠে বসে। তার ভিষন ভয় করছে। ওই মেয়েটা পাপাকে সব বলে দিয়েছে কি?
রাওনাফ ঘরে ঢুকে বাতি জ্বালিয়ে দিয়ে বলে,”এই সময়ে ঘর অন্ধকার করে বসে আছো কেনো?”
-না মানে এমনিই পাপা।

-শর্মী কোথায়?

-দাদীর ঘরে গিয়েছে।
– তোমার কি অবস্থা। এরকম হলে চলবে কি করে? সামনে পরীক্ষা!

শায়মী কিছুই বুঝতে পারছে না। তার বুক ধুকপুক করছে।‌ তার পাপা যদি সব জেনে যায় তাহলে কি পাপা তাকে চ’ড় মারবে যেমন মাহজাবীনের পাপা মাহজাবীনকে মেরেছিল!

রাওনাফ বলে,”আমার মাঝে মাঝে ইচ্ছে করে ডাক্তারি ছেড়ে তোমাদের তিন ভাই বোনকে সময় দেই। তোমরা যে যার মতো করে থাকো। যা ইচ্ছে তাই করে বেড়াচ্ছো।”

শায়মী শীতেও ঘামতে থাকে। রাওনাফ বলতে,”আজ শরীর বেশি খারাপ করেছিলো মামনী?”

শায়মী এবার বুঝতে পারে,তার পাপার কাছে ওই মেয়েটা তার অসুস্থতার অজুহাত দেখিয়েছে। সে কিছুটা স্বস্তি পায়।

মাথা নাড়িয়ে নিচু স্বরে জবাব দেয়,”একটু খারাপ করেছিলো পাপা!”

***
দরজার ওপাশ থেকে উর্বী উঁকি দিয়ে বলে ওঠে,”ইন্সট্যান্ট স্ন্যাকস বানিয়েছি শর্মী। খাবে তুমি?”

শর্মীর থেকে কোনো উত্তর পাওয়া যায়না। সে বিছানায় উপুড় হয়ে পেটে হাত দিয়ে কাতরাচ্ছে। শায়মী বই থেকে মাথা তুলে তাকায়। উর্বী ঘরের ভেতরে ঢুকে উৎকণ্ঠা নিয়ে বলে,”কি হয়েছে শর্মী?”

_পেটে ব্যাথা আন্টি!

উর্বী বলে,”পিরিয়ড হয়েছে? গরম পানি এনে দেবো?”

শর্মী মাথা নাড়ায়।

উর্বী বিছানার একপাশে বসে বলে,”কি হয়েছে! খুলে বলো।”

কাঁতরাতে কাঁতরাতে বলে,”চটপটি খেয়ে এসেছি স্কুল থেকে। আপনি প্লিজ পাপাকে বলবেন না।”

উর্বী হেসে ফেলে। তারপর বলে,”সিক্রেট রাখবো?”

শায়মী উর্বীর দিকে তাকায়। উর্বী শায়মীর চোখে চোখ রেখে শর্মীকে বলতে থাকে,” তোমাদের এতো এতো সিক্রেট পেটে রাখতে রাখতে আমার পেট তো রীতিমত ফুলে যাচ্ছে! এর বিনিময়ে আমি কি পাবো!”

শায়মী মাথা নিচু করে হাসে। তারপর নিচু স্বরে বলে ওঠে,”থ্যাংকস আন্টি! পাপাকে কিছু না বলার জন্য।”

***
উর্বী ব্যাগ গোছাচ্ছিলো। রাওনাফ এসে মাথা থেকে টুপি খুলে আলমারিতে তুলে রেখে ঘুরে উর্বীর দিকে তাকায়। সে এই মাত্র জুম্মার নামাজ আদায় করে ফিরেছে। পরনে তার ধবধবে সাদা রঙের পাঞ্জাবি। উর্বী একপলক রাওনাফের দিকে তাকায়। রাওনাফ নিচু স্বরে বলে,”আমি দুঃখিত, তোমার মা অসুস্থ। আমি যেতে পারছি না। ওনার কাছে ক্ষমাপ্রার্থী!”

উর্বী ম্লান হেসে বলে,”এভাবে বলার কিছু নেই। আর তাছাড়া মা অসুস্থ নয়। আমাকে দেখতে চাইছেন বলে মিথ্যা বলেছে। এমনিতে তো আমি যেতাম না।”

রাওনাফ দাঁড়িয়ে থাকে চুপচাপ।
রওশান আরা চেঁচামেচি শুরু করে দিয়েছে তার বড়ছেলের উপর।
উর্বীকে এভাবে একা কেনো ছাড়া হচ্ছে তাই।

রাওনাফ বারবার তার মাকে বুঝিয়েছে তার অনেক কাজ আছে। তবুও চেঁচামেচি কমছেই না।

কিছু সময় বাদে রওশান আরা মুখ ভার করে পায়চারি করছে।
উর্বী তার ব্যাগ রেখে রওশান আরার ঘরের বাইরে এসে দাঁড়ায়।
“মা।”
রওশান আরা তাকায়।
_মা আমি তবে এবার রওনা দিলাম। আপনি ভালো থাকবেন, ওষুধ ঠিকঠাক মতো খাবেন।
রওশান আরা বলে,”দু’দিন কিন্তু। দেরী করবে না। মনে থাকে যেন।”

উর্বী হেসে মাথা নাড়ায়।
রওশান আরার কাছে সে হাসি বড্ড মধুর লাগে।

উর্বী বলে,”দুদিনের বেশি থাকতেও পারবো না মা। আমার অফিস আছে।”

_তবুও। বাপের বাড়ি গেলে মেয়েদের পা আটকে যায় কি না।
মজার ছলে বলে ওঠে রওশান আরা।

_ঠিকাছে। আপনি আমাকে একটা কথা দিন এবার।

_কি কথা?
কৌতুহলী হয়ে রওশান আরা জানতে চায়। উর্বী বলে,”অন্তরার উপর চেঁচামেচি করবেন না। সেদিন যেমন আদর করেছিলেন,তেমন করেই আদর করবেন!”

অন্তরার ঘরের দরজা খোলাই ছিলো। সে হাত পা ছড়িয়ে শুয়ে আছে। তার শরীরটা বেজায় খারাপ।
উর্বী ঢুকে বিছানায় বসে। অন্তরা উঠে বসতে চায়। উর্বী বাঁধা দেয়।

“আপনি রওনা দিচ্ছেন ভাবি?”
_হু,এইতো এখন দেবো।

_একটু যে নিচে নামবো তাও পারছি না। মাথা তুলে দাঁড়াতেই পারছি না।
_তোমার নামতে হবে না। তুমি বিশ্রাম করো। যেকোনো সমস্যার কথা আমীরুনকে জানিও। ও সব করে দেবে। তাছাড়া তোমার মেজো ভাবিও দু একদিনের মধ্যে এসে পরবে।

অন্তরা মাথা নাড়ায়।
_আপনি না থাকলে বাড়িটা অন্যরকম হয়ে যাবে ভাবি। ফাঁকা ফাঁকা হয়ে যাবে।

উর্বী হাসে। অন্তরা বলতে থাকে,”হাসবেন না ভাবী। আপনাকে যে কতটা পছন্দ করে ফেলেছি আপনি জানেন না।”

শর্মীকে বলে উর্বী গাড়িতে ওঠে। শর্মীর বলতে ইচ্ছা করছে সে আন্টিকে মিস করবে কিন্তু পাশেই নাবিল দাঁড়িয়ে। তাই সে চুপ করে থাকে।
উর্বী গাড়িতে উঠে বসে জানালা দিয়ে রাওনাফের দিকে তাকায় ‌। রাওনাফ ফোনে কথা বলছে। উর্বী কেন এমনটা করলো উর্বী জানে না। সে কেনো তাকালো রাওনাফের দিকে!

ড্রাইভার গাড়ি ছেড়ে দেয়। নাবিল বিড়বিড় করে বলে,”থাক দুটো দিন শান্তিতে থাকতে পারবো।”
শায়মী আর শর্মী কপাল কুঁ’চ’কে তার দিকে তাকিয়ে থাকে।

***
তহুরা একটা পেয়ালায় কিছু কাঠবাদাম নিয়ে এসে উর্বীর সামনে রাখে। তারপর উর্বীর পাশে বসে।
উর্বী মাথা তুলে ভাবীর দিকে তাকিয়ে শুকনো গলায় বলে,”মায়ের মিছিমিছি অসুস্থতার কথা বলা উচিৎ হয়নি। এমনি বললেই চলে আসতাম।”

তহুরা তার জবাব না দিয়ে বলে,
“নে বাদাম খা। ভাত খাবি এখন? ভাত বেড়ে দেই?”
_না। পরে।

_হ্যারে, জামাইয়ের সাথে কথা হয়?
পাশ থেকে লুৎফুন্নাহার বলে ওঠে।

_কেনো মা?

_না,সারাদিনে একবার ও দেখলাম না ফোন দিতে।

_মা সে একজন ডাক্তার, তার কত কাজ জানো?

_তা বুঝলাম,রাতে তো দিতে পারে। তুইও তো দিতে পারিস।

উর্বী হাসে,বলে,” আমার দরকার হলে আমি দেবো। তুমি এত চিন্তা করছো কেনো?”
_ চিন্তা করবো না? ওবাড়ির সবার সাথে কথা বলিস অথচ যার সাথে বিয়ে হয়েছে তার সাথেই কথা বলিস না। চিন্তা করবো না আমি?

_না করবে না।

লুৎফুন্নাহার চুপ হয়ে যায়, কিছু সময় পরে বলতে থাকে,”এতো শিক্ষিত না হয়ে ভালোই করেছি। বাবা মা যার সাথে বিয়ে দিয়েছে। চুপচাপ মেনে নিয়েছি। সুখে থেকেছি।”

“আর কিছু বলবে?”
জিজ্ঞেস করে উর্বী।

_নাহ।
লুৎফুন্নাহার চলে যায়। তহুরা উর্বীর দিকে তাকিয়ে মিনমিন করে বলে,”তুই কিছু মনে না করলে একটা কথা জিজ্ঞেস করবো উর্বী?”

_হ্যা। করো।

_রাওনাফ ভাই আর তুই, তোরা এক বিছানায় ঘুমাস তো?

উর্বী হাসে, পাগলের মতো গা দুলিয়ে হাসে। কিছুক্ষণ পর হাসি থামিয়ে বলে,”হ্যা, একেবারে একবিছানায়, পাশাপাশি, কাছাকাছি ঘুমাই। যাও তুমি। ভাত খাবো ভাবী।”

তহুরা বসে থাকে‌ উর্বীর দিকে তাকিয়ে। আল্লাহ যেনো তার ননদ ননদাইকে ভালো রাখে, সে সেই দোয়া করতে থাকে মনে মনে। সে উর্বীর জীবনে আর কোনো ঝামেলা চায়না।

উর্বী ফোনের দিকে তাকায়। সত্যিই তো‌। এতগুলো ঘন্টা পেরিয়ে গিয়েছে, তার শাশুড়ি ফোন দিয়েছে,তার জা দুজন ফোন দিয়েছে,শর্মীও ফোন দিয়েছে। শুধু রাওনাফ দেয়নি। রাওনাফের কি ফোন দেওয়া উচিত ছিলো? স্ত্রী হিসেবে সামনা সামনি এতোটা কনসার্ন দেখায় উর্বীর প্রতি। এই সম্পর্কের সমীকরণ উর্বী বুঝতে পারছে না। পাজেলড হয়ে আছে সে। অবশ্য এটা ঐ জীবনের থেকে বেটার। যেটা উর্বীর অতীত ছিলো। যেটুকু সম্মান পাচ্ছে তাই সই! একজীবনে সব পেতে হবে এমন তো কোনো কথা নেই!

হুট করে হাতে ফোনটা তুলে নেয় সে। সামনের সপ্তাহে আক্তারুজ্জামানের কাছে কাউন্সিলিং-এর জন্য যেতে হবে। উর্বী একমনে হাসতে থাকে। বিড়বিড় করে বলে ওঠে,”পাগলের ডাক্তার তোমাকে সারাতে পারবে উর্বী?”

***
অন্তরা ঢুলুঢুলু চোখে তাকিয়ে আছে ‌। তার সামনে সামিউল দাঁড়িয়ে। স্ত্রীর জন্য তাকে ভীষণ চিন্তিত দেখা যাচ্ছে।

লামিয়া বলে ওঠে,
“হুম বাচ্চার অবস্থা স্বাভাবিক একেবারে। ভয়ের কিছুই নেই। এই সময়ে একটু শরীর খারাপ লাগবেই। ভয়ের কিছুই নেই। আমি কিছু মেডিসিন প্রেস্ক্রাইব করে দিচ্ছি। বেশি অসুবিধা মনে হলে আমাকে জানাবে।”

অন্তরা উঠে বসে। দুজন নার্স তাকে সাহায্য করে। তার সমস্ত শরীরে অসহ্য যন্ত্রনা।
রাওনাফ ডক্টর লামিয়ার কেবিনের বাইরে গিয়ে দাঁড়ায়। লামিয়া বলে,”রাওনাফ শোনো, তোমার ভাইয়ের বৌয়ের পাশাপাশি তোমার ভাইয়ের খেয়াল রেখো। বৌয়ের চিন্তায় চিন্তায় আবার কি না কি হয়।”
সামিউল লজ্জা পায়। রাওনাফ মৃদু হাসে। বলে,”অন্তরাকে নিয়ে আমার কেবিনে যা। আমি লামিয়ার সাথে কথা বলে আসছি।”

ওরা চলে যায়। রাওনাফ বলে,”কোনো অসুবিধা নেই তো? ”
‌_নো ম্যান,অল ইজ ওয়েল।
_যেভাবে দূর্বল হয়ে পরছে। সামিউল খুব চিন্তা করছিলো। আচ্ছা আমি যাই। আমার একটা ও.টি. আছে আধ ঘন্টা পর।
_রাওনাফ শোনো।

রাওনাফ লামিয়ার দিকে তাকায়।

_তোমার বৌ আসবে কবে?

_আগামীকাল হয়তোবা। কেনো!
_জাহাঙ্গীর একটা গেট টুগেদারের আয়োজন করছে রিভানায়।

রাওনাফ কিছু বলে না,মুচকি হেসে কেবিন থেকে বের হয়ে যায়।

নিজের কেবিনের দিকে যেতে যেতে সে হাতের ফোনটার দিকে একপলক তাকায়। তার কি একবার উর্বীকে ফোন করা উচিত? উর্বী কি কিছু মনে করবে? সবসময় আগ বাড়িয়ে সবকিছু তো রাওনাফই করে। না, ফোন দিয়ে কাজ নেই। যদি বাড়াবাড়ি ভাবে!

***
নাবিল তার গিটারে সুর তুলছিল। শায়মী এসে পাশে বসে। নাবিল বলে,”নতুন গানটা শোন আমার। শর্মী কোথায়? ওকে ডাক।”

_শর্মী বিজি।
_কি করছে পড়ছে?
_না আন্টির সাথে কথা বলছে। ফোনে।

_বাহঃ চমৎকার! তা তুই আন্টি আন্টি করছিস কেনো? ছোটো মা বল!

তাচ্ছিল্য নিয়ে বলে নাবিল।
শায়মী নাবিলের দিকে তাকিয়ে থাকে। নাবিল বলে ওঠে,
_শুনলাম রাফিকে নিয়ে রেস্তোরাঁয় ধরা খেয়েছিস হাসান স্যারের কাছে।
শায়মী ভয় পেয়ে বলে,”তুই জানলি কিভাবে?”
_আকিব বলেছে। আর এগোস না, বেয়াদব একটা। তোর নামে আজেবাজে কথা বলে বন্ধুমহলে। ওকে ব্লক করে দে।

শায়মী মুখ কালো করে বসে থাকে। নাবিলের মুখে সে এই বিষয়ে কোনো কথা শুনতে প্রস্তুত ছিলো না।

কিছু সময় পরে বলে,
_জানিস পাপার কাছে আন্টি কিছুই বলেনি এ ব্যাপারে। আমি তো অবাক হচ্ছি।
_আমি মোটেও হচ্ছি না।
_কেনো বলতো?
_খুব সিম্পল। এটা হচ্ছে ওনার চাল। শর্মীকে হাত করেছে। এখন তোকেও হাত করতে চাচ্ছে। তারপর আমাকে করবে।

শায়মী চুপ করে নাবিলের কথা শোনে। বিড়বিড় করে বলে,”উনি অমন মহিলা নন নাবিল, আমার মনে হয়।”

_যেমন হোক। আমি আমার মাম্মার যায়গা কাউকে দেবো না।
কঠিন গলায় বলে নাবিল ।

দোতলা থেকে শর্মীর খিক খিক হাসির শব্দ আসছে। সে উর্বীর সাথে কথা বলছে।
নাবিল মুখে চ কারন্ত শব্দ করে উঠে দাঁড়ায়। শায়মী বলে,”কোথায় যাচ্ছিস?”
_যাই গিয়ে ওকে কানের গোড়ায় একটা চ’ড় মেরে আসি।

শায়মী অবাক হয়ে তার ভাইয়ের কর্মকাণ্ড দেখে।

***

উর্বী হাটছে। অন্ধকারে সে কিছুই দেখতে পাচ্ছে না। চারিদিকে কুয়াশায় আচ্ছন্ন। সে দু হাত দিয়ে হাতরে পথ খুঁজতে থাকে। তার ভয় ভয় করছে। গলা শুকিয়ে যাচ্ছে। হঠাৎ পায়ের কাছ দিয়ে একটা সাপ চলে যায়। উর্বী জোরে চিৎকার দেয়। রাওনাফ এসে উর্বীকে ধরে। উর্বী ঠকঠক করে কাঁপতে থাকে।
রাওনাফ বলে,”কিছু হবে না। ভয় পেয়ো না। আমি আছি।”
উর্বী শান্ত হতে চেষ্টা করে। হঠাৎ পায়ে ঠান্ডা ঠান্ডা অনুভব করতে থাকে। নিচে তাকিয়ে দেখে আরেকটা সাপ।

উর্বী জোরে চিৎকার দিয়ে উঠে বসে। সে এতক্ষন স্বপ্ন দেখছিলো তবে।
শর্মী খিকখিক করে হাসছে।
“কি আন্টি? পায়ে কেমন ঠান্ডা দিলাম বলো?”

উর্বী জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিতে থাকে। সে বিষয়টা বুঝতে দুমিনিট সময় নেয়।
শর্মী বলে,”আন্টি তোমাকে সালোয়ার কামিজে একেবারে বাজে লাগছে। যাও গিয়ে মুখ হাত ধুয়ে শাড়ি পরো।”
উর্বী চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে থাকে। সত্যিই শর্মী তো এটা?

_আরে আন্টি এভাবে ভয় পাচ্ছো কেনো। সত্যিই এটা আমি শর্মী। তোমায় নিতে এসেছি দাদুর সাথে।
উর্বী এবার বুঝতে পারে।

“আচ্ছা আন্টি! তোমার রুমটা এতো সুন্দর করে গুছিয়ে রাখো কিভাবে?”
শর্মী ঘরের আশেপাশে দেখতে দেখতে বলে।

_তোমরা কখন এলে? মা কোথায়?
_দাদু তোমার আম্মু আর ভাবীর সাথে তোমাদের রান্নাঘরে। আমরা এসেছি ফজরের পরে। রাত তিনটায় রওনা দিয়েছি আমরা।
_রাত তিনটায়?
_হ্যা। দাদু বললো,ভোরে এসেই খেজুরের রস খাবে। তাই এতো তাড়াতাড়ি এলাম।
_আর কে কে এসেছে?
_আর কেউ না।

উর্বী কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলে,”তোমার পাপা আসেনি?”
_ওমা‌। পাপা কিভাবে আসবে? পাপা তো রাজশাহী গিয়েছে। তুমি জানো না আন্টি?
উর্বী অবাক হয়ে বলে,”না। রাজশাহী কি?”
_সেখানে আমাদের হসপিটালের একটা শাখা খোলা হয়েছে। সেটা দেখতেই গিয়েছে। আজ বিকেলে ফিরতে পারে।

উর্বী কিছু না বলে ওয়াশরুমে ঢোকে। তার হঠাৎ করে এমন অদ্ভুত লাগছে কেনো। তার অবচেতন মন কি চাইতো রাওনাফ আসুক?

চলমান………

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here