সদ্য বিয়ে করা সজীব রাতে তার নববধূর কোমল ঠোঁ”টের ভাঁজে আঙ্গুল বোলাতে বোলাতে বলল
” একটু সাবধানে চলাফেরা করো তুমি। চোখ কান সজাগ রেখো। আমি যে বলছি একথা কাউকে বলনা।”
শুনে বি>ষম খেল তার স্ত্রী লতা। সে কৌতুহল চোখে চাইল সজীবের মুখপানে। তাকে পাল্টা প্রশ্ন করার সুযোগ না দিয়ে সজীব ঘুমের বাহানায় দুচোখ বুঁজে ফেলল।
তার পরেরদিন দুপুরে খালি ঘরে সজীবের মা সুজানা পুত্রবধুকে ডাক দিলেন আস্তে করে। এবং বললেন,
” শোন মা। তুমি এই বাড়িতে নতুন এসেছ। তাই সবকিছু না জানাই স্বাভাবিক। অহেতুক ঘরের ও বাইরের মানুষের সাথে কথা বলিওনা। কেউ কিছু বললে আমাকে অবশ্যই বলবা। আবার আমি যে একথা বলছি এটা দ্বিতীয় কান করনা। খবরদার। নইলে তুমিই বি>পদে পড়ে যাবে।”
লতা থ বনে গেল শুনে। ফ্যালফ্যালিয়ে শাশুড়ীর দিকে চাইল। এবং অনুগত ছাত্রীর মত ঘাড় কাত করে সম্মতি পোষণ করল।
সজীবের বলা কথাটার চেয়ে সুজানার বলা কথাগুলো বেশ ভাবিয়ে তুলল লতাকে। কেন তারা মা ছেলে অমন সাবধানী বাক্য শোনাল তাকে। এই কেনর উত্তর বা কারণ সে এফোঁড়ওফোঁড় করেও উদঘাটন করতে ব্যর্থ হলো।
তার দুইদিন পরে এক গৌধূলি ঝরা বিকেলে সজীবের দাদা আলতাফ লতাকে ডাকলেন পান বানিয়ে দেওয়ার জন্য। লতা পানের বাটা থেকে সব উপকরণ দিয়ে পানের খিলি তৈরি করতে মনোযোগী। সে টনটনে গলায় লতার উদ্দেশ্যে বললেন,
” শোন নাত বউ। কপাল দোষে হউক আর কপাল গুনে হউক। আসছ এ ঘরের বউ হয়ে। আমি তোমার ভালোর জন্যই বলতাছি। দরকার না হলে গায়ে পড়ে কারো সাথে খাতির করতে যাইবানা। তবে আমি যে কথাগুলো কইলাম। তুমি কাউরে কইবানা। কইলে তুমি সমস্যায় পড়বা। আমার কথাটা আমলে রাইখো।”
লতা গোপনে চমকে গেল। আশ্চর্যের চূড়ান্ত সীমায় পৌঁছে গেল তার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়। হাত থেকে জর্দার কৌটা পড়ে গেল বিছানার উপরে।
ওকি নাত বউ। কি হলো তোমার?
না দাদাজান। কিছুনা। আমি তুলে ফেলছি। এই নেন আপনার পান।
আলতাফ মিয়া আস্ত পানের খিলি মুখে পুরে দিলেন। চিবোতে চিবোতে আরও বললেন,
আমি জানি তোমার মনে এখন প্রশ্ন জাগতাছে,দাদাজান হঠাৎ একথা বলল ক্যান?
নাহ দাদজান এমন কিছু ভাবছিনা আমি। আমি নতুন বউ। কিছুই জানিনা বুঝিনা। আপনিতো আমার মঙ্গলের জন্যই কথাটা বলছেন। আমি মনে রাখব আপনার কথা।
লতা উঠে যায় নিজের রুমে। সে এখানে নতুন। তাই আপাতত কাউকে কারণ জিজ্ঞেস করা সমীচীন হবেনা। পাছে ভাববে বউ সাহসী,অভদ্র,ফাজিল।
লতার বিয়ে হয়েছে মাত্র পনেরোদিন হলো। একই জেলা হলেও লতার বাবার বাড়ি ও শশুর বাড়ির বিস্তর ফারাক। এখানে লতার বিয়ে ঠিক করেছে তার বাবা জয়নুলের দ্বিতীয় স্ত্রী মাসুদা। বিয়ের দিন সে ছিল অতিরিক্ত খুশী। যেন হিমালয় জয় করে এসেছে। কারণ এই লতা ছিল তার সৎ মা অর্থাৎ মাসুদার জীবনে এক আতংক। লতার জন্যই নাকি তার রোজ ভাবনা চিন্তা করে চলতে হয়। নিজের খেয়াল খুশিমতে চলতে পারেনা সে। বিয়ের দিন অবশ্য লতার বাবাও খুব খুশি ছিল। কারণ কন্যাদায়গস্থ পিতার অভিশাপ থেকে মুক্তি পেতে যাচ্ছেন বলে। ছোট ভাই সবুজ ও ছিল দারুণ উচ্ছ্বসিত। কেননা তার একমাত্র বড় বোনের একটা গতি হবে বলে। লতার দাদী মালেকাও বেজায় খুশি। মা হারা নাতনির নতুন জীবন দেখতে পারবেন বলে। বিয়ের আগে পাত্রকে না দেখলেও লতা যে অখুশি ছিল তা কিন্তু নয়। কারণ ভালো মায়ের আড়ালে লুকিয়ে থাকা সৎ মায়ের কুটিল রূপের আক্রমণ থেকে এবার রক্ষা মিলবে তাই।
মাসুদার সাথে ঘরের কারো সাথেই তর্ক বা উচ্চবাচ্য তেমন হয়না বললেই চলে। যত ঝামেলা বাধে লতার সাথে। লতা মাসুদার চালচলনে, আচার ব্যবহারে কাজেকর্মে কোন ভুল দেখলেই ধরিয়ে দেয়। এতেই দিনেদিনে হয়ে গেল লতা তার বিষকাঁটা। নিংড়ে ফেলতে পারলেই যেন বাঁচে মাসুদা।
লতা ছিল সচ্ছল পরিবারের মেয়ে। সজীবেরা তারচেয়েও অধিক ধনী খানদানি পরিবার। এত ভালো সুপাত্র পেয়ে মাসুদা নিজেই ঘটকের মাধ্যমে পাত্রকে পাকা কথা দিয়ে ফেলে। লতার শিশুকালে যখন তার মা মারা যায়। তার পিতা তাদের দুইভাইবোনকে ভালো রাখার জন্য দ্বিতীয় বিয়ে করে মাসুদাকে। মাসুদা তাদের দূর সম্পর্কের আত্মীয়। ধীরে ধীরে মাসুদা পুরো সংসারের কর্তৃত্ব নিজের আয়ত্তে নিয়ে নেয়। তার অধিকার ও খবরদারির কাছে লতার বাবা জয়নুল আরশোলা হয়ে গেল।
মাসুদার সবকিছুকেই বেদবাক্য মনে করেন তিনি। মাসুদাও ছলেবলে জয়নুলের আস্থাভাজন হয়েছে বিয়ের দুই বছর না গড়াতেই।
তবে মায়ের জোর অনুরোধে মাসুদার কথার উপরে নিঃশ্চিন্তে না থেকে জয়নুল পাত্র সম্পর্কে খোঁজ খবর নিল। ভালো ছাড়া মন্দ কিছুই তার কর্ণগোচর হয়নি। অবশেষে ঘরোয়া আয়োজনেই বিয়ে সম্পন্ন হয়ে গেল বি এ পাশ করা লাস্যময়ী,বুদ্ধিমতী ও যুবতী লতার।
শশুর বাড়িতে পা দিয়েই লতার মন ফুরফুরে হয়ে গেল। অফুরন্ত ভালোলাগায় ভরে গেল অন্তরখানি তাদের সৌহার্দপূর্ণ আচরণে। সজীবকে প্রথম দেখল বাসর রাতেই। মুগ্ধতায় ছেয়ে গেল লতার পোড় খাওয়া হৃদয়ভূমি।
মনে পড়ল বিয়ের আগের দিন বলা মাসুদার কথাটা। হুম তিনি ঠিকই বলেছেন। সৎ ছোট বোন রুমকি যখন মাসুদাকে বলল,
আম্মা বুবুর হবু জামাইর নাকি বয়স বেশী?
মাসুদা মেয়েকে ধমকে উঠে জবাব দিলেন,
এই পাজী মেয়ে। পুরুষ মানুষের বয়স বেশী বলে কোন কথা আছে নাকি? পুরুষ মানুষের অর্থকড়ি থাকলেই সে বাদশা। আমাদের লতা রাজরানী হয়ে থাকবে দেখিস। সুখ উপচায়ে উপচায়ে পড়বে লতার জীবনে।
একদিন সন্ধ্যার পর লতা শাশুড়ির রুমের পাশ দিয়ে অন্যরুমে যাওয়ার সময় পা থেমে গেল। চুপটি করে জানালার পাশ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে ভিতরের বাক্য বিনিময় শুনতে লাগল।
আমি বাড়ি যাব। আমার বেতনগুলো দিয়ে দিবেন।
দৃষ্টি অবনত রেখে নমনীয় স্বরে বলল চুমকি নামের মেয়েটি।
অবাক চোখে চুমকির দিকে চাইল সুজানা। আচম্বিতে কাজের মেয়ের বিদায়ের কথা শুনে থতমত খেলেন যেন।
হঠাৎ গ্রামে যাবি? তোর কারও অসুখ বিসুখ নাকি?
নাহ। আমি একবারেই চলে যাব।
সুজানা আরেক ধাপ বিস্মিত হলেন। একগাল সরস হাসি দিয়ে জানতে চাইলেন,
বলা নেই কওয়া নেই। হুট করে এই সিদ্ধান্ত কেন নিলি? বাসার কেউ তোকে কিছু বলছে? মানে ঝাড়ি দিল?
নাহ। এমন কিছুইনা খালাম্মা।
তাহলে যাবি কেন?
এমনিই। আপনাদের বাড়িতে থাকতে মন টানছেনা আর। দম আটকে আসে আমার।
কি বলিস এসব? দম আটকে আসে। এসব কেমন কথা? আসল সমস্যা খুলে বল আমাকে।
কোন সমস্যা নাহ। এমনিই ভালো লাগছেনা।
উমমম। আচ্ছা যাবি ভালো কথা। কিন্তু অন্তত আরো মাসখানেক থেকে যা। বাসায় নতুন বউ। কি ভাববে বল? তুই আসলি মাত্র ছয়মাস হয়েছে। যাবিই যদি তাহলে নতুন বউ আসার আগেই চলে যেতি।
তাইলে আর এক সপ্তাহ থাকুম মাত্র। এরপর আর জোর করতে পারবেন না।
আচ্ছা করবনা। যা এখন।
চুমকি বেরিয়ে গেল। চট করে লতাও সরে গেল জানালার পাশ থেকে।
লতা ভাবছে চুমকির সাথে একটু কথা বলবে। এত সুন্দর আরামদায়ক জীবন ছেড়ে কেন যাবে মেয়েটা। যাওয়ার মততো কোন কারণই চোখে পড়ছেনা। কিন্তু পরক্ষণেই মনে পড়ল তাকে বলা সবার হুঁশিয়ারি সংকেত। বিশেষ করে শাশুড়ীর মায়ের। প্রয়োজন না হলে বলছে কারো সাথেই যেন কথা না বলে। ভেবেই মনের ভিতর জিইয়ে থাকা ইচ্ছেটাকে দমিয়ে নিল।
সেদিন রাতেই সজীবের কোলে মাথা রেখে লতা আহ্লাদী কন্ঠে জিজ্ঞেস করল,
আচ্ছা আমাকে সেদিন যে বললেন, আমি সেই কথাটার মানে বুঝিনি।
সজীব লতাকে বুকের ওমে মিশিয়ে নিল। গমগমে স্বরে আদেশের সুরে বলল,
ঘুমাও। পরে বলব ডিটেইলস। ওসব শোনার জন্য উতলা না হয়ে এই পুরুষটার জন্য উতলা হতে পারনা বউ?
লতা মিছেমিছি চোখ বুঁজে গেল স্বামীর আদেশে। কিন্তু মনে মনে ভাবছে,
বিষয়টা কারো সাথে শেয়ার করব। নাকি নিজে নিজেই রহস্য খোঁজার চেষ্টা করব। চুমকির সাথে কথা বলতে পারলে একটু ধোঁয়াশা দূর হতো।
#নীল_বুনোলতা ( ১)
লেখনীতে #রেহানা_পুতুল