স্বচ্ছ_প্রণয়াসক্ত #পর্ব_১৫ #মুসফিরাত_জান্নাত

#স্বচ্ছ_প্রণয়াসক্ত
#পর্ব_১৫
#মুসফিরাত_জান্নাত

ঘড়িতে রাত্রি এগারোটা বিশ বাজে ।চারিদিকে শুনশান নিরাবতা।যান্ত্রিক শহরের অহেতুক কোলাহল রুপান্তরিত হয়েছে গাঢ় নিস্তব্ধতায়।রাস্তা ঘাটের কোথাও কোথাও যান বাহনের অস্তিত্ব থাকলেও হসপিটালের মোড়ের এদিকটায় কোনো যান বাহনের অবস্থান নেই।শহরের এই গলিতে নিরাবতার চিহ্ন পেতে উস্কানি পেয়েছে যেনো অম্বরের চাঁদ।নিজের শরীর নিঙড়ে জোছনা ঢেলে দিতে লাগলো ধরিত্রীর সর্বাঙ্গে।উত্তাপহীন নরম আলোয় ঝলসে যেতে লাগলো নির্জন শহর।সেই সাথে ঝলসে গেলো প্রেমিক পুরুষের তৃষ্ণার্ত হৃদয়।হসপিটালের করিডোরে দাঁড়িয়ে ঘুম জড়ানো অক্ষি মেলে নিজের দিকে আগত রমনীর মুখশ্রী পানে দৃষ্টি আবদ্ধ রেখেছে সাদাত।গুটি গুটি পা ফেলে তার কাছে এগিয়ে আসছে তার ব্যক্তিগত মেয়েটি।নিজেদের মাঝের ব্যবধান ঘুচিয়ে সে যতই নিকটবর্তী হচ্ছে গ্রিলের ফাঁক গলিয়ে স্নিগ্ধ চন্দ্রিমার দ্যূতি ছড়িয়ে পড়ছে মেয়েটির মায়াবী মুখাবয়বে।স্পষ্ট থেকে স্পষ্ট হচ্ছে তার সুচারু বদন খানি।যা ধীরে ধীরে ব্যগ্র চোখের অধিকারী পুরুষটির ঘুম কেড়ে নিচ্ছে।তীক্ষ্ণ হচ্ছে পতিত দৃষ্টি।মোহগ্রস্ততা ছড়িয়ে দিচ্ছে সর্বাঙ্গে।বেসামাল হয়ে যাচ্ছে সে।আস্তে ধীরে নিজস্ব তাল হারিয়ে ডুব দিচ্ছে মেয়েটির যাদুমিশ্রিত আননে।

ধীর পায়ে সাদাতের পাশে এসে দাঁড়ায় ঐশী।নিস্তব্ধতা ঠেলে অভিযোগের সুরে বলে,

“কেনো শুধু শুধু কষ্ট করে এখানে থাকতে গেলেন?তারচেয়ে বরং বাড়ি ফিরতেন।অকারণেই ঘুমের কষ্ট করে লাভ হবে কোনো?”

সাদাত নিস্পৃহ কণ্ঠে জবাব দেয়,

“তুমিও তো আধ ঘুমে রাত কাটাবে।”

“আমার হিসেব আলাদা।তাছাড়া মাঝে মধ্যে ঘুমানোর সুযোগও পাবো আমি।আপনি তো একই রুমে নিজ শশুরের সাথে শেয়ার করে ঘুমাতেও পারবেন না।”

“তুমি ঘুমাও।আমার ঘুম পায় নি।”

নিষ্কম্প গলায় বাক্য দুটি বললো সাদাত।ঐশী স্পষ্ট বুঝলো সাদাত মিথ্যা বলছে।চোখ দুটো কেমন লালচে হয়ে এসেছে ঘুমের চোটে।সারাদিন কলেজ করে ক্লান্তিমাখা শরীরে ঘুম পাওয়াটা অস্বাভাবিক নয়।বরং পূর্ণ দিবস পরিশ্রমের শেষে না ঘুমানোটা কষ্টকর।অথচ তাকে সঙ্গ দিবে বলে হসপিটালেই রয়ে গেলো সে।খানিকটা জোর দিয়ে ঐশী বললো,

“খোঁজ নিয়ে দেখলাম পাশের কেবিনের পরেরটা ফাঁকা রয়েছে।ওখানটায় গিয়ে ঘুমিয়ে যান।কাল তো আবার কলেজ যাবেন নাকি!”

ভ্রু কুটি করলো সাদাত।মেয়েটি তার খেয়াল রাখা শুরু করেছে।ব্যাপারটা বেশ ভালো লাগে তার।স্নিগ্ধ হাসি খেলে যায় শুষ্ক ওষ্ঠদ্বয়ে।মনের খেয়ালে মাঝ রাতেও রগড় করতে ভোলে না সে।ভ্রু নাচিয়ে বলে,

“কি ব্যাপার?আজকাল খেয়াল রাখা শুরু করেছো দেখছি।আগ্রহ হচ্ছে নাকি?”

সাদাতের এহেন প্রশ্নে থতমত খায় ঐশী।লজ্জায় রক্তিমা আভা জমে মেদুর দুই গালে।লজ্জা লুকাতে মাথা নত করে ফেলে সে।কতো বদ এই লোকটা।সে আগ্রহ দেখালে দেখাচ্ছে তার মুখ ফুটে বলতে হবে কেনো?সে তো ভালো চেয়েই লোকটির থাকার ব্যবস্থা করতে হন্য হয়ে কেবিন খুজলো।অথচ লোকটা এভাবে আড়ষ্ট করলো তাকে।মনে মনে বিড়বিড় করে কিছু একটা বলে ঐশী।ঐশীর উত্তরের অপেক্ষা না করে চারিদিকে চোখ বুলায় সাদাত।বদমাইশি হেসে বলে,

“ওহ!আমি তো ভুলেই গিয়েছিলাম।প্রেমের ঋতু বসন্ত এসেছে ধরায়।আগ্রহ তো হবেই।”

লজ্জার ভীরে আরও লজ্জার সংখ্যা যুক্ত হয় ঐশীর।মিইয়ে যায় একেবারে।শ্বাস প্রশ্বাস দ্রুত হয়।কন্ঠ নালী রুদ্ধ হয়ে যায়।বুকের মাঝে অস্বস্তির ঢোল দ্রিম দ্রিম বাজতে থাকে। চোখ দুটো বন্ধ করে নিজেকে ধাতস্থ করার আপ্রান চেষ্টা করে ঐশী।ঘড়ির কাটায় কিছু সময় যুক্ত হতেই সফলও হয় সে।নিজেকে ধাতস্থ করে সে বলে,

“স্বামী হিসেবে দ্বায়িত্ব শুধুমাত্র আপনার একারই নয়।বরং স্ত্রী হিসেবে আমারও কিছু দ্বায়িত্ব রয়েছে।সেই দ্বায়িত্ববোধ থেকেই আপনার খেয়াল রাখছি।অন্যকিছু ভাবার কোনো কারণ নেই।”

“ওহ আচ্ছা।স্বামী মানো তাহলে?”

কিছুটা রসিকতা করে বলে সাদাত।প্রতিউত্তরে নিস্পৃহ কণ্ঠে ঐশী বলে,

“না মানার কি আছে?অবশ্যই মানি।”

বেশ স্বাভাবিক কণ্ঠেই উত্তর দেয় ঐশী।ভ্রু কুটি করে সাদাত।মেয়েটার পুরোটাই রহস্যে ঘেরা।তার মনে কখন কি চলে বুঝে উঠতে পারে না সে।ঐশীর আচরণে মাঝে মাঝে দ্বিধায় পড়ে যায় সাদাত।আজও তার ব্যতিক্রম হলো না।কয়দিন আগেই তার থেকে দূরত্ব বজায় রাখতে কেমন কাণ্ড করলো।আজ আবার বলছে তাকে স্বামী মানে।প্রতিউত্তরে ঐশীর এক হাত টেনে নিয়ে কণ্ঠে অধিকার মিশিয়ে বলে,

“তবে বেশ,ধরলাম এই হাত।না মানতে চাইলেও আর ছাড়ছি না।”

থমকালো ঐশী।বিহ্বল অভিব্যক্তি।সাদাতের কণ্ঠে স্পষ্ট অধিকারবোধ।চোখ গোল করে তাকিয়ে থাকে কিছু সময়।অতপর নিজেকে ধাতস্থ করে ফেলে।মিইয়ে যাওয়া কণ্ঠে বলে,

“রাত বাড়ছে।এখন গিয়ে শুয়ে পড়ুন।”

প্রতিউত্তর করে না সাদাত।কিছু সময় নিভৃতেই কাটে।ঐশী সাদাতকে সুবিধা করে দিলেও এই মুহুর্তে ঘুমানোর কোনো সাধ জাগছে না তার।বরং ঐশীর আচরণটা বেশ প্রভাব ফেলেছে তার উপর।এই জোছনা মুখর রাতে প্রেয়সীর সান্নিধ্যে কাটানো প্রহরটা আরও একটু দীর্ঘায়িত করতে ইচ্ছে করছে।এই হাতটা ছাড়তে ইচ্ছে করছে না তার।গম্ভীর কণ্ঠে সে বলে,

“এসবের কোনো প্রয়োজন ছিলো না।ঘুমানোর ইচ্ছে নেই আমার।”

বিষ্মিত হয় ঐশী।এতো কষ্ট করে খুঁজে খুঁজে থাকার জন্য একটা রুম জোগাড় করলো সে।আর লোকটা কিনা এখন বলছে তার ঘুমাতে ইচ্ছে করছে না।ভ্রু কুটি করে সে বলে,

“তাহলে কিসের ইচ্ছে আছে আপনার?”

“তোমাকে দেখার।”

মোহগ্রস্তের ন্যায় জড়ানো গলায় উত্তর দেয় সাদাত।থমকে যায় ঐশী।দুটি শব্দ, অথচ মাধুর্য সুবিশাল।যা তরঙ্গিত করে রমনীর সারা অঙ্গ।ভালো লাগার জোয়ার ওঠে বক্ষের সমুদ্রে।শীতল হয় হৃদমাঝার।ক্ষনকালের জন্য নিভে যায় নিজের খেয়াল প্রদীপ।এক অনাকাঙ্ক্ষিত ভালো লাগায় ছেয়ে যায় সে।তোমাকে দেখার।এর চেয়ে সুন্দর জবাব কি আর দু’টি হতে পারে?

বিহ্বল হয়ে সাদাতের দিকে তাকিয়ে থাকে ঐশী।বুকে তার ধুকপুক স্পন্দন।সেই স্পন্দনকেও থমকে দিতে মুখ খোলে সাদাত।তার মসৃণ ওষ্ঠ নাড়িয়ে মোহগ্রস্ত কণ্ঠে বলে,

“তোমার ওই ধারালো চোখের তীরে একবার বিদ্ধ হলে,নির্ঘুমে পারি দিবো এ রজনী, চক্ষে তৃষ্ণা নিয়ে।”

কিছু সময় থামলো সে।অতপর কণ্ঠ আরও খানিকটা নামিয়ে বললো,

“ঘুমপ্রিয়া,তুমি গিয়ে ঘুমাও।আমি চেয়ে চেয়ে চোখের তৃষ্ণা মিটাই।”

সাদাতের কথাগুলোর মাঝে হয়তো অস্তিত্বহীন এলকোহলের বিচরন ছিলো।যা মাতাল করে দিলো ঐশীকে।বাধ্য করলো নিজের তাল হারাতে।মুগ্ধ মন্ত্রের ন্যায় আকৃষ্ট করলো তাকে।লজ্জা অস্বস্তিকে ক্ষনকালের ন্যায় ছুটি দিয়ে এক ধ্যানে সাদাতের দিকে তাকিয়ে থাকে সে।বুকে প্রশান্তির ঢেউ,চোখে তার অপার মোহগ্রস্ততা।যা আরও তৃষ্ণার্ত করলো সাদাতের হৃদয়।প্রেমময়ীর দৃষ্টিতে বিদ্ধ হয়ে সে মনের গহীনে রচিত করলো কতোশতো গল্প ও কবিতা।তা উৎপত্তি স্থলেই তলিয়ে গেলো।ওই দু’চোখে তাকিয়ে শব্দ মেলানোর সাহস সে পেলো না।এতো গভীর চাহনিকে যে শব্দ দিয়েই ব্যাখ্যা করুক তা যে অপূর্ণই রয়ে যাবে।

করিডোরে দাঁড়িয়ে একে অপরের দিকে বিনা অর্থে, বিনা শর্তে,বিনা কারণে দুনিয়ার সব চাহিদা ভুলে তাকিয়ে রইলো একদল কপোত কপোতি।কথাও হলো টুকটাক।সময় গড়িয়ে প্রহরে পদার্পণ হলো।তাদের এই মধু মাখা মুহুর্তের সাক্ষী হয়ে হয়তো বেহায়া চন্দ্রিমারও খানিকটা লজ্জা হলো।নিজের অবস্থান সড়িয়ে নিলো সে।যার দরুন গ্রিল গলিয়েও আর ভিতরে প্রবেশ করলো না তার আলোকচ্ছটা।চাঁদের দ্ব্যর্থহীন আলো সড়ে যেতেই মুখাবয়ব অস্পষ্ট হলো রমনীর।আফসোস হলো পুরুষটির।সময়টা আরও একটু দীর্ঘ হলো না।চাঁদটার আরও একটু আলো দিলে কি খুব ক্ষতি হতো?

নিজেদের ইচ্ছাকে দমিয়ে ভেতরে প্রবেশ করলো তারা।শশুর বাবার কেবিনে ঐশীকে স্থান দিয়ে ফাঁকা কেবিনের দিকে পা বাড়ালো সাদাত।রাত্রি অনেক বেড়েছে।এখন একটু বিশ্রাম নেওয়া যাক।শরীরে জেঁকে বসা ক্লান্তি এতোই ছিলো যে এক পলকও পিছু ফিরে তাকালো না সে।যদি তাকাতো তবে দেখতে পেতো ব্যকুল চক্ষু মেলে তার দিকে তাকিয়ে আছে এক জোড়া চোখ।যাত্রাপথে দৃষ্টি মেলে মনে মনে সে বলছিলো,

“আমি চাই শুধু আজকের এই জোছনা রাতেই নয়,প্রতিটা প্রহরে চক্ষু উজার করে আমাকে দেখার তৃষ্ণা কারণে অকারণেই আপনার জাগ্রত হোক অন্য পুরুষ।”

আনমনেই কথাগুলো বলে বিমূঢ় হলো ঐশী।ভ্যাবাচ্যাকা খেলো সে।হটাৎ এমন ইচ্ছে পোষণ করলো কেনো?তবে কি সে সত্যি সাদাতের প্রতি আগ্রহী হচ্ছে?

আনোয়ার খাঁনের সার্জারির চারদিন অতিবাহিত হয়েছে।এই চার দিন টানা সেবা যত্ন ও রাত্রি জাগরণের জন্য আজকে প্রায় জোর করেই মা’কে বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছে ঐশী।সেও না হয় একটু বাবার সেবা যত্ন করুক।সাথে রয়ে গিয়েছে সাদাত।হাজার বলেও তাকে ভিড়ানো যায় নি।এই চারদিনের প্রথম দিন ছুটি কাটালেও পরের দিনগুলো কলেজ করে তারপর সোজা হসপিটালে চলে আসে সে।এখানের প্রয়োজনীয় অপ্রয়োজনীয় বিষয়গুলো নিজ হাতে সামলে নেয়।সময় মতো প্রয়োজনীয় মেডিসিন কিনে নিয়ে আসা বা সঠিক সময়ে বাড়ি থেকে খাবারের সরবরাহ করা সব এক হাতে সামলাচ্ছে সে।তার এই দ্বায়িত্ব পরায়ণতায় অন্য রকম প্রশান্তির ছোঁয়া খুজে পাচ্ছে ঐশী।সাদাতের মন মানসিকতাও চমৎকার।সাদাতের এই অনন্য ব্যক্তিত্ব কয়েকদিনের ব্যবধানেই ঐশীর হৃদয়ের সুপ্ত এক কোণে নিজের জায়গা করে নিয়েছে।কে জানে এই জায়গায়ই তরতাজা হয়ে তার মাঝে আগ্রহের সৃষ্টি করছে কি না।
_____
সাপ্তাহিক ছুটির দিন হিসেবে শুক্রবারের সাথে শনিবারের স্থান হয়েছে অনেক পূর্বেই।সেই সূত্র ধরে আবারও দুই দিন কলেজের চাপ মুক্ত হয়েছে সাদাত।দিনটা শুক্রবার।প্রাতরাশ শেষে অলস ভঙ্গিতে মুঠোফোন স্ক্রোল করছে সে।চেহারায় স্বভাবগত গম্ভীর্যতার রাজত্ব বিরাজমান।দেহখানি চেয়ারের দেয়ালে হেলান দিয়ে রাখা।গুরুত্বপূর্ণ একটা খবরের পাতায় ডুব দিয়ে আছে সে।
একটু পরেই সেখানে তুষারের আগমন হয়।সাদাতের মনোযোগে বিঘ্ন করে বলে,

“ডেকেছিলেন দুলাভাই।কিছু বলবেন?”

তুষারের কণ্ঠ শুনে চোখ তুলে তাকায় সাদাত।স্মিত হেসে বলে,

“হুম।বিয়ের পর তো তোমার সাথে তেমন কথা বার্তা হয় নি। তাই দেখলাম একটু আলাপ করি।”

বিষ্মিত হয় তুষার।বিয়ের পর থেকে সাদাতকে দেখে তার রাশভারি গোছের লোক মনে হয়েছে।কথাও বলে কেমন মেপে মেপে।সে কি না নিজ উদ্যোগে গল্প জমাতে চাইছে।চোখে মুখে বিষ্ময়ের রেশ নিয়েই পাশের আরেকটা চেয়ারে বসে সে।কিছুসময় কাচুমাচু করলেও সাদাতের কথা বার্তার ধরনে কখন স্বাভাবিক হয়ে যায় বুঝতেই পারে না তুষার।লোকটা তো আসর জমাতে বেশ পটু।তবে গম্ভীর থাকে কেনো সবসময়,বুঝে আসে না তুষারের।অল্প সময়ের ব্যবধানেই সম্মানের পাশাপাশি দুলাভাইয়ের প্রতি মুগ্ধ হয় সে।পারিপার্শ্বিক বিষয় নিয়ে খুচরো আলাপের মাঝে যখন সাদাত অনুধাবন করে তুষারের ভিতরকার সংকোচ ও জড়তা পুরোটা কেটে গিয়েছে, তখন কথার মোড় বদলায় সাদাত।স্বাভাবিক ভাবেই তুষারের মুখ থেকে আরও একবার আনোয়ার খাঁনের হটাৎ অসুস্থ হয়ে পড়ার ঘটনার বিবৃতি শোনে সে।সবটা বর্ণনা শেষে তুষার ক্রুদ্ধ হয়ে বলে,

“সবকিছু বড় আপুর জন্য হইছে।আমাদের বংশের নিয়ম ভঙ্গ করে ও নিজে নিজের জন্য ছেলে ঠিক করে ফেলেছে।ও প্রেম না করলে আব্বুর কিছুই হতো না।আব্বুর জন্য কি ওর কোনো চিন্তা আছে নাকি?চিন্তা থাকলে তো আর বিয়ের আসর থেকে পালাতে পারতো না।”

সাদাত তীক্ষ্ণ চোখে তাকায় তুষারের দিকে।তার অভিব্যক্তি পরোখ করে বলে,

“তুমি একদম ঠিক বলেছো।আপু এমনটা না করলে কারোরই কিছু হতো না।কিন্তু বিষয়টা একটু উল্টো করে দেখলে কেমন হয় বলোতো?”

বিষ্মিত হয় তুষার।সাদাতের কথার অর্থ বোধগম্য হয় না তার নিকট।যা মুহুর্তেই ধরে ফেলে অভিজ্ঞ সাদাত।ধাতস্থ কণ্ঠে বলে,

“ধরো তুমি যদি আপুদের কাপল পিকটা বাবাকে না দেখাতে তাহলেও কিন্তু বাবা অসুস্থ হতো না।”

তটস্থ হয় তুষার।মস্তিষ্ক জেগে ওঠে।এটা তো ভেবে দেখেনি সে।গোল গোল চোখ মেলে সাদাতের দিকে তাকিয়ে থাকে সে।লোকটা যে সুকৌশলে তার ভুল ধরাতে ডেকে এনেছে তা বুঝতে কিঞ্চিৎ সময় লাগে।তড়িৎ মাথা নত করে ফেলে।সাদাত তুষারের দিকে চেয়ে স্মিত হেসে বলে,

“আসলে কি জানো?সব সময় অন্যের দোষ খোঁজাটা আমাদের মানুষ সমাজের দোষ।অথচ নিজের থলেই অসংখ্য দোষে ভর্তি, আমরা তা চেয়েও দেখি না।তুমি হয়তো ভাবছো তাবাসসুম আপুর সব দোষ, সে প্রেম না করলে তোমার বাবা অসুস্থ হতো না।অথচ একবারও ভাবলে না তুমি, তোমার বাবার কাছে এই ব্যাপারটা ওভাবে উপস্থাপন না করলে কিছু হতো না।দেখো দুই দিন পর ওদের প্রেমটা ঠিকই মেনে নিবে সবাই।ডক্টর. রাসেল এস্টাবলিশ একজন মানুষ।তোমার বোন ভুল কাওকে নিজের জীবনের জন্য চয়েজ করেনি।সবকিছু গোছানোই থাকবে,শুধু মাঝখান থেকে বাবার উপর দিয়ে ঝড় বয়ে গেলো।আর সঠিক বিচার করলে এসব কিছুর পেছনে তোমারই হাত পড়ে।আসলে সব কিছু যাচাই না করে কোনোকিছু নিয়ে ঝামেলা করতে নেই।বড়দের বুঝ বেশি,তারা সম্মানের পাত্র।তাদের সম্মান করতে শেখো।তাদের চেয়ে নিজেকে অধিক জ্ঞানী ভেবে কোনো অ্যাকশন নিলে হিতে বিপরীত হয় তা তো নিজ চোখেই দেখলে।আর মানুষের জন্ম থেকে বেড়ে ওঠা পর্যন্ত বাবা মায়ের পরেই বড় ভাই বোনের অবদান থাকে।সেই হিসেবে তোমার জন্যও আপুর অনেক ত্যাগের গল্প আছে।তাই ওনার সাথে এমন আচরণ করাটা তোমার উচিৎ হয়নি।যেখানে তুমি বাবার সম্মান রক্ষার্থে বোনের পিছনে পড়ে আছো।সেখানে তোমার নিজেকে এমন ভাবে তৈরি করা উচিৎ যেনো তোমার কারণেও বাবা মা’কে অপদস্ত হতে না হয়।তুমি ভালোর জন্যও যদি বড়দের সাথে বেয়াদবি করো তোমার পারিবারিক শিক্ষার উপর আঙুল তুলবে লোকে।এটা কি তোমার বাবার সম্মানে আঘাত হানবে না,বলো?আর বিয়ের ক্ষেত্রে একটা মানুষের নিজস্ব মতামত, পছন্দ অপছন্দ এসবের পূর্ণ অধিকার আছে।মানছি রিলেশন করা হারাম।কিন্তু জোর পূর্বক অন্য কারো সাথে বিয়ে দেওয়াটাও হাদিসে উল্লেখ নেই।তাই পূর্বে বিয়ের আসর থেকে পালানোর জন্য তাকে ব্লেইম করা অনুচিত কাজ।তার পূর্ণ অমতে বিয়ে হলে ওটা বিয়ের মধ্যেই পড়তো না।পারলে আপুর কাছে ক্ষমা চেয়ো।”

নতমুখে নিরব শ্রোতা হয়ে কথা গুলো মস্তিষ্কে গ্রথিত করলো তুষার।প্রত্যেকটা কথাই তাকে নিজের ভুল বুঝতে সহায়তা করছে।অতিরিক্ত আদরে কখন সে বেয়াদব হয়ে গিয়েছে বুঝতেই পারেনি কখনো।অনুশোচনায় মাথা নত হয়ে গিয়েছে তার।একে একে অক্ষিপটে নিজের ভুলগুলো ভেসে উঠছে।সত্যি কতোটা অন্যায় করেছে সে।তার বোনের সাথে অকারণেই চড়াও হয়েছে।অথচ দোষটা ছিলো তার।লজ্জায়, অনুশোচনায় নিশ্চুপ হয়ে বসে রয় তুষার।দরজার আড়াল থেকে এই কথাগুলো শুনে দীর্ঘশ্বাস ছাড়েন সালেহা খাঁনম।যেই কথাগুলো তাদের বলা দরকার ছিলো তা মেয়ের জামাই বলে দিলো।আসলে আনোয়ার খাঁনকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ায় এসবে খেয়ালই হয় নি তাদের।মেয়ের জামাইয়ের প্রতি সন্তুষ্টির খাতা আরও লম্বা হয়।লম্বা শ্বাস ছেড়ে চলে যায় সে।সাদাতও তুষারকে ভাবার সময় করে দিয়ে উঠে পড়ে।করিডোরের ওই চেয়ারে বসে অনুশোচনায় দুমড়ে মরে একটি প্রাণ।অনুতপ্ত মস্তিষ্ক জুরে কেবল একটি বিষয়েরই বিচরণ। অন্যায় করেছে সে।ঘোর অন্যায়।

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here