মনের_অরণ্যে_এলে_তুমি #তাহিরাহ্_ইরাজ #পর্ব_৩

#মনের_অরণ্যে_এলে_তুমি
#তাহিরাহ্_ইরাজ
#পর্ব_৩

” মিস্টার চৌধুরীর সঙ্গে হৃদুর বিয়েটা দিয়ো না আব্বু। ”

রাঈশার কথা শুনে হতবাক রায়হান সাহেব! উনি বিস্ময় ভাব এড়িয়ে বড় কন্যাকে প্রশ্ন করে বসলেন,

” তুমি হঠাৎ এমন কথা বলছো কেন? ”

রাঈশা নম্র স্বরে বললো,

” আমি ভুল কিছু বলেছি কি আব্বু? মিস্টার চৌধুরী আমাদের হৃদুর জন্য পারফেক্ট ম্যাচ না। হৃদু আরো বেটার ডিজার্ভ করে। ”

রাশেদ সাহেব বলে উঠলেন,

” এমন করে বলছো কেন মা? ইরহাম চৌধুরী যথেষ্ট ভালো একজন মানুষ। তার কোনো ব্যাড রেকর্ড নেই। চারিত্রিক গুণাবলী নজরকাড়া। জনসেবায় তার জুড়ি মেলা ভার। ”

এমন সময়ে সেথায় উপস্থিত হলেন ফারহানা এবং নাজরিন। হৃদির মা ও ছোট চাচি। তারাও শুনতে লাগলেন রাঈশার বক্তব্য,

” কিন্তু চাচু! সে রাজনীতি করে। রাজনীতিবিদদের আর যাই হোক না কেন চরিত্র ভালো হয় না। এদের আপাদমস্তক মুখোশের আড়ালে লুকায়িত। ইরহাম চৌধুরী নিশ্চয়ই তার ব্যতিক্রম নয়? ”

রায়হান সাহেব গম্ভীর স্বরে বলে উঠলেন,

” রাজনীতি মানেই খারাপ এমন ধারণা পোষণ করো না। সব পেশাতেই ভালোমন্দ দু-ই থাকে। ”

রাঈশা দৃষ্টি নত করে কোমল স্বরে বললো,

” আব্বু! হৃদু বেটার কাউকে ডিজার্ভ করে। ওই লোকটা রাজনীতি করে। জীবনভর ঝামেলা। অশান্তি। সামনে সে ইলেকশনে দাঁড়াচ্ছে শুনলাম। এমন একজনের সাথে আমাদের হৃদু? কেমন করে? তারচেয়ে বরং ফাহিম বলছিল… ”

রায়হান সাহেব হাতের ইশারায় থামতে বললেন। চুপটি করে গেল রাঈশা। উনি বললেন,

” আমি এখনো এই সমন্ধে হাঁ বা না বলিনি। তাদের থেকে সময় চেয়েছি। ভালো করে খোঁজখবর নিচ্ছি। তোমরা তোমাদের আব্বুকে বিশ্বাস করো তো? ”

রাঈশা হাঁ সূচক মাথা নাড়ল।

” তাহলে ভরসা রাখো। তোমাকে যেমন সুপাত্রে দান করেছি তোমার ছোট বোনকেও তাই করবো। ”

বলবার মতো আর কিছু রইলো না। অগত্যা চুপচাপ আশাহত হয়ে সেথা হতে প্রস্থান করলো রাঈশা। ফারহানা এবং নাজরিন একে অপরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করলেন। বুঝতে পারছেন না ঠিক কি হতে চলেছে।

অন্ধকারাচ্ছন্ন কক্ষটি।‌ বিছানার ঠিক মধ্যিখানে শায়িত এক রমণী। কাঁথার অন্তরালে লুকায়িত তার আপাদমস্তক। সে মুহূর্তে কক্ষের দ্বার উন্মোচন করে ভেতরে প্রবেশ করলেন ফারহানা। মেয়েকে ডাকতে ডাকতে পৌঁছে গেলেন বাতায়নের ধারে। দু হাতে ভারী পর্দার পাল্লা ঠেলে বিভক্ত করে দিলেন। স্বল্প সময়ের মধ্যেই ভানু’র কিরণে আলোকিত হয়ে উঠলো কক্ষটি। তাতে বিন্দুমাত্র ভ্রুক্ষেপ নেই ঘুমন্ত কন্যার। ফারহানা বিরক্ত হয়ে মেয়ের পানে এগিয়ে গেলেন। মাথা হতে সরিয়ে দিলেন কাঁথা। বিরক্তিকর অভিব্যক্তি প্রকাশ করে ওপাশ ফিরে শুয়ে পড়লো হৃদি। এলোকেশে লুকায়িত তৈলাক্ত মুখখানি।

” হৃদু! অ্যাই হৃদু! কটা বাজে খেয়াল আছে? ভার্সিটি যেতে হবে না? ওঠ বলছি। ”

বিরক্ত হয়ে উঠলেন ফারহানা। হৃদি ঘুম ঘুম কণ্ঠে বললো,

” যা বো। ”

” আর কখন যাবি? এক ঘন্টা বাদে ক্লাস। ওঠ বলছি। ”

পিঠে ধাক্কা দিয়ে মেয়েকে ডাকতে লাগলেন। অসন্তুষ্ট হয়ে আঁখি মেলে তাকালো হৃদি। থেমে থেমে শুধালো,

” কি হয়েছে? সক্কাল সক্কাল ডাকছো কেন? ঘুমাতে দাও না। ”

” রাতভর ঘুমিয়েছিস তাতে হয়নি? ওঠ এবার। রেডি হয়ে ভার্সিটি যা। পড়ালেখা তো পুরো চা*ঙ্গায়। শুধু শুধু বাবার টাকাগুলো নষ্ট করছিস। ”

মায়ের কথায় ভ্রুক্ষেপ না করে দেয়ালঘড়িতে চোখ বুলালো মেয়েটি। হকচকিয়ে তৎক্ষণাৎ বিছানা ত্যাগ করলো।

” ওহ্ শিট! এতগুলো বেজে গেছে? ”

এলোমেলো বিছানা তেমন রূপে ফেলে রেখেই তোয়ালে এবং পোশাক নিয়ে ওয়াশরুমের পানে ছুটলো সে। ফারহানা মেয়ের কাণ্ডে পুরো অসন্তুষ্ট। কোনো সময়জ্ঞান নেই। একে নিয়ে কি যে করবেন! স্বল্প সময়ের মধ্যেই ফ্রেশ হয়ে বেরিয়ে এলো হৃদি। তড়িঘড়ি করে দাঁড়ালো সমতল আরশির সম্মুখে। দক্ষ হাতে দীঘল কেশে চিরুনি চালনা করে, কেশের সম্মুখ ভাগ ক্ষুদ্র বিনুনি করে হেয়ার পিনে আবদ্ধ করে নিলো। ব্রেইডেড সাইড স্ট্রান্ড প্রস্তুত। মুখশ্রীতে মানানসই কৃত্রিম প্রসাধনীর ছোঁয়া। মায়াবী আঁখি যুগল অঙ্কিত হলো কাজল কালো রেখায়। ওষ্ঠাধরে লিপলাইনারের প্রলেপ। বাঁ হাতে গলিয়ে নিলো লেডিস ওয়াচ। প্রস্তুত সে! পড়নে তার কৃষ্ণবর্ণ সালোয়ার কামিজ। সাথে প্রিন্টেড দোপাট্টা। দোপাট্টাটি দেহের উপরিভাগে জড়িয়ে দ্রুত পায়ে টেবিলের কাছে পৌঁছে গেল। কাঁধে জড়িয়ে নিলো ব্যাগটি। অতঃপর তড়িঘড়ি করে কক্ষ হতে বেরিয়ে এলো।

ফারহানা ব্রেকফাস্ট করার কথা বললেও শুনলো না মেয়েটি। হাতে সময় নেই। দ্রুত পায়ে অ্যাপার্টমেন্ট হতে বেরিয়ে এলো। বড় বড় কদম ফেলে পৌঁছে গেল লিফটে। সেথায় প্রবেশ করে ঘন শ্বাস ফেললো। উফ্! কি তাড়াহুড়ো। রোজ রোজ এমনটি হয়। ব্যতিক্রম আর হয় না। এ যেন বহু পুরনো অবিচ্ছেদ্য এক অভ্যেস।

ভার্সিটি সংলগ্ন সড়কে অবস্থিত একাধিক ফুড স্টল। রয়েছে ফুচকা, ঝালমুড়ি সহ রকমারি ফুড আইটেম।
‘ ওরা সাতজন ‘ হাসিঠাট্টা করতে করতে ভার্সিটি প্রাঙ্গন ত্যাগ করে বেরিয়ে এলো। পৌঁছে গেল পুরনো ডেরা পলাশ মামার ফুচকা স্টলে। গিয়েই হৃদি ফুচকা অর্ডার করলো।

” মামা! সাত প্লেট ফুচকা। পাঁচটা ঝাল ঝাল আর দুটো… ”

” ঝাল কম। তাই তো? ”

চল্লিশোর্ধ পলাশ মামা একগাল হেসে বললেন। পুরনো কাস্টমার কিনা? খুব ভালো করেই চেনেন। ওদের প্রয়োজন বোঝেন। হৃদি হাসিমুখে সম্মতি জানালো।

” কারেক্ট আছে মামা। এই দুই ছা’গলের জন্য ঝাল কম দিয়ে ফুচকা দাও। এরা তো আবার ঝাল খাইলেই টালমাটাল। ”

সশব্দে হেসে উঠলো বন্ধুরা। নাবিল এবং সাবিত তৎক্ষণাৎ আপত্তি জানালো। নাবিল বললো,

” ফাও কথা বলবি না হৃদু। আমরা কি তোগো মতো রা*ক্ষস যে ঝাল খাইয়া লাল হইয়া যাবো? ”

নাদিরা ওকে শুধরে দিলো,

” ও য়ে। লিঙ্গ ঠিক করে কথা বল। রা ক্ষস কি রে? বল রা’ক্ষসী। ”

নাদিরার কথায় তেঁতে উঠলো নাবিল। ওর কেশের একাংশ টেনে দাঁতে দাঁত চেপে বললো,

” লু*ইচ্চা মাইয়া! লিঙ্গ ঠিক কইরা কথা কমু মানে কি? হুঁ? ”

নাদিরা তৎক্ষণাৎ জিভ কাটলো। নাবিল ব্যতিত বাকিরা সমস্বরে হেসে চলেছে। নাদিরা মেকি হেসে বললো,

” হে হে। ও ই স্লিপ অফ টাঙ। ”

নাবিল বিড়বিড় করে ওর কেশ মুঠোমুক্ত করলো। আস্তে ধীরে ওকে কটা গালমন্দ করলো নাদিরা। সাবিত বন্ধুকে টিজ করে বললো,

” দোস্ত উগ্লা ঠিক কইরা কথা বলবা, ঠিক আছে? ”

ধপাধপ পিঠে কয়েক ঘা লাগিয়ে দিলো নাবিল। সাবিত নিজেকে বাঁচানোর চেষ্টা করবার পাশাপাশি হেসে চলেছে। তন্মধ্যে ফুচকা হাজির। হৃদি পরিস্থিতি সামাল দিতে বললো,

” এই যে কুস্তিগীর গণ! বাহুবলীর চ্যা লা। কুস্তি পড়ে করিস। আগে ফুচকা খেয়ে শক্তি সঞ্চয় কর। ”

নাবিল ধমক দিয়ে বললো, ” রাখ তো তোর ফুচকা। ”

ইভা বলে উঠলো, ” রাখতে যাবো ক্যান? তারচেয়ে বরং খেয়ে নি। ”

বলতে না বলতেই নাবিলের ফুচকায় আ’ক্রমণ। নারীগণ ওর ভাগের ফুচকা লু”টপাট করে খেয়ে নিলো। নাবিল শুধু চেয়ে চেয়ে দেখলো একঝাঁক রা ক্ষসীর কাণ্ড‌।

ফোনালাপে লিপ্ত মানব বেরিয়ে এলো কফিশপ হতে। কর্ণ কুহরে ঠেকে মুঠোফোন। কয়েক কদম অগ্রসর হয়েই রাস্তার ধারে পার্ক কৃত গাড়ি। ইরহাম ফোনে কথা বলতে বলতে ডান হাতে ড্রাইভিং সিটের ডোর উন্মুক্ত করলো। যেই না ভেতরে প্রবেশ করবে সহসা নজর বন্দী হলো রাস্তার ওপাড়ে। নভোনীল ( স্কাই ব্লু ) চক্ষুজোড়া স্থির হলো এক ললনায়। প্লেটে রাখা ফুচকা অতি তৃপ্তির সহিত খেয়ে চলেছে সে ললনা। মাঝেমধ্যে হাতে থাকা ফুচকা বেজার মুখো ছেলেটির মুখের সামনে ধরে আবার নিজেই মুখে পুরে নিচ্ছে। চক্ষু বন্ধ করে উপভোগ করছে টক টক স্বাদ। আহা! সে কি তৃপ্তিময় স্বাদ! চক্ষু মেলে শুভ্র দন্ত বের করে ঝলমলে হাসিতে মুখরিত হচ্ছে সে ললনা। ইরহাম এক লহমায় মোহাচ্ছন্ন হলো কি! গাড়ির হর্নের শব্দ কর্ণ কুহরে পৌঁছাতেই মানুষটি জাগতিক হুঁশ ফিরে পেল। ফোনালাপ সমাপ্ত করে সংযোগ বিচ্ছিন্ন করলো। পাঞ্জাবির পকেটে মোবাইল পুরে বসলো চালকের আসনে। পেশিবহুল পেটানো দেহ আবদ্ধ করে নিলো সিটবেল্টে। অতঃপর সুদক্ষ হাতে স্টিয়ারিং ঘুরিয়ে প্রস্থান করলো সেথা হতে। রাস্তার ওপাশে অবস্থিত ললনা টেরও পেলো না তার অন্যতম ক্রাশের উপস্থিতি। জানলে না জানি কি করতো!

আনন্দে আত্মহারা মিসেস মালিহা। ওনার অধরে লেপ্টে খুশির ছোঁয়া। উৎফুল্ল চিত্তে শাশুড়ি মা এবং কন্যার মাঝে মিষ্টি বিতরণ করছেন উনি। করবেন না? ওনার একমাত্র পুত্র ইরু। অবশেষে বুঝি বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হতে চলেছে। খুশিমনে একটি মিষ্টি মুখে পুরে উনি শাশুড়ি মায়ের পাশে সোফায় বসলেন। রাজেদা খানম মৃদু হেসে বললেন,

” তো? মাইয়া পক্ষ রাজি হইয়া গেছে! ”

” জ্বি মা। ”

” আলহামদুলিল্লাহ্। মিয়া বিবি রাজি। এখন শত্তুর শ্বশুর কোনো আকাম কুকাম করনের আগে আমগো কিছু করা দরকার। নইলে ওই শিনু মাইয়া আমার নাতির কান্ধে ঝুইল্লা পড়বো। ”

মালিহা হঠাৎই চিন্তিত হয়ে পড়লেন।

” মা! আপনার ছেলে তো রাজি না। তাহলে? এবার কি করবো? ভাই সাহেব তো মতামত দিয়ে দিয়েছেন। এখন ইরুর বাবা যদি বেঁকে বসে? তখন কি হবে? ”

” বেহুদা চিন্তা কইরো না তো বৌমা। আমি এহনো জীবিত আছি। ম রি নাই। তোমার জামাই আর যাই হোক আমার মুহের ওপর কথা কইতে পারবো না। এইডা নিশ্চিত থাহো। ”

উচ্ছ্বাস প্রকাশ করলো ইনায়া।

” দাদি ও দাদি! তাহলে সত্যি সত্যিই ভাইয়ার বিয়েটা আমরা খেতে চলেছি? এটা আসলেই আমাদের তাকদীরে ছিল? ”

দাদি হেসে বললেন,

” হ রে বুইন। এইডা ভাগ্যে আছিল। তো.. বিয়ার আয়োজন শুরু করি দাও। হ্যার আগে তো বিয়ার তারিখ ঠিক করতে হইবো। ”

পুত্রবধূর পানে তাকিয়ে,

” এক কাম করো বৌমা। আইজ রাইত এজাজ আইলে ওরে আমার রুমে পাডাইয়ো। কথা আছে। ”

মালিহা হাঁ সূচক মাথা নাড়লেন। তবে চিন্তার পাহাড় গড়ে উঠছে মন মাঝারে। না জানি কি হবে!

তমস্র রজনী। ‘ আনন্দাঙ্গন ‘ এর লিভিং রুমে থমথমে পরিস্থিতি বিরাজমান। এজাজ সাহেব সকলের মধ্যমণি হয়ে বসে। উপস্থিত দু’জন নতুন মুখ। মালিহার ভ্রাতা জহির সাহেব এবং তার পত্নী পল্লবী। একমাত্র অনুপস্থিত ইরহাম। বরাবরের মতই। জহির সাহেব বোঝার চেষ্টা করছেন বোন জামাইয়ের মনোভাব। এমন এক সংবাদে সে ঠিক কিরূপ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করবে? বেশি রাগারাগী করবে কি? নীরবতা ভঙ্গ করে রাজেদা খানম বলে উঠলেন…

চলবে.

[ আসসালামু আলাইকুম পাঠকবৃন্দ। কেমন লাগছে নয়া উপন্যাসটি? সদ্য শুরু হয়েছে তো। কাহিনী গুছগাছ করে অগ্রসর হতে একটু সময় লাগছে। আশা করি ইরহাম এবং হৃদির ভালোবাসাময় সফর আপনাদের মন ছুঁয়ে যাবে। ধন্যবাদ সবাইকে পাশে থাকার জন্য।‌ ]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here