#অনিমন্ত্রিত_প্রেমনদী
#দ্বিতীয়_অধ্যায়
#পর্ব_০৩
#জিন্নাত_চৌধুরী_হাবিবা
(কপি করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ)
অরু কিঞ্চিৎ চুপ থেকেই হেসে ফেললো। বলল,
“এতদিন বুঝি ছোটো ছিলাম?”
রামি দৃষ্টি স্বাভাবিক করে নিলো। দূরদূরান্তে ঝাপসা দৃশ্যে দৃষ্টি মিলিয়ে গেল তার। লম্বা শ্বাস টে*নে বলল,
“ছোটোই ছিলি। আজ হুট করেই বড়ো বড়ো লাগছে।”
অরু মলিন হেসে বলল,
“আমি তো সেই কবেই বড়ো হয়ে গিয়েছি। কেবল লোক-চোখে নিজেকে ছোটো করে রেখেছি।”
রামি পাশ ফিরে তাকালো। অরুর সজ্জিত শুভ্র চেহারায় অমাবস্যা নামলো যেন! বাতাসে লম্বাচুল দোল খাচ্ছে।
রামি বলল,
“তোর কি আন্টির কথা খুব মনে পড়ছে?”
অরুর ডান চোখের কোল ঘেঁষে একফোঁটা নোনাজল গড়িয়ে পড়লো। দ্রুত চোখ মুছে বলল,
“না তো।”
রামি এ ব্যাপারে আর কথা বাড়িয়ে অরুর কষ্ট দ্বিগুণ করতে চাইলোনা। তাই প্রসঙ্গ পাল্টে বলল,
“আবিরের সাথে তোর কতদিনের পরিচয়?”
“এডমিশনের সময় পরিচয় হয়।”
“সম্পর্ক কতদিনের?”
অরু অবাক হলোনা। সবাই যে আবিরের সাথে তার একটা সম্পর্ক আছে এটা ভেবে বসে আছে তা অরু পূর্ব থেকেই অবগত। ফিক করে হেসে বলল,
“পরিচিত, কিন্তু এর বেশি সম্পর্ক নেই। দুদিন আগেই উনি প্রপোজ করেছিলেন। আমিও খামখেয়ালি মেজাজে বলে দিলাম ‘চলুন বিয়ে করে ফেলি’।
উনি যে সিরিয়াস হয়ে পড়বেন কে জানতো!”
রামি বিদ্রুপ করে বলল,
“মানুষ কী দেখে তোকে পছন্দ করে আমি বুঝিনা। ভোলাভালা চেহারার আড়ালের ডা*ই*নি দেখলে বাপ বাপ করে পালাতো।”
অরু রেগে গেল ভীষণ।
“তুমি নিজে তো বুড়ো খাটাশ।”
রামি বিশেষ পাত্তা দিলোনা। তবে কৌতুহল বাড়লো। জানতে চাইলো অরুর মন কী চায়? হুট করেই সে কেন অরুকে নিয়ে এতটা ভাবতে শুরু করলো সেটা বুঝতে পারছেনা। সন্দিহান গলায় শুধালো,
“তোর কি আবিরকে পছন্দ হয়েছে?”
“না হওয়ার মতো কিছুই দেখছিনা।”
“যদি আবির বলেন যে তোকে বিয়ে করবেনা, তখন খা*রা*প লাগবে?”
অরু ফের হাসলো। বলল,
“তার প্রতি আমার ফিলিংস তৈরি হয়েছে না-কি? তবে অপমানিত হব খুব। নিজ থেকে এসে কেউ রিজেক্ট করলে সেটা সত্যিই অপমানজনক। তখন তাকে আমি ছেড়ে কথা বলবো না।”
রামি ঠোঁট গোল করে শ্বাস ছাড়লো। বিরক্তি গলায় বলল,
“তুই শাড়িটা চেঞ্জ করে আয় তো। কেমন বুড়ী বুড়ী লাগছে তোকে। ঠিক আমার নানীর মতো। আর চুলগুলো বেঁধে নে। আমারই কেমন গরম লাগছে তোকে দেখে।”
অরু চোখেজোড়া তীক্ষ্ণ করে চাইলো। চশমার ফাঁক গলে এই দমশ্যটুকু রামির নজরে পৌঁছাতে পারলোনা। নাক, গাল ফুলিয়ে বলল,
“আমাকে তো শাড়ী পরায় বুড়ী লাগছে আর তুমি তো সত্যি সত্যিই বুড়ো দামড়া হয়ে আছো। বিয়ে সাদি সঠিক বয়সে করলে দু-চারটা বাচ্চা ব্যা ব্যা করে ডাকতো।”
“আমার বাচ্চা ব্যা ব্যা ডাকবে না-কি পাপা ডাকবে, সেটা কি তুই ঠিক করে দিবি? দু’দিন হলো মেডিকেলের স্টুডেন্ট হয়েছিস। অথচ ভাব ধরছিস বিজ্ঞদের মতো। একটা চ*ড় মা*র*লে উঠে দাঁড়ানোর শক্তি নেই, সে এসেছে আমাকে জ্ঞান দিতে।”
এমন তুচ্ছতাচ্ছিল্য মোটেই পছন্দ হলোনা অরুর। তেতে উঠে বলল,
“ননীর পুতুল পেয়েছো আমায়? আমাকে চ*ড় মা*র*লে আমি বুঝি বসে বসে দেখবো? তোমার শুধু একটা বাচ্চা হোক। তাকে আসতে এক চ*ড়, যেতে এক চ*ড় বসাবো। তখন বুঝবে অরুকে চ*ড় দেওয়ার ফলাফল কতটা ভয়া*বহ।”
“তোকে আবিরের সাথে বিয়ে দেওয়া উচিত নয়! একদমই নয়! তোর জন্য আসলেই একটা বুড়োলোক দরকার। এমন ঝগড়ুটে মেয়ের জন্য বুড়োলোকই পারফেক্ট।”
“আমি কাকে বিয়ে করবো, সেটা কি তোমাকে জিজ্ঞেস করে করবো?”
বলেই অরু সিঁড়ি ভেঙে নামতে যায়। রামি অরুকে আরেকটু রাগিয়ে দিতে পেছন থেকে চেঁচিয়ে বলল,
“দেখবি তার চান্দিটাও ছিলা থাকবে। বড়ো একটা ভুঁড়ি থাকবে।”
★★★
নিস্তব্ধ রজনী। ঘন হয়ে এলো অন্ধকার। ছাদে দাঁড়িয়ে অপেক্ষারত রামি। পাশের দালানের সামনেই এসে একটা গাড়ি থামলো। ভেতর থেকে বেরিয়ে এলো কোন ধারালো ব্যক্তিত্বের পুরুষ। যার পূর্ব সত্তার সাথে বর্তমান সত্তার আকাশপাতাল তফাৎ। কেবল অতি আপনজনেরা তার আসল সত্তার সাথে পরিচিত। বাইরের মানুষোর কাছে সে একগুয়ে, গম্ভীর পুরুষ।
পুরুষ অবয়বটি বাড়ির ভেতর যাওয়ার জন্য পা বাড়াতেই রামি ডেকে উঠলো,
“মিঠু।”
চোখ তুলে পাশের ছাদে তাকালো মিঠু। খানিক সময় স্থির দাঁড়িয়ে থেকে পা চালিয়ে পাশের দালানের সামনে এলো। ধীরে ধীরে এগিয়ে গেলো সিঁড়ি ঘরেের দিকে। রামি রেলিঙে পিঠ ঠেকিয়ে দাঁড়ালো। আগাগোড়া মিঠুকে পর্যবেক্ষণ করে জিজ্ঞেস করলো,
“কেমন আছেন জমিদার সাহেব?”
মিঠু গম্ভীর মুখো হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। কিয়দংশ সময় ওভাবেই অতিবাহিত হলো। অতঃপর এক অকল্পনীয় চমক ঘটলো। মিঠু দু’হাতে শক্ত করে আলিঙ্গন করে নিলো রামিকে। ঠোঁটের কোনে চওড়া হাসি। সহাস্যে বলল,
“তোর মতো ছ্যাঁ*চ*ড়া জীবনে থাকলে কি আর জমিদারি টিকিয়ে রাখা যায়?”
রামি থাপ্পড় বসিয়ে দিল মিঠুর পিঠে। দু-জনের অল্পস্বল্প মা*রা*মা*রি লেগে গেল। ক্লান্ত হয়ে ছাদের ফ্লোরে হাসতে হাসতে বসে গেল দুজন।
মিঠু বলল,
“তুই এসেছিস চারদিন হলো, অথচ ব্যস্ততার কারণে দেখা করা হয়নি। আজ যখন সুযোগ হলো, তখন দুজন একসাথে ঘুমাবো চল।”
রামি বলল,
“চা হলে ভালো হতো।”
মিঠু বলল,
“আমাদের বাসায় আয়। এখন আর আপুকে জাগানো ঠিক হবে না। অরু বানিয়ে দেবে।”
দুজন উঠে পড়লো। নিচে এসে গেইট লক করে চাবি নিয়ে চলে গেল রামি। বাবা ঘুমাচ্ছেন। মিঠু নিজের কাছে থাকা এক্সট্রা চাবি দিয়ে দরজা খুলে ভেতরে ঢুকলো। অরুর ঘরের আলো জ্বালানো। নিশ্চয়ই বইয়ের ভাজে মুখ গুঁজে আছে! মিঠু সোজা ওর ঘরে ঢুকে অরুর মাথায় টোকা মে*রে বলল,
“কীরে ঝগড়ুটে মহিলা, সারাদিন কী এত পড়িস? একদিন তো বিয়েই করে ফেলবি। পড়ে আর কী লাভ?”
অরু রেগে গেল। দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
“পঁচা কুমড়া মিঠুর বাচ্চা, আমি মাথায় ব্যথা পেয়েছি না?”
মিঠু অবাক হলো যেন৷ এদিক-ওদিক তাকিয়ে কিছু খোঁজার চেষ্টা করলো। ব্যর্থ হয়ে বলল,
“আমার বাচ্চা এলো কোথা থেকে রে, অরু? আমি তো তাদের দেখতে পারছি না। বুঝলাম না, অল্প বয়সে চোখের মাথা তুই খেলে না-কি আমি?”
অরু ক্রমাগত ফুঁসে উঠছে। গাল ফুলিয়ে গম্ভীর স্বরে বলল,
“দু-চারটা ঝাড়ুর বা*ড়ি খেতে না চাইলে এখান থেকে যাও। তোমার শরীর দিয়ে দু*র্গ*ন্ধ বের হচ্ছে।”
মিঠু ঝট করে শার্ট ছাড়িয়ে নিল শরীর থেকে। অরুর মাথা ঢেকে দিয়ে তার নাকের কাছে শার্ট ধরে বলল,
“দেখ্ শুঁকে দেখ্, আমার শার্ট থেকে কী মিষ্টি ঘ্রাণ আসছে। পারফিউম কোম্পানি আমাকে খুঁজে বেড়াচ্ছে। আমার বডি স্মেল দিয়ে দারুণ পারফিউম তৈরি করে তাঁরা আর্থিকভাবে লাভবান হবে। আর তুই কি-না দু*র্গ*ন্ধ বলছিস!”
অরু নাকমুখ কুঁচকে বলল,
“তোমাকে পারফিউম কোম্পানি খুঁজছে না। চি*টা*র, বা*ট*পা*র*রা খুঁজছে। রাস্তায় মানুষ ধরে লুট*পাট করার জন্য কোন ক্লোরোফর্ম প্রয়োজন নেই। তোমার ব্যবহৃত একটা শার্ট সামনে ধরলেই মানুষ দু*র্গ*ন্ধ সইতে না পেরে অ*ক্কা পাবে। ছিঃ! কী বি*শ্রী।”
মিঠু চুলের ভাঁজে আঙ্গুল চালিয়ে বলল,
“তুই কী বুঝবি আমার ডিমান্ড? রতনে রতন চেনে। শেয়ালে চেনে কচু। তুই কি আর ভালো জিনিসের কদর বুঝবি?
আমার ভীষণ খিদে পেয়েছে, উঠে খাবার গরম করে দে। সাথে দু-কাপ চা বানাবি। রামি আজ আমার ঘরে ঘুমাবে।”
অরু ঘাড়ত্যাড়া মেয়ে। স্বভাব অনুযায়ী ত্যাড়ামো করতে তার ভুল হলো না। বলল,
“তুমি গরম করে খাও।”
মিঠু কিঞ্চিৎ লো*ভ দেখিয়ে বলল,
“কেউ চাইলে কাল তাকে একটা নতুন ফোন কিনে দিতে পারি। যদি লাগে, তবেই…।”
অরু দাঁত কেলিয়ে হেসে বলল,
“চল তো, দুই ভাই-বোন মিলে কিছু একটা বানাই। এতরাতে নিশ্চয়ই তোমার ভাত খেতে ইচ্ছে করবে না!”
মিঠু বিড়বিড় করে বলল,
“আমার বাবা-মায়ের ঘরে উচ্চমানের ধা*ন্দা*বা*জ জন্ম হয়েছে।”
অতঃপর অরুর সাথে রান্নাঘরে ঢুকে পড়লো। অনেকক্ষণ যাবত মিঠুর দেখা নেই। রান্নাঘর থেকে টুংটাং আওয়াজ ভেসে আসছে। রামি সেদিকে এগিয়ে দুই ভাই-বোনকে দেখে সেও যোগ দিল। অরু প্লাজুর সাথে একটা লং শার্ট পরে আছে। গলায় ওড়না ঝোলানো। পোশাক-আশাকের ব্যাপার তার অতো সেন্স কাজ করেনা। যখন যা পরতে ইচ্ছে হয় সে পরে ফেলে। রামির অবাধ্য চোখের নজর না চাইতেও ঘুরেফিরে আজ অরুতে আবদ্ধ হচ্ছে। অরুর কথা বলা, হাসি সব তাকে আজ ভয়*ঙ্করভাবে আকর্ষণ করছে। অথচ এর আগেও অরুর সাথে কত হাসিঠাট্টা করেছে। তখন সবকিছুই স্বাভাবিক মনে হয়েছে। আজ কেন যেন সবকিছুতেই বিশেষত্ব খুঁজে পাচ্ছে। রামি ঘোরের মাঝেই সামনে অরুর বদলে পেঁয়াজ দেখতে পেল। এখানে তো অরু থাকার কথা, পেঁয়াজ নয়। চোখ কচলে সামনে তাকিয়ে দেখলো অরু তার দিকে পেঁয়াজ বাড়িয়ে দিচ্ছে কে*টে দেওয়ার জন্য। বলল,
“ধরুন, পেঁয়াজ কে*টে দিন।”
রামি অবোলা প্রাণীর মতো বিনাবাক্য পেঁয়াজ হাতে তুলে নিল। পেঁয়াজ কাঁটতে গিয়ে তার মাথায় ভাবনা এলো এখন যদি তার হাতটা কে*টে যায়! অরু কি বিচলিত হবে? হাত ধরে ব*কা*ব*কি করবে?
পরক্ষণেই তার মাথায় এলো সে এসব কী ভাবছে? কেনই বা ভাবছে? তাছাড়া এমন কিছু হলে অরু বিচলিত হওয়ার বদলে হা হা হি হি করবে। এই মেয়ের মনে মায়া, দরদ কিছুই নেই। যার কপালে এই মেয়ে লিখা আছে, রামি চোখ বন্ধ করে বলে দিতে পারবে তার জীবন তেজপাত।
পাস্তা রান্না করে রান্নাঘরের এলোমেলো অবস্থা করে তিনজনই রামির ঘরের বারান্দায় চলে গেল। খাবার শেষ করে অরু ঘরে ফিরে এলেও রামি আর মিঠুর আড্ডা চললো অনেকক্ষণ।
★★★
অরুকে নিয়ে মিঠুর আজ বের হওয়ার কথা থাকলেও সকালে তাড়া থাকায় সে তাড়াহুড়ো করেই বেরিয়ে পড়লো। অরুও ফিরে যাবে পড়াশোনার জগতে। বাড়ি আসলে কিছুই ফিরতে ইচ্ছে করেনা। কিন্তু কী করবে? নিজ থেকেই এমন একটা বিষয় বেছে নিয়েছে যেখানে পড়াশোনার বিকল্প হিসেবে থাকছে পড়াশোনা। চলনসই টুকটাক রান্নাবান্না অরু জানে। সকালের নাস্তা তৈরি করে ঘর্মাক্ত শরীর নিয়ে এলোমেলো হয়ে রান্নাঘর থেকে বের হলো। রামি ঘুম থেকে উঠে বাসায় যাচ্ছিল। অরুকে এভাবে দেখে থমকে দাঁড়ালো। অরু নাস্তা বেড়ে রাখতে রাখতে রামির দিকে না তাকিয়েই বলল,
“কোথায় যাচ্ছো তুমি? নাস্তা করে তারপর যেও।”
রামির বুকের ভেতর ধ্বক করে উঠলো। তবে উপরে উপরে সে বেশ স্বাভাবিক। এই মেয়ে তাকে জ্বালিয়ে খাচ্ছে। এমনভাবে ডাকার মানে হয়? যেন বউ তার বরকে যত্ন করে শাসন করছে।
#চলবে…….