মনসায়রী
পর্ব-৩৪
অফিসে কাজ করতে করতে ঘড়ির কাঁটায় চোখ বুলিয়ে নিয়ে আবারো কাজে মন দিলো দুপুর। ক্ষুধায় পেট চোঁ চোঁ করছে। চোখ থেকে চশমাটা খুলে ডেস্কে মাথা রেখে চোখ বুঁজে বসে রইলো। মনে মনে ভাবলো, অফিস, পড়াশোনা সব সামলানো খুব একটা সহজ না। সামনের মাস থেকে ভার্সিটিতে পরীক্ষা শুরু হবে। তখন এতো প্রেশার সে সামলাবে কী করে! সামলাতে তো হবেই। তাও চাকরিটা আছে বিধায় রক্ষে। সংসারটা এখন একটু ভালো মতো চালানো যাচ্ছে। আগের টানাপোড়েন গুলো মনে করলে এখনো কান্না আসে। কী কষ্ট করেই না সে সংসারটা চালিয়েছে! যখন শিহাব কোমা থেকে বের হলো তখন সবাই বেশ হাসিখুশি ছিলো। প্রথম প্রথম শিহাব হাঁটতেও পারতো ঠিকঠাক। শিহাবের বাবার শেষ ইচ্ছে অনুযায়ী শিহাবকে তনয়ার সাথে বিয়ে দেয়া হলো। এরপর একমাসের মাথায় হঠাৎ শিহাবের পায়ে চিনচিনে ব্যাথা হতে শুরু করলো। এক্সরে করে ধরা পড়লো শিহাবের পায়ের একটা সাইড গভীর ভাবে ক্ষত হয়েছে। সেটা ব্যাধির মতো ছড়িয়ে যাচ্ছে। এখানে থেকে ক্যান্সারও হতে পারে এমনকি পা কেটে ফেলতেও হতে পারে। দুপুরের মাথায় তখন আকাশ ভেঙে পড়ার মতো অবস্থা। চোখেমুখে আঁধার দেখছিলো। পারিবারিক ব্যবসাটা ততদিনে প্রায় ডুবে যাচ্ছে। বাড়ি, গাড়ি লোনে করা হয়েছিলো। লোন পরিশোধ না করার কারণে ছয় মাসের মধ্যে তা ফেরত নেওয়া হয়। সব হারিয়ে দিশেহারা অবস্থা দুপুরের। তারপর শক্ত মনে সিদ্ধান্ত নেয়। যেহেতু পুরো পরিবারে আর কোনো পুরুষ নেই পরিবারের হাল ধরার মতো। শিহাবের অবস্থাও তখন ভালো না। তাই টিউশনি করেই আস্তে আস্তে সংসারটা চালিয়ে রাখছিলো দুপুর। এমনও দিন গেছে সারাদিন এক গ্লাস পানি খেয়ে সে গাধারখাটুনি খেটেছে। দিন ছয়, সাতটা টিউশনি করে, নিউজপেপারে এঁকে কখনো কখনো ছোট খাটো কোনো সেলসগার্লের জবও সে করেছে অস্থায়ী ভাবে।
জীবন কতো অদ্ভুত। আমরা যেমনটা ভাবি তার কিছু হয়না। বরংচ এমন ঘটনা ঘটে যায় যা কল্পনাও করা সম্ভব নয়। এই নিশ্চয়তা আর অনিশ্চয়তাকে ঘিরেই তো জীবন। দীর্ঘ শ্বাস ফেলে চশমাটা আবার চোখে পড়ে নিলো দুপুর। মোবাইলটা হাতে তুলে মা’কে কল করলো। শিহাবের চেক আপ হওয়ার কথা আজ। কী অবস্থা তা জানা দরকার। মা ফোন ধরে বললেন,
‘হ্যা দুপু বল! ‘
‘শিপুদার কী অবস্থা মা? অনেক দিন তো হলো চিকিৎসা হচ্ছে। ‘
‘ডাক্তার চেক আপ করেছে দুপু। বললো আগের তুলনায় অনেকটাই উন্নতি হয়েছে। ‘
‘আলহামদুলিল্লাহ! এটা তো ভালো খবর। ‘
‘কিন্তু আরেকটা কথা বললো জানিস!’
‘কী কথা মা?’
‘এদেশে চিকিৎসা করালে পুরোপুরি শিহাব ঠিক হবে কিনা তাঁর কোনো নিশ্চয়তা নেই। যদি শিহাবের চিকিৎসাটা বাহিরের দেশে হয় তাহলে বোধ হয় দ্রুত ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু তা তো সম্ভব না, আমাদের অবস্থা কী আর আগের মতো আছে বল!’
দুপুরের মনটা খারাপ হলো। হু হা বলে ফোনটা রেখে দিলো। কতদিন হলো শিহাব হুইলচেয়ারে বসে আছে। স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারছেনা। এই শিহাবই তো ছিলো যে দুপুরকে হাঁটতে শিখিয়েছিলো। প্রেমিক হওয়ার আগে হয়ে উঠেছিলো দুপুরের জীবনের সবচেয়ে বিশ্বস্ত হাত। যে হাতটা কখনো তাঁকে পড়ে যেতে দেয়নি। কোনো আঘাত পাওয়ার পর সবার আগে যার কথা মনে পড়তো। দুপুরের চোখ ভিজে উঠলো। মনে মনে বলল,
‘অনেক দিন হলো শিপুদা তোমাকে আমার পাশে দেখিনা। আমাকে আঘাত পাওয়ার থেকে বাঁচানোর জন্য তোমার ঐ হাতটা খুব দরকার শিপুদা। তোমার ভালো চিকিৎসা করাবো আমি। স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনবো। এতে যা করতে হয় তা-ই করবো। ‘
–
ওড়না দিয়ে মুখটা মুছে আরেকবার কলিং বেল চাপলো দুপুর। এতো দেরি করছে কেনো গেট খুলতে! সবাই গেলো কোথায়! কিন্তু বাহিরে যে এতোগুলো জুতা! বাসায় এতো মেহমান এলো কখন। রাত আটটা বাজে। এমন সময় দরজা খুললো কেউ। দুপুরের মা দরজা খুলেই মুচকি হাসলেন। তিনি দুপুরকে বললেন তাড়াতাড়ি হাতমুখ ধুয়ে ভালো কাপড় পড়ে নিতে। দুপুর প্রথমে তো বুঝতেই পারলো না কী হয়েছে। এরপর বসার ঘরের দিকে তাকিয়ে মাথা চক্কর দিলো। একি! সায়র বসে আছে সোফায়। গায়ে পাঞ্জাবি পায়জামা। পাশে দুপুরের অফিসের বস। মানে সায়রের বাবা। আর তাঁর পাশে হাস্যজ্জ্বল এক আধুনিক মহিলা। এটা বোধ হয় সায়রের মা। এরা সবাই তাঁর বাড়ি কী করছে!
দুপুর সায়রের বাবাকে দেখে সালাম দিয়ে বলল,
‘স্যার আপনি আমার বাসায়! কী হয়েছে? ‘
সায়রের বাবা কিছুক্ষণ হাসলেন। এরপর বললেন,
‘মা, তোমাকে এখানে আমাকে আর স্যার বলতে হবেনা। তুমি তো আমার মেয়েই এখন থেকে।’
দুপুর বুঝতে পারলো ঘটনা। সায়রই তাহলে বাবা মা নিয়ে হাজির হয়েছে। এজন্যই কাল রাতে অদ্ভুত কথাবার্তা বলছিলো। এই তাহলে কারণ। সায়রের দিকে তাকিয়ে দেখলো সে মিটমিট করে হাসছে তার দিকে তাকিয়ে। কিন্তু আফসোস! এই হাসি আর বেশিক্ষণ থাকবেনা। কারণ, দুপুর ভালোবাসা আর দায়িত্বের মধ্যে সবসময় দায়িত্বকেই বেছে নেয়। এবারও হয়তো তা-ই নেবে!
চলবে-
লেখায়-নাঈমা হোসেন রোদসী।