#হৃদকোঠোরে_রেখেছি_তোমায়🖤(৮)
#Maisha_Jannat_Nura (লেখিকা)
(১২)
মাঝরাতে পানি পিপাসায় তরুনিমার ঘুম ভে’ঙে যাওয়ায় সে কিছুটা বিরক্তি বোধ নিয়ে শোয়াবস্থা থেকে উঠে বসে। বেডসাইড টেবিলের উপর থেকে পানির বোতল টা হাতে নিতে দেখে সেখানে পানি নেই এতে তরুর মাঝে বিরক্তি ভাব আরো বেড়ে যায়। বিছানা থেকে নেমে কুশলের দিকে লক্ষ্য করতেই দেখে কুশল ঠান্ডায় কিছুটা জড়োসড়ো হয়ে শুয়ে আছে আর মেঝেতে ওর কম্বলটিও পরে আছে।
তরুনিমা কম্বলটি উঠিয়ে কুশলের শরীরের উপর দিয়ে পানির বোতল হাতে নিয়ে রুম থেকে বেড়িয়ে যায়। সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে ডায়নিং সাইডে এসে টেবিলের উপর রাখা জগ থেকে বোতলে পানি ঢালতে শুরু করে। ডায়নিং সাইডের ডানপার্শেই রায়হানুলের থাকার ব্যবস্থা করে দিয়েছিলো কুশল। সেইসময় তরুর চোখে পড়ে রায়হানুলের রুমের দরজার সামনে দু’জন ছায়া মানব দাড়িয়ে আছে। তরু ভ্রু যুগল কুচকে বললো……
—“এতোরাতে বড় বাবার রুমের সামনে কারা দাঁড়িয়ে আছে! বড় বাবার কোনো সমস্যা হয় নি তো?”
এই বলে তরু রায়হানুলের রুমের দিকে অগ্রসর হতে শুরু করে। তরুর পায়ের আওয়াজ কর্ণপাত হতেই ছায়া মানব দু’জন তৎক্ষণাৎ স্থান ত্যগ করে। তরু রায়হানুলের রুমের অপরপার্শে কেও আছে নাকি দেখার চেষ্টা করলেও অন্ধকারের জন্য কাওকে দেখতে পায় না। অতঃপর তরু সেই বিষয়টিকে আর ঘাটাঘাটি না করে রায়হানুলের রুমে প্রবেশ করে। রুমে প্রবেশ করতেই তরু দেখে রায়হানুল বিছানায় শুয়ে থরথর করে কাঁপছে।
দীর্ঘ ২৮ বছর ধরে কো*মায় থাকা একজন পেশেন্টকে মধ্যরাতে এভাবে থরথর করে কাঁপতে দেখে তরুর মাঝে চি*ন্তা ও ভ*য় কাজ করতে শুরু করে। তরু দ্রুততার সাথে রায়হানুলের রুম থেকে বেড়িয়ে উচ্চস্বরে সকলকে ডাকতে শুরু করে। মধ্যরাতে পুরো পরিবেশে শান্ত ও নিস্তব্ধতা বিরাজ করছিলো। সেইসময় তরুর উচ্চস্বরের ডাক শুনে বাসার সকলের ঘুম ভে*ঙে যায়। সবাই তাদের নিজ নিজ ঘর থেকে বেড়িয়ে এসে ড্রয়িংরুমে উপস্থিত হয়।
কুশলও নিজের ঘর থেকে বেড়িয়ে আসে। সাবরিনা চৌধুরী বললেন…..
—“কি হয়েছে তরুনিমা! মাঝরাতে এভাবে চিৎকার চেঁচামেচি করছো কেনো?”
তরু ভী*ত কন্ঠে বললো….
—“ব-বড়-বড় বাবা…!”
সেইসময় কুশল সিঁড়ি বেয়ে নামতে নামতে প্রশ্ন করলো….
—“বড় বাবা! কি হয়েছে বড় বাবার?”
—“উনি শোয়াবস্থাতেই কেমন থরথর করে কাঁপছেন, ওনাকে দেখতে ভিষণ অস্বাভাবিক লাগছে!”
তরুর এমন কথা শুনে কুশল সহ সকলেই অনেক অবাক হয়ে যায়। রিজভীর পাশে দাঁড়িয়ে কামিনী নিজের মুখে একহাত রেখে বললো…..
—“এতোগুলো বছর ধরে কো*মায় থাকা রো*গী কিনা মাঝরাতে থরথর করে কাঁপছে! কি গো আমাদের চৌধুরী মেনশনে কি ভূ’ত-পে’তে’রা বাসা বাঁধতে শুরু করলো নাকি?”
সায়মন চৌধুরী রাগী স্বরে বললেন….
—“আহহহ…রিজভী তুই তোর বউকে সামলা আর উল্টো-পাল্টা কথা বলতে নিষেধ কর।”
কুশল সেখানে দাঁড়িয়ে সকলের কথা শুনে সময় নষ্ট না করে দ্রুতপায়ে রায়হানুলের রুমের দিকে অগ্রসর হতে শুরু করে। তরুনিমাও কুশলের পিছন পিছন যেতে থাকে। সাবরিনা চৌধুরী বাকিদের উদ্দেশ্য করে বললেন….
—“চলো বড় ভাইজানের রুমে গিয়ে দেখি তরুনিমা যা বলছে তা আসলেই ঠিক বলছে কি না!”
সায়মন সহ বাকিরাও সাবরিনার কথায় সম্মতি জানিয়ে রায়হানুলের রুমের দিকে অগ্রসর হতে শুরু করে। কুশল রায়হানুলের রুমে প্রবেশ করতেই দেখে রায়হানুল সম্পূর্ণ ভাবেই স্থির হয়ে শুয়ে আছে। তরুর কথানুযায়ী রায়হনুলের মাঝে কোনোরকম অস্বাভাবিকতা কিংবা কাঁপার লক্ষণ নেই। সেইসময় তরু সহ চৌধুরী বাড়ির বাকি সদস্যরাও রায়হানুলের রুমে প্রবেশ করে একই অবস্থা দেখে তরুনিমার প্রতি বেশ বিরক্ত হয়। সায়মন বিরক্তি ও রাগমিশ্রিত কন্ঠে বললেন….
—“মাঝরাতে সকলের ঘুম ভাঙিয়ে এতোসময় ধরে কি মশকরা করলে তুমি তরুনিমা!”
কামিনী নিজের বিনুনি নাড়াতে নাড়াতে বললেন…..
—“আমারও তো তাই মনে হচ্ছে আমাদের রাতের ঘুম ভ*ঙ্গ করার জন্যই এমন জ*ঘ*ণ্য মশকরা করেছে আপনাদের ছেলের বউ।”
রিজভী রাগী স্বরে বললেন….
—“বংশ মর্যাদা আর সম্পর্ক রক্ষার জন্য আমার ভাতিজাকে বিয়ে করতে বাধ্য হয়েছো বলে আমাদের বড় ভাইজানের অসুস্থতাকে মাঝরাতে সকলের সামনে মজার খো*রা*ক বানানোর মতো জ*ঘ*ন্য কাজ করতে তোমার রুচিতে বাঁ*ধলো না! এই তোমাদের সিকদার বংশের সুশিক্ষার রূপ! ছি*হ্:…..”
উপস্থিত মধ্যবয়সের প্রায় সকলেই তরুনিমাকে কোনো কথা বলার সুযোগ না দিয়েই নানান ধরণের উল্টোপাল্টা কথা শুনাচ্ছে। তরু অ’প*মানে, ল*জ্জায় মাথা নিচু করে নিয়ে চোখের পানি ফেলতে শুরু করে। সেইসময় কুশল রায়হানুলের পাশ থেকে উঠে দাঁড়িয়ে উচ্চস্বরে বললো…..
—“ব্য*স…..যথেষ্ট বলেছেন আপনারা সবাই।”
কুশলের উচ্চস্বরে বলা কথা শুনে রায়হানুলের রুম জুড়ে এখন নিস্তব্ধতা বিরাজ করছে। কুশল তরুর পাশে এসে দাঁড়িয়ে কমোরের পিছনে দু’হাত রেখে কঠিন কন্ঠে বললো…..
—“আপনারা সবাই হয়তো ভুলে যাচ্ছেন বর্তমান স্থানে দাড়িয়ে তরুনিমা সিকদার বংশের মেয়ে হওয়ার আগে এই রওনাক আজমাইন চৌধুরী কুশলের বিবাহিতা স্ত্রী সে। আর আমার স্ত্রীর সম্মান ও শিক্ষার উপর আঙুল উঠানো মানে আমার সম্মান ও শিক্ষার উপর আঙুল উঠানোর সমতুল্য। আমি আমার সম্মান ও শিক্ষার উপর আজ পর্যন্ত কারোর আঙুল উঠাতে দেই নি ভবিষ্যতেও কখনও দিবো না। রইলো তরুনিমার বলা বড় বাবার অস্বাভাবিক আচারণ করার বিষয়টি! এটা যে তরুনিমা সত্য বলেছে তার যেমন কোনো প্রমাণ আমাদের কাছে নেই তেমনি এটা যে তরুনিমা মিথ্যা বলেছে তারও কোনো প্রমাণ আমাদের কারোর কাছেই নেই। এমনটাও তো হতেই পারে এতোগুলো বছর পর বড় বাবা তার নিজের বাসায় এসেছেন তাই তার মাঝে ক্ষণিক সময়ের জন্য ইম্প্রুভমেন্ট হতে শুরু করেছে। আর ভাগ্য ক্রমে তরুনিমাই শুধু বড় বাবার ইম্প্রুভমেন্ট টুকু নিজ চোখে দেখতে পেরেছে। আমরা বড় বাবার কাছে আসার পূর্বেই তিনি আবারও আগের মতো হয়ে গিয়েছেন! নিজের পরিবারের মানুষদের মাঝে দো*ষ ও ভু*ল গুলো খোঁজার চেষ্টা না করে, তাদেরকে আ*ঘা*ত দায়ক কথা না শুনিয়ে প্রথমত প্রতিটি বিষয়ের পজেটিভ দিকটি চিন্তা করা উচিত আমাদের। পরবর্তীতে দো*ষ ও ভু*ল গুলোর যথাযথ প্রমাণ হাতে পেলে যা সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত তা নিতে হবে । নয়তো শুধু শুধুই মনোমালিন্য বা ভুল বুঝাবুঝির সৃষ্টি করে সুন্দর সম্পর্ক গুলো নষ্ট করা উচিত না।আজকের পর আর কখনও কেও আমার স্ত্রীকে কোনো বিষয় নিয়ে ভুলাক্রমেও একটা ছোট-বড় কথা শোনানোর চেষ্টা করলে আমি তাকে ছেড়ে কথা বলবো না। যদি কোনো বিষয়ে আমার স্ত্রীর সামান্যতমও ভুল বা দোষ থেকে থাকে তাহলে সেই ভুল বা দোষের যথাযথ প্রমাণ এনে আমার হাতে তুলে দিবেন এরপর আমি আমার স্ত্রীর কি শাস্তি প্রাপ্প্য তা নির্ধারণ করবো।তরুনিমা এসো আমার সাথে।”
কথাগুলো বলে কুশল তরুনিমার হাত ধরে রায়হানুলের রুম থেকে বেড়িয়ে নিজের রুমে যাওয়ার উদ্দেশ্যে হাঁটা ধরে। তরু স্তব্ধ ও ছলছল দৃষ্টি নিয়ে কুশলের দিকে তাকিয়ে থেকেই ওর সাথে হাটছে।
(১৩)
কামিনী নিজের বিনুনি নাড়াতে নাড়াতে সাগরিকার হাতের বাম পার্শে এসে দাঁড়িয়ে তাঁর দিকে কিছুটা ঝুঁকে ফিসফিসিয়ে বললেন…..
—“মেজো ভাবী….ছেলের বিয়ের ১ম রাতই কাটে নি এখনও পর্যন্ত। এতো তাড়াতাড়িই সিকদার ভাইজানের মেয়ে তো আপনার ছেলের উপর ভালো জা*দু*টো*না করে নিজের ব*শে নিয়ে নিয়েছে। ছেলের লা*গা*ম নিজের হাত থেকে পুরোপুরি ছু*টে যাওয়ার আগেই শক্ত করে ধরুণ নয়তো ২দিন পর এই ছেলেই তার বউয়ের কথায় উঠাবসা করবে। তখন সে আপনাকে, মেজো ভাইজানকে কোনো তো*য়া*ক্কা*ই করবে না।”
সাগরিকা চৌধুরী কিছু একটা বিষয় নিয়ে ভাবলেন মাত্র। অতঃপর কামিনীর কথাগুলোর কোনো প্রতিত্তুর না করেই রায়হানুলের রুম থেকে বেড়িয়ে গেলেন। সাগরিকা চৌধুরী চলে যেতেই একে একে বাকি সদস্যরাও নিজ নিজ রুমে চলে যায়।
(১৪)
কুশল তরুর হাত ধরে সোজা নিজেদের রুমে নিয়ে আসার পরই ছেড়ে দেয়। তরু স্তব্ধ মুখশ্রী নিয়ে বিছানায় গিয়ে বসে। কুশল ও তরুকে পাল্টা কোনো প্রশ্ন না করে শান্ত মুখশ্রী নিয়েই সোফায় গিয়ে বসে। তরু বিছানায় পা ঝুলিয়ে বসে মনে মনে ভাবে…..
—“বড় বাবার রুমের বাহিরে দরজার সামনে এতো রাতে দাঁড়িয়ে থাকা সেই ছায়া মানব দু’জন কে ছিলো? কেও আমার কথা বিশ্বাস না করলেও আমি নিজ চোখে যা দেখেছিলাম তা তো মি’থ্যা হয়ে যাবে না। উনাকে বা এই বাসার কাঔকেই ঐ ছায়া মানব দু’জনের কথা বলা যাবে না। তাহলে তখন যেমন সবাই আমাকে অবিশ্বাস করে ছোট-বড় কথা শুনিয়েছিলেন এখনও তেমনি শুনাবেন। আগে আমাকে খুঁজে বের করতে হবে সেই ছায়া মানব দু’জন কে ছিলো! কি ছিলো তাঁদের উদ্দেশ্য! বড় বাবাই বা হঠাৎ ওমন অস্বাভাবিক আচারণ কেনো করছিলেন! সত্যিই কি তিনি ইম্প্রুভমেন্ট করছিলেন! নাকি এই সবকিছুর মাঝে লুকিয়ে আছে আলাদা কোনো রহস্য?”
চলবে ইনশাআল্লাহ………………..