‘মনসায়রী’
১৯.
কিছু কিছু ক্ষত কখনো মন থেকে মুছে যায় না। ক্ষতগুলো অক্ষত থেকে যায় বুকের এক কোণে। দহনযন্ত্রনা দেয় যত্ন করে। পরিবেশ মুহুর্তেই স্তব্ধতায় পূর্ণ হলো। কারো কারো মুখ হা হয়ে আছে। চোখেমুখে বিরাট কৌতূহল। এ কী এলাহি কান্ড! পৃথিলার মাথা গরম হয়ে গেছে। অল্পতেই রেগে যাওয়ার মানুষ সে৷ এতো কষ্ট করে তিনটে একই লেখার চিরকুট বক্সে রেখেছিলো সবার উপরে। যাতে সায়রের হাতে ওটাই আগে আসে। যেহেতু, এখানে পৃথিলার প্রতিদ্বন্দ্বী আর কেউই নেই। তাই, বাধ্য হয়ে হলেও আজকে প্রপোজ করতে হতো সায়রকে। এরপর নাহয় আস্তে ধীরে সায়রকে বশ করা যেতো। কিন্তু, সব প্ল্যান মাটি করে কিনা সায়র এই বুড়িটাকে প্রপোজ করলো! রাগে গা জ্বলছে পৃথিলার।
দুপুরের বুকে চিনচিনে ব্যথা করে উঠলো। চোখ ছলছল করছে। অন্ধকারের আবছা আলোয় সেই ভেজা চোখ দুটো হয়তো কেউই দেখেনি। কেউই হয়তো বোঝেনি, শীতল চোখমুখে দাঁড়িয়ে থাকলেও কী নির্মম ভাঙচুরে ভেঙে পড়ছে দুপুর। যতই হোক কোনো খেলা, এটা তো দুপুরের ভাঙাচোরা এক স্মৃতিরই কুৎসিত অংশ। সায়র ততক্ষণে দাঁড়িয়ে গেছে। তাঁর চোখমুখ স্বাভাবিক। একটু আগের আকুলতা ভরা মুখ পালটে গম্ভীর হয়ে গেছে। মুখে সামান্য হাসি বজায় রেখে দুপুরকে বলল,
‘সরি, আসলে এটা ডেয়ার ছিলো। ‘
দুপুর জানে এটা ডেয়ার গেম ছিলো। যেখানে সায়র মিথ্যা নাটক করেছে মাত্র। তবু্ও! খারাপ লাগলো দুপুরের৷ এই ধরনের খেলা তাঁর একটুও পছন্দ নয়। দুপুর ফারাহর পাশের সিটে বসে নিরস কন্ঠে বলল,
‘জীবন কোনো খেলা নয়। সব জিনিস নিয়ে যারা খেলা করে, তাদের পুরো জীবনটাই খেলনায় পরিণত হয়। ‘
সায়র মুচকি হাসলো। অত্যন্ত নিচু কন্ঠে বলল,
‘সব খেলাতে মিথ্যা থাকেনা মিস! মাঝে মাঝে সফট ইমোশনসও থাকে। ‘
দুপুরের পাশেই দাঁড়িয়ে থাকায় দুপুর শুধু এটুকু বুঝলো সায়র কিছু বলেছে। মাথা উঁচু করে বলল,
‘কিছু বললেন?’
‘আপনি বুঝবেন না। ‘
সায়র কোল্ড ড্রিংকসের গ্লাসে চুমুক দিয়ে আয়েশ করে বসেছে দুপুরের পাশে। দুপুর একবার ভ্রু কুচকে তাকালো সেদিকে। সায়রের কোনো হেলদোল নেই। নিজের মতো বসে বসে মোবাইল দেখে সময় পাড় করছে সে। দুপুর দীর্ঘ শ্বাস চুপচাপ বসে রইলো।
পৃথিলা এমন সময় এসে ফারাহর পাশে বসে আহ্লাদী সুরে নিচুকন্ঠে বলল,
‘ম্যাম, আপনি তো সায়রকে অনেক বছর ধরে চেনেন। আমাকে তার পছন্দ অপছন্দ গুলো বলুন না!’
ফারাহ মোবাইলে কারো সাথে চ্যাট করছিলো। পৃথিলার কথা শুনে মাথা তুলে তাকালো। পরমুহূর্তেই হালকা বিরক্তি নিয়ে বলল,
‘সায়রের পছন্দ অপছন্দ জেনে তুমি কী করবে পৃথিলা?’
পৃথিলা লাজুক মুখে হাসি ফুটিয়ে বলল,
‘ইয়ে মানে, আমার সায়রকে খুব ভালো লাগে ম্যাম। আপনি বলুন না, কীভাবে আমি তাঁর ভালোবাসা পেতে পারি?’
ফারাহ মোবাইল ফোনটা এক সাইডে রেখে গম্ভীর গলায় বলল,
‘ভালোবাসা কোনো জোর করে পাওয়ার জিনিস নয়। ভালোবাসা হচ্ছে মনের ব্যাপার। পৃথিবীর সব জিনিস টাকা দিয়ে কেনা গেলেও ভালোবাসা কেনা যায়না। সেটা অমূল্য । ‘
কিছুটা থেমে আবার বলল,
‘সায়র আমার ছোটো ভাইয়ের মতো বলে আমি ওকে নাম ধরে ডাকি। ছোট বেলা থেকেই আমাকে বড় বোন মানে। কিন্তু, তুমি সায়র বলছো কেনো? ‘
পৃথিলা ভাবেনি ফারাহ তাকে এভাবে অপমান করবে। যদিও কথা বলার সময় ফারাহ অত্যন্ত বিনয়ী স্বর ব্যবহার করেছে, তবুও পাশের দুই তিনজন মুখচেপে হাসছে। মনে মনে ক্রুদ্ধ হলো পৃথিলা। একমাত্র ওই দুপুরের সাথেই এতো হাসিখুশি রূপে কথা বলে ফারাহ। বাকি স্টাফদের সাথে কথা বলার সময় গম্ভীর মুখ ছাড়া কিছু দেখা যায়না। যতসব আদিক্ষ্যেতা!
সবার আড্ডা দিতে দিতে রাত একটা বাজলো। সারাদিনের জার্নিতে নুইয়ে পড়েছে দুপুর। ঘুমালে হয়তো ভালো লাগবে। কিন্তু, ফারাহ এতো মনোযোগ দিয়ে গল্প করছে।কিছুতেই দুপুর উঠতে পারছেনা। কথার এক পর্যায়ে ফারাহ দুপুরকে মুচকি হেসে বলল,
‘আচ্ছা দুপুর, তুমি কখনো কারো প্রেমে পড়েছিলে? ‘
দুপুর চকিতে তাকালো। গায়ের ওড়নাটা পিঠে আরেকটু ভালো করে জড়িয়ে নিয়ে বলল,
‘হ্যা আপু। ‘
‘সত্যি! কার?’
ফারাহ কৌতূহলী হয়ে বলে উঠলো। দুপুর সামান্য হেঁসে বলল,
‘পড়েছিলাম আপু, কিন্তু টিকেনি। ‘
ফারাহ স্বাভাবিক হাসলো। দুপুরের দিকে তাকিয়ে বলল,
‘ওহহ তাহলে সেটা শুধু প্রেম ছিলো!’
দুপুর ভ্রু কুঞ্চন করে বলল,
‘প্রেম আর ভালোবাসা কী আবার আলাদা নাকি?’
ফারাহ মুচকি হেসে বলল,
‘দুপুর, তোমাকে ছোটো বোনের মতো ভাবি। একটা উপদেশ দেই, প্রথমবার তো শুধু প্রেমে পড়েছিলে, তাই প্রেম একসময় ছাই হয়ে গেছে। পরেরবার আর কারো প্রেমে পড়োনা। যেদিন ভালোবাসা দরজায় কড়া নাড়বে, সেদিন দরজা খুলে দিও। বুঝেছো?’
দুপুরের চোখ টলমল করছে। উপরের দিকে তাকিয়ে দুপুর বলল,
‘বুঝেছি আপু। ‘
‘কী বুঝলে?’
‘পরেরবার আগে কাউকে মন থেকে ভালোবাসবো, তারপর প্রেমে পড়বো। ‘
শরীরের তাপমাত্রা হু হু করে বেড়ে গেছে দুপুরের। মাথা ব্যাথা করছে। গা গুলিয়ে আসছে। তবুও চুপ করে বসে আছে দুপুর। একা একা রুমে বসে থাকতে ভালো লাগবেনা। এজন্যই কিছু বলছেনা সে। ফারাহ হঠাৎ করে দুপুরের কপালে হাত রেখে আঁতকে উঠে চেচিয়ে বলল,
‘একি! দুপুর তোমার গা তো জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে! ‘
কানে কিছুই শুনছেনা দুপুর। ততক্ষণে চোখজোড়া বুঁজে এসেছে।
সায়র অন্য পাশে গিয়ে দাঁড়িয়েছিলো। ফারাহর চিৎকার শুনে এদিকে আসলো। দুপুরকে চোখ বুজে চেয়ারে এলিয়ে থাকতে দেখে দ্রুতপায়ে এগিয়ে আসলো সে। দুপুরের গালে হাত রেখে দুশ্চিন্তাগ্রস্থ হয়ে বলল,
‘উনি বেহুশ হয়ে গেছেন। ‘
বলেই কোলে তুলে নিলো সায়র৷ সবাইকে এক পাশে সরতে বলে হন্তদন্ত পায়ে হোটেলের ভেতরে ঢুকে পড়লো। রুমে এসে দুপুরকে শুইয়ে দিয়ে লেপটা গায়ে চেপে দিলো। সবাইকে বাহিরে দাঁড়াতে বলেছে সে। সায়র দুপুরের সরে যাওয়া ওড়নাটা আলতো করে ঠিক করে দিলো। কপালে পড়ে থাকা চুলগুলো সরাতে গিয়ে দেখলো, চোখের কোণে কাজল লেপ্টে গেছে চোখের পানিতে। আঙুল দিয়ে চোখটা মুছে দিলো সায়র৷ অতঃপর ঝুঁকে নিজের ওষ্ঠ দুপুরের কপালে ছুঁইয়ে দিয়ে দুই হাত গালে রেখে কানের কাছে ফিসফিস করে বলল,
‘এতো কীসের দুঃখ আপনার দুপুর? আপনি তপ্ত দুপুরের মতোই। আমাকে আপনার দুঃখগুলোর ভাগ দিয়ে দিন না! আমি তো তা পাওয়ার অধিকার রাখি! ‘
দুপুর শুনলো কিনা বোঝা গেলো না। অজ্ঞান অবস্থায় কোনো কিছু শোনার মতো অবস্থা নেই তার। শুধু অর্ধজাগ্রত হয়ে সায়রের হাতে রাখা নিজের হাতটা দিয়ে টেনে গালের সাথে মিশিয়ে নিলো। সায়র তা দেখে হেঁসে বলল,
‘আপনি বয়সে বড় হলেও, আমি আপনাকে বড় হতে দেবোনা দুপুর। আপনি একটা আদুরে বিড়ালের বাচ্চা! ‘
চলবে –
লেখায়-নাঈমা হোসেন রোদসী।