তুমি_শুধু_আমারই_হও লেখনীতে- অরনিশা সাথী |অন্তিম পর্ব|

#তুমি_শুধু_আমারই_হও
লেখনীতে- অরনিশা সাথী

|অন্তিম পর্ব|

ভোরের আলো ফোটার সাথে তাল মিলিয়ে অর্নি-উৎসব, অর্নব-টায়রা, নূর-শান্ত এই তিন দম্পতির জীবনেরও নব সূচনা হলো। একটা নতুন সকাল, নতুন পরিবেশ, নতুন সম্পর্ক। নিজের ভালোবাসার মানুষটাকে সারাজীবনের জন্য নিজের বন্ধনে বেঁধে ফেলার আনন্দ। ভালোবাসার মানুষটাকে সম্পূর্ণ নিজের করে নেওয়ার আনন্দ। ভালোবাসার মানুষটার সুখ দুঃখ সবকিছু ভাগ করে নিজের নামে নেওয়ার আনন্দ। সব সবকিছু যেন আজ অন্যরকম সাজে সেজে উঠেছে। সকলের মুখে এক অন্যরকম তৃপ্তির হাসি। সকলেই তার ভালোবাসার মানুষটাকে সারাজীবনের জন্য নিজের করে নেওয়ায় সফল হয়েছে। নিজেদের ভালোবাসায় সফল হয়েছে ওরা। জীবনটাকে যেন আজ অদ্ভুত রকমের সুন্দর লাগছে সকলের কাছে। যে যাকে চেয়েছে সে শুধু তাকেই পেয়েছে। তিন-জোড়া মানুষের ভালোবাসা পূর্ণতা পেয়েছে।

আত্নীয় স্বজন সকলেই চলে গেছে। এখন শুধু অর্নব টায়রা, উৎসব অর্নি, নূর শান্ত, তরী রুশান, ইশা নেহাল এবং আয়ান আছে। মিসেস অদিতি, শায়লা বেগম-নিলয় আবরার, এবং শান্ত’র পরিবার সকাল সকাল বেরিয়ে গেছেন। ঢাকায় ফিরে আবার নতুন বউ বরণের বন্দবস্ত করতে হবে তো। সাথে টায়রার পরিবারও ফিরে গেছে উনাদের সাথে। দুটো গাড়ি রেখে যাওয়া হয়েছে এখানে। একটাতে, অর্ন-টায়রা, তরী-রুশান, নেহাল এবং আয়ান যাবে৷ আর অন্যটাতে, নূর-শান্ত, অর্নি-উৎসব এবং ইশা যাবে৷ ঢাকায় ফিরে আলাদা গাড়ি করে যার যার বাড়ি ফিরবে।

মাত্রই সকালের খাবার শেষ করলো সকলে। সবাই মিলে গার্ডেন এরিয়ায় বসে আড্ডা দিচ্ছে। আড্ডার টপিক ভালোবাসা। উৎসব অর্নির দিকে ক্ষানিকটা ঝুঁকে বললো,
–“বলেছিলাম #তুমি_শুধু_আমারই_হও, আর আমার চাওয়াকে পূর্ণ করে আমার ভালোবাসায় সাড়া দিয়ে তুমি শুধু আমারই হয়েছো। তার জন্য এক আকাশ সম ভালোবাসা বউ।”

উৎসবের কথায় অর্নি লজ্জায় মাথা নিচু করে নিলো। সেখানে উপস্থিত সকলেই মৃদু হাসলো উৎসবের কথায়। টায়রা ওর হাতের কুনই দিয়ে অর্নবের পেটে গুঁতো দিয়ে বললো,
–“বউকে কিভাবে ভালোবাসতে হয়, কিভাবে রোমান্টিক রোমান্টিক কথা বলতে হয়, কিভাবে বউয়ের মন বুঝতে হয় শিখো কিছুটা। দেখছো উৎসব কি সুন্দর ভাবে অর্নিকে কথাগুলো বললো?”

অর্নব টায়রার দিকে ঝুঁকে ফিসফিস করে বললো,
–“কাল রাতে বুঝি ভালোবাসি নি আমি? সে ভালোবাসায় পোষায়নি তোমার? ব্যাপার না আজ রাতে একেবারে পুষিয়ে দিবো।”

–“অসভ্য।”

অর্নব হাসতে হাসতেই সরে গেলো টায়রার কাছ থেকে। শান্ত একবার দুই জুটিকে পরখ করলো। তারপর নূরকে বললো,
–“এই নূর, #তুমি_শুধু_আমার_হও প্লিজ।”

নূর ভ্রু কুঁচকে তাকালো। বললো,
–“তো আমি কি অন্যকারো নাকি? আমি তো আপনারই, কালই তো সারাজীবনের জন্য বাঁধা পড়লাম আপনার সাথে।”

শান্ত দাঁত দিয়ে জীব কাটলো। স্যরি বলার ভঙ্গিতে বললো,
–“উপস, আমি তো ভুলেই গেছিলাম তুমি শুধু আমারই।”

শান্ত আর নূরের পাশেই রুশান তরী বসা ছিলো। ওদের দুজনের কথা শুনে তরী মৃদু শব্দ করেই হেসে দেয়। নূর চোখ রাঙিয়ে তাকায় তরীর দিকে। তরী ইশারায় স্যরি বলে। রুশান বললো,
–“বউ দিনে দিনে অন্যের কথায় আড়ি পাতার স্বভাব হচ্ছে তোমার। এটা কিন্তু ভালো না।”

তরী রাগী চোখে তাকিয়ে বললো,
–“মোটেও আমার আড়ি পাতার স্বভাব নেই। পাশাপাশি বসে আছি তাই শুনতে পেয়েছি। আর তাছাড়া অন্যের ভালোবাসাময় কথা শুনতে ভালো লাগেই।”

–“হ্যাঁ শুধু আমার ভালোবাসাগুলো হজম করতেই কষ্ট হয় তোমার তাই না?”

–“কারেক্ট, তোমার ভালোবাসাগুলো হজম করতে সত্যিই আমার কষ্ট হয়। তোমার অত ভালোবাসার লোড আমার এই ছোট্ট দেহখানা নিতে পারে না।”

রুশান অসহায় চোখে তাকালো। মলিন স্বরে বললো,
–“হ্যাঁ, বিয়ের পর থেকে তাই তো দেখছি। উৎসব ভাইয়ের ওরকম পাগলামী, লাভ টর্চারগুলো অর্নি সহ্য করতে পারে। আর আমি তো উৎসব ভাইয়ের মতোও না সেখানে তুমি___”

–“এই এক মিনিট, তুমি বুঝলে কি করে উৎসব ভাই পাগলামি করে, লাভ টর্চার করে।”

রুশান তরীর কাছ ঘেঁষে বসে বললো,
–“আরেহ মানুষ দেখেই বোঝা যায়। দেখোনি উৎসব ভাই অর্নিকে পাওয়ার জন্য কি রকম পাগলামী করেছে? কতটা ভালোবাসে অর্নিকে? যে মানুষটা অর্নিকে এত ভালোবাসে সে মানুষটা এখন অর্নিকে নিজের করে পেয়ে লাভ টর্চারগুলো তো করবেই তাই না?”

তরী ছোট ছোট চোখে তাকালো রুশানের দিকে। রুশান ফিক করে হেসে দিলো। আরো কিছুক্ষণ আড্ডা চললো এভাবে। অতঃপর এগারোটা নাগাদ সবাই গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়লো ঢাকার উদ্দেশ্যে।

গাড়ি চলতে শুরু করেছে ঢাকার উদ্দেশ্যে। উৎসব ড্রাইভ করছে। পাশেই অর্নি বসা। পেছনে বসেছে নূর শান্ত এবং ইশা। নূর জানালার সাইডে বসেছে। ওর পাশেই শান্ত। তারপর বেশ কিছুটা দূরত্বে ইশা বসেছে অপরপাশের জানালা ঘেঁষে। অর্নি জানালার উপর হাত রেখে তাতে থুতনি ঠেকিয়ে বসেছে। ওর পেছনে নূরও সেইম ভাবেই বসেছে। দুজনেই বেশ মুগ্ধ চোখে বাইরের পরিবেশ দেখছে। এই যে দ্রুত গাড়ি চলছে, যার ফলে শাঁ শাঁ করে বাতাসের শব্দ আসছে কানে। পেছনে সুন্দর সুন্দর দৃশ্য গুলো ফেলে আসছে। এসব বেশ উপভোগ করছে ওরা দুজনে। মাঝে মধ্যে তো আবার হাত বাইরে দিচ্ছে। এ নিয়ে উৎসব বেশ কয়েকবার রাগারাগিও করেছে। কিন্তু কে শোনে কার কথা? অর্নি আর নূর নিজেদের মতো করে সময়টাকে উপভোগ করছে। পাহাড় গুলো পেরিয়ে যাওয়ার সময় অর্নি বায়না ধরে গাড়ি থামানোর জন্য। ওর সাথে নূরও ক্ষানিকটা তাল মেলায়। তাই উৎসব বাধ্য হয়েই একটা চায়ের দোকান দেখে গাড়ি থামায়। ওদের গাড়ি থামতে দেখে পেছনে অর্নবও গাড়ি থামায়। অর্নি উৎসব ওরা সকলেই গাড়ি থেকে নেমে যায়। অর্নব গাড়ির জানালা দিয়ে মাথা বের করে জিজ্ঞেস করলো,
–“কি ব্যাপার? সবাই নেমে পড়লো যে?”

উৎসব সেদিকে তাকিয়ে বললো,
–“আপনার বোনের আবদার গাড়ি থামাতে হবে এখানে। জায়গাটা নাকি তার ভীষণ মনে ধরেছে।”

অর্নব মুচকি হাসলো বোনের পাগলামিতে। সাথে ভালো লাগা কাজ করলো উৎসবের প্রতি। ওর বোনের ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতম ইচ্ছেকেও বেশ প্রাধান্য দেয় ছেলেটা। ততক্ষণে টায়রা তরী ওরা সকলেই নেমে পড়েছে গাড়ি থেকে। নেহাল অর্নবের সামনে গিয়ে বললো,
–“কি ব্যাপার? তুই কি গাড়িতেই বসে থাকবি নাকি?”

নেহালের কথায় ধ্যান ভাঙলো অর্নবের। গাড়ি থেকে নেমে পড়লো দ্রুত। সকলে মিলে টং দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে চায়ের আড্ডা দিলো বেশ কিছুক্ষণ। অর্নি নূর রুশান এবং তরী চারজনেই পাহাড়ের সাইডে চলে গেছে ছবি তুলতে। এই নিয়ে উৎসব অর্নব শান্ত’র বেশ বারণ ছিলো। অর্নি এক সময়ে টেনে উৎসবকে নিয়েও ওর সাথে বেশ কয়েকটা ছবি তুলে। অর্নবকে চায়ের বিল দিতে দেখে উৎসব সেদিকে এগিয়ে যায়। উদ্দেশ্য ও বিল দিবে। অর্নি ওরা তখনো ছবি তোলায় ব্যস্ত। টায়রা, আয়ান, ইশা, নেহাল ওরা চারজনে টং দোকানের এক পাশে দাঁড়িয়ে আড্ডা দিচ্ছে। ইশা আড্ডা দিচ্ছে বললে ভুল হবে। ও চুপচাপ সকলের কথা শুনছে। ওদের সাথে ওর তেমন একটা সখ্যতা গড়ে না উঠায় ও পুরোপুরিভাবে মিশতে পারছে না। অর্নব আর উৎসবও এগিয়ে এলো সেদিকে। সবাই মিলে আড্ডা দিচ্ছে। উৎসব বারবার অর্নি ওদের দিকে তাকাচ্ছে। ও এখানে থাকলেও ওর মনটা অর্নির ওখানে আছে। পাহাড় ঘেঁষে রাস্তাটা অনেক দূর চলে গেছে। রাস্তার অপর পাশেই বড় একটা খাদ আছে। বিপদের কথা তো আর বলা যায় না। যদিওবা ওরা খাদ থেকে বেশ অনেকটা দূরেই আছে। তবুও উৎসব নজর রাখছে সেদিকে বারবার। এদিকে নেহালও আজ নিজের অজান্তেই বারবার তাকাচ্ছে অর্নির দিকে। মেয়েটাকে যেন আজ অন্যরকম সুন্দর লাগছে। ও বুঝতে পারছে এটা ঠিক না। অর্নি এখন উৎসবের বউ তবুও বারবার নিষিদ্ধ জিনিসটার উপরই চোখ যাচ্ছে। নেহাল নিজেকে সামলে নিয়ে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিলো। মনোযোগ দিলো সকলের সাথে আড্ডায়। তবুও বেহায়া মন ঘুরেফিরে অর্নির দিকেই যেতে চাচ্ছে। নেহাল বহু কষ্টে নিজের মনকে বেঁধে রাখছে। ও চায় না ওর জন্য অর্নি উৎসবের ভালোবাসায় কোনরূপ ফাঁটল ধরুক। কিন্তু ভালোবাসাটা তো মনের ব্যাপার। মস্তিষ্কের কথা তো আর মন মানবে না।

অর্নি রুশান নূর ওরা আশপাশটা ঘুরে দেখছে। ভীষণ ভালো লাগছে যায়গাটা ওদের কাছে। অর্নি চলতে চলতেই বললো,
–“এই জায়গাটা আমার এত্ত ভালো লেগেছে আমি ভাষায় প্রকাশ করতে পারবো না। আজীবন আমার স্মৃতির পাতায় এই জায়গাটা থেকে যাবে।”

রুশান হেসে অর্নির মাথায় গাট্টা মেরে বললো,
–“কত জায়গা-ই তো তোর স্মৃতির পাতায় থাকবে বলেছিলি, সেসব কি আছে এখনো? নাকি গুলিয়ে খেয়ে ফেলেছিস?”

অর্নি চোখ কটমট করে তাকালো রুশানের দিকে। নূর রুশানকে বললো,
–“এই রুশাইন্নায়ায়ায়া, তোর সাহস তো কম না আমার ভাবীর মাথায় গাট্টা মারিস তুই, একদম ধাক্কা দিয়ে খাদে ফেলে দিবো কিন্তু বলে দিলাম।”

অর্নি মুচকি হেসে নূরকে জড়িয়ে ধরলো একপাশ থেকে। রুশান মলিন স্বরে বললো,
–“হ্যাঁ তোরা দুজন তো একজোট হবিই, আগেই একজোট ছিলি আর এখন তো দুজনে ননদ ভাবী।”

রুশানের কথায় অর্নি আর নূর ফিক করে হেসে দিলো। এদিকে তরী আর শান্ত মুচকি হাসলো ওদের তিনজনের কান্ডে। উৎসব ডেকে গাড়িতে বসতে বললো সবাইকে। চলে যাবে এখন। তাই ওরা গাড়ির দিকেই এগোচ্ছে।

সবাই একসাথেই গাড়ির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। অর্নির ফোনটা নিচে পড়ে যাওয়ায় ও সবার পেছনে পড়ে গেলো। ওর থেকে হাত দুয়েক দূরত্বে নূর হাঁটছে। নূর পিছন ফিরে দেখলো অর্নি মাটি থেকে ফোন তুলে নিলো। নূর বললো,
–“তাড়াতাড়ি পা চালা, ভাইয়া পরে আবার চটে যাবে।”

অর্নি মুচকি হাসলো নূরের কথায়। নূর সামনে ফিরে আবারো হাঁটতে শুরু করলো। হঠাৎ কিছু একটা মনে হতেই দ্রুত গতিতে পেছন ফিরে তাকালো নূর। দেখলো একটা গাড়ি ধেয়ে আসছে এদিকেই। আর কিছুটা হলেই অর্নিকে ধাক্কা মেরে দিবে গাড়িটা। নূর ‘অর্নি’ বলে চিৎকার করে এগিয়ে গেলো অর্নির দিকে। দ্রুত অর্নির হাত ধরে টেনে একসাইডে নিয়ে এলো। দূর্ভাগ্যবশত খাদের দিকেই এসে পড়লো দুজনে। কোনো কিছু বুঝে উঠার আগেই স্লিপ কেটে খাদে পড়ে গেলো নূর। অর্নি হাত বাড়ায় সেদিকে। কোনোরকমে নূরের আঙুল স্পর্শ করে অর্নি। পুরো হাত আকঁড়ে ধরতে পারেনি। নূরের ওড়নাটা চলে আসে অর্নির হাতে৷ এদিকে প্রথমে নূরের চিৎকার শুনেই সকলে এগিয়ে আসে। কিন্তু এসেই যে এরকম একটা কিছু দেখবে তা মোটেও কল্পনা করেনি কেউ। অর্নি নূরের ওড়নাটা বুকে আগলে নিয়ে চিৎকার করে নূরের নাম ধরে ডেকে সেন্স হারায় সেখানেই।

ঘটনার আকস্মিকতায় সকলেই বাকরুদ্ধ হয়ে যায়। অর্নব টায়রাকে উদ্দেশ্য করে বললো,
–“অর্নির চোখ মুখে পানি দিয়ে জ্ঞান ফেরানোর ব্যবস্থা করো।”

অর্নবের কথায় তরী আর টায়রা তাই করলো। শান্ত’র পাগলামি শুরু হয়েছে। খাদের ধাড়ে বসে পাগলের মতো আচরণ করছে আর নূরকে ডাকছে। ওদিকে উৎসবের পা আটকে আছে আগের জায়গাতেই। নিজের চোখের সামনে আদরের ছোট বোনটাকে খাদে পড়ে যেতে দেখেও কিচ্ছুটি করতে পারলো না ও। রুশানের অবস্থাও করুন। নেহাল আর ইশা শান্তকে সামলানোর চেষ্টা করছে। আয়ান লোকাল থানায় ফোন করে জানালো ঘটনাটা। ক্ষানিক সময়ের মাঝেই পুলিশ ফোর্স চলে এলো সেখানে। তারা তল্লাসি চালাচ্ছে জায়গাটা। কয়েকজন পুলিশকে খাদে নামানো হয়েছে। উৎসবের মতো শক্ত মানুষটাও কাঁদছে আজ চোখের সামনে নিজের বোনের এই পরিনতি দেখে।

অর্নির জ্ঞান ফিরতেই পাগলামি শুরু করে দিলো ও। রুশানের গলা জড়িয়ে ধরে কাঁদছে ও। রুশানও কাঁদছে। তিনজনের বন্ধুত্ব খুবই স্ট্রং ছিলো। তিনিটা দেহে যেন একটাই প্রান ছিলো। প্রানপ্রিয় সেই বন্ধুর এরকম অবস্থায় নিজেকে সামলে রাখা বড্ড কঠিন। অর্নি নূরের ওড়নাটা বুকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বললো,
–“আ্ আমার জন্য, আমার জন্য নূর ওখানে পড়ে গেলো। আমি, আমি মেরে ফেলেছি ওকে। নূরকে আমি মেরে___”

কথাগুলো বলতে বলতে আবারো সেন্স হারায় অর্নি।

দুদিন চলে গেলো এর মাঝে৷ নূরের কোনো হদিশ পাওয়া যায়নি। শায়লা বেগম আর নিলয় আবরারের অবস্থা খুবই খারাপ। একমাত্র মেয়ের সাথে এরকম ঘটনা ঘটেছে মেনে নিতে পারছে না উনারা। সুখি পরিবারটাতে যেন হঠাৎই বিষাদের ছায়া নেমে এলো। অন্ধকারে ডুবে গেলো পরিবারটা। সাথে শান্ত’কেও রেখে গেলো নিকষ কালো অন্ধকারে। আজ আবারো সেই খাদের কাছে এসেছে উৎসব শান্ত অর্নব রুশান। অর্নি আসতে চেয়েছিলো বার বার। উৎসবই আনেনি ওকে। উৎসব ওদের সাথে পুলিশের উচ্চপদস্থ দুজন কর্মকর্তাও আছেন। একজন বললেন,
–“স্যার খাদটা অনেক গভীর, ওখানে কেউ পড়ে গেলে তার বাঁচার চান্স একদমই নেই। আমাদের যতদূর মনে হয় উনি বেঁচে নেই।”

এমন কথায় রেগে গেলো শান্ত। পুলিশের কলার চেপে ধরে বললো,
–“বেঁচে নেই মানে কি হ্যাঁ? বেঁচে নেই মানে কি বোঝাতে চাচ্ছেন আপনারা?”

অর্নব শান্তকে ছাড়িয়ে নিলো। শান্ত হতে বললো ওকে৷ উৎসব একধ্যানে গভীর খাদটার দিকেই তাকিয়ে আছে। অর্নব বললো,
–“বাঁচার চান্স নেই বুঝলাম। কিন্তু বডিটা? বডিটা নিশ্চয়ই পাওয়া যাবে। আপনারা___”

আরেকজন পুলিশ কর্মকর্তা বললেন,
–“স্যার আমাদের টিম লাস্ট দুদিন ধরে অনেক খোঁজাখুঁজি করেছে। কিন্তু কোনো লাভ হয়নি। কোনো বডি পাওয়া যায় নি খাদে।”

উৎসব এবার রেগে গেলো। চিৎকার করে বললো,
–“তাহলে বলছেন কি করে বেঁচে নেই আমার বোন? কোনো এভিডেন্স ছাড়া আপনারা আমার বোনকে মৃত ঘোষণা করতে পারেন না অফিসার।”

–“স্যরি স্যার, এই মূহুর্তে কোনো এভিডেন্স নেই আমাদের হাতে। তবে এটা মানতেই হবে এখান থেকে একবার কেউ পড়লে তার বাঁচার চান্স একদমই নেই।”

–“ওকেহ ফাইন, মেনে নিলাম আপনার কথা। আমার বোন বেঁচে নেই। তাহলে ওর বডি দেখাতে পারছেন না কেন আমাদের?”

–“মেবি আমাদের টিম ওখানে পৌঁছানোর আগেই কোনো জীব জন্ত___”

উৎসবের এবার নিজেকে সামলে রাখতে কষ্ট হলো। পুলিশের দিকে এগিয়ে গিয়ে বললো,
–“এই অফিসার একদম___”

অর্নব টেনে নিয়ে গেলো উৎসবকে। পুলিশকে স্যরি বলে উৎসবের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। বললো,
–“মাথা গরম করছো কেন উৎসব? ভালো ভাবে ভেবে দেখো খাদটা অনেক গভীর। এত উচুঁ থেকে পড়লে বাঁচার চান্স সত্যিই খুব কম।”

উৎসব এবার নিজেকে সামলে রাখতে পারলো না। অর্নবকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে দিলো। অর্নব উৎসবের পিঠে হাত বুলিয়ে বললো,
–“শান্ত হও উৎসব। তুমি এভাবে ভেঙে পড়লে আংকেল আন্টিকে কে সামলাবে? শান্ত’র কথাটা ভাবো একবার। ওর মনের অবস্থাটা বুঝো একবার।”

উৎসব অর্নবকে ছেড়ে চোখের পানি মুছে নিলো। শান্ত’র কাছে গিয়ে জড়িয়ে ধরলো ওকে৷ ছেলেটাও উৎসবের সান্নিধ্য পেয়ে হুঁ হুঁ করে কেঁদে উঠলো।

সময় কারো জন্য থেমে থাকে না। সে তার আপন গতিতে চলে। এর মাঝে কেটেছে অনেক গুলো দিন। নূর খাদে পড়ে যাওয়ার ছয় মাস হলো আজ। সেই খাদের ধারেই গাড়ি থামিয়ে গাড়ির ডিকির উপর বসে আছে শান্ত৷ এই ছয় মাসে ছেলেটা আর নিজের মাঝে নেই। শুকিয়ে কাট হয়ে গেছে। অযত্নে বেড়ে চলেছে চুল দাঁড়ি। একধ্যানে খাদের দিকে তাকিয়ে আছে শান্ত। অস্ফুটস্বরে বললো,
–“নূর? এই নূর, শুনতে পাচ্ছো তুমি? আমি সত্যিই ভালো নেই তোমাকে ছাড়া। বলেছিলাম তো #তুমি_শুধু_আমারই_হও তাহলে আজ আমাকে ছেড়ে কেন চলে গেলে তুমি? আমাকে ছেড়ে যাওয়ার আগে একটাবারের জন্যও আমার কথা মনে হলো না তোমার?”

একা একা আরো অনেক কথাই বলে যাচ্ছে শান্ত। কিছুটা স্পষ্ট আবার কিছুটা অস্পষ্ট। এমন সময় উৎসবও গাড়ি নিয়ে এলো সেখানে। শান্তকে বসে থাকতে দেখে ওর থেকে অনেকটা দূরত্বে গিয়ে গাড়ি থামালো ও। শান্তকে একা ছেড়ে দিলো কিছু মূহুর্তের জন্য।

গাড়ি থেকে নেমে রাস্তার ধারেই ঘাসের উপর বসে পড়লো উৎসব৷ সামনেই বিশাল খাদ৷ এই খাদেই পড়ে গেছে ওর আদরের ছোট বোনটা। উৎসব পকেট থেকে একটা ভাজ করা কাগজ বের করলো। কাগজটা খুলে চোখ বুলালো একবার। দুই ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়লো কাগজটার উপর। এটা অর্নির রেখে যাওয়া লাস্ট চিরকুট। হ্যাঁ ঠিকই ধরেছেন, অর্নিরই রেখে যাওয়া লাস্ট চিরকুট। যাতে লিখা আছে,
–“উৎসব, ক্ষমা করবেন আমাকে। আমি বাঁচাতে পারিনি নূরকে৷ আমাকে গাড়ি এক্সিডেন্টের হাত থেকে বাঁচাতে গিয়েই নূর খাদে পড়ে যায়। ও ওর বন্ধুকে বাঁচাতে পারলেও আমি আমার বন্ধুকে বাঁচাতে পারিনি উৎসব। আমার জন্য, শুধুমাত্র আমার জন্যই এমনটা হয়েছে আজ।
আমি আপনাদের কারো সামনে দাঁড়ানোর সাহস পাচ্ছি না উৎসব। পারলে ক্ষমা করে দিয়েন আমাকে। আর খোঁজার চেষ্টা করবেন না প্লিজ।
ওহ আর একটা কথা, যদি সম্ভব হয় তাহলে আপনি শুধু আমারই থাকবেন প্লিজ। আপনার কথাই আজ আপনাকে বলছি আমি উৎসব, #তুমি_শুধু_আমারই_হও।”

চিঠিটা পড়ে চোখ বন্ধ করে নিলো উৎসব। ওর অর্নিও ওর কাছে নেই। নূর খাদে পড়ার দুদিনের মাথায়ই অর্নি এই কাগজটা উৎসবের ল্যাপটপের উপর রেখে চলে যায় বাড়ি ছেড়ে। উৎসব সেদিন এখানেই ছিলো। শান্ত যখন ওকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছিলো তখনই বাসা থেকে ফোন আসে অর্নিকে পাওয়া যাচ্ছে না৷ সেই থেকেই মেয়েটা নিখোঁজ হয়ে আছে। হাজার চেষ্টা করেও কোথাও কোনো খোঁজ পায়নি অর্নির। সারা শহর তন্নতন্ন করে খুঁজেও লাভ হয়নি। নিউজপেপার, নিউজ চ্যানেল সব জায়গায় অর্নির খোঁজ লাগিয়েছে উৎসব। কোথাও থেকে কোনো খবর আসেনি। পাগলের মতো খুঁজেছে অর্নিকে। পাগল পাগল অবস্থা ছিলো উৎসবের। একসাথে দুটো ধাক্কা সামলাতে বেশ বেগ পেতে হয়েছে উৎসবকে। আকাশ পানে তাকিয়ে উৎসব বললো,
–“তোমাদের দুজনকেই আমাকে ছেড়ে যেতে হলো? নূরকে হারিয়ে তোমাকে আকড়ে ধরে বাঁচতে পারতাম তো অর্নি। তাহলে তুমিও কেন আমাকে একা করে এই অসহায়ত্বের মাঝে ফেলে গেলে? কেন অর্নি কেন?”

দুইটা জায়গাতে বড্ড খটকা লাগে৷ প্রথমত অর্নির চিঠিতে উল্লেখিত এক্সিডেন্টের কথা। আর দ্বিতীয়ত অর্নির এভাবে বাসা ছেড়ে চলে যাওয়াটা। অর্নি লিখে গেছে এক্সিডেন্টের হাত থেকে ওকে বাঁচাতেই নূর খাদে পড়ে যায়৷ এক্সিডেন্ট’টা কি তাহলে স্বাভাবিক ছিলো? আর অর্নির এভাবে বাড়ি ছেড়ে যাওয়ার কারণটাও রহস্য মনে হয়। শুধুমাত্র এই কারণে বাড়ি ছেড়ে যাওয়ার মেয়ে অর্নি নয়। যেখানে আগের দিন রাতেও উৎসবের বুকে মাথা রেখে এত করে কাঁদলো মেয়েটা সেখানে তারপর দিনই কিনা জাস্ট একটা চিঠি লিখে রেখে বাড়ি ছেড়ে চলে গেলো অর্নি? কি সত্যি লুকিয়ে আছে এসবের পেছনে? আর কে আছে? আর অর্নিই বা কোথায় আছে? আর কিভাবে আছে? নূর কি বেঁচে আছে? নাকি সত্যিই বেঁচে নেই নূর? আর বেঁচে থাকলেও কোথায় আছে নূর?

সমাপ্ত~

|অবশেষে ইতি টানলাম এই গল্পেরও। প্রতিটা গল্পই যে হ্যাপি এন্ডিং হয় তা না। এই গল্পটা হ্যাপি বা স্যাড এন্ডিং কোনোটার মাঝেই পড়ে না৷ এই গল্পটা শেষ হইয়াও হইলো না শেষ।
লেখিকার চিন্তাভাবনা যেখানে শেষ, পাঠকদের চিন্তাভাবনা সেখান থেকে শুরু। তাই শেষের এই ছকটা মানে এই প্রশ্নগুলোর উত্তর আপনারাই খুঁজে নিন। এন্ডিংটা সাজিয়ে নিন নিজেদের মন মতো।
আর হ্যাঁ আজ কিন্তু আর কেউ নাইছ লিখবেন না। গল্পটা যেহেতু আজ শেষ, সেহেতু আজ সবাই এই গল্প সম্বন্ধে দুই চার লাইন লিখে যাবেন ধন্যবাদ|

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here