স্বচ্ছ_প্রণয়াসক্ত #পর্ব_৫ #মুসফিরাত_জান্নাত

#স্বচ্ছ_প্রণয়াসক্ত
#পর্ব_৫
#মুসফিরাত_জান্নাত

রবির অস্ত যাওয়ার সাথে সাথেই আঁধারে নিমজ্জিত হলো নীলাভ অম্বর।হিম বাতাস বইছে চারিদিকে।আযানের ধ্বনি বাতাসে ভাসতেই কৃত্রিম আলোয় আলোকিত হয়েছে যান্ত্রিক শহর।আঁধার ঘনিয়ে আসতেই খাঁন বাড়ির ড্রয়িং রুম নিমজ্জিত হলো কলোহাস্যে।মাগরিব নামায শেষে সন্ধ্যা কালীন নাস্তায় বসেছে তারা।গরম গরম সিঙ্গাড়া ও ধোঁয়া ওঠা চা রয়েছে মেন্যুতে।একটা পিরিচ এ দুইটা সিঙ্গাড়া ও এক কাপ চা নিয়ে নিজ রুমে আসে ঐশী।বেড সাইড টেবিলে নাস্তা রেখে মুঠোফোন খুলে বসে সে।ফেসবুকের নিউজ ফিড ঘাটছে অলস ভঙ্গিতে।এমন সময় রুমে আবির্ভাব হয় তাবাসসুমের।সতর্ক পা ফেলে ঘরে প্রবেশ করে সে।আড়চোখে বোনকে একবার পর্যবেক্ষণ করে ঐশী।তাবাসসুমের চোখে মুখে ভয় লেপ্টানো।ড্রয়িং রুমে আনোয়ার খাঁনের উপস্থিতি হওয়ার সাথে সাথে কে’টে পড়েছে সে।সেদিনের ঘটনার পর থেকে বাবার মুখোমুখি হওয়ার সাহস হয় নি তার।আজ সাতদিন হয়ে গেলে মেয়ের সাথে কথা বলেন না আনোয়ার খাঁন।এমনকি কড়া গলায় বলে দিয়েছেন তাবাসসুম যেনো তার চোখের সামনে না যায়।বড় মেয়ের চেহারা দেখতে চায় না সে।বাবার রাগ সম্পর্কে ভালোভাবেই অবগত তাবাসসুম।বাবার নিষেধাজ্ঞা সত্বেও ওনার সামনে গেলে যে তুলকালাম লাগিয়ে ফেলবে এতে কোনো সন্দেহ নেই তার।এছাড়া বাবার সামনে দাঁড়ানোর মতো মুখও অবশিষ্ট নেই।তাই তো ভয়ে ভয়ে,বাবার আড়ালে থেকে দিনাতিপাত করছে এখন।সময়ের সাথে বাবার রাগ পড়ে গেলে তখন না হয় কেঁদে কে’টে ক্ষমা চাইবে।

তাবাসসুমকে আসতে দেখে একটু সড়ে গিয়ে বসার জায়গা করে দেয় ঐশী।তাবাসসুম নিঃশব্দে গিয়ে বসে পড়লো ঐশীর পাশে।ঐশী ঘাড় ঘুরিয়ে তাকানোর আগেই খপ করে পিরিচের সিঙ্গাড়া নিয়ে কামড় বসিয়ে দেয় সে।পাশে রাখা চায়ের কাপে এক চুমুক দিয়ে বলে,

“আহ! কি শান্তি।”

ঐশী ভ্রু কুঁচকে তাকায়।মুখ ঘুচে বলে,

“ওখানে নাস্তা করিস নি তুই?”

তাবাসসুম দাঁত কেলিয়ে বলেছি,

“করেছি।তো কি হয়েছে?”

“একবার নাস্তা করে এসে আমার নাস্তায় ভাগ বসানোর সাহস করলি কি করে?এখনি বের হ এইখান থেকে।খচ্চর একটা।”

তাবাসসুম ধীর কন্ঠে জবাব দেয়,

“তোর নাস্তার একাংশ একটু খেয়েছি বলে এইভাবে বলতে পারলি তুই?বোন নামের কলঙ্ক তুই।”

ঐশী মুখ বাকিয়ে বলে,

“তোর মতো স্বার্থ সন্ধানী মেয়ের বোন হওয়ার চেয়ে কলঙ্ক হওয়া ঢের ভালো।যা ভাগ।”

তাবাসসুম দাঁতে দাঁত চেপে বলে,

“দোয়া করে দিলাম।তোর জামাই যেনো আমার চেয়েও ডাবল স্বার্থ সন্ধানী হয়।তোর সব জিনিসে ভাগ বসায়।আমি তাও অর্ধেক খেয়ে বাকিটুকু তোর জন্য অবিশিষ্ট রাখি।সে যেনো পুরোটা খেয়ে তোকে না খাইয়ে শুটকি বানায়া রাখে।ফুহ!”

“শকুনের দোয়ায় কি আর গরু ম’রে নাকি?”

“গরু না ম’রুক তুই ম’রবি।অবশ্য এমনেই ওই দজ্জালকে বিয়ে করে ম’রে গেছিস।ম’রার পর জামাই এর সোহাগে যদি জ্যান্তও হস তাও আবার না খেতে পেরে ম’রবি।”

প্রতিত্তোরে রোষানলে জ্বলে ওঠে ঐশী।অগ্নি চোখে তাকিয়ে বলে,

“বাজে বকবি না একদম।”

তাবাসসুম টিপ্পনী কাটে।

“বাব্বাহ বিয়ে হইতে না হইতেই জামাইয়ের প্রতি এতো টান।এই ব্যাটারই না একসময় কতো বদনাম করতি তুই।ওনার সাথে তার হবু বউ তুলেও কতো অভিশাপ দিয়েছিস ভুলে যাস না।আচ্ছা বাই এনি চান্স তোর বিবাহপূর্ব দোয়া গুলো যদি কবুল হয়ে যায় তখন তোর কি হবে?নিজের অভিশাপে নিজেই জ্বলবি রে ঐশী।আমার তো ভেবেই হাসি পাচ্ছে।”

অট্টহাসিতে ফে’টে পড়ে তাবাসসুম।অগ্নি চোখে তাকায় ঐশী।পরিস্থিতি গরম দেখে কথার বিষয়বস্তু পরিবর্তন করে তাবাসসুম।দাঁতের সামনের সবগুলো পাটি বের করে হেসে বলে,

“আচ্ছা তোর স্যার ওরফে জামাইয়ের কি খবর?তোদের প্রেম কতদূর জমলো?”

ঐশী জবাব দিলো না।ঘাড় ঘুরিয়ে ফোনের স্ক্রিনে মনোযোগ দেয়।সন্দিগ্ধ নয়নে তাকায় তাবাসসুম।

“তোর জামাইয়ের সাথে কথা হয় না?সে কল টল দেয় না তোকে?”

এবারও নিশ্চুপ রয় ঐশী।তার নিরবতার মাঝেই জবাব পেয়ে যায় তাবাসসুম।কপাল চাপড়ে বলে,

“হায় আল্লাহ!বিয়ের এক সপ্তাহ কেটে গেলো এখনো সে কল করে নি?এ কেমন জামাই জুটলো তোর কপালে!সে কি বিয়ের পরেও ব্যাচেলার লাইফ লিড করার পণ করেছে নাকি?এমন করলে তোর কি হবে!”

ঐশী বিরক্ত হয়ে তাকায় বোনের দিকে।ভ্রু কুঁচকে বলে,

“কি আর হবে,তোর মাথাটা যে টুকু ভালো ছিলো তাও নস্ট হবে।ফলস্বরূপ পাগলা গারদে তোর জন্য সিট বুক দিতে হবে।”

“হ হইতেও পারে।একমাত্র বোন তুই আমার।তোর চিন্তায় যদি মাথা খারাপ না বানাই তাইলে কিসের বোন হইলাম বল?আচ্ছা ওসব বাদ দে।তুইও কিন্তু তোর স্যার ওরফে বরকে কল টল দিতে পারিস।তোর জামাই নিরামিষ তো কি হইছে?নিজে থেকেই প্রেমালাপ শুরু করে একটু রোম্যান্টিক বানা।এখন থেকে প্রেমালাপ শুরু না করলে কি চুল টুল পেকে গেলে প্রেম করবি?”

“বিয়ে হইলো আমার আর পেকে গেলি তুই,ব্যাপারটা কেমন না?তোর ভিতরে যখন এতোই রোম্যান্স উতলাইতেছে বিয়েটা করলি না কেন?আম্মুকে এসব বলে তোর একটা ব্যবস্থা নিতাছি দাঁড়া।”

“বোনেদের এসব গোপন আলাপের মাঝে আম্মুকে টানিস কেন?এসব কথায় আম্মুকে টানতে লজ্জা লাগে না?বেহায়া মাইয়া।”

“না লাগে না।লজ্জা তোর কাছে পাঁচার করতে নিয়ে আমি লজ্জা শূন্য হইছি।তাও তোর মুখে লাগাম পড়ে নি।বিখাউজ একটা।”

তাবাসসুম ফোঁড়ন কেটে বলে,

“আমাকে এমনি এমনি না বকে হাতের ফোনটা গুতাইয়া এক্ষুনি জামাইকে কল দাও।সময় থাকতেই অফার লুফে নেও।সময় ফুরাইয়া গেলে কাইন্দাও কুল পাইবা না।যেই নিরামিষ জামাই কপালে জুটাইছো।আমার টিপস না শুনলে কপালে জামাইয়ের সোহাগ জুটতো না বলে দিলাম।”

ঐশী এবার চেঁচিয়ে ওঠে,

“হা’রা’মির বাচ্চা।”

মা’ইর দিতে এগিয়ে যায় ঐশী।এক লাফে উঠে পড়ে তাবসসুম।ড্রয়িং রুমে উঁকি দিয়ে বাবাকে না দেখে বেড়িয়ে পড়ে।যাওয়ার সময় ঐশীকে খোঁচা দিয়ে বলে,

“তোকে ফ্রীতে টিপস দেওয়াই ভুল হইছে আমার।কুত্তার পেটে কি আর ঘি হজম হয়।এরপর যখন জামাইয়ের কাছে রোম্যাঞ্চকর কিছু পাবি না তখন খালি আসিস আমার কাছে।সেধে সেধেও টিপস পাবি না।শব্দ প্রতি দশ টাকা ঘুষ নিব তখন।হুহ!”

___________
ঘড়িতে রাত্রি দশটা বাজে।ডিনার শেষে যার যার নিজস্ব রুমে অবস্থান করছে সকলে।এক কাপ কফি নিয়ে একটু বই খুলে বসে সাদাত।পরদিন যে টপিক নিয়ে লেকচার দিবে তা ভালোভাবে ঝালাই করে নেওয়া তার নিত্যদিনের অভ্যেস।বইয়ের দিকে মনোযোগ দিয়ে মাত্র অর্ধেক পৃষ্ঠা পড়তে সক্ষম হয় সে।এর মাঝে রুমে প্রবেশ করে সিন্থিয়া।হাতে তার আরেক মগ কফি।ভাইয়ের টেবিলে কফির কাপ দেখে আদুরে সুরে বলে,

“তুমি কষ্ট করে কফি আনতে গেলে কেনো ভাইয়া?আমি কি ম’রে গিয়েছি নাকি?আমাকে বললে কি এমন হতো?”

ঘাড় ঘুরিয়ে বোনের দিকে তাকায় সাদাত।সুক্ষ্ম নয়নে দেখতে থাকে বোনকে।মাথা নুইয়ে ফেলে সিন্থিয়া।কফি মগটা সাদাতের স্টাডি টেবিলে রেখে বলে,

“এটা তোমার জন্যই বানিয়ে নিয়ে আসলাম।জানা ছিলো না আমার, নিজের কাজ নিজে করতে শিখে গেছো তুমি।যাইহোক আজকে তোমাকে অনেক হ্যান্ডসাম লাগছে ভাইয়া।”

ভ্রু যুগল কুঞ্চিত করে তাকায় সাদাত।বোনের দিকে সরু দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বোঝার চেষ্টা করে মতলবটা কি।মেয়েটা হটাৎ এতো ভালো হলো কি করে?তাকে তুমি সম্বোধন করছে আবার নিজে থেকে কফি বানিয়ে আদুরে বুলি শোনাচ্ছে।অন্য সময় তো কোনো কাজে সাহায্য লাগলে সার্চ লাইট দিয়েও খুঁজে পাওয়া যায় না তাকে।সন্দিগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে সাদাত বলে,

“সূর্য আজকে কোন দিক দিয়ে উঠেছে সিন্থিয়া?”

“আজব প্রশ্ন তো!সূর্য আবার কোনদিক দিয়ে উঠবে?রোজ যেদিক দিয়ে ওঠে ওদিক দিয়েই উঠেছে।”

“আমি আসমানের সূর্য নয় তোর সূর্যের কথা বলছি।”

ভাইয়ের তির্যক কথায় বিষম খায় সিন্থিয়া।তার ভালো আচরণটা যে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত তা কিভাবে বুঝে গেলো সে?শিয়ালের চেয়েও বেশি চালাক বেটা।মনে মনে শ খানেক গালি দেয় সিন্থিয়া।মুখে তটস্থ হাসি ঝুলিয়ে বলে,

“না মানে ভাইয়া বলছিলাম কি,কয়েকদিন পর তো শিক্ষাসফর।কিছু কেনাকাটা করা লাগতো না?”

“যাওয়া হচ্ছে না তোর।”

“কিন্তু কেনো?এখান থেকে তো সাত মার্ক আছে আমাদের ডিপার্টমেন্টে।”

“ওই সাত মার্ক গোল্লায় যাক।প্রথম বর্ষে শিক্ষা সফরে যেয়ে যেই কাহিনি করছিস।তারপর আবার কোন সাহসে নিয়ে যাব তোকে?”

“এবার আর এমন কিছু করব না ভাইয়া।প্রমিজ।”

“কোনো প্রমিজ মানা হবে না।বিদায় হ এখান থেকে।তুই যাচ্ছিস না এটা ফাইনাল।”

“এতোটা নিষ্ঠুর তুই হতে পারিস না।ভুলে যাস না আমি তোর একমাত্র ছোটো বোন।”

“তুই যাবি এখান থেকে?না দিব কয়েক ঘা।”

“যাইতাছি তো এমন করিস কেন?দে আমার কফি ফেরত দে।খবিস একটা।”

নিজের সাথে আনা মগটা নিয়ে চলে যায় সিন্থিয়া।সেদিকে তাকিয়ে চোখ পাকায় সাদাত।আবারও বইয়ের পাতায় মনোযোগ দিতে যাবে এমন সময় মুঠোফোন বেজে ওঠে তার।কল রিসিভ করে সালাম দেয় সে।

“আসসালামু আলাইকুম।কে বলছেন?”

কোনো উত্তর আসে না।বার কয়েক একই কথার পুনরাবৃত্তি করে সাদাত।তবুও উত্তর আসে না।এবার একটু বিরক্ত হয় সে।ঈষৎ মেজাজ দেখিয়ে বলে,

“আশ্চর্য তো কথা বলছেন না কেনো?চুপ থাকার জন্য কল দিয়েছেন নাকি?”

টুট টুট করে কল কেটে যায়।ফোনের দিকে কিছু সময় বিরক্তি নিয়ে তাকিয়ে থাকে সাদাত।হিসেব মেলানোর চেষ্টা করে কে কল দিতে পারে।পরক্ষণেই অক্ষিকাচে ভেসে ওঠে দুপুরের অপেক্ষারত মায়বি মুখ।বিচক্ষণ মস্তিষ্কের বিচার শেষে অস্ফূটস্বরে সে বলে ওঠে,

“ঐশী!”

সাথে সাথে কল ব্যাক দেয় সাদাত।ইশ! বিয়ের এতোদিন পার হয়েছে,সে একটি বারও কল দিয়ে খোঁজ নেয় নি।তারই আগে কল দেওয়া উচিৎ ছিলো।অথচ মেয়েটি কল দিলো তাও না বুঝে তাকে কড়া কথা বলে ফেলেছে সে। বার বার কল ব্যাক দিয়েও আর সাক্ষাৎ পায় না মেয়েটির।লজ্জায় ফোন সুইচ অফ করে ফেলেছে ঐশী।আর বইয়ের পাতায় ডুব দেওয়া হয় না সাদাতের।মনের কোনে সুক্ষ্ম অনুশোচনা ও একরাশ অজানা অনুভুতির ঢেউ অনুভব করে।যা অজান্তেই ঠোঁটের কোণে প্রশস্ত রেখা আঁকে।মেয়েটি তবে মিস করে তাকে?

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here