তিক্ত_বুকের_বাঁপাশ
ফিজা_সিদ্দিকী
#ষপর্ব_২১(আমার বউ)
২৪.
দার্জিলিং থেকে ফেরার একমাস পেরিয়েছে। ফেরার পর বেশ কিছুদিন রাফিদের অনেক ব্যস্ত দিন কেটেছে।এতদিন ছুটি কাটানোর ফলে কাজের চাপ ছিল বেশ। রীতিমত হাঁপিয়ে পড়ার মতো অবস্থা। রাত করে বাড়ি ফিরলে কাছাকাছি পেতো নম্রমিতাকে। এটাই শান্তির। এইযে রাফিদ ফেরার আগে তার জামা বের করে রাখা, ওয়াশরুমের সব জিনিস হাতের কাছে রেখে দেওয়া, নিজে না খেয়ে রাফিদের জন্য অপেক্ষা করা, এসব ছোটো ছোটো জিনিসের মাঝে লুকিয়ে থাকে নম্রমিতার অগাধ ভালোবাসা। প্রতিনিয়ত মুগ্ধ হয় রাফিদ।
রনকের বাড়ির লোক আজ তোহাকে দেখতে আসবে। চৌধুরী বাড়ির লোকজন সারাদিন ছোটাছুটির উপর আছে। সকাল থেকে দুপুর গড়িয়েছে নানা পদের রান্না করছে নম্রমিতা। গেস্ট আসবে বিকালে। মেয়ে দেখে একেবারে আংটি পরিয়ে দেওয়ার কথা আছে। সেজন্যই এতসব আয়োজন। তোহাকে রুম থেকে বাহির হতে একদম নিষেধ করেছে সে। কাজের মাসি আছে সাথে সাথে সবকিছু এগিয়ে দেওয়ার জন্য। আনোয়ারা বেগমও আজ সব নিষেধাজ্ঞা অগ্রাহ্য করে হাতে হাতে এটা ওটা করছেন। একমাত্র মেয়ে বলে কথা। কোনকিছুতেই যেনো কোনো কমতি না থাকে। রাফিদ বেশ অনেক রকম মিষ্টি এনে রাখে ড্রয়িং রুমে। এরপর রুমে গিয়ে নম্রমিতাকে ডাক দেয়। ক্লান্ত শরীর বিছানায় এলিয়ে দিয়ে জোরে জোরে বেশ কয়েকবার ডাকে নম্রমিতাকে। খানিকটা বিরক্তি নিয়েই কাজের মাসিকে রান্নাগুলো সামলাতে বলে রুমে আসে সে।
“কী হয়েছে? এভাবে চিল্লাচিল্লি করে সারা বাড়ি মাথায় তুলেছ কেনো?”
“কিচেনে কখন গেছো তুমি?”
“এটা জিজ্ঞাসা করার জন্য ডেকেছো আমাকে? ধুর!”
“বলতে বলছি আমি।”
“ওই সকাল নয়টার দিকে।”
“আর এখন কটা বাজে! বেলা তিনটা।”
“দেখো এতো প্যাঁচাল করার সময় নেই। যা বলার জলদি বলো। অল্প কিছু রান্না বাকি এখনও।”
রাফিদ শোয়া থেকে উঠে এসে মুখোমুখি দাঁড়ায় নম্রমিতার। হকচকিয়ে যায় নম্রমিতা। মূলত সে কিছু ভুল করলেই রাফিদ এভাবে তার মুখোমুখি হয়। কিন্তু আজ সারাদিনে কী ভুল করেছে কিছুতেই মাথায় আসছে না তার।
“খেয়েছো কিছু?”
“না মানে..”
রাফিদ আগেই জানতো এই মেয়ে একেবারে বদ্ধ উন্মাদ। পাগলের মাত্রা ছাড়িয়ে গেছে বহু আগেই। নিজের প্রতি তার এতটুকু খেয়াল থাকেনা। মরে গেলেও নিজের সমস্যার কথা ভাবতে যাবেনা। এজন্য প্রায়ই বকা খায় তার কাছে। তাও একটুও শোধরায় নয় সে। তপ্ত দীর্ঘশ্বাস ফেলে রাফিদ বেরিয়ে যায় রুম থেকে। যাওয়ার আগে কড়া নির্দেশ দেয় নম্রমিতাকে রুমের বাইরে পা না রাখার জন্য। নম্রমিতাও রাফিদের নির্দেশ অমান্য করার স্পর্ধা দেখায়নি। কারণ এর ফল খুবই ভয়াবহ হতে পারে।
কিছুক্ষনের মাঝে হাতে ভাতের প্লেট নিয়ে রুমে উপস্থিত হয় রাফিদ। নম্রমিতাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে ভাত মাখিয়ে ধরে তার মুখের কাছে। অসহায় চোখে তাকায় নম্রমিতা। মিনমিনিয়ে বলে,
“আর একটু পরে খাই প্লিজ! ওরা চলে আসবে যে কোনো মুহূর্তে। ”
“ভাত খাবে নাকি চুমু খাবে?”
“চুমু”
রাফিদ ভেবেছিলো নম্রমিতা ভাত খেতে চাইবে। কিন্তু তার ধারণা একেবারে মিথ্যে প্রমাণ করে দ্বিতীয় অপশনটা বেছে নিলো। দুইপাটি দাঁত বের করে তাকে খিল খিল করে হাসতে দেখে দুষ্টুমি বুদ্ধি চেপে বসে রাফিদের মাথায়। ভাতের প্লেট সাইডে রেখে হুট করেই আঁকড়ে ধরে নম্রমিতার নরম পেলব অধর। গাঢ় থেকে আরও গাঢ় হতে থাকে চুম্বন। কেমন যেনো উন্মাদের মতো লাগছে রাফিদকে। তার ভালোবাসার দরিয়ায় ঠাঁই পেতে গিয়ে ভিমড়ি খাচ্ছে নম্রমিতা। অবশেষে ক্ষ্যান্ত হলো রাফিদ। শেষ পর্যায়ে ঠোঁটে ছোট্ট একটা কামড় দিয়ে সেখানে গাঢ় চুম্বন দিয়ে সরে আসে। মুখে হাত চেপে ধরে নম্রমিতা। বেশ বুঝতে পারছে কেটে গিয়ে জ্বলছে ঠোঁট। কাঁদো কাঁদো চোখে তাকায় নম্রমিতা। হো হো করে হেসে ওঠে রাফিদ। এরপর একহাতে নম্রমিতার গাল চেপে ধরে এক লোকমা ভাত পুরে দেয় মুখে। রাগে কটমট দৃষ্টিতে তাকায় নম্রমিতা। ঠোঁট জ্বলছে অসম্ভব রকম। মন চাইছে রাফিদের সারা শরীরে যত্ন করে একে একে কামড়ের দাগ করে দিতে। কিন্তু সময়ের স্বল্পতায় তা করতে পারছে না সে।
“তুমি ভাত নয়তো চুমু খাওয়ার কথা বলেছিলে। চুমু খেলাম তো, সাথে কামড়ও দিলে। এবার যেতে দাও।”
“চুমু তো শেষ হয়নি আমার।”
“মানে কি?”
“মানে হলো তোমার ঠোঁট কেটে গেছে। তাই যতোবার খাবার মুখে দেবো তরকারির ঝোল কেগে ঠোঁট জ্বলবে। তাই আমি চুমু খেয়ে ঝোলটুকু মুছে দেবো, ব্যাস।”
“এমনটা কিন্তু কথা ছিলোনা।”
“তাতে কী হয়েছে!”
নম্রমিতাকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে রাফিদ আবারও এক লোকমা ভাত পুরে দেয় তার মুখে। এরপর সযত্নে অধরে অধর মিলিয়ে মুছে ফেলে লেগে থাকা ঝোলটুকু।
“নম্র”
“হুম”
“রাগ করেছো!”
“রাগ করতে পারলে এতদিনে অনেক কিছুই করে ফেলতাম। আর আমার রাগ না করতে পারার সুযোগ তুমি নিতে পারতে না।”
হাসে রাফিদ। প্রকাশ্যে হাসলেও মনে মনে মুগ্ধ হয় সে। মুগ্ধ হয় এই পরিবারের প্রতি নম্রমিতার ভালোবাসা দেখে। মুগ্ধ হয় তোহার প্রতি ননদ নয় বোনের মতো ভালোবাসা দেখে। মেয়ে হয়েও তোহা কখনও এই পরিবারকে এতো সুন্দরভাবে আগলে রাখতে পারবে না যতটা নম্রমিতা পেরেছে। নম্রমিতা যেনো আস্ত এক ভালোবাসার খনি। যেখান হতে শুধুমাত্র ভালোবাসা আহরণ করা যায়। মুখে খানিকটা গাম্ভীর্য ভাব বজায় রেখে রাফিদ বলে,
“তোমাকে ডক্টর খালি পেটে থাকতে একদম বারণ করেছে নম্র। মাইগ্রেনের পেইনে কতো রাত ঠিক করে ঘুমাতে পারো না। আমি তো নিজের চোখে দেখেছি, যন্ত্রণায় কতোটা ছটফট করো। নিজের একটু খেয়াল রাখো নম্র প্লীজ। তোমার কষ্ট আমার যে একটুও সহ্য হয়না পাগলী। নিজের জন্য না হলেও, আমার আমিটাকে ভালো রাখার জন্য নিজের একটু খেয়াল রাখো প্লিজ।”
চোখ জ্বলছে রাফিদের। নম্রমিতার সামান্যতম কষ্ট চিরে রেখে দেয় তার বুক। হাহাকার করে যন্ত্রণায়। নম্রমিতা দুই হাতে জাপ্টে ধরে রাফিদকে। মাথা রাখে বুকে। চোখ বন্ধ করে শুনতে থাকে রাফিদের হৃদস্পন্দন। যেনো প্রতিবার তারা বলে চলেছে ভালোবাসি, ভালোবাসি। কে বলেছে মুখে ভালোবাসি বললেই ভালোবাসা হয়! কই তারা তো কেউ কখনো ভালোবাসি বলেনি। তবুও যে কী ভীষণ ভালোবাসে একে অপরকে!
রনকের বাড়ির লোক সহ চৌধুরী পরিবারের সকলে উপস্থিত আছে ড্রয়িংরুমে। তোহাকে এখনও আনা হয়নি নীচে। নম্রমিতাও নীচে আসেনি। কাজ সেরে মাত্র কিছুক্ষন আগেই সে রুমে গিয়েছে ফ্রেশ হতে। কোনোমতে তারাহুরো করে গোসল সেরে ল্যাভেন্ডার কালারের একটা শাড়ি পরে এগিয়ে আসে ড্রয়িংরুমের দিকে। রনকের বাবা, মা, দাদী আর তারিন এসেছে তোহাকে দেখতে। দাদী ছাড়া সকলে আগেই তোহাকে দেখেছে। তোহাকে তাদের সবারই বেশ পছন্দ হয়েছে। সবচেয়ে বড়ো কথা রনক ভালোবাসে তোহাকে।
“নাতবউ দেহি মেলা সুন্দরী আছে।”
রনকের দাদির কথা শুনে সকলে তাকায় সামনে। হাসিমুখে এগিয়ে আসছে নম্রমিতা। শাড়ি পরে মাথায় কাপড় দিয়ে। একেবারে বউ বউ সাজ। তাও কিভাবে যে ভুল হলো তার! রাগ হয় রাফিদের। তার বউকে এভাবে অন্যকারোর নামের সাথে জুড়ে দেওয়া ব্যাপারটা একটুও সহ্য হচ্ছে না তার। কয়েক সেকেন্ডের ব্যবধানেই রনকের দাদীকে বিষ বিষ লাগছে তার। ভাবনাটা যদিও বড্ডো ছেলেমানুষী, তবুও সে ছেলেমানুষ থাকতে চায়। তার অনেক কষ্টে পাওয়া এক বউ নম্রমিতা। তাকে এভাবে অন্য করার বউ কেনো ভাববেন উনি! অনেকটা লজ্জায় পড়ে যায় রনক। রাফিদ বাদে চৌধুরী বাড়ির সবাই ঠোঁট টিপে হাসছে। রনক আড়চোখে বাবার দিকে ইশারা করে দাদীকে সত্যিটা বলতে বলে। আড়ষ্ঠতায় চোখ তুলে তাকাতে পারছে না রনক। ইশ, কি বিশ্রী এক ব্যাপার। ভাগ্যিস তোহা এখানে নেই। নয়তো সেও তার মত লজ্জা পেতো বেশ। রাফিদ উঠে গিয়ে নম্রমিতার কাঁধ ধরে সকলের সামনে আনে। রণকের দাদির দিকে তাকিয়ে শক্ত কণ্ঠে বলে ওঠে,
“আমার বউ, এই বাড়ির বড়ো আর একমাত্র বউ নম্রমিতা। আমার বউ হলেও এই বাড়ির বড়ো মেয়ে কিন্তু সে।”
নিজের ভুল বুঝতে পেরে খানিকটা লজ্জাবোধ করেন রনকের দাদী। হালকা কিছু নাস্তা তাদের সামনে এগিয়ে দিয়ে আনোয়ারা খাতুনের নির্দেশে তোহাকে রুম থেকে নিয়ে আসতে যায় নম্রমিতা। সারা রুমের মাঝে পায়চারি করছে তোহা। ভীষণ অস্থির অস্থির লাগছে আজ সকাল থেকে। দুই দন্ড বসে থাকতে পারেনি সে। দার্জিলিং থেকে ফেরার আগে রণকের নম্বর নেওয়া হয়নি বলে বেশ বিরক্ত সে নিজের উপর। এতগুলো দিন রনকও কোনোভাবে যোগাযোগের চেষ্টা করেনি। নম্বর নেই তার কাছে, এই ভেবে নিজেকে বুঝ দিয়েছে সে। দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ পেয়ে নিজেকে গুছিয়ে নিয়ে বাইরে বের হয় তোহা। বাসন্তী রঙের শাড়ি পরেছে আজ সে। হালকা সাজ, চুলগুলো খোঁপা করা। বিয়ের কথাবার্তা চললে বোধহয় মেয়েদের রূপ আরও খানিকটা বেড়ে যায়। তোহাকে দেখে এমনটাই ধারণা করছে নম্রমিতা। চোখের তলা থেকে কাজল নিয়ে নজরটিকা দিয়ে দেয় কানের পিছে। এরপর মিষ্টি হেসে তোহাকে সাথে করে নিয়ে যায় ড্রয়িংরুমে।
চলবে!
আগামি পনেরো তারিখ পর্যন্ত একদিন পর পর গল্প দেবো। ভুলত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।