তরঙ্গিনী পর্ব-২৭ #আরশিয়া_জান্নাত

#তরঙ্গিনী পর্ব-২৭

#আরশিয়া_জান্নাত

তৌকিরের বাসায় হঠাৎ করেই রেইড করে দু*দ*ক। ওর নামে ঘু*ষ নেওয়ার এবং অ*বৈধ ডিলার পাস করার অভিযোগ উঠেছে। একটা সাধারণ সরকারী চাকুরিজীবি হয়েও কিভাবে বিলাসবহুল জীবনযাপন করছে সে, তার ইনকাম সোর্চ এর সাপেক্ষে পারিবারিক আর্থিক অবস্থা অনুযায়ী এসব যে সৎভাবে উপার্জিত নয় যে কেউ অনায়েসে আঁচ করতে পারবে। বেশি না রাইসার আলমারিভর্তি শাড়িগহনার হিসেব করতে বসলেই যে কারো চক্ষুচড়কগাছ হবে। তৌকিরের কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমা হচ্ছে, আশেপাশের সব ফ্ল্যাটের মানুষ তার দরজায় ভীড় জমিয়েছে। তৌকির দ্রুত ভাবতে থাকে কি করা যায় কাকে কল‌ করা যায়?

দু*দ*ক অফিসার ওর সব ফাইলপত্র নিয়ে পুলিশের সামনেই জিজ্ঞাসাবাদ করে। এতো অল্পদিনেই এতো টাকার মালিক হওয়ার মতো বাপ-দাদার সম্পত্তিও তার নেই,না শ্বশুড়বাড়ির আছে। তবে এসবের উৎস কি?

তৌকির মাথা ঠান্ডা রেখে বলল, আপনাদের ভুল হচ্ছে, আমি আপনাদের এক্সপ্লেইন করতে পারবো। প্লিজ আমাকে একটু সময় দিন।

আপনার বিরুদ্ধে আমাদের হাতে যথেষ্ট প্রমাণ আছে তৌকির সাহেব!

তৌকির মনে মনে বলল, এমনভাবে কস হা*লারপুত যেন এদেশে আমি একাই ঘু*ষ খাই তোরা ধোঁয়া তুলসি পাতা? সব আসছোস ধান্দা করতে বুঝি না আমি?

তৌকির মেইন পরিদর্শককে আড়ালে নিয়ে কিছু টাকা অফার করার ট্রায় করলো। বাট উনারা ঐসব কানে তুললেন না। বললেন, আপনার কে*ইসটা উপরের থেকে নজরদারি করা হচ্ছে। এখন মানে মানে ঢাকা ছাড়ার ফুরসত পান কি না ভাবুন! মনে তো হচ্ছেনা মানসম্মান আর থাকবে আপনার।

কিন্তু আমার উপরেই কেন? কে আছে এর পেছনে?

এসব তো আমরা জানবো না। আমরা জাস্ট অর্ডার পালন করছি। একটা কথা বলি আমরা সরকারী লোক সেই হিসাবে আপনি আমাদের ভাই ব্রাদার। আপনি বড় কাঁচা খেলোয়াড়। টাকার কামড় সহ্য করা খুব কঠিন। চারপাশে ভালোমতো চোখ কান খোলা রেখে আগানো উচিত ছিল আপনার। যাই হোক গ্রামে বাপ দাদার ভিটা আছে তো?

তৌকির তরতর করে ঘামতে লাগলো, তবে কি তার সব শেষ হয়ে যাবে? চাকরী যে থাকবেনা এটা নিশ্চিত। যা জুড়িয়েছে তাও কি থাকবেনা? একদম খালি হাতেই কি তবে এ শহর ছাড়তে হবে!

নিউজপেপার থেকে শুরু করে প্রতিটি চ্যানেলে ব্রেকিং নিউজ হয়ে গেল। তৌকিরের ছবি সব জায়গায়। মানুষও নতুন ইস্যু পেয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়েছে। আত্মীয়স্বজন সবাই কাটা গায়ে নুনের ছিটা দিতে কল দিচ্ছে। রাইসা নিজের গয়নাগাটি হারিয়ে পাগলপ্রায় হয়ে গেছে, অকথ্য ভাষায় তৌকিরকে গালিগালাজ করে যাচ্ছে, তার ধারণা তৌকির একটা ইউজলেস পুরুষ। নয়তো তার ঘরেই কেন দু*দ*ক আসে? ও যে এখন বাপের বাড়ি যাবে সেই মুখটাও নেই‌। এদিকে আশেপাশের সবাই যা নয় তা বলে যাচ্ছে। এসব আর সহ্য করা যাচ্ছেনা। যারা আগে চোখের দিকে চেয়ে কথা বলতে সাহস করতো না তারাও কথা শুনিয়ে যাচ্ছে। তৌকির আছে মহা ঝামেলায়। না বাইরে গিয়ে শান্তি না ঘরে শান্তি। কোথায় রাইসা তার এই বিপদের সময় সাপোর্ট দিবে, মেন্টালি সাহস জোগাবে তা না ও উল্টো বোম্বে মরিচ হয়ে পোড়াচ্ছে। এই কঠিন সময়ে এসে তৌকির রেবাকে মিস করতে থাকে। কত ইন্টারভিউ, এক্সাম সে দিয়েছে জীবনে। প্রতিবার একরাশ হতাশা ছাড়া কিছুই পায়নি। চাকরি পাওয়াই যেখানে কঠিন ব্যাপার সরকারী চাকরি তো সোনার হরিণ। অথচ রেবা সবসময় ওর পাশে থাকতো, মনোবল দিতো। ওর চাকরি হয়নি জানার পর কখনো ভ্রু কুচকে বলেনি “এখনো হলো না?” বরং সবসময় বলেছে, দেখবে একদিন খুব ভালো পদে টিকে যাবে, সেদিন এই ব্যর্থটাগুলোকেই আশীর্বাদ মনে হবে।

তৌকির নিজের ভাগ্যের উপর বিদ্রুপ করে বলতো, এইসব স্বপ্ন স্বপ্নই থেকে যাবে। বাস্তবে হবে বলে মনে হচ্ছেনা। মামা-চাচা ছাড়া এখন চাকরি মেলেনা।

রেবা ওর কাধে হাত রেখে বলতো, এতো হতাশ হচ্ছো কেন? মনোবল রাখো। জীবনে কোনোটাই স্থায়ী হয় না। না সুখ না দুঃখ। পার্থক্য এই দুঃখের সময়টা অনেক দীর্ঘ মনে হয় আর সুখেরটা স্বল্প,,,

তৌকির ভাবতে থাকে এই মুহূর্তে রাইসার জায়গায় যদি রেবা থাকতো সেও কি এমন বিহেভ করতো? নাকি আগের মতোই শান্তস্বরে স্বান্ত্বনা দিতো। মিথিলার কথাই কি তবে ফলে গেল? রেবার নিঃস্বার্থ ভালোবাসা অগ্রাহ্য করার ফলই বুঝি সে পেলো? এই চাকরি নিয়ে কত গর্বই না করেছিল সে, রেবাকে অযোগ্য বলেছে। ওর দীর্ঘ অপেক্ষাকে তুচ্ছ করে ওকে অপমান করতে কি যে আনন্দ লাগতো ওর। সবচেয়ে বেশি মজা লাগতো ওর কান্নার কল রেকর্ডিং রুমমেটদের শোনাতে। একটা মেয়ে ওর জন্য কান্নাকাটি করছে, ও গালি দেওয়ার পরো স্যরি বলছে, এসব দেখে ওর রুমমেটরা যখন বিস্মিত হতো- গর্বে ওর বুকটা ভরে যেত। অবশ্য এদের মধ্যে একজন সবসময় বলতো, দোস্ত যাই বলোস না কেন এই মেয়ের মতো মেয়ে হয় না। ওরে কষ্ট দিয়ে পাপ করিস না। ভালোবাসার মূল্যায়ন করতে শিখ। তৌকির সেসব কানেই তুলতো না। চারদিকে তার রঙিন প্রজাপতি, জীবনটা উপভোগ করার মতো অঢেল উপাদানের হাতছানি। সেই মোহে পড়ে ভুলেই গেল সব। সুখে থাকার জন্য কত কিই না করলো। দামি ফ্ল্যাট, এয়ার কন্ডিশনড বেডরুম, অসম্ভব সুন্দরী স্ত্রী। আর কি চাই এক জীবনে? অথচ ভাগ্য তাকে কোথায় এনে দাঁড় করিয়ে দিলো। আগে সে বেকার হলেও সম্মানীয় ছিল, কিন্তু এখন কোথাও মুখ দেখানোর মতো মুখও রইলো না। তৌকির গাঢ় ব্যথায় নীল হয়ে গেল। এই পৃথিবীর কোথাও কি তার লুকোনোর জায়গা নেই? সে কোথায় আত্মগোপন করে বাঁচবে?

মিথিলা– হ্যালো বান্ধবী কেমন আছোস? নিউজ পাইছোস?

রেবা– কিসের নিউজ তুই আবার কনসিভ করছোস?

মিথিলা– কি যে কস, সিজারের পর জান লইয়া বাঁচি না আবার কনসিভ, আমি বলতেছি ঐ হ্যাংলা তৌকিরের কথা। হালায় তো একদম ঠুসস

রেবা– মানে?

মিথিলা বিস্তারিত সব বলল রেবাকে।সব শুনে রেবা বলল, ওর সৎ থাকা উচিত ছিল। এতো চাহিদার দরকার ছিল না।

মিথিলা– তোর চাহিদা কম তাই তুই এমন বলছিস। খবর নিয়ে দেখ সিক্স ডিজিটের আশেপাশে জামাইয়ের ইনকাম না হইলে অনেক মেয়েরা ঘরে ঢুকতেও দেয় না। যাদের যত টাকা তাদের ততো বেশি ক্ষুধা। এজন্য তোর ভাইয়া বলে, বৌয়ের জিহ্বা যত ছোট স্বামীর ইনকাম ততো হালাল।

তুই ওই বেচারির দোষ দিচ্ছিস কেন? তৌকির যদি ভালো হতো তাহলে এতোকিছু হতো না। এখানে বৌয়ের কি দোষ?

সিরিয়াসলি ভাই তোর এটা মনে হয়? শোন তোরে একটা গল্প বলি। একটা লোক ছিল যার স্ত্রী তাকে সবসময় একটা লম্বা লিস্ট ধরিয়ে বলতো আজ এসব লাগবে, যেভাবে পারো নিয়ে আসবে। তো স্বামী বেচারা যেখানে যেভাবে পারে টাকা আয় করে স্ত্রীর ঐ লিস্ট সম্পূর্ণ আনে। তো স্ত্রী ভাবে আরেহ বাহ আমার স্বামীর তো অনেক টাকা। অথচ সে জিজ্ঞাসা করেনা এটা কিভাবে এলো- ন্যায়পথে নাকি ভুল পথে। সে কেবল নিজের চাহিদার লিস্ট বানাতেই ব্যস্ত। একদিন ঐ লোকটা এক শায়েখের কাছে গিয়ে বিষয়টা বলে, তখন শায়েখ বলে দেখুন আপনার কৃতকর্মের জবাব আপনাকে দিতে হবে, আপনি যাদের জন্য অবৈধ ইনকাম করছেন তাদের আমলনামায় কিছুই আসবে যাবে না। না তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। এখন আপনিই সিদ্ধান্ত নিন আপনি কি করবেন।
পরে লোকটি ঐ নারীকে তালাক দিয়ে অন্য এক নারী বিয়ে করে। এবারের পরহেজগার স্ত্রী তাকে রোজ সকালে বলে শুনুন, যেখানেই রিজিকের সন্ধানে যাচ্ছেন মাথায় রাখবেন হারামের টাকায় বরকত নেই। আল্লাহ রিজিকে যা রেখেছেন অল্প হলেও হালালটাই চাই। আমি চাই না আপনি আমার জন্য জাহান্নামীদের খাতায় নাম তুলেন। তাই সৎ পথে থাকবেন। ইনশাআল্লাহ আল্লাহই বরকত দিবেন। লোকটা নিশ্চিন্ত মনে সৎ পথেই ইনকাম করে, কোনোদিম কম কোনোদিন বেশি।অল্প হলেও তার স্ত্রী অসন্তুষ্টি প্রকাশ করেনা বরং শোকর আদায় করে। গল্পটা শুনে কি বুঝলি?

গল্পটা আমিও শুনেছি। তবে তুই জগাখিচুড়ি বানাইছোস মনে হচ্ছে।

মোরাল অফ দ্য স্টোরি ঐটাই ছিল। আমিতো মুখস্ত করে বসে থাকি নাই।

তবুও বোইন কারো সম্পর্কে খারাপ ধারণা রাখা ঠিক না।

তুই আসলেই সাফ দিলের মেয়ে। তুই খুশি না হইলেও আমি অনেক খুশি হইছি। বহুত উড়ছিল হারামজাদা। এখন এক্কেবারে জমিনে পইড়া চিৎপটাং হইয়া গেছে। সরকারী চাকরি পা** শিক ডু*কাই দিছে। এখন জেলে বইসা ভাব মারা সরকারী খানা খাচ্ছস যে তার। হেহেহে।

তুই এতো খারাপ ভাষায় কথা বলতে পারোস! উফফ

শোন নূর আমার কথা শুনে তোর মেজাজ গরম হতেই পারে। আমি কথায় রাগ ঝেড়ে ফেলি বলেই আমার বিপি নরম্যাল থাকে। নয়তো কত আগেই রাগের জন্য মরে যাইতাম।

তাও যা বলছোস।

যাক তোর খবর বল, কি হালে আছিস?

আছি ভালো তোর কি খবর?

ভালোই। এখন তো আরো বেশি ভালো।

তুই সিলেট আসবি কবে?

আমার এতো সময় আছে? বড়টারে স্কুলে দিছি তো। আরেক বন্দিজীবন শুরু। এখন বললেই আর ঘুরতে যাওয়া যাবেনা। বাচ্চাকাচ্চা হওয়ার আগেই ঘুরে নে। এরপর আর পারবি না।

তোর অনেক কষ্ট হয়, না রে?

আরেহ না। দিনশেষে ওদের দেখলে মন ভরে যায়। পরের জন্য তো খাটতেছি না, নিজের স্বামী আর সন্তানের জন্যই করতেছি। জীবন এতেই সুন্দর। আমরা মেয়েরা সবসময় এটাতেই শান্তি পাই,,, কষ্ট হলেও প্যারা নাই।

ঠিক বলছোস।

আচ্ছা দোস্ত রাখি, তোরে খবরটা দেওয়ার জন্যই পেট গুড়গুড় করতেছিল। এখন অল ক্লিয়ার। কি যে শান্তি লাগছে তৌকিরের নিউজ দেইখা। সব তোর অভিশাপ বুঝছোস।

নারেহ আমি অভিশাপ দেই না। ওর পরিবারের কথা ভেবে খারাপ লাগছে।

তুই পারোসও। ঢঙ্গী। ভালো থাকিস বায়

তুইও ভালো থাকিস, টাটা।

রেবা বেলকনী দিয়ে সুদূর নীল আকাশে চেয়ে রইল। এটা সত্যিই নিয়তির খেলা? আল্লাহ সত্যিই এভাবে পরাস্ত করলো তৌকিরকে নাকি এ নিছকই কাকতালীয় ব্যাপার? আচ্ছা তৌকিরের ছেলেটার কি হবে??

চলবে,,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here