মন_বিনিময় #পর্বঃ২১ #লেখনীতে- তাসফিয়া হাসান তুরফা

#মন_বিনিময়
#পর্বঃ২১
#লেখনীতে- তাসফিয়া হাসান তুরফা

ঘড়ির কাটায় রাত ১১টা ছুই ছুই। রাস্তাঘাট তুলনামূলক ফাঁকা থাকায় গাড়ি চলছে নির্বিঘ্নে। এরই মধ্যে বেশ কয়েকবার ড্রাইভ করার ফাঁকে ফাঁকে স্বপ্নিল আড়চোখে তাকাচ্ছে রাহিতার দিকে। সে কথা বলার চেস্টা করেছে কয়েকবার কিন্তু বিশেষ সুবিধা হয়নি তাতে। দু-একবার হু হা করে থেমে গেছে রাহিতা! অর্থাৎ গাড়িতে বসার পর থেকে সেই যে চুপ করে বসে আছে তো আছেই, স্বপ্নিলের কথাই বলছেনা কোনো। মনে মনে বেশ বিরক্ত হয় স্বপ্নিল। এত রাগ তো আজকাল সে নিজেও দেখায়না! আশ্চর্য! মনের কথা ভেতরে রাখেনা স্বপ্নিল, মুখ ফুটে জিজ্ঞেস করেই ফেলে,

—কি হয়েছে তোমার? এত চুপচাপ কেন?

—ফোন কোথায় আপনার?

এবার শীতল কণ্ঠে জিজ্ঞেস করে রাহিতা। ওর কথায় কপালে ভাজ সোজা হয় স্বপ্নিলের। এতক্ষণে বুঝে রাহিতা কেন চুপচাপ আছে৷ জিব দিয়ে শুষ্ক ঠোঁট ভিজিয়ে উত্তর দেয়,

—ওহ এজন্য এত রেগে আছো? অনেক ফোন দিয়েছিলে তাইনা?

—কতবার ফোন দিয়েছি জানেন? শুধু একবার কলব্যাক করে কি বলা যেতোনা আসতে দেরি হবে? আমার কত টেনশন হচ্ছিলো আপনি কি বুঝবেন!

স্বপ্নিলের দিক তাকিয়ে অভিমানি কণ্ঠে বলে রাহিতা। যা শুনে খানিকক্ষণ ওর দিকে নিষ্পলক তাকিয়ে থাকে স্বপ্নিল। অতঃপর দৃষ্টি সামনের দিক ফিরিয়ে ড্রাইভ করতে করতে বলে,

—সরি, রাহি। জানি তোমায় অপেক্ষা করিয়েছি। কিন্তু আমি ইচ্ছে করে এমন করিনি। আসলে হয়েছিলো কি জানো? আমার দু-তিনটে বন্ধু যোগ দিয়েছিলো আমাদের সাথে। সবাই ডিনার করে আড্ডা দেওয়ার মাঝে সময় পেরিয়ে যায়। তার মধ্যে আমার ফোনে চার্জ কম ছিলো, সাইলেন্ট করেছিলাম অফিসে। বাসায় এসে সেটা চার্জ দেওয়া বা সাইলেন্ট অফ করার মতো সময় ছিলোনা৷ তোমায় নিয়ে তো ডিরেক্ট চলে এলাম না এদিকে? তাই ফোন কখন দিয়েছো বুঝতে পারিনি।

একসাথে এতকিছু বলে কিছুক্ষণ দম নেয় স্বপ্নিল। অতঃপর পুনরায় বলে,

—তুমি এতক্ষণ পার হওয়ার পরেও ফোন দিচ্ছিলে না দেখে আমার চিন্তা হয়। হাতঘড়িতে সময় দেখে ফোন দিবো এমন সময় দেখি ফোন চার্জ শেষ হয়ে অফ হয়ে গেছে। তখন মনে হলো আমার আগেই ফোন চেক করা উচিত ছিলো, তুমি হয়তো আমায় না পেয়ে অপেক্ষার করছো। তাইতো আর কোনোকিছু না ভেবে দ্রুত চলে আসি। এরপরেও যদি তুমি রাগ করে থাকো তাহলে আমি আর কি করবো?

—আচ্ছা, ঠিক আছে।

—তুমি এখনো রাগ করে আছো, তাই না? ঠিক আছে বলো কি করলে তোমার ভালো লাগবে? এই প্রথম বিয়ে করেছি তো, বউয়ের রাগ ভাঙানো নিয়ে কোনো এক্সপেরিয়েন্স নেই আমার!

রাহিতাকে হাসাতে মজার ছলে বললো স্বপ্নিল। কিন্তু ওর হাসি বেশিক্ষণ টিকলোনা রাহিতার কথা শুনে।

—প্রেম তো করেছেন আগে। প্রেমিকার রাগ ভাঙানোর অভিজ্ঞতা নিশ্চয়ই আছে!

হুট করে স্বপ্নিলের থমথমে মুখ দেখে রাহিতার নিজেরও টনক নড়ে। কখন যে মুখ ফস্কে কথাটা বেরিয়ে গেছে মুখ থেকে টের পায়নি সে নিজেও! এখন পরিস্থিতি অন্যদিক যেতে দেখে খানিকটা অপরাধবোধ ভর করে ওর মাঝে৷ স্বপ্নিলকে নীরব দেখে ইনিয়েবিনিয়ে রাহিতা নিজেই বলে,

—আমি আসলে ওভাবে বলতে চাইনি। হঠাৎ করে মুখ ফস্কে বের হয়ে গেছে।

—ইটস ওকে। মিথ্যে তো বলোনি। সত্যিই বলেছো। তবে প্রেমিকার রাগ ভাঙানো নিয়েও আমার খুব একটা অভিজ্ঞতা নেই বুঝেছো?
মিহি কণ্ঠে উত্তর দেয় স্বপ্নিল। ওর কথায় ভ্রু কুচকে তাকায় রাহিতা। গোলগোল চোখে উত্তর করে,

—কেন? আনিকা আপু রাগ করতোনা বুঝি?

—করতো কিন্তু তোমার মতো না। তোমায় আমি শুরুতে রাগহীন শান্তশিষ্ট মেয়ে ভাবতাম কিন্তু এখন দেখছি তুমি আস্ত একটা এংরি বার্ড!

রাহিতা চোখ পাকিয়ে তাকাতেই হেসে ফেলে স্বপ্নিল। কিছুক্ষণ বাদে গম্ভীর হয়ে বলে,

—আসলে আনি খুব একটা রাগ করতোনা৷ মাঝেমধ্যে হয়তো করতো, তখন আমি ওকে গান গেয়ে শুনাতাম। কিন্তু বাধ সাধতো একটা জায়গায়।

—কি?
আগ্রহ নিয়ে সুধায় রাহিতা।

—ওর পছন্দ ছিলো আধুনিক গান আর আমার প্রিয় ছিলো আগেকার দিনের গান৷ আমাদের পছন্দ একে-অপরের থেকে পুরো আলাদা ছিলো, হয়তো এজন্যই শেষ পর্যন্ত আমায় আর ভালো লাগেনি ওর। নিজের মতোই আধুনিক কাউকে বেছে নিয়েছিলো বিদেশ যেয়ে!
কথাগুলো বলতে বলতে খানিকটা অন্যমনস্ক হয়ে পড়ে স্বপ্নিল। এতক্ষণ মনোযোগ দিয়ে ওকে লক্ষ্য করে রাহিতা, ওর প্রতিটা কথার ভাজে লুকিয়ে থাকা সূক্ষ্ম বিষাদের ছাপ স্পষ্ট টের পায় সে। মনে মনে ভাবে নিজের অভিমানের আড়ালে স্বপ্নিলের পুরনো ক্ষতকে সে পুনরায় জাগ্রত করছেনা তো?

রাহিতার কোমল মন গলে যায় নিমিষেই। গিয়ারের উপর রাখা স্বপ্নিলের হাতে হাত ছুয়ে দেয় আলতোভাবে। স্বপ্নিল ওর দিক তাকাতেই কথা ঘুরিয়ে বলে,

—আগেকার দিনের গান তো আমারও ভীষণ প্রিয়। বিশেষ করে রবীন্দ্র সংগীত। বৃষ্টির দিনে এক কাপ চা হাতে প্রিয়জনের সাথে বসে রবীন্দ্র সংগীত অনুভব করার মজাটাই আলাদা!

উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে বলে রাহিতা। ওর চঞ্চলতায় নিজের বিষাদ ঝেড়ে হেসে ফেলে স্বপ্নিল। যাক অবশেষে মেয়েটা নিজের আসল সত্ত্বায় ফিরে এসেছে! কে বলবে কাল রাত থেকে এ মেয়েটাই তার সাথে অভিমান করে একটু আগ পর্যন্ত কথা বলছিলোনা? অথচ এখন স্বপ্নিলের একটু সঙ্গ পেয়ে সে যেন আগেকার মতোই স্বাভাবিক ও প্রাণোচ্ছল হয়ে গেছে। মেয়েটা যে ইচ্ছে করেই স্বপ্নিলের যাতে খারাপ না লাগে সেজন্য কথা ঘুরিয়েছে তা বেশ বুঝে স্বপ্নিল কিন্তু রাহিতাকে বুঝতে দেয়না ব্যাপারটা।
মেয়েটা বড্ড সরল, স্বচ্ছ মনের অধিকারিণী। তাই তো হাসিখুশি রাহিতাকে এভাবেই মানায়, মনে মনে ভাবে স্বপ্নিল। ওদের কথার মাঝেই গাড়ি এসে থেমেছে বাসার সামনে। নেমে পড়ার সময় চলে এসেছে। সিটবেল্ট খুলে গাড়ি থেকে রাহিতা নামতে যাবে এমন সময় ওর হাত ধরে আটকায় স্বপ্নিল।

—রাহি

—হু?

—আই থিংক এখন বিষয়টা ক্লিয়ার করা উচিত।

—কোন বিষয়?
জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে প্রশ্ন করে রাহিতা। এক দীর্ঘশ্বাস ফেলে স্বপ্নিল বলে,

—আমি জানি তুমি হয়তো আমার কথায় কস্ট পেয়েছো এ কয়দিনে। কিন্তু বিশ্বাস করো, আমি ওভাবে মিন করে বলিনি তোমায়। তুমি শুধু এটাই দেখেছো যে আমি তোমায় বউ হিসেবে অস্বীকার করেছি কিন্তু এটা কখনো ভেবে দেখেছো যে তার পিছনের কারণটা কি?

স্বপ্নিলের কথায় আড়চোখে ওর দিকে তাকায় রাহিতা। সত্যিই তো সে এটা কখনো ভাবেনি। কি এমন কারণ থাকতে পারে স্বপ্নিলের এমন করার? ওর ভাবনার মাঝেই স্বপ্নিল আবারো বলে,

—এই যে আমি বারবার বন্ধুত্বের কথা বলতাম। সেটা কেন বলতাম জানো? কারণ আমার মতে পৃথিবীতে সব সম্পর্কের মধ্যে বন্ধুত্বের সম্পর্ক সবচেয়ে সহজ, সবচেয়ে নির্মল। তুমি জানো কেন? কারণ বন্ধুত্বের সম্পর্কে এত দায়বদ্ধতা থাকেনা, এত ভুল-বোঝাবুঝি থাকেনা আর না থাকে কোনো জোর। কারণ বন্ধুত্ব সবার সাথে হয়না, শুধু তার সাথেই হয় যার সাথে মানুষ মনের মিল খুজে পায়। যার সাথে মন খুলে জীবনের কথা বলা যায়। যার সাথে নির্দ্বিধায় নিজের মতো করে মেশা যায়, নিজের সব সিক্রেট শেয়ার করা যায়। আমি তোমার-আমার সম্পর্কটা সেই পর্যায়েই নিয়ে যেতে চেয়েছিলাম। আর থাকলো কথা আমাদের সম্পর্কের, তাহলে বলবো আমরা নিঃসন্দেহে স্বামী-স্ত্রী। আর এটা আমি মুখে একবার কেন হাজারবার বল্লেও দুনিয়ার কেউ অস্বীকার করতে পারবেনা যে তুমি আমার বউ, এমনকি আমি নিজেও না। কিন্তু এত সব বুঝার পরেও ঠিক কোন কারণে আমি এ বিষয়টা বারবার এড়িয়ে চলতাম তা কি তুমি বুঝোনা?

রাহিতার চোখের দিক সরাসরি তাকিয়ে প্রশ্ন করে স্বপ্নিল। যে চোখের ভাষা পড়তে দিশেহারা হয় রাহিতা। স্বপ্নিলের গভীর দৃষ্টির মাঝে হারায় মন, অদ্ভুত কম্পন ধরে তনুমনে। কাপা কাপা গলায় সহসা সে প্রশ্ন করে,

—ক- কেন?

—কারণ আমি ভয় পাই, রাহি। দ্বিতীয়বার কাউকে মন দিয়ে তাকে হারানোর ভয়। দ্বিতীয়বার কাউকে ভরসা করে তার থেকে বিনিময়ে বিশ্বাসঘাতকতা পাওয়ার ভয়। আমি জানি তুমি এমন নও। আমার সম্পর্কে এতকিছু জানার পরেও, আমার আগেকার খারাপ আচরণ সহ্য করার পরেও তুমি আমার সাথে আছো, হয়তো তোমার জায়গায় অন্য মেয়ে হলে থাকতোনা। আমি নিজেও তোমার জায়গায় হলে থাকতে পারতাম না। কিন্তু তবুও আমার মনে যে অজানা ভয় হয় সেটাকে কি করে থামাবো, রাহি? আমায় বলো।

স্বপ্নিলের প্রশ্নে নিরুত্তর রয় রাহিতা। এ প্রশ্নের কি জবাব দিবে এটা যে সে তার নিজেরও অজানা। তাইতো চুপচাপ দৃষ্টি ফিরিয়ে নেয়। মাঝে নীরবে কাটে কিছুটা সময়। মনে মনে চলে কথোপকথন। এরই মাঝে নীরবতা ভেঙে বুকভরে এক লম্বা শ্বাস নেয় স্বপ্নিল। এরপর দৃঢ় কণ্ঠে স্বপ্নিল বলে ওঠে,

—স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক সবচেয়ে সুন্দর, সবচেয়ে পবিত্র। এ সম্পর্কে কঠিন দায়িত্ববোধ যেমন আছে ঠিক তেমনি একে-অপরের প্রতি নির্মল বিশ্বাস ও স্বার্থহীন ভালোবাসা সেভাবেই প্রয়োজন। জানি একটু সময় লাগবে ঠিকি কিন্তু আমার বিশ্বাস, আমি-তুমি সাথে থাকলে দুজনে এ উঁচুনিচু পথ মসৃণভাবে পাড়ি দিতে পারবো। একটি সুন্দর পরিসমাপ্তি ঘটাতে পারবো। শুধু আর একটু ধৈর্য ধরো প্লিজ? আমার জন্য?

আশাভরা চোখে রাহিতার দিক তাকায় স্বপ্নিল। এতক্ষণে রাহিতা নিজেও ওর দিকে তাকিয়েছে। স্বপ্নিলের কথায় পুরনো আশা জেগে উঠে মনে। অন্তর প্রশান্ত হয় রাহিতার। স্বপ্নিলের বাড়িয়ে রাখা হাতে হাত রেখে ঠোঁটে হাসির রেখা টেনে বলে,

—আপনি মন থেকে আমাদের সম্পর্ক মেনে নেন, আমায় স্ত্রী হিসেবে মেনে নেন আমি তো শুধুই এটাই চেয়েছিলাম। জোর করে আর যাই হোক ভালোবাসা হয়না এবং আপনার পরিস্থিতিতে তো আরও না! তাই আমি কখনোই আপনাকে জোর করতে চাইনি। এতদিন মনের মাঝে কস্টগুলো লুকিয়ে রেখে আমি ক্লান্ত হয়ে গিয়েছিলাম তাই নিজেকে হালকা করতে ও আপনাকে আমার মনের অবস্থা বুঝাতে সেদিন ওসব বলি। নিজের দুঃখ শেয়ার করা কি বন্ধুত্বের মাঝে পড়েনা? আপনিও করেছিলেন, আমিও করেছি। হিসাব বরাবর!

ভ্রু নাচিয়ে বলে রাহিতা। ওর কথার ধরনে হেসে ফেলে স্বপ্নিল। হাসতে হাসতেই বলে,

—তোমার হিসাব মিললে এখন গাড়ি থেকে নামি চলো? নয়তো দেখা যাচ্ছে পুরো রাত বাসার সামনেই কাটিয়ে দিচ্ছি আমরা। তারপর পরদিন সকালে তোমায় বাসায় খুজে না পেয়ে তোমার শাশুড়ি আমার নামে থানায় মামলা করে দিবে!

—ছি! আপনি কত খারাপ!

চোখ পাকিয়ে স্বপ্নিলের উদ্দেশ্যে বলে রাহিতা। এরপর সিটবেল্ট খুলে গাড়ি থেকে নামে দুজনে। বাসায় ঢোকার আগে রাহিতার উদ্দেশ্যে হাত এগিয়ে দেয় স্বপ্নিল, সহাস্যে সে হাত মুঠোয় বন্দি করে রাহিতা। দুজনের ঠোঁটের কোণে মুচকি হাসির আভাস। মিলিত কদমে নিজেদের সম্পর্কের এক অন্য সমীকরণের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করে তারা।
সুদূর আকাশের চাঁদটাও যেন হাসছে তাদের পিছে। এ রাত এবং পেছনে ফেলে আসা রাস্তাও যেন সাক্ষি আজ এক জোড়া কপোত-কপোতীর মন বিনিময়ের নতুন অধ্যায়ের সূচনার!

#চলবে

রিচেক করা হয়নি।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here