তিক্ত_বুকের_বাঁপাশ #ফিজা_সিদ্দিকী #পর্ব_২৫(রেহাই দাও আমাকে, একটু বাঁচতে দাও!)

#তিক্ত_বুকের_বাঁপাশ
#ফিজা_সিদ্দিকী
#পর্ব_২৫(রেহাই দাও আমাকে, একটু বাঁচতে দাও!)

৩০.

“আমার যদি কিছু হয়ে যায়, তবে তুমি আর একটা বিয়ে করে নিও রাফিদ।”

সময়টা মাঝরাত। হুট করেই ঘুম ভেংগে যায় নম্রমিতার। অসহ্য রকম ব্যথায় মাঝে মাঝেই এমন ঘুম ভেংগে যায় তার। পেট কেমন কেনো খিঁচে ধরছে। মনে হচ্ছে ভেতর থেকে কেউ যেনো খামচি মেরে ধরে আছে। ঘুমের মাঝেই দুই হাত বেডে ঝাপটায় নম্রমিতা। একেবারে কাটা মুরগীর মতো ছটফট করছে সে। নম্রমিতার অস্থিরতা আর বেডের ঝাঁকনিতে ঘুম ভেঙ্গে যায় রাফিদের। চট করে নম্রমিতার মাথা নিজের বুকে টেনে একহাত বাড়িয়ে মেডিসিনের বক্স টেনে নেয় সে। বিগত এক সপ্তাহ ধরে এমন ঘটনা মাঝে মাঝেই ঘটে। ডক্টরের দেওয়া মেডিসিন খাইয়ে নম্রমিতাকে নিজের বুকের মাঝে জাপ্টে ধরে রাফিদ। যেনো সে প্রয়াশ চালাচ্ছে প্রিয়তমাকে দুনিয়ার সকল কষ্ট থেকে দূরে রাখার। একেবারে নিজের বুকের মাঝে চুপটি করে লুকিয়ে রাখতে চায় সে। মাঝে মাঝে নিরবে কাঁদে সে। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের শেষে সে নিজের জন্য কিছু চায়না, বরং তার সবটুকু চাওয়া এই একটা মানুষের তরে।

বেশ খানিকটা সময় পর শান্ত হয় নম্রমিতা। ব্যথা কমে এসেছে তার। প্রাণভরে শ্বাস টেনে নিজেও জড়িয়ে ধরে রাফিদকে। অতঃপর ক্ষীণ কণ্ঠে বলে ওঠে উপরোক্ত কথা। রাফিদ কোনো প্রতিক্রিয়া দেখায়না। রাগ কিংবা অভিমান প্রকাশ করেনা। আস্তে ধীরে নম্রমিতার মাথা রাখে বালিশে। নিঃশব্দে উল্টোদিকে মুখ ফিরে নিজেও শুয়ে পড়ে পাশের বালিশে। রাতের নিস্তব্ধতা ছাপিয়ে শোনা যাচ্ছে ভারী ভারী নিঃশ্বাসের শব্দ। নম্রমিতার হাসি পায়। সে জানে রাফিদ কাঁদছে। তার কান্না শব্দহীন। নীরবে একে একে অশ্রুকণারা গড়িয়ে পড়ে জলধারার ন্যায়। আজকাল রাফিদকে প্রায়শই কাঁদতে দেখে সে। কখনও লুকিয়ে তো কখনও প্রকাশ্যে। রাফিদকে কাঁদতে দেখলে ভালোলাগে নম্রমিতার। মনে হয় ভালোবাসা এখনও মরে যায়নি। আজ তা জীবন্ত, ঠিক আগের মতো। আবার হয়তো আগের চেয়ে বেশি প্রানবন্ত। নিজের ভাগ্যের উপর নিজেরই আফসোস হয় তার। এতো ভালোবাসা তার কপালে আদৌ সইবে তো! অচিরেই হারিয়ে ফেলবে না তো!

“শুনছো, এদিকে ঘোরো।”

রাফিদ আগের মতোই নির্বাক। একইভাবে শুয়ে আছে। এবারে ফিক করে হেঁসে দেয় নম্রমিতা। হাসতে হাসতে বলে,

“আরে বাবা, এখনও মরে টরে যাইনি তো! তাতেই একজন মুখ ঘুরিয়ে শুয়ে আছে। এরপর তো দেখবো…”

বজ্রের বেগে নম্রমিতাকে জড়িয়ে ধরে তার গলায় মুখ ডুবিয়ে দেয় রাফিদ। রাফিদ যে আরও বেশি করে কাঁদবে এখন, তা নম্রমিতার জানা। সে ইচ্ছে করেই করে এমন। রাফিদকে অভ্যস্ত হতে হবে এগুলোর সাথে। নয়তো হুট করে পাওয়া আঘাত সে সইতে পারবে না। ধীরে ধীরে সহনীয় আঘাতের ধাক্কা কম লাগে। কিন্তু হুট করেই পাওয়া কোনো দুঃসংবাদ মানুষকে খুব বিশ্রীভাবে ভেঙে দেয়। নম্রমিতা চায়না রাফিদ ভেঙে পড়ুক। তার জন্য যে অনেক বড়ো এক দ্বায়িত্ব রেখে যাবে সে! নম্রমিতার ভালোবাসাটুকুও যে রাফিদকেই দিতে হবে!

“আমাকে কষ্ট দিয়ে খুব বেশি মজা পাও তাইনা! একদিন দেখবে তোমার কাছে সব থাকবে, কিন্তু এই আমিটাই থাকবো না। কাকে কষ্ট দেবে তখন!”

“রাফিদ! মাঝরাতে কিসব কথা বলছো তুমি! একসাথে দুইজনে ছুটি নিলে চলে নাকি!”

“আমি পাগল হয়ে যাবো নম্র। আর নিতে পারছিনা। প্লীজ নম্র, প্লিজ! আমি আর পারছিনা এই কথাগুলো হজম করতে। রেহাই দাও আমাকে। একটু বাঁচতে দাও।”

জল গড়িয়ে পড়ে নম্রমিতার চোখের কোণ ঘেঁষে। তারও যে যেতে ইচ্ছে করেনা। এতো এতো সুখ ছেড়ে কে যেতে চায়! কাউকে ভীষণভাবে ভালোবাসলে নিজেকে ভেঙেচুরে ভালোবাসতে হয়। রাফিদ তার সর্বোত্তম উদাহরণ। রাফিদের মতো এমন পাগল প্রেমীক, অতুলনীয় হাসবেন্ড পাওয়ার যোগ্য তো সে নয়! কেনো বানরের গলায় মুক্তার মালা ঝুলিয়ে দিলো বিধাতা! আর ভাবতে পারেনা নম্রমিতা। ভাবনার মাঝেই ঘুমে ঢুলে আসে চোখ। ঘুমন্ত প্রিয়তমার কপালে সিক্ত ঠোঁট ছোঁয়ায় রাফিদ। বেশ অনেকটা সময় ধরে কপালে ঠোঁট ছুঁইয়ে বিড়বিড় করে কী যেনো বলে, আবারো গভীর চুমু আঁকে সেখানে। আরও একটা রাত নির্ঘুম করে তার। ঘুম উৎসর্গ হয় সৃষ্টিকর্তার নিকট আহাজারীতে। প্রিয়তমাকে সুস্থ সালামত ফিরে পাওয়ার আকাঙ্খায় লুটিয়ে পড়ে সিজদায়।

৩১.

ডক্টরের চেম্বারে পাশাপশি বসে আছে রাফিদ আর নম্রমিতা। হাতে কিছু টেস্টের রিপোর্ট। ডক্টরের মুখ থমথমে। অনেক বেশি আশঙ্কায় খানিকটা ফ্যাকাশেও লাগছে। তপ্ত দীর্ঘশ্বাস ফেলে ডক্টর। অতঃপর রাফিদের উদ্দেশ্যে বলে ওঠে,

“মিষ্টার চৌধুরী, আই অ্যাম সরি। আপনাদের দুই সন্তানের মধ্যে একজন আর নেই। ইতিমধ্যে তার শরীরে পচন সৃষ্টি হয়েছে। মূলত এই কারনেই আপনার ওয়াইফের পেইন হচ্ছে ভীষণ রকম। কেস রীতিমত ক্রিটিকালের দিকে যাচ্ছে।”

ডক্টরের কথা শুনে থম মেরে বসে থাকে নম্রমিতা। কোনো রকম অনুভূতিই কাজ করছে না তার মাঝে। নিজেকে মানসিকভাবে বেশ খানিকটা শক্তপোক্ত করলেও ধাক্কা তো লাগছে। সন্তান হারানোর ব্যথা একজন মায়ের চেয়ে বেশি বোঝার ক্ষমতা পৃথিবীতে যে আর কারোর নেই! সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় হলো তার কান্না আসছে না। একটুও নাহ। তবে কি অতি শোকে পাথর হয়ে গেল!

নম্রমিতার পরিস্থিতি সম্পর্কে নানারকম আলাপচারিতা চলছে ডক্টরের সাথে রাফিদের। এই মুহূর্তে এবরশন করার মতো কোনো পরিস্থিতি নেই। কারণ নম্রমিতার গর্ভে এখনও একটা সন্তান জীবিত আছে। আবার মৃত বাচ্চাকে পেটের মধ্যে রেখে দিলে মা আর জীবিত বাচ্চা দুজনেরই ক্ষতি হতে পারে।

রনক হাঁটুমুড়ে বসে আছে রুহেলের কবরের সামনে। চোখে তার জল। নত শিরে বিড়বিড় করে বলে ওঠে,

“তুমি না থেকেও যে থেকে গেছো রুহেল। তোমার মৃত্যু আমাদের মাঝে তোমাকে রেখে দিয়ে গেছে। তুমি চলে গিয়েও আমাদের মাঝে তৃতীয় ব্যাক্তি হয়ে রয়ে গেছো। তোমার প্রতি কোনো অভিযোগ নেই আমার। বরং যা আছে তা হলো কৃতজ্ঞতা। আমার তোহাকে বাঁচিয়ে পরোক্ষভাবে আমাকে বাঁচিয়ে দিয়েছো তুমি। জানো, এর আগে তোহা তোমার নাম মনে তো দূর মুখেও আনতো না। তোমার প্রতি তার না ছিলো কোনো ভালোবাসা আর না ঘৃণা। কিন্তু তোমার মৃত্যু তার মনে একটা বিশেষ জায়গা করে দিয়েছে তোমাকে। আমার যে কষ্ট হয় রুহেল! ভীষণ কষ্ট হয়। তার সবটুকু জুড়ে যে আমি একাই থাকতে চেয়েছিলাম। কেনো থাকবে সেখানে তোমার অস্তিত্ব! আমি যে মেনে নিতে পারিনা। এ যে আমার ভীষণ বড়ো এক ব্যর্থতা।”

আজ অনেকগুলো দিন পরে রনক এসেছে রুহেলের কবরের সামনে। যোহরের নামাজ শেষে কবর জিয়ারত করে একাকী দুঃখবিলাশ করে সে। তার অভিযোগ করার মতো কোনো জায়গা নেই, তবুও অভিমান হয়। মাঝে মাঝে প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয় সৃষ্টিকর্তার নিকট। ভালোবাসার মানুষের সামান্যতম ভাগও যে কাউকে দেওয়া যায়না!

৩২.

দিনের শুরুটা গুমোট। আকাশে নেই কোনো রোদের ছিটেফোটা। তারপরও কেমন যেনো ভ্যাপসা এক গরম। মাথার উপর ফ্যান চলা সত্বেও ঘেমে নেয়ে একাকার নম্রমিতা। আগামী সপ্তাহে ডেলিভারির ডেট দেওয়া হয়েছে তাকে। আজই হসপিটালে অ্যাডমিট করতে হবে। এই কয়দিন ডক্টরদের নিরীক্ষণে রেখেই পরবর্তী পদক্ষেপ নেবেন তারা। খুব বেশি সমস্যা হলে সময়ের আগেই সিজার করে নেওয়া হবে। মূলত এই কারণেই শেষের একটা সপ্তাহ তাকে হসপিটালাইজড রাখার সিদ্ধান্ত নেন নম্রমিতার ডক্টর।

মেডিসিন পুষ করে অক্ষত রাখা হয়েছে মৃত বাচ্চাটাকে। তবে খুব বেশিদিন এমনভাবে রাখা সম্ভব নয়। এতে ক্ষতি হতে পারে নম্রমিতার। যেহেতু তার গর্ভেই পচনরোধক মেডিসিন দেওয়া হচ্ছে তাই শারীরিক অক্ষমতাও দেখা দিতে পারে অনেক সময়। আবার জীবিত বাচ্চার শারীরিক কার্যক্রমও ব্যাহত হচ্ছে খানিকটা। যেহেতু জরায়ুতে থাকা অ্যামনিওটিক তরলের মাঝে ভাসমান অবস্থায় থাকে ভ্রূণ। ভ্রূণের যাবতীয় পুষ্টি উপাদান সরবরাহের কাজ করে এই তরল। তাই মৃত ভ্রূণকে অক্ষত রাখার উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা সামান্যতম পচননাশক ঔষধীও খানিকটা প্রবেশ করছে জীবিত ভ্রূণের দেহে। যার মাত্রা সামান্য বেশি হলে ভ্রূণের মৃত্যু নিশ্চিত।

#চলবে!

এই কয়দিন গ্যাপের জন্য ক্ষমাপ্রার্থী। রাতে আরও একটা পর্ব আসবে। তাই ছোটো করেই দিলাম।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here