তরঙ্গিনী পর্ব-২৮ #আরশিয়া_জান্নাত

#তরঙ্গিনী পর্ব-২৮

#আরশিয়া_জান্নাত

মানুষ মুখে যতোই বলুক তার সাথে অন্যায় করা মানুষটার শাস্তি হোক। কিন্তু মনের কোথাও না কোথাও একটু হলেও কষ্ট লাগে। এই মমত্ববোধ বা মনুষ্যত্ব এখনো আছে বলেই পৃথিবী এখনো টিকে আছে। সবাই নির্মম হলে তা সম্ভব হতোনা। রেবা সবসময় চাইতো তৌকিরকে কষ্ট পেতে দেখতে। ও যেমন কষ্ট পেয়েছে তেমনটা পেতে দেখতে। রেবার মতো যাদের মন ভেঙেছে, তারা সবাইই হয়তো চায় বেঈমানদের শাস্তি হোক, অহঙ্কারের পতন ঘটুক। মজার ব্যপার হলো পৃথিবীতে আল্লাহ সবকিছুর শাস্তি না দিলেও ক্ষেত্রবিশেষে অনেকটাই দেন। সেই শাস্তি যে ভোগ করে সে অনেকসময় বুঝে আবার অনেক সময় বোঝেনা কোন পাপের শাস্তি সে পাচ্ছে। এর একটা সহজ কারণ হলো স্বভাবতই মানুষ নিজের কৃতকর্ম ভুলে যায়। তাই শাস্তি হয়না, পায়না এই কথা বলার পথ নেই।
রেবা তৌকিরকে ভালোবাসতো এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই। অতীতের বেশ বড় অংশজুড়ে যে মানুষটা ছিল তাকে এড়িয়ে গেলেও উপেক্ষা করা কি যায়? মানুষের মনটা বড়ই অদ্ভুদ। পশুপাখিকে দুটোদিন আদরযত্ন করে পোষ মানানো গেলেও মানুষকে পোষ মানানো যায়না। এই মন বড়ই নিষ্ঠুর! যুক্তি বোঝেনা, ভালোমন্দ বোঝেনা।
রেবার নিজেকে জঘন্য মনে হয়, মনে হয় ও আসলেই দুশ্চরিত্রা! নয়তো এখনো এই মন কেন তৌকিরের জন্য পুড়বে? তৌকিরের বিপদ শুনে কেন অস্থির লাগবে? ওর ভালোমন্দে ওর কি-ই বা এসে যায়? কেন সে পারছেনা আনন্দিত হতে? কোথায় বিঁধছে ওর?
রেবা ঘর অন্ধকার করে পড়ে থাকে। ওর এই মনখারাপের বিষাক্ততা ছড়িয়ে যায় পুরো শরীর জুড়ে,,

আরাফ দরজায় নক করে ভেতরে ঢোকে, লাইট জ্বালিয়ে বলে, কি ব্যাপার এমন অন্ধকারে বসে আছেন যে?

রেবা কপালের উপর থেকে হাত না সরিয়েই বলে, আলো চোখে লাগছিল,তাই।

আপনার কি শরীর খারাপ? মাথা ব্যথা করছে?

নাহ

তাহলে?

সবকিছুর কারণ থাকতে হবে? এমনি একটু শুয়ে থাকতে পারিনা? অন্ধকারে একা সময় কাটাতে পারিনা? আমায় কি একটু স্পেস দেওয়া যায়না? এতো কৈফিয়ত কেন দিতে হয়?

আপনি এতো হাইপার হচ্ছেন কেন? আমিতো জাস্ট জিজ্ঞাসা করলাম। বললেই পারতেন একা থাকতে চাইছেন।

রেবা বুঝতে পারে ও অযথাই আরাফের উপর রাগ ঝাড়ছে, কিন্তু স্যরি বলতে ইচ্ছে করছেনা তার। সে উল্টোদিকে ফিরে বলল, ভালো লাগছেনা আমার। কাইন্ডলি লাইটটা অফ করে অন্য ঘরে যান।

আরাফ লাইট অফ করে বেরিয়ে গেল। রেবা এই প্রথম তার সাথে এতো রুডলি কথা বলেছে। সে মনকে যতোই বলছে হয়তো ওর মুড অফ তাই এমন করেছে। ব্যাপার না! মন ততোই কু ডাকছে। তৌকিরকে কি এখনো ও ভালোবাসে? ওর খারাপ সংবাদ শুনেই কি তবে,,, না আর ভাবতে পারেনা। অতীতে কি ছিল না ছিল তা নিয়ে আরাফের মাথা ব্যথা নেই, তবে বর্তমানেও যদি রেবার মনে ওর জায়গায় অন্য কেউ থাকে এটা আরাফ সহ্য করবেনা। আরাফ রেবাকে অনেক ভালোবাসে, ওর যত্ন করে, ওকে বোঝার চেষ্টা করে। ও কষ্ট পায় এমন কোনো কাজ ও পারতে করেনা। এতো ডেডিকেশন, এতো এফোর্ট সবকিছুই কি ঠুনকো তৌকিরের সামনে? তৌকিরের প্রতি রেবার অনুভূতি কি এতোই তীব্র যে আরাফের ভালোবাসা সেটা নিঃশেষ করতে পারেনা?
আরাফের মন ভারাক্রান্ত হয়ে যায়, মনে হয় রেবা ওকে সত্যিকার অর্থে ভালোবাসতে পারেনি। ও এখনো অতীতেই পড়ে আছে।

আরাফকে একা বসে থাকতে দেখে সানজেনা এসে ওর পাশে বসলো।

কি ব্যাপার ভাইয়া একা বসে আছ যে?

এমনি হাওয়া খেতে এসেছি।

তুমিতো এই টাইমে নিজের ঘর থেকে বের হওনা, আজ হাওয়া খেতে এসেছ? স্ট্রেইঞ্জ!

আরাফের নিজের রাগ সংবরণ করে হেসে বলল, স্ট্রেইঞ্জের কিছু নেই। অফিসে প্রেশার বেশি পড়লে আমি মাথা ঠান্ডা করার সময় নেই।

বাবাহ! মাথা ঠান্ডা করে ওয়াইফের কাছে যাও যাতে তার উপর প্রভাব না পড়ে! কেন সে বুঝি তোমার রাগ সহ্য করে না? তাকে ভালো দিকটাই দেখাও সবসময় মন্দ দিক দেখাও না? এ কেমন সম্পর্ক?

এখানে খারাপ কি পেলে?

অবশ্যই পেয়েছি। শোনো, আমরা যখন কাউকে পছন্দ করতে শুরু করি তার ভালোদিকগুলো দেখেই পছন্দ করি, শুরুরদিকে সেসবই আমাদের চোখে পড়ে। আরেকটু সহজ করে বলি, একটা মানুষের ভালোগুণ দেখে যে আকর্ষণটা হয় সেটা হচ্ছে পছন্দের প্রথম পর্যায়, এরপর ধীরে ধীরে মন্দ দিক নজরে পড়বে। দেখা গেল মানুষটার সব ঠিক আছে কিন্তু ভীষণ ঠোঁটকাটা, মুখের উপর অপমান করে দেয়। বা মেজাজ ভীষণ তিরিক্ষ রেগে গেলে কোনো হুঁশ‌ থাকেনা। আবার হতে পারে তার কিছু বদঅভ্যাস আছে যা সে ছাড়তে পারেনা। কোনো মানুষই ১০০% পারফেক্ট না; দোষগুণ থাকবেই। তো যেসব পছন্দ এই দোষগুলি দেখার পরও কমেনা বরং আগের মতোই থাকে অর্থাৎ পছন্দের মানুষর দোষগুণ জেনেই মানুষটাকে মেনে নেওয়ার মতো মানসিকতা থাকে তখনই সেটা ভালোবাসা বলে অভিহিত হয়। তুমি তাকে তোমার ভালো দিক দেখিয়েই মুগ্ধ করছো, খারাপ দিক দেখাচ্ছ না। কতদিন থাকবে এই মুগ্ধতা বলো?

তোমার এমন কেন মনে হচ্ছে আমার খারাপ দিক ও দেখেনি?

ভেরি সিম্পল, আসার পর থেকেই শুনছি বিয়ের পর থেকে তুমি বদলে গেছ। আগের মতো রাগ নেই, ঠান্ডা হয়ে গেছ। এখন আবার তুমি নিজেই বললে মাথা ঠান্ডা করে রুমে যাবে জাস্ট বিকজ তোমার রাগ ও না দেখুক!! এসব কি আড়াল করা নয়?

তুমি কঠিন করে ভাবছো। বিষয়টা তেমন নয়।

আরাফ ভাইয়া! একটা কথা বলি শুনবে? আমরা মেয়েরা না ক্রিটিক্যাল মাইন্ডের। গোছানো পারফেক্ট ছেলে আমাদের টানেনা, আমরা মিষ্টি কথায় প্রেমে পড়লেও ভালোবাসি ঐ পাত্তা না দেওয়া ছেলেটাকেই। যে আমাদের কষ্ট দেয় তাদের প্রতিই আমাদের যত টান, যতো অনুভূতি। অথচ আমাদেরকে যে চায়, দিনরাত উজাড় করে ভালোবাসে তাদের প্রতি চাইলেও মন আনতে পারিনা। বড়জোর মায়ায় পড়ি!

আরাফ গভীর চিন্তায় মগ্ন হয়ে গেল। সানজেনার কথাই কি তবে সত্যি? এজন্যই কি রেবা,,,,,,,

কোথায় ডুব দিলে?

নাহ বলো কি বলছিলে।

কালকে আমি চলে যাবো, আর কখনো বাংলাদেশে আসা হবেনা। আর আসলেও তোমাদের সঙ্গে দেখা হবেনা হয়তো। রেবা তোমায় ভালোবাসে কি না আমি জানিনা, তবে তুমি ওকে অনেক ভালোবাসো এটা আমি নিশ্চিত। আর সেজন্যই আমার ভীষণ পুড়ছে। আরাফ ভাইয়া আমি তোমাকে অনেক পছন্দ করি, পছন্দের পরিধি কতটা হয়তো তুমি ভালোই জানো। ভয় পেও না, আমি তোমাদের মাঝে আর আসবোনা। জাস্ট কনফেস করছি। আমি চাই তুমি সুখে থাকো।
সানজেনা কিছুক্ষণ চুপ থেকে ধরা গলায় বলল, আমার ভয় তোমার এই কঠিন ভালোবাসার মর্যাদা ও দিতে পারে কি না। আমি যদি কখনো‌ সুযোগ পাই তোমার হাত ধরার, তবে সেটা ওয়েস্ট যেতে দিবোনা। Until then, আমি চুপ থাকবো। মাইন্ড ইট।

সানজেনা আরাফের কোনো কথা শোনার অপেক্ষা করলো না।
আরাফ আকাশের দিকে ঝাপসা চোখে চেয়ে রইলো। রেবা আপনি সত্যিই আমাকে ভালোবাসতে পারেননি?এসব জাস্ট সম্পর্কের জোরে গড়ে ওঠা মায়া? আপনার কাছে আমি গোছানো পুরুষ তাই ভালোবাসা নেই? কিন্তু আমি গোছানো না রেবা, আমার অনেক দোষ আছে। যন্ত্রণায় আরাফের বুক ভার হয়ে যায়।


রুহি গাল ফুলিয়ে বলল, পিহু তুই বিয়ের পর এতো বদলে যাবি আমি কল্পনাও করিনাই।

কি করেছি আবার?

কি করেছিস? আসার পর থেকেই ফাহিমের এই ফাহিমের ঐ এসব বলে বলে কান পাকাচ্ছিস। কোথায় এতোদিন পর দেখা আমার কথা শুনবি জিজ্ঞাসা করবি তা না,,, তুই তো কলে পর্যন্ত আমার সাথে বেশিক্ষণ কথা বলোস না। এতো পাষন্ড তুই!

তুই এতো রাগ করোস কেন? আমি কত বিজি থাকি জানোস? ঐখানে সবকিছু আমাকে দেখতে হয়। তার উপর নতুন নতুন বিয়ে হয়েছে সারাক্ষণ ফোন নিয়ে বসে থাকা যায় নাকি?

হুহ!

শুনেছিস একটা কথা?

কি?

কারিয়ান ভাইয়া আসছে,,,

কবে কখন?আমি জানিনা তো।

পিহু দোলনায় বসে বলল, এইতো কয়দিন পরেই আসবে। এরপর তুইও বিজি হয়ে যাবি। মন খারাপ করার সময়ই পাবিনা।

ঢং করিস না তো। উনি কি আর আমার কথা মনে রেখেছেন? এই পর্যন্ত আমাকে একটা টেক্সট পর্যন্ত করেনাই। কলেও কথা হয়েছে হাতে গণা কয়েকবার। আমার মনে হয়না তেমন কিছু হবে,,

সেটা আসলে বোঝা যাবে। দূর থেকে কিছু আঁচ করা যায়না।

হ্যাঁ রে ছোট ভাইয়ার খবর কি? সে কি এখনো নেঅওয়ার্কের বাইরে?

নাহ মাঝে একদিন কল করেছিল, পঞ্চগড় থেকে।

কবে ফিরবে বলেছে?

নাহ। ইচ্ছে হলেই একদিন হাজির হবে হয়তো।

ও না পারেও বটে। কেমন ভবঘুরে হয়ে উড়ে বেড়াচ্ছে। পৃথিবীর কোনোকিছুই ওকে ঘরে ফেরার তাড়ায় ফেলে না।

মা বলে ওকে ধরে বিয়ে দিলেই ও আটকাবে। নয়তো এভাবেই ঘুরতে থাকবে।

ছোটভাইয়া এটা জানে বলেই আসেনা। কত বছর ওরে দেখিনা,,,

আসলেই, অনেক মিস করি ওকে।

রেবা বের হয়ে আরাফের খোঁজ করতে থাকে।ঐ সময় তার সঙ্গে এমন ব্যবহার করা একদম ঠিক হয় নি। অযথাই নিজের মন খারাপের ঝাঁজ তার উপর উঠিয়েছে। না তার এখুনি ক্ষমা চাওয়া উচিত!
সারাবাড়ি খুঁজেও আরাফকে যখন পাওয়া গেল‌না রেবা তখন আরাফকে কল করে। কিন্তু আরাফ কল রিসিভ করলো না। রেবা লনে গিয়েও আরাফকে খুঁজে, সেখানেও আরাফ নেই। তবে সে গেল কোথায়? রাতে তো সচরাচর সে বাড়ির বাইরে যায় না। তবে আজ কোথায় গেল? সে কি রাগ করে কোথাও চলে গেল নাকি?

চলবে,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here