মনসায়রী” ২৩.

“মনসায়রী”

২৩.
আজ কক্সবাজারে আসার পঞ্চম দিন। আর দুইদিন বাকী আছে ঢাকায় ফেরার। তাই অফিসের কাজ শেষ করে সবাই সমুদ্র দেখতে নেমেছে। দুপুর ফারাহর সাথে সেদিকেই যাচ্ছিলো। হঠাৎ ফারাহর ফোনে একটা কল আসলো। দুপুরকে বলল,

‘তুমি একটু কষ্ট করে সায়রকে ডেকে নিয়ে আসতে পারবে?আমিই যেতাম, কিন্তু নিচে কী যেনো গন্ডগোল লেগেছে। নামার সময় ডাকতে মনেই নেই আমার৷ ছেলেটা অসুস্থ হয়ে গেলো হঠাৎ। এতো কল দিচ্ছি, ধরছেই না। স্যারের কাছে আমি কী জবাব দেবো, ওর দায়িত্ব তো আমার উপরই। ‘

দুপুরের ইচ্ছে না থাকলেও জোরপূর্বক হেঁসে বলল,

‘হ্যা, আমি যাচ্ছি। সমস্যা নেই। ‘

লিফটে উঠে আবারো সেকেন্ড ফ্লোরে গিয়ে সায়রের দরজায় নক করলো। মোটেই ডাকতে আসতে ইচ্ছে করছিলো না। গতকাল সায়রের আচরণ দেখে অনেক কিছুই টের পেয়েছে। কিন্তু, যখন মনে পড়লো অসুস্থ, আর ফারাহর কলও রিসিভ করছেনা। তখন কেমন যেন চিন্তা ভর করলো। তিন চার বার নক করার পরও ভেতর থেকে যখন দরজা খুললো না তখন, দুপুর ভয় পেয়ে গেলো। অজ্ঞান টজ্ঞান হয়ে যায়নি তো! শুকনো ঢোক গিলে নাম ধরে কয়েকবার ডাক দিলো। এবার দুপুর নিচে যেতে উদ্যত হলো। সবাইকে ডেকে নিয়ে আসার জন্য। এমন সময় দরজা খুলে গেলো। আওয়াজ শুনতে পেয়ে থেমে গেলো দুপুর। পেছনে তাকিয়ে দেখলো, দরজা ধরে এলোমেলো জামাকাপড় ও চুলে দাঁড়িয়ে আছে সায়র। চোখ ফুলে ঢোল। মুখ ফোলা ফোলা লাগছে। লম্বা হাই তুলে বোকাহেঁসে বলল,

‘সরি, আসলে আমি ঘুমিয়ে ছিলাম। ‘

দুপুর ভীষণ ঘাবড়ে গেছিলো। অস্থির হয়ে উঠেছিলো৷ এখন সায়রকে দেখে রেগে গিয়ে বলল,

‘তোমার কী কোনো বুদ্ধি নেই? এতো গাঢ় ঘুম হলে দরজা বন্ধ করে রাখলে কেনো? জানো কতো চিন্তায় পড়ে গেছিলাম আমি!’

রীতিমতো হাঁপাচ্ছে দুপুর। বিধ্বস্ত দেখাচ্ছে। সায়র মুচকি হাসলো দুপুরের চেহারা দেখে। দুপুরের কানের কাছে ফিসফিস করে বলল,

‘কতোটা চিন্তায় পড়েছিলেন দুপুর? ‘

দুপুরের কান শিরশিরিয়ে উঠলো। অজানা অনুভূতিতে হৃৎস্পন্দন বেড়ে গেলো। ব্যাপারটা খেয়াল করেছে দুপুর। যতবার সায়র কাছে আসে ততবারই তার হার্টবিট প্রোডাকশন বেড়ে যায়। এসবকে পাত্তা না দিয়ে দুপুর সায়রের কাঁধে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিয়ে বলল,

‘ফারাহ আপু টেনশন করছে তোমার জন্য। ডাকতে এসেছিলাম। ইচ্ছে হলে এসো। ‘

বলেই গমগম করে হেঁটে চলে যেতে নিলো দুপুর। সায়র পেছনে থেকে ওর হাত টেনে ধরে বলল,

‘আপনি চাইলেই আসবো। না চাইলে আমি আসবো না। আপনি কী চান দুপুর? ‘

দুপুর নজর ফেরালো না৷ মিনিট দুয়েক নীরব রইলো। তারপর হাতটা ছাড়িয়ে নিতে নিতে আলতো স্বরে বলল,

‘তুমি আসলে সবার ভালো লাগবে। বাকীটা তোমার ইচ্ছে। ‘

আর কোনো কথা না বলেই চলে গেলো দুপুর। আর কিছুক্ষণ সায়রের সামনে থাকলে কী না কী বলে ফেলবে। নিজেকে দিয়ে ভরসা নেই কোনো। সায়র দুপুরের পালিয়ে যাওয়া দেখে স্বশব্দে হেঁসে বলল,

‘আপনি আরো কিছু চান দুপুর, বলবেন কবে!’

টানটান উত্তেজনা চলছে। তুমুল বাকবিতন্ডা। টিয়া আর পৃথিলা উড়াধুরা কিছুক্ষণ বকাঝকা করলো। পাশ থেকে সিতারা আর ফারাহ ওদের থামানোর চেষ্টা করছে। প্রতিপক্ষ দল থেকেও কেউ চুপ নেই। দুপুর সমুদ্র পাড়ে এই ঝগড়াঝাটি দেখে অবাক হলো। ওদের কাছে গিয়ে দাঁড়াতেই শুনলো, পৃথিলা উচু কন্ঠে বলছে,

‘কী তার চেহারা, নাম দিয়েছে পেয়ারা! হাস্যকর৷ ‘

ওপাশের একটা ছেলে রাগী কন্ঠে বলল,

‘আপনি কিন্তু বেশি বেশি বলছেন! ‘

ফারাহকে দুপুর জিজ্ঞেস করলো ঘটনা কী। ফারাহ সংক্ষিপ্ত করে বলল, আসলে ছোটো একটা ঘটনাকে কেন্দ্র করে ঝগড়া লেগেছে। পৃথিলা আর টিয়া এক সাইডে দাঁড়িয়ে ছিলো। এমন সময় ওদের পাশ দিয়ে একটা ছেলে দৌড়ে যাচ্ছিলো। পেছন থেকে কেউ ছেলেটাকে ধাওয়ান করছিলো বলে হুঁশ হারিয়ে দৌড় দিতেই হাতে থাকা জুস ছিটকে গিয়ে পৃথিলা আর টিয়ার মুখে। ছেলেটা সঙ্গে সঙ্গে সরি বলে ক্ষমা চাইলেও পৃথিলা গিয়ে ছেলেটাকে কষিয়ে একটা থাপ্পড় দিয়ে বসলো। এরপরেই অপরপক্ষের ছেলে মেয়েরা এসে প্রতিবাদ করলো। সবার মাঝে একটা কৃষ্ণবর্ণের লম্বা চওড়া একটা ছেলে এসে পৃথিলাকে উচিত জবাব দিচ্ছে৷ পৃথিলা পারছেনা ছেলেটার গলা চেপে ধরতে।

দুপুর দীর্ঘ শ্বাস ফেললো৷ পৃথিলাকে তার ব্যাক্তিগতভাবে পছন্দ নয়। এর একটা গোপন কারণ, পৃথিলা সুযোগ পেলেই সায়রের কাছে গিয়ে ভাব জমায়। সেদিকে কখনো মনোযোগ দিতে চায়না দুপুর। তবুও মনের আড়ালে আবডালে কোথাও একটা জ্বলে ওঠে ওদের একসাথে দেখলে। এটাই হয়তো কারণ পৃথিলাকে পছন্দ না হওয়ার। আপাতত ওদের ঝগড়া থামাতে হবে। অনেক লোক জড়ো হচ্ছে।

দুপুর পৃথিলা আর বাকী সবার উদ্দেশ্যে বলল,

‘আপনারা বাচ্চাদের মতো ঝগড়া করছেন কেনো? এটা কী কোনো সমাধান? ‘

পৃথিলা দুপুরের দিকে তাকিয়ে চেঁচিয়ে উঠে বলল,

‘খবরদার! তুমি কোনো কথা বলবে না! ছোটো মুখে বড় কথা মানায় না। তোমার মতো থার্ড ক্লাস মেয়ের থেকে আমাকে ম্যানার্স শিখতে হবে!’

কথাটা দুপুর শুধু পৃথিলার উদ্দেশ্যে নয়, ঐ ছেলেদের জন্যও বলেছিলো। কিন্তু পৃথিলা এমন খারাপ ভাবে প্রতুত্তর করলো, চোখের কোণে জল এসে গেলো দুপুরের। অন্য সময় হলে ওর কথায় অতো পাত্তা দিতো না। কিন্তু, এতোগুলা মানুষের সামনে বলায় খুব খারাপ লাগলো। কৃষ্ণবর্ণীয় ছেলেটা এবার পৃথিলাকে বলল,

‘প্রথমে ভেবেছিলাম, এখন রেগে আছেন বলে এমন আচরণ করছেন। এখন দেখছি আপনি একজন জঘন্য মনের মানুষ। ‘

পৃথিলা আরেকদফা ঝগড়ার প্রস্তুতি নিয়ে কিছু বলার আগেই সেখানে সায়র উপস্থিত হলো। মুহুর্তেই পরিবেশ থমথমে । সায়রের দৃষ্টি প্রথমেই গিয়ে থামলো দুপুরের ভেজাচোখে। পৃথিলার কথা সে দূর থেকেও শুনতে পাচ্ছিলো, এতো চিল্লিয়ে কথা বলছিলো পৃথিলা। মুখ গম্ভীর হয়ে আসলো। সে ফারাহর কাছে সবই শুনেছে। পৃথিলার এহেন আচরণে সে বিরক্ত। পৃথিলা সায়রকে দেখে বলল,

‘সায়র, তুমি এই ছেলেগুলোকে কিছু বলো! ‘

সায়র এগিয়ে আসলো। একবার ছেলেগুলোর দিকে তাকিয়ে, পৃথিলার উদ্দেশ্যে নির্লিপ্ত কণ্ঠে বলল,

‘প্রতিটা মুদ্রার দুটো পিঠ থাকে। ওরা দোষ করেছে তোমার গায়ে ভুল করে জুস ফেলে। এর বিনিময়ে তুমি কী করেছো? থাপ্পড় দিয়েছো?’

পৃথিলা আমতা আমতা করে বলল,

‘আসলে ওরা আমার সাথে অসভ্যতামি করছিলো তাই।’

‘শাট ইউর মাউথ আপ!’

সায়র উচ্চস্বরে ধমকে উঠলো। দুপুর সহ কেঁপে উঠলো। সবাইকে অবাক করে দিয়ে সায়র পৃথিলাকে থমথমে কন্ঠে বলল,

‘দুপুরের কাছে এক্ষুনি ক্ষমা চাও। ‘

পৃথিলা চোখ বড় করে আপত্তি তুলে বলল,

‘এসব তুমি কী বলছো সায়র! ওর মতো.. ‘

‘তোমার সাহস কী করে হয়, ওনাকে থার্ড ক্লাস বলার! হু আর ইউ?’

পৃথিলা ভয়ে কাচুমাচু করে দাঁড়ালো৷ রাগ চেপে দাঁত কিড়মিড় করে উঠলো। কখনো ভাবেনি দুপুরের কাছে ক্ষমা চাইতে হবে।
এ তো ভীষণ আত্মসম্মানের প্রশ্ন। প্রচুর রাগ দমিয়ে কোনো রকম বলল,

‘সরি । ‘

দুপুর হা করে তাকিয়ে আছে। এই মেয়ে যে সরি বলতে পারে এটাই বিস্ময়কর ব্যাপার। সায়র ভ্রু কুচকে বলল,

‘হোয়াট সরি? সুন্দর করে বলবে, আমাকে ক্ষমা করে দাও। ‘

পৃথিলা ফুপিয়ে উঠে বলল,

‘এবার বেশি বেশি হচ্ছে সায়র! এই দুইদিনের মেয়ে এখন এতো ইম্পর্ট্যান্ট, আর আমি যে তোমার ছোটোবেলার বন্ধু! একসাথে স্কুল করেছি আমরা। ‘

সায়র বিরক্ত ভঙ্গিতে কোঁকড়া চুলে হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল,

‘এতো নাটক তুমি পরেও করতে পারবে। এখন ক্ষমা চেয়ে বিদায় হও৷ আর নাহয় আমি বাবার সাথে কথা বলবো, তোমার চাকরিটা থাকবে কিনা তা নিয়ে আরেকবার ডিসকাস করতে বলবো। ‘

পৃথিলা অবাক না হয়ে পারছেনা ৷ কতো স্পষ্ট করে সায়র বলে দিলো কথাগুলো। সব দোষ এই মেয়েটার। দুপুর আসার পর থেকে সায়রের পরিবর্তন লক্ষ্য করছে সে। তাহলে, এদের দু’জনের ব্যাপারে যা শুনছে সবই সত্যি। একরাশ ক্ষোভ জমিয়ে দুপুরকে বলল,

‘সরি দুপুর। ক্ষমা করে দাও আমাকে। ‘

দুপুর নিশ্চুপ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। পৃথিলা ধপাধপ পা ফেলে চলে গেলো। মিনিট খানেক পর পরিবেশ স্বাভাবিক হলো। সবাই অন্য পাশে চলে যেতেই, দুপুর সায়রকে বলল,

‘এরকম না করলেও পারতে তুমি। এবার পৃথিলা আরো রেগে গিয়ে উল্টো পাল্টা কাজ করবে। ‘

দুপুরের কথায় সায়রের গম্ভীর মুখে হাসি দেখা গেলো। সে দুপুরের ওড়নার আঁচল আঙুলে পেঁচিয়ে নিতে নিতে বলল,

‘আমি কাউকে আপনার ক্ষতি করতে দেবো না দুপুর। আপনি একান্তই আমার । ‘

চলবে-
লেখনীতে-নাঈমা হোসেন রোদসী।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here